সংস্কৃতি, আগ্রাসন ও আমার কিছু অনুধাবন

সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় বড় অনুষ্ঠান হয়ে গেল যেখানে বাইরের দেশের নামকরা শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছেন। শাহরুখ খান, রাণী মুখোপাধ্যায় প্রমূখ একটি নাচের অনুষ্ঠান করলেন, তারপর বিশ্বকাপ উদ্বোধনীতে গান পরিবেশন করে গেলেন সনু নিগাম, শংকর এহসান লয় এবং ব্রায়ান এ্যাডামস এর মত গুনী শিল্পীগণ, আর সবশেষে গতকাল আবার আরেকটি নাচগানের অনুষ্ঠানে একটি শ্রীলংকার ব্যান্ড, ভারতীয় ব্যান্ড মেট্রো (প্রীতম), আনুশকা, ক্যাটরিনা, অক্ষয় এবং সালমান।

কারো জানতে বাকি নেই যে, শাহরুখের সেই প্রোগ্রাম সারা দেশে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে, এবং তার কারণগুলিও। সবাই বলেছে শাহরুখ বাংলাদেশকে অপমান করে গিয়েছেন, সেই সাথে ঊগ্র পোশাকের নাচাগানা দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে করেছে দূষিত। এর বদলে তাঁরা নিয়ে গেছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। ভিন্ন মত যে শুনিনি তা-ও নয়। আমার কলেজের এক বন্ধুর কথা: “যারা পয়সা দিয়ে গিয়েছে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য entertained হওয়া। তারা নিজেদের entertain করার জন্য পয়সা খরচ করছে; এতে সমস্যাটা কোথায়? যাদের এধরণের entertainment পছন্দ না তারা যাবেনা – হয়ে গেল! এত কথা বলার কি দরকার??” তার কথায় যুক্তি আছে, সহজ সোজাসাপ্টা যুক্তি। তারা জানে যে ভারতীয় প্রোগ্রামগুলিতে আজকাল একটু ঊগ্রতা থাকেই। জেনেশুনে ওরকম প্রোগ্রাম দেখে আসা, আর তারপর বিষোক্তি করা – controversial বটে!

বাংলাদেশের আয়োজনে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য্য পৃথিবীবাসীকে অবাক করেছে, এটা অবশ্যই আমাদের জন্য গৌরবের। কোনো একটা জরিপে দেখা গেছে, জাকজমক ও সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে আমাদের করা এই অনুষ্ঠান নাকি বিশ্বে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। খুবই আনন্দের কথা। তবু আরও কথা থেকে যায়। মমতাজের ‘নান্টু ঘটক’ টাইপের গান সিলেকশন নিয়ে আমি কিছু বলবনা কারণ এই টাইপের গান বাংলাদেশের অনেক মানুষই পছন্দ করে, ব্যক্তিগত ভাবে আমার হয়ত পছন্দ না-ও হতে পারে এটার কিম্ভুতকিমাকার লিরিকের জন্য; কিন্তু সেই সাথে রুনা লায়লার “মাস্তকালান্দার” ঊর্দূ গানের পরিবেশন, তা-ও আবার ভাষা দিবসের মাসেই, যেই ভাষার জোরপূর্বক আরোপ ঠেকানোর প্রয়াসে কত মানুষ ‘৫২ তে জান দিয়ে দিল — ব্যাপারটা একটু কেমন নয় কি?? এটা একটা আন্তর্জাতিক ইভেন্ট, এখানে মূল জিনিসটা হল সার্বিক পারফর্ম্যান্স, ঊর্দূ গজল গেয়ে গলার কাজ দেখানোর জায়গা ওটি নয়। স্বীকার করি যে, ভাষা ভাষাই – কিন্তু যেখানে নিজের সংস্কৃতির শোডাউন সেখানে নিজের ভাষাতে গান করাটাই তো উত্তম। এমন তো নয় যে, গান আর কোনোটা ছিল না গাওয়ার মত!

