দিনাজপুর – দিনাজপুর রাজবাড়ি

হীরাবাগ

ঠাকুরবাড়ির কালীয়াকান্তের মন্দিরের উত্তরে, মন্দির ও রানীমহল সংলগ্ন রাজ পরিবারের একটি রাজকীয় বাগান আছে। রাজার আমল থেকেই চারিদিকে সু-উঁচ্চ প্রাচীর ঘেরা বাগানটি হীরাবাগ নামে পরিচিত। দেশী-বিদেশী হরেক রকম বাহারি গাছ-গাছালিতে ভরপুর ছিল রাজাদের এ বাগান। কালের পরিক্রমায় আজ সে সব কেবলই ইতিহাস। চিত্ত বিনোদনের জন্য রাজ পরিবারের সদস্যরা এখানে অবসরে ঘুরে-বেড়াতেন। হীরাবাগে প্রবেশের জন্য রাণী মহল থেকে একটি প্রবেশপথ থাকার কথা জানতে পারলাম। তাহলে রাণীরাও নিশ্চয় এখানে আসতেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ বললেন যে, রানীদের এখানে প্রবেশে বাঁধা ছিল।

সে যা হোক, রাজারা এখানে আমোদ-ফূর্তি, বাইজি-বাদ্য, পাশা-দাবা খেলে সময় কাটাতেন। সে জন্য বাগানের মধ্যবর্তী স্থানে একটি মঞ্চও আছে। মঞ্চটির গঠনশৈলী নান্দনিক। অনেকে মনে করেন, এ মঞ্চ আসলে রাজার সিংহাসন, সেখানে বসে তিনি বিচার কাজ করতেন। আবার কেউ বলেন, ওটা নাকি রাজার দরবার। তবে একজন হাস্যকর একটি তথ্য দিলেন, তিনি বললেন-এটা ছিল রাজার্ ইট-ভাটা। রাজবাড়ি আর রাজার আমলে যে সব স্থাপত্য তৈরী হয়েছিল সে সবের ইট নাকি এ ভাটা থেকে সরবরাহ করা হতো।

এ মঞ্চের পূর্বদিকে একটি পুকুর আছে, যা ‘হীরাবাগ পুকুর’ নামে পরিচিত। প্রায় বর্গাকার পুকুরটির প্রতি বাহুর আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৫৫-৬০ মিটার। পশ্চিমপাড়ের মধ্যখানে এবং মঞ্চের নিকটে একটি শান-বাঁধানো ঘাট আছে। ঘাটটি আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধু নিজের ক্ষীন অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য ঘাটের পরিত্যাক্ত ইটের কিছু দেওয়াল এখনো ভগ্নাবস্থায় পড়ে আছে। পুকুরের পাড়গুলো ভূমি সমান্তরাল এবং উল্লেখ করার মত কোন দ্রষ্টব্য আজ আর চোখে পড়ে না। পুকুরের উত্তর পাড়ে অবৈধভাবে বাড়ি-ঘর তৈরী করা হয়েছে। রাজকীয় বাগানের অনেকখানিই এখন অবৈধ দখলদারীদের অধিকারে। যে যেখানে পেরেছে ইচ্ছামত সেখানে বাড়িঘর তৈরী করেছে। দেখে যেন মনে হয় অভিভাবকহীন, অসহায় বাগানটি এখন শ্বাস নেওয়ার জন্য আহাজারি করছে।

কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও রাজার আমলের বেশ কয়েকটি প্রাচীন আম গাছ বাগানের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে টিকে আছে। তবে বাগানের পশ্চিম কোণার একটি বট গাছ বয়স হবে প্রায় ৩০০/৩৫০ বছর, ২০১৫ খ্রীঃ এক ঝড়ে ভেঙ্গে গেছে। বোঝাই যায়, এখন এখানে যে সব আম গাছ আছে তা খুব একটা বেশী দিনের নয়। এ মূহুর্তে আম গাছ ছাড়া আর কোন গাছ সেখানে দেখলামও না। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় হীরাবাগসহ রাজবাড়ির চৌহদ্দীর মাঝে হরেক রকম দেশী-বিদেশী গাছ ছিল। এ সবের মধ্যে অনেকগুলো তমাল ও প্রচুর মেহেগনী গাছ ছিল। তমাল গাছ বাংলাদেশে এখন প্রায় দূর্লভ।