গতদিন ‘ট্রাই নেশন বিগ শো’ দেখে একটা বিষয় নিয়ে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম এই ভেবে যে, এবার অন্ততঃ শাহরুখ খানের প্রোগ্রামের মত নারী-চামড়া দেখানো পোষাকও ছিল না, অতি উত্তেজক শারীরিক অঙ্গভঙ্গীও ছিল না। আয়োজকরা অতীত থেকে কিছু শিখেছে ভেবে ভাল লাগল। শাকিব খানের নাচের শেষটা পতাকা নাড়িয়ে বাংলাদেশকে ভালবেসে শেষ হয়েছে দেখে তার প্রতি-ও সম্মানটা একটু উজ্জীবিত হল। মেট্রো “বাংলার গান গাই” গেয়ে আবার বাংলা ভাষাকে সম্মান প্রদর্শন করল যেটা প্রশংসার দাবীদার। ক্যাটরিনার ‘২০১০-এর উষ্ণতম আইটেম গান’ নামে খ্যাত “শীলা কি জাওয়ানি” নিয়ে কিছুটা আশংকা ছিল, তবে দেখা গেল তার কোরিওগ্রাফি সহনীয় পর্যায়ে মার্জিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে অনেক অব্যাবস্থা থাকলেও কোনো নোংরামী হয়নি – এটা দেখে ভাল লেগেছে।

ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা প্রসংগে আসি। ফেসবুকে এক ক্যাডেট বড়ভাই-এর স্ট্যাটাস দেখলাম এরকম: “যারা হিন্দী সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে শঙ্কিত,তারাই আবার ইংরেজীতে মুখে খই ফুটিয়ে ফেলে;লাল,নীল,বেগুনী ইংরেজী সিনেমা দেখে।টাকা দিয়ে ফ্রেঞ্চ,স্প্যানিশ শিখে!তখন কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির কোন ক্ষতি হয়না!যত্তসব হিপোক্রিসি। এতই যদি দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তিত,তাইলে তারা কেন শুধু সাকিব খান-ময়ুরী’র সিনেমা দেখেনা,কিংবা কেন শুধু মমতাজের গান শুনেনা?” … উনি যেটা বলতে চেয়েছেন সেটি হল – ভারতীয় ভাষা বা সংস্কৃতির পিছনে নিন্দুকেরা যেভাবে লাগোয়া, সেটি হওয়া উচিত নয়। সংস্কৃতি চর্চা ঊন্মুক্ত থাকুক – এটাই তার চাওয়া।

তার এই কথার প্রেক্ষিতে সিনেমা-চলচ্চিত্র ইত্যাদি প্রসঙ্গক্রমে উঠে এলো। হ্যা, আমরা জানি বাংলাদেশে গুটিকয়েক ভাল ছবি হয়, আর বেশির ভাগ-ই চরম মাত্রায় কমার্শিয়াল। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হাস্যকর সংলাপ ডেলিভারি, তীব্রভাবে প্রেডিক্টেবল প্লট, বাস্তবিক পটভূমীতে গাঁজাখুরি শট ইত্যাদি স্ক্র্যাপ দেখতে যাওয়া আমাদের হয়ে ওঠে না বা তাদের অযথা সময়ক্ষেপণ মনে হয়। তাই ঐ ছবিগুলি এখন “রিক্সাওয়ালাদের ছবি” বা তৃতীয় শ্রেণীর বিনোদন হিসেবে আখ্যা পায়। মনে হতে পারে এই, যে আমাদের শিল্পীরা হয়তো প্রতিভাবান নয়। আমি এই উক্তির বিপক্ষে স্থান নিব। কারণ আমি বিশ্বাস করি আমাদের প্রতিভা আছে কিন্তু সেটার সঠিক প্রস্ফুটনের সুযোগ নেই।

এই প্রসঙ্গে একটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে বেশ আগে দেখেছিলাম, হুমায়ুন আহমেদের পরিচালনায়, নামটা মনে পড়ছে না, ১৯৭১-এর সময় ব্যাসিসে করা। রিয়াজের মিনমিনে বিড়াল টাইপ মওলানা চরিত্রে অভিনয় এবং পরে পাকিস্তানী রাজাকার কর্তৃক স্ত্রীকে লাঞ্ছনার অপমানে গর্জে ওঠার দৃশ্যকে সঠিক মাত্রায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। অথচ সেই একই রিয়াজের সাধারণ চলচিত্রে অভিনয় আমাকে মোটেই টানে না, overacting কিংবা অবাস্তবিক মনে হয়। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, ছবির মান ডিরেক্টর এবং স্ক্রিপ্ট রাইটারের হাতে। ভাল ডিরেক্টর এ্যামেচার আর্টিস্ট দিয়েও ভাল কাজ বের করে নিয়ে আসতে পারে।

ভাল জিনিস সবারই ভাল লাগে। একটা কাঁপা-কাঁপা হাতে তোলা ছবি আর একটা ঝকঝকে স্পষ্ট ছবির মধ্যে দ্বিতীয়টার দিকেই মানুষ তাকাতে পছন্দ করবে বেশি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি: থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার -এর মত ফালতু একটা ছবির প্রোমো যখন দেখলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে শহীদ মিনারের সামনে বসে, সেটার ঝকঝকে ডিভিডি প্রিন্ট, নির্দিষ্ট কিছু শট এবং অভিনয়ের ফুটেজ আমাকে convince করতে সক্ষম হয়েছিল যে, ছবিটা হলে বসে দেখে আসা উচিত। পরে অবশ্য বলাই বাহুল্য – ভাল লাগেনি। এক. ছবির কাহিনী যেমনই হোক (আরও ভাল হবার সুযোগ ছিল), প্রেজেন্টেশন সেই মাপের নয়। দুই. বাংলাদেশের প্রত্যেকটা হলে প্রজেকশন মেশিন কম্পমান এবং ফিল্ম-গ্রেইনে ভরপুর। সুন্দর দৃশ্যকে অসুন্দর বানাতে এদের সময় লাগেনা। এই দোষ তো আর শিল্পীদের নয়। TPSN-এ সবার অভিনয় নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই।

আবার বলব – ভাল জিনিস সবারই ভাল লাগে; আর তাই আমরা বিদেশী ছবি দেখি মজা করে, আর বাংলা ছবি কে ‘দুয়ো-দুয়ো’ বলি। কারণ বাংলা ছবি আমাদেরকে expected quality দিতে পারেনা। হলিউড বা বলিউডের বেশীরভাগ ছবিতে অভিনয়, গল্প, সিনেমাটোগ্রাফি কিংবা স্পেশাল ইফেক্ট সবই নজর কাড়ার মত। সুন্দরকে মানুষ স্বাগত জানাবেই – এটা প্রাকৃতিক। আমাদের যে ব্যাপারটাতে সতর্ক থাকা প্রয়োজন সেটা হল, ভিন্ন সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়ে আমরা যেন আমাদেরটা ভুলে খেয়ে বসে না থাকি বা আমাদের নিজস্বতাকে অপমান না করি। নতুন কিছু শেখা, সেটা নিয়ে খেলা করাতে কোনো দোষ আমি দেখি না।

মমতাজ ও সেলিন ডিওনের মধ্যে তুলনা করলে মমতাজ কি ধারেকাছেও আসতে পারছে? সার্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে আসছে গান, লিরিক, কম্পোজিশন, মিউজিক, এ্যাম্বিয়েন্স, প্রেজেন্টেশন – সবকিছু। কোয়ালিটি জিনিস কিন্তু সেলিন ডিওন’ই দিচ্ছে। হোক না মমতাজ আমাদের দেশীয় শিল্পী, কিন্তু ফোক সম্রাজ্ঞী হয়েও তো তিনি সেই মানের গান দিতে পারছেন না। এমন নয় যে সেটা অসম্ভব একটা কাজ। আমাদের জিনিসকে আমাদের মতই রেখে সুন্দর করার কৌশলগত জ্ঞানের অভাব আমাদের।