IMG_2913 IMG_2914 IMG_2916

রাজ বংশের কোন এক রাজার হীরা নামের এক অতি প্রিয় বাইজির নাম থেকে হীরাবাগ নামকরণ হয়েছে – এমনটিই বলে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। হীরাবাগে প্রবেশের জন্য স্বতন্ত্র প্রবেশপথ যা ‘হীরাবাগ দেউড়ী’ নামে অধিক পরিচিত ছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এখন সে সবের কোন চিহ্ন মাত্র নেই। অবৈধ দখলদারীদের দৌরাত্ম্যে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সহজে হীরাবাগের প্রবেশ পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাজকীয় বাগানের হতশ্রী দশা দেখে আজ অনুমান করতেও কষ্ট হয় যে, এক কালে এখানে পরিপাটি-সাজানো-গোছানো একটি মনোরম বাগান ছিল।

 

চাপাতলী পুকুর

রাজবাড়ির আয়না মহলের দক্ষিনে ছোট্ট একটি পুকুর আছে যা চাপাতলী পুকুর নামে পরিচিত। পুকুরপাড়ে অনেক চাপা ফুলের গাছ ছিল তো তাই পুকুরের নাম চাপাতলী। রাজাদের মধ্য থেকে কেউ নিশ্চয় এটা খনন করেছিলেন, তবে কাজটি যে ঠিক কে করেছিলেন তা নির্দিষ্ট করে আজ বলা মুশকিল। পুকুরের দক্ষিনে এখন সীমানা প্রাচীর, পূর্বদিকে বৃদ্ধাশ্রম, বিদ্যালয় আর পশ্চিম দিকে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অফিস। আয়না মহল ও চাপাতলী পুকুরের মধ্য দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে সেটি এসব স্থাপনায় প্রবেশের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ব্যতীক্রম ভাবে পুকুরটি পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ। প্রথাগত ভাবে সাধারনতঃ সনাতনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা খননকৃত পুকুর/দিঘী উত্তর-দক্ষিনে দীর্ঘ আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা পূর্ব-পশ্চিম হয়ে থাকে। সম্ভবত এটি পুকুর হিসাবে খনন করা হয়নি বরং বাড়ির আঙ্গিনায় ঝর্ণা/ফোয়ারা, সৌখিন জলজ দ্বারা চিত্ত বিনোদনের জন্য জলাশয়রূপে খনন করা হয়েছিল। সদর মহলের প্রাকৃতিক উপায়ে জৌলুস বৃদ্ধিই ছিল এর অভীষ্ট উদ্দেশ্য।

পুকুরটি বর্তমানে আনুমানিক ৬৩ মিটার দীর্ঘ আর ৩৮ মিটার প্রশস্ত। গভীরতা আনুমানিক ৩ মিটার কিন্তু তাতে পানির পরিমান নগন্য। প্রায় মজে যাওয়া পুকুরটি এখন ব্যবহার অনুপোযোগী। পুকুরের পশ্চিম পাশ ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিনত করা হয়েছে। পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণায় বড় আকারের একটি ঘাট ছিল। ঘাটের প্রশস্ততা দেখে মনে হয় এখানে বসে সময় কাটানোর জন্য সু-ব্যবস্থা ছিল। ঘাটের দু’পাশের খন্ড-খন্ড ইটের গাঁথুনী ছাড়া এখন আর সেখানে কিছু নেই। ঘাটে ব্যবহৃত প্রাচীন ইটের টুকরোগুলো দিক-বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে পুকুরের ভিতর যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘাটের পূর্বদিকের অংশে মাটি ভরাট করে এর প্রশস্ততা ছোট করে ফেলা হয়েছে।

IMG_2778 IMG_2779 IMG_2776

পুকুরের পাড়গুলো স্বাভাবিক কারনে ভূমি সমান্তরাল। পাড়ের চারিপাশ জুড়ে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ ছিল। আরো ছিল পায়ে চলা পথ। সদর মহলে প্রবেশের জন্য যে মূল ফটকটি ব্যবহৃত হতো সেটি ছিল এ পুকুরের পাশ ঘেঁষে – আজ সে সব নিষ্ঠুর সময়ের ক্ষণিক ইতিহাসে পরিনত হয়েছে।