হিন্দী সিরিয়ালের প্রতি আসক্তিকে আরেকটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে অনেকেই, আমিও বলি। এমন বলার কারণ হল- বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের হাতাকাটা ব্লাউজের শাড়ী পরা মানায় না, যেটা হরহামেশা ইদানিং দেখা যায় বিভিন্ন বিয়ে বা বড় অনুষ্ঠানে গেলে, এমনকি গতকালের শো-তেও মৌসুমি নামক এক বাঙালী মেয়েকে অমন ডিজাইনের লাল রঙের একটা শাড়ী পরতে দেখা গেছে, যেটি আমার ধারণামতে এসব হিন্দী সিরিয়ালে দেখানো সাজপোষাকের বাহার থেকেই শেখা।

প্রশ্ন হল- হিন্দি সিরিয়াল কেন এত দেখছে এদেশের মানুষ? বাংলাদেশে কি ভাল নাটক হয়না? খুব হয়; বাংলাদেশের নাটক বরঞ্চ অনেক বেশি ন্যাচেরাল হয়। কিন্তু ঐ যে বললাম ‘কোয়ালিটি’… শুধু ভাল গল্প বানালে তো আর হয়না, এই সময়ের সাথে তাল রেখে তাকে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপনের ব্যাপারেও নজর দেওয়া লাগে। কোনো নাটকে একটা আউটডোর শটে বাতাসের noise -এর চোটে ডায়ালগই শোনা যায় না ঠিকমত, আর সেটা ঠিক করার জন্য যখন ডাব করা হয়, তখন সেটা হয়ে যায় যাকে বলে একেবারে Studio-raw জিনিস। কিন্তু হিন্দী বা বিদেশি অন্য সিরিয়ালে আউটডোর শটে যদি সমস্যা হয় (সাধারণত হয় না কারণ তাদের equipments ভাল থাকে) তখন ডাব করা হয় এবং সাথে ambience মিক্স করা হয়, যাতে দর্শক ঐ অবস্থা বা অবস্থানের আসল অনুভূতিটা পায়।

সেদিন বাসে আসতে আসতে আমার কলেজের বন্ধু সাকিবের কাছে তার একটা Jazz কনসার্ট দেখার অভিজ্ঞতার কথা শুনলাম। যাদের Jazz সম্পর্কে একেবারেই কোনো ধারণা নেই তাদের উদ্দেশ্যে বলি: এটি একটি খুবই উচুমানের মিউজিক genre যার কম্পোজিশন সাধারণতঃ অসাধারণ, মানে সাধারণদের জন্য মাথার উপর দিয়ে যাওয়া টাইপ হয়। জ্যাজ-এর সঠিক মজাটা পেতে হলে গান ও মিউজিক উভয়ের ব্যাপারে উচুদরের taste থাকা জরুরী। তাই দেখা যায় যারা জ্যাজ করে তারা অধিকাংশই বেশ বয়স্ক, অর্থাৎ মিউজিক করতে করতে চুল-দাড়ি পেকে যাবার পর তাদের এই ঘরানায় আগমন। তো, যেটা বলছিলাম- সাকিব বলল যে, সেই জ্যাজ ব্যান্ড নাকি বাংলাদেশে আসার আগে এদেশের সঙ্গীত সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশুনা করেছে, নিবিষ্টভাবে আমাদের গান শুনেছে এবং সবশেষে তাদের মনে হয়েছে – এদেশীয় বাউলা গান, রবীন্দ্র-নজরুল, লোকগীতি খুব সোজা জিনিস নয়। তারা সেই কনসার্টে আমাদের দেশীয় সংগীতের জ্যাজ ফিউশন করেছে এবং বলেছে যে, গানের আবেদন ঠিক রেখে এই জিনিস করতে তাদের ঘাম ছুটে গেছে। এমন ঊচ্চমর্গীয় সঙ্গীতবোদ্ধারা যদি এমন কথা বলে থাকেন তাহলে কোনো সন্দেহ-ই থাকেনা যে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি যথেষ্ট মানসম্পন্ন। তাহলে কি দাঁড়ালো? আমরাই পারছিনা আমাদের সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে চর্চা করতে, জানতে পারছিনা সঠিক কৌশল এটিকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে, গ্রহণযোগ্য করে তুলতে।

একজন লিজেন্ডারী পাশ্চাত্য গিটারিস্ট Steve Vai যদি ভারতীয় ধারার সঙ্গীতের আবহ ফিউশন করে তার নিজস্ব কম্পোজিশনে রাখতে পারে সেটা আমার মতে ভারতীয়দের সার্থকতা। আমরাও পারি আমাদের সংস্কৃতিকে সেভাবে তুলে ধরতে। শুধু দরকার একটু নিবিষ্টতা, মানোন্নয়নের আত্মিক চেষ্টা এবং নিজেদের প্রতি ভালবাসা। ভাষা চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদিতে ক্ষতি নেই, এমনকি adoptation-এও নয়, বরং শেখার আছে অনেক কিছু। শিখে-জেনে-বুঝে এবার নিজেদেরকে তুলে ধরি, আমাদেরটা অন্যকে শেখার সুযোগ করে দিই।

১৮ টি মন্তব্য : “সংস্কৃতি, আগ্রাসন ও আমার কিছু অনুধাবন”

  1. নাজমুল (০২-০৮)

    ভাইয়া আপনার লেখাটা পড়লাম, লেখা পড়ে ভালো লাগলো 🙂
    আমি বিদেশে আসার পর হিন্দী ভাষার প্রতি আমার রাগ আরো বেড়ে যায়। কারণ, এখানকার ইন্ডিয়ানদের ধারণা বাঙ্গালী মানেই হিন্দী বলে এবং বুঝে। এর জন্য আমি তাদের না যত দোষ দিব তার থেকে বেশি দিব, বাঙ্গালীদের।
    তারা ইন্ডিয়ান্দের সাথে যেভাবে হিন্দী বলে দেখলে মনে হয় গাধার বাচ্চাদের ধইরা থাপ্পর দেই কয়েকটা। পাকি দের সাথেও উর্দু/হিন্দী বলে। এবং তারা এটাকে খুব ক্রেডিট মনে করে।
    তবে সব ভাষার লোকদেরই আমাদের সম্মান করা উচিত, তবে নিজের ভাষার প্রতি সম্মান রেখে 🙂

    জবাব দিন
  2. আন্দালিব (৯৬-০২)

    আগ্রাসনটা আসলে বাণিজ্যিক। সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি, ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সিরিয়ালগুলো তার প্রতিনিধি নয়। যেভাবে আমাদের দেশে ভারতীয় অভিনেতাদের এনে নাচানো হচ্ছে অন্যের গাওয়া গানে, সেটা কোন 'সাংস্কৃতিক' বিনিময় না। সেটা বাণিজ্য। আমার মনে হয় সবাই আগ্রাসন বলতে এটাই বুঝিয়ে থাকেন।

    জাকির হোসেন, সুমন চ্যাটার্জি, কিংবা ব্রায়ান এডামসের কনসার্ট নিয়ে কিন্তু এমন চিৎকার হয় না, কারণ তারা শিল্পী। নিজের শৈল্পিক গুণ ও পারদর্শিতা দেখাতেই আসেন, এবং দেখিয়ে মুগ্ধও করেন। কিন্তু ভারতীয় অভিনেতারা এখানে এসে নাচানাচি করেন। এটার মাঝে একবিন্দুও 'শিল্প' কিংবা 'সংস্কৃতি' নাই।

    মমতাজের গান আমার ভালো লাগে। নায়ক রিয়াজকে নিয়ে যে তুলনা দিলে, সেই একই ব্যাপার মমতাজের বেলাতেও খাটে। ভালো সুর আর লিরিক পেলে মমতাজের মতো গাইতে বাংলাদেশের কোন গায়ক পারবে না বলে মনে করি। তুমি মাটির ময়না ছবিতে মমতাজের গাওয়া গান শুনো, কিংবা মনপুরায় অর্ণবের সুরে তার গলা শুনো। 'নান্টু ঘটক'-এর সাথে 'শৈল্পিক পার্থক্য' বুঝতে পারবে।