 

ভূতনাথ মন্দির

বর্তমানে রাজবাড়ির পূর্ব দেওয়াল ঘেঁষে যে সড়কটি চাপাতলী পুকুর হয়ে শুকসাগরের দিকে চলে গেছে সে পথের মোড়ে দু’টি মন্দির আছে। পূর্ব পাশেরটি কৃষ্ণ মন্দির আর পশ্চিম পাশেরটি ‘ভূতনাথ’ শিব মন্দির। এ মন্দির সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। রাজবাড়ির প্রাচীর সংলগ্ন এমন একটা মন্দির কেনই বা প্রয়োজন হল কে জানে? অবশ্য মন্দিরটি একটি শিব মন্দির এবং রাজবাড়ি অঙ্গনে এটিই একমাত্র শিব মন্দির। জানা যায়, সেই রাজার আমল থেকেই এখানে বিভিন্ন পালা-পার্বনে পূঁজা উতযাপিত হয়ে আসছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বিয়ে-শাদী হলে এখনো এখানে পূঁজা দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে।

IMG_2771 IMG_2772 IMG_2773

ষড়ভূজাকৃতির মন্দিরটি খুবই ছোট পরিসরে তৈরী। বেদীবিহীন কেবল ভূমির উপর দন্ডায়মান মন্দিরটি দেখতে আদতে সাদামাটা। ইট দ্বারা তৈরী মন্দিরের কারুকাজহীন দেওয়ালে শুধু পলেস্তরা করা। প্রতি বাহুতে দু’টি করে খিলান রয়েছে। প্রতিটি খিলানের পাদদেশ কলশ স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান। পূর্বে প্রবেশ পথ কয়টি ছিল তা জানা না গেলেও এখন মাত্র একটির অস্তিত্ব টিকে আছে এবং সেটি দক্ষিণমূখী। রাস্তার দিকে এর দু’বাহু দৃশ্যমান আর বাকী দিকগুলো সীমানা প্রাচীরের ভিতরে। খিলানযুক্ত অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির প্রবেশ পথের উপরে নকশা ও একটি ফুলের অলংকরন রয়েছে। তার উপর প্লাস্টার করে ‘ভূতনাথ’ শব্দটি অংকিত আছে। ধনুকবক্রাকারের বাংলার চালা ঘরের আদলে তৈরী ছাদটির উপর একটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজটিও ষড়ভূজাকৃতির। গম্বুজের উপর খাঁজকাটা নকশা ও লোহা দন্ডের ত্রি-শূল বসানো।

কালী মন্দির

ভূতনাথ মন্দিরের ঠিক সামনে রাস্তার দক্ষিণ পাশে আয়তকার একটি ঘর আছে। হলুদ রংয়ের পলেস্তরাবিহীন এবং টিনের ছাউনি দ্বারা আবৃত অত্যন্ত সাদামাটা ঘরটিকে হঠাত দেখে রাস্তার পাশে কোন দোকানই মনে হবে। কিন্তু এটি আসলে একটি মন্দির – কালী মন্দির। কোন দিকে কোন জানালা নেই। উত্তর দিকে শুধু একটি দরজা আছে। দরজার দু’পাশে দেওয়ালে একটির-পর-একটি ইটের গাঁথুনী খালি রেখে বাতাস চলাচলের জন্য ঘুলঘুলি তৈরী করা হয়েছে। আনুমানিক তিন মিটার লম্বা, দুই মিটার চওড়া ও দুই মিটারের মত উঁচু হবে স্থাপনাটি। ইটের গঠন দেখে মনে হয় এটি খুব বেশী দিন আগে তৈরী করা হয়নি। মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ৩০/৩৫ বছরের পুরোনো বট গাছ আছে। প্রাচীন বট গাছটি মরে গেলে নতুন এ গাছটি এখানে বেড়ে উঠেছে। মন্দিরে নিয়মিত কালী পূঁজা হয়ে থাকে।

IMG_2764 IMG_2770 IMG_2774

সিপাহীখানা

কালী মন্দিরের পূর্ব দিকে আনুমানিক দুই মিটার দূরত্বে অষ্টকোনাকার একটি স্থাপনা আছে। প্রাচীন ইটের তৈরী স্থাপনাটি দেখে প্রথমে খানিকটা অবাকই হতে হয়। বদ্ধ ছোট্ট এই ঘরে কোন জানালা নেই, উত্তর-পশ্চিম বাহুতে আগে একটি দরজা ছিল। রাস্তায় চলাচলকারী পথিক ও পাড়ার ছেলেরা মল-মূত্র ত্যাগ করার উত্তম স্থান নির্বাচন করে যখন এর ব্যবহার অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি করে দিল, তখন বাধ্য হয়ে ইমারত সংলগ্ন দোকানীরা ইট দ্বারা তা বন্ধ করে দেয়। স্থাপনাটির উপর অষ্টকোনাকার একটি গম্বুজ আছে। বাহিরের দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় পলেস্তরা খসে পড়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, এখানে নাকি রাজার সিপাহীরা থাকত। এত ছোট্ট জায়গায় সিপাহীদের থাকা অর্থ হতে পারে এটি রাজবাড়ির কোন পর্যবেক্ষন চৌকি ছিল। রাজাবাড়ির পাহারারত শান্ত্রীরা মনে হয় এখানে দাঁড়িয়ে রাজবাড়ি পাহারা দিত। স্থাপনাটি এখন ব্যবহার অনুপোযোগী ও পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে।

IMG_2762 IMG_2767 IMG_2768

ফাঁসি-মঞ্চ

রাজবাড়ির কোন এক অংশে একটি অন্ধকূপ ও ফাঁসি-মঞ্চ ছিল, এমন কথা স্থানীয়দের নিকট থেকে শোনা যায়। অন্ধকূপে শাস্তিপ্রাপ্তদের ফেলে দেওয়া হতো, আর সেখানে থাকা বড় বড় সাপ তাদেরকে গিলে ফেলত। কি অমানবিক – কি নৃসংস…!!! রাজবাড়ির বিশাল সব অট্টালিকাসমূহের ধ্বংসস্তুপের নীচে ঢাকা জায়গাটি যে ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে পেলাম না। বাপ-দাদাদের মুখে তারা শুনেছেন যে, ফাঁসি-মঞ্চে নাকি বড় বড় শিকলসহ কপিকল ছিল যা লোহার দন্ডের সাথে যুক্ত করে তথাকথিত আসামীদের ফাঁসি কার্যকর করা হত।

প্রত্ন-সম্পদ

রাজবাড়ির প্রাচীনতম প্রত্নবস্তুটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত গঙ্গারামপুরের বিখ্যাত বানগড় নগরের গৌড়েশ্বরের শিবমন্দির থেকে সংগৃহীত যা ইতিহাসে ‘বানগড় স্তম্ভ’ নামে অধিক পরিচিত। সুক্ষ কারুকাজখচিত স্তম্ভটির গুরুত্ব বোদ্ধা মহলের কাছে এত বেশী কেন? কারণ এটি বাংলায় কম্বোজ নৃপতিদের একমাত্র স্মারক চিহ্ন। স্তম্ভের নীচের অংশে তিন লাইনের যে শিলালিপি আছে তা পাঠে এর সময়কাল সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে সংস্কৃত ভাষায় “কুঞ্জরঘটাবর্ষেণ” পাঠ উল্লেখ আছে। ‘কুঞ্জর’ অর্থ ‘দিগহস্তী’ অর্থাত ৮ আর ঘট অর্থ ৩; তাহলে দাঁড়াল ৮৮৮ শকাব্দ বা ৯৬৬ খ্রীঃ (সূত্রটি হলঃ শকাব্দ+৭৮=খ্রীস্টাব্দ)। সুতরাং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শিবমন্দিরটি ৯৬৬ খ্রীঃ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ পাঠ নিয়ে পন্ডিতগণের মাঝে বিস্তর মত বিরোধ আছে। যাহোক, প্রত্নবিদরা মনে করেন পৌরানিক কম্বোজ দেশ হল আজকের আফগানিস্থানের গজনী প্রদেশের উত্তরের কোন এক এলাকা।