    আর সব গান তো এক রকম মুডের না। স্টেডিয়ামে উন্মাতাল দর্শকের জন্য মমতাজের গান সেরা - এইটা অনস্বীকার্য।

    জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    প্রথমেই বলে নেই লেখাটির মূলসুর ভালো লেগেছে।দেশীয় সংস্কৃতিকে সম্মান দেয়ার এই জিনিসটা আসলেই চমৎকার।এবার আসি আমার দ্বিমতের জায়গায়ঃ

    হোক না মমতাজ আমাদের দেশীয় শিল্পী, কিন্তু ফোক সম্রাজ্ঞী হয়েও তো তিনি সেই মানের গান দিতে পারছেন না।

    আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হচ্ছে তুলনাটা অনেকটা আপেল আর কমলার মধ্যে তুলনার মত হয়েছে-দুটো কাচগাকাছি হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস,এদের মধ্যে তুলনা চলেনা।ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজের সাথে পাশ্চাত্যের ফোক গায়িকা জোয়ান বায়াজ বা এই ঘরানার শিল্পীদের তুলনা চলে,সেলিন ডিওনের নয়।তাছাড়া ভাল লাগা খারাপ লাগা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার-বাংলাদেশেই কোটি কোটি মানুষ আছে যারা সেলিন ডিওনের নাম শোনেনি কিন্তু মমতাজের পাগল।মমতাজ ইজ বেস্ট এ্যাট হোয়াট শি ডাজ-তার লাইনে সে কিন্তু সেরা,যেটি সেলিন ডিওনের ক্ষেত্রে এরকম নির্দ্বিধায় বলা যাবে কিনা সন্দেহ।আমাদের দেশে মমতাজকে নিয়ে যে উন্মাদনা সেলিন ডিওন তার নিজ দেশে এরকম আদর পায় কিনা তাও প্রশ্নযুক্ত।আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক একক এ্যালবাম পাবলিশ করার গিনেস বুক রেকর্ড কিন্তু আমাদের এই মমতাজের দখলে(সংখ্যাটি সম্ভবত ৫০০+)-যা তার অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তাকেই প্রমাণ করে।সুতরাং সেলিন ডিওন আর মমতাজের মধ্যে প্রথমতঃ তুলনা চলেনা আর দ্বিতীয়তঃ সেলিন ডিওনের কোয়ালিটি মমতাজের চেয়ে ভালো এইটা তোর ব্যক্তিগত মতামত।

    পুনশ্চঃ এই বেলা বলে রাখি আমাদের আদনান কিন্তু নাম করা গায়ক-আইসিসি মিউজিক মিট ২০০২ এ ও ব্যান্ড সঙ্গীতে রূপা জিতেছিলো এবং বর্তমানে ও গায়ক হিসেবে বেশ সুপরিচিত।আমি নিজে ওর গান মুগ্ধ হয়ে শুনি-ওর মত মিউজিক সেন্স আমার আরো ১০০ বছরেও হবেনা।

    জবাব দিন
    • আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

      দোস্ত, আমি কিন্তু 'মমতাজের প্রতিভা নাই, শুধু সেলিন ডিওন-ই প্রতিভা' জাতীয় কোনো এক্সপ্রেশন দেইনাই কোথাও। আর এ্যালবাম রিলিজের সাথে গানের মান ভাল হওয়া মিলাইস না। বাংলাদেশে বছরে বহু সিনেমা বাইর হয়, এমনকি এরকম-ও হয় যে, এক প্রডিউসারের/ডিরেক্টরের অনেক সিনেমা; এর মানে কি এই যে তারা সব ফাটাফাটি ছবি বানায়? আরো ব্যাপার- ছবি কিন্তু ফ্লপ যায়না, সব ছবি চলে।