এ ছাড়াও আরো অনেক প্রাচীন নিদর্শন রাজবাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এ সবের মধ্যে গনেশ মূর্তি ও বুদ্ধ চৈত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলোর প্রত্নতাত্বিক মূল্যমান কোন কিছুর মাধ্যমেই বিনিময়যোগ্য নয়। বৌদ্ধ চৈত্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ন, কারণ এটি একাদশ শতাব্দীর কাল নির্দেশক এক অমূল্য সম্পদ এবং এতে গৌতম বুদ্ধের জম্ম, গৃহত্যাগ, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহা নির্বানের চিত্র উতকীর্ণ ছিল। বর্তমানে এসব প্রত্ন নিদর্শনগুলো জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে বলে শুনেছি।

রাজবাড়ির বিভিন্ন স্থাপনায় পাথরের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। এ সব পাথর ইমারতের বিভিন্ন তোরণ, স্তম্ভ, দরজা-জানালা, দেউড়ী, ভিত্তিমূল, খিলান, এমনকি কোণা-র গ্রন্থিবন্ধনে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথা থেকে এলো এ সব পাথর? পৌরানিক কাহিণী থেকে জানা যায়, সহস্র হাতের অধিকারী অসুর রাজ বান, বানগড়-এ তার রাজধানী স্থাপন করেছিল। গড়ে তুলেছিল বিশাল বিশাল অট্টালিকা ও নগর সভ্যতা। এক সময় সে রাজধানীর পতন ঘটে এবং সে নগর হয় পরিত্যাক্ত। দিনাজপুরের রাজারা পাথরগুলো সম্ভবত নৌকাযোগে সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিল। পুনরায় উল্লেখ্য যে, বানগড় দিনাজপুর থেকে ২৭ কি.মি. পশ্চিমে এবং এখন ভারতের অন্তর্গত।

[বানগড়ের বানরাজা – পৌরানিক চরিত্র মহাবীর বান/বানাসুর বানগড় প্রতিষ্ঠা করেন। বানগড়ের যেখানে আজ প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সেখানে ছিল তার রাজধানী। পৌরানিক উপাখ্যান সম্মৃদ্ধ এ নগর ও এর নিদর্শনসমূহ। কালের স্বাক্ষী হয়ে সেখানে আজও অমৃতকুন্ড, জীবতকুন্ড, কালদিঘী ও তপনদিঘী নামক জলাশয়সমূহ মহামহিম বানরাজের মহিমা কীর্তন করছে। বান ছিল শিব উপাসক। কথিত আছে, প্রথম দু’টি দিঘী মহাদেব শিব নিজে তার প্রিয় উপাসক বানকে দান করেছিলো। তৃতীয়টি খনন করে বান তার রাণী কালারাণীকে উতসর্গ করেন। আর চতুর্থটি রাজার ইচ্ছানুযায়ী খনন করা হয়।  

আজ আমরা যে মরণব্যাধি ম্যালেরিয়া/শিবজ্বর ও কালাজ্বরের প্রকোপে জর্জরিত তার উতপত্তির সাথেও জড়িয়ে আছে বানরাজা। কিভাবে? সে এক অমর প্রেম কাহিনী। বানরাজার কণ্যা উষা আর শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। উষাদেবী বাবার অমতে অনিরুদ্ধকে বিয়ে করে এবং লুকিয়ে তার ঘরে নিয়ে আসে। বানরাজ ঘটনা টের পেয়ে অনিরুদ্ধকে উষাদেবীর ঘরে কৌশলে বন্দী করে ফেলে। ঐদিকে শ্রীকৃষ্ণ পৌত্রের অবরুদ্ধ হবার বিষয় নারদ মুনি’র মারফত জানতে পেরে অগ্নিমূর্তি ধারন করে। বানরাজকে অনুরোধ করে তার পৌত্রকে তার কাছে ভালয়-ভালয় ফিরিয়ে দিয়ে আসতে। বানরাজ এতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে নিজ কর্মে লিপ্ত থাকে। আর যায় কোথায়? বেঁধে যায় দু’পক্ষের তুমুল যুদ্ধ।

শিব উপাসক বান মহাদেবের সাহায্য কামনা করলে শিব নিজেই এ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের শিবিরে ‘শিবজ্বর’ সৃষ্টি করে মহামারি বাঁধিয়ে দেয়। শ্রীকৃষ্ণ বসে থাকার পাত্র নয়, শত্রূকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য ‘কালজ্বর’ সৃষ্টি করে বানরাজকে পরাস্থ করতে বাধ্য করে। মাঝখানে পৃথিবীতে ম্যালেরিয়া/শিবজ্বর ও কালজ্বর’র উপদ্রব এসে হাজির হয়। হায়…!!! রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, নলখাগড়ার জীবন মরে।