      "কমার্শিয়াল" শব্দটার আরো একটা ব্যবহার শিল্পীরা করে, যেটা শুধুমাত্র 'অর্থসংক্রান্ত' mean করে না। যেটার মানে তারা করে 'শিল্পমানহীন' হিসেবেও। কারণ সেই সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য থাকে অর্থ, শিল্প নয়। আর তাই তাকে terminologize করা হয় "কমার্শিয়াল" বলে।

      মমতাজের ৫০০+ এ্যালবামের আমার ধারণা প্রায় সবগুলিই ঐ 'কমার্শিয়াল' ঘরানার। আর আমি কিন্তু বলেই দিয়েছি যে, আমি সেলিন ডিওনের সাথে যখন তার তুলনা করলাম তখন সাথে সেলিনের গানের accompaniment অর্থাৎ মিউজিক কম্পোজিশন ইত্যাদির কথাও বলেছি, যেটা মমতাজের গানের মধ্যে বলতে গেলে নেই। কিন্তু সেটা যদি থাকত তাহলে কোয়ালিটি নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকতোনা সেটার প্রমাণ যেটা আন্দালিব ভাই বললেন --- ভাল সংগীতায়োজক বা মিউজিক ডিরেক্টর ছিল তার সাথে, ভাল জিনিস-ও মমতাজ দিতে পেরেছেন আমাদের।

      আমারও গান শোনা বা মুভি দেখার নির্দিষ্ট taste আছে। আমি heavy metal পছন্দ করিনা, হাউকাউ মনে হয়। তাই বলে কি আমি কখনও বলব হেভি মেটাল যারা করে তারা মিউজিশিয়ানের জাত না? Never, আমার এটা বলার অধিকার তো পরে বিচার্য, যুক্তিগতভাবেই কোনো গ্রাউন্ড নাই।

      সেলিন আর মমতাজের মধ্যে অবশ্যই তুলনা চলে কারণ দুই জন-ই সংগীতে 'সিরাম' প্রতিভা রাখেন।

      জবাব দিন
  4. মমতাজের সাথে সেলিন ডিওনের লিরিকের তুলনা করলে হবে? বরং শাকিরার লিরিকের তুলনা করেন ... "হিপস ডোণ্ট লাই" এর একটা [url=http://www.somewhereinblog.net/blog/thukemariblog/28711189]বাংলা অনুবাদ[/url] দেখতে পারেন ... এইটার চেয়ে নান্টু ঘটক খারাপ হইলো কোনদিকে দিয়ে?

    জবাব দিন
  5. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    লেখাটা ভাল লাগল। সিসিবিতে এরকম লেখা অনেক বেশি বেশি করে দেখতে চাই।
    মমতাজের সাথে সেলিনের তুলনাটা অসামাঞ্জস্য। প্রতিটা দেশের নাগরিক বাসিন্দারা ইংরেজি মুভি, গান বা সাহিত্যের সাথে পরিচিত। কিন্তু দেশের বিশাল জনগোষ্টির বিনোদনের চাহিদা পূরণে মমতাজ অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথের সারা বিশ্বের সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ছিল। উনি প্রয়োজন মতো নিজ দেশের সংস্কৃতিতে অন্য দেশের সংস্কৃতি থেকে কিছু কিছু জিনিষ (যেমন গানের সুর) সংযোজন করেছিলেন। রাশিয়ান বা দক্ষিন আমেরিকার লেখকরা ইংরেজীতে না লিখেও গুনগতমানের কারণে তাদের সাহিত্যে বিশ্বমানের।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
    • আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

      আপু আমি বলছিনা যে সেলিন ডিওন-ই ভাল, মমতাজ ভাল না। খেয়াল করুন আমি বলেছি "....কিন্তু ফোক সম্রাজ্ঞী হয়েও তো তিনি সেই মানের গান দিতে পারছেন না। এমন নয় যে সেটা অসম্ভব একটা কাজ।" আমরা সেই মানের জিনিস তার কাছ থেকে যে বের করে নিয়ে আসবো সেই ব্যাপারটা-ই হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আন্দালিব ভাই একটা ভাল জিনিস পয়েন্ট আউট করেছেন অর্ণবের সুরে তার করা গানের কথা উল্লেখ করে-- এবং সেখানেই দেখা যায় যে, ভাল লিরিক ভাল সুর ভাল কম্পোজিশন থাকলে আমাদের ফোক গানও কত আকর্ষনীয় ও হৃদয়কাড়া হতে পারে।

      জবাব দিন
  6. আহমদ (৮৮-৯৪)

    লেখাটা কয়েকদিন আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়ার সময় সুযোগ করে উঠতে পারছিলাম না। আজ শেষ করলাম। যাই হোক, নতুন মাত্রার লেখা মনে হল। এটাকে সমালোচনা বলা যেতে পারে; আবার সমসাময়িক চিন্তার ফসলও বলা যেতে পারে। এরকমের লেখার প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে।


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
  7. আয়েশা ( মগকক) আয়েশা

    এসময় এমন লেখার বড্ড প্রয়োজন ছিল।এই পোস্টটা একেবারেই আমার মনের কথা, বিশেষ করে তোমার এই কথাগুলো-

    -ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা প্রসংগে আসি। ফেসবুকে এক ক্যাডেট বড়ভাই-এর স্ট্যাটাস দেখলাম এরকম: “যারা হিন্দী সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে শঙ্কিত,তারাই আবার ইংরেজীতে মুখে খই ফুটিয়ে ফেলে;লাল,নীল,বেগুনী ইংরেজী সিনেমা দেখে।টাকা দিয়ে ফ্রেঞ্চ,স্প্যানিশ শিখে!তখন কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির কোন ক্ষতি হয়না!যত্তসব হিপোক্রিসি। এতই যদি দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তিত,তাইলে তারা কেন শুধু সাকিব খান-ময়ুরী’র সিনেমা দেখেনা,কিংবা কেন শুধু মমতাজের গান শুনেনা?” … উনি যেটা বলতে চেয়েছেন সেটি হল – ভারতীয় ভাষা বা সংস্কৃতির পিছনে নিন্দুকেরা যেভাবে লাগোয়া, সেটি হওয়া উচিত নয়। সংস্কৃতি চর্চা ঊন্মুক্ত থাকুক – এটাই তার চাওয়া।

    . শুধু একটা ব্যাপারেই দ্বিমত আছে, তাই ওটা নিয়েই লিখছি। সিলিন ডিওন আর মমতাজের তুলনাটা একবারেই অসামাঞ্জস্য মনে হয়েছে। মমতাজের গান আমার কালেকশনে কখনই স্থান পায়নি ( আমার taste ভিন্ন ব'লে ),ঠিক যেমনটি আমার মনে স্থান পায়নি উচ্চমান সম্পন্ন বিশ্ববরেন্য অপেরা "Dido and Aeneas ' এর ARIA । এটি দেখার পর মনে হয়েছিল টাকাগুলো আমি জলে ফেলে দিয়ে এসেছি।
    যারা মমতাজের live কনসার্টে গিয়েছেন তারা আমার সাথে একমত হবেন যে মমতাজের কন্ঠে dissonace কখনোই শুনতে পাওয়া যায়না, যেটি আমরা পেয়েছি অনেক সুখ্যাত মিষ্টি কন্ঠের অধিকারীদের মাঝে, যারা কিনা live কনসার্টে দু-একবার (মাঝে মাঝে বহুবার) সুরের এপাশ ওপাশ দিয়ে চলে যায়। মমতাজের lung power অনেক বেশি এবং ভোকাল range সপরানোর ( soprano ) মতই।বরং সনু নিগম আমাকে যথেষ্ঠ আশাহত করেছে...উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওর experimental গানটা আমার ঠিক metrical pattern এর গ্রেগরিয়ান chant এর মতই লেগেছে।

    জবাব দিন
  8. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)

    লেখা খুব ভাল লেগেছে।আর মমতাজের সব গান শুরুর দিকে ভাল লাগতনা।একবার টিএসসি তে (সম্ভবত বিজয় দিবসের) কনসার্টে গিয়ে বুঝলাম এরকম আসর জমাতে ওস্তাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।