বান রাজার ছিল সহস্র হাত। কৃষ্ণের সহিত সে যুদ্ধে কৃষ্ণ বানরাজার ৯৯৮টি হাত কেটে দেয়। তপন দিঘীর নিকটে যেখানে এই হাতগুলো পড়েছিল তা করদাহ নামে পরিচিত। ‘কর’ অর্থ ‘আঙ্গুল/হাত’ আর ‘দাহ’ অর্থ ‘সমাহিত করা’, সম্ভবত এ কারনেই এমন নামকরণ করা হয়েছে।

উষা আর অনিরুদ্ধের কি হলো? যুদ্ধ শেষে কৃষ্ণ তাদেরকে সাথে করে নিয়ে গেলো… ”অতপরঃ তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল”।

কৈফিয়তঃ সাধারনতঃ আমি বাংলাদেশের প্রত্নকীর্তিগুলো নিয়েই বেশী উতসাহী। প্রথমে বানরাজার এ আখ্যানটির বর্নণা এখানে সচেতন ভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কেননা বানগড় বর্তমান ভারতের অংশ – সে সব বিষয়াদি খানিক বাদে জানলেও চলবে। আগে দেশেরগুলো সম্পর্কে ভালভাবে জানি, তারপর না হয় বিদেশ…! কিন্তু এটা সত্য যে, দিনাজপুরের প্রত্ন-ইতিহাস অখন্ড দিনাজপুরেরই(বাংলাদেশ ও ভারতের অন্তর্গত) ইতিহাস।]

দেবীসিংহ

দিনাজপুর মহারাজ বংশের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে ইতিহাস কুখ্যাত দেবী সিংহের নাম। মহারাজা বৈদ্যনাথের মৃত্যুর পর তার দত্তক পুত্র রাধানাথ জমিদারীর ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু সদ্য অভিষিক্ত রাজা নাবালক হওয়ায় তার পক্ষে বৈদ্যনাথের স্ত্রী রাণী স্বরসতিকে বৃটিশ কর্তৃক উত্তারিধীকারিণী নিযুক্ত করা হয়। আর রাজস্ব আদায়ের জন্য বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক পূর্ণিয়ার বাসিন্দা দেবী সিংহকে ১,০০০ টাকার মাসিক মাসোয়ারার বিনিময়ে দেওয়ানির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। নির্মম-নৃসংস প্রজা নিপীড়ক, নরপিশাচ ও বৃটিশ বেনীয়ার তাবেদার হিসাবে তার কুখ্যাতি সর্বজনবিদিত।

দেবীসিংহের প্রজা পীড়নের মাত্রা এতটাই মর্মান্তিক ও পাশবিক যে, তা অসুস্থ কল্পনাকেও হার মানায়। বিশ্বের ইতিহাসে এ কুলঙ্গারের প্রতি বাংলার, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের মানুষের; সেই সাথে বিশ্ব মানবের চরম ঘৃণা আমৃত্যু বজায় থাকবে। যদিও ১৭৮১ ও ১৭৮২ খ্রীঃ এ দু’বছর দেবী সিংহ দেওয়ান হিসাবে তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়, তথাপিও তার ঐ সব কুকীর্তির জন্য বৃহত্তর দিনাজপুর-রংপুরের আপামর জনগন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, চারিদিকে বিদ্রোহের লেলীহান শিখা প্রজ্জ্বলিত করে স্বাধীনতার ডাক দেয়।

অবশেষে

কালের করাল গ্রাসে রাজবাড়ির অমূল্য সম্পদরাশি লুটেরা বাহিনীর দ্বারা খোয়া যায়। রাজবাড়ির রাজকীয় সম্পত্তির পাশাপাশি লোহার গ্রীল, কড়ি-বরগা, মর্মর পাথর, ঝাড়বাতি, তৈজসপত্র, আসবাব, দলিল-দস্তাবেজ, স্তম্ভে সাঁটানো ও মেঝেতে প্রথিত পিতলের পাত ইত্যাদি আর কি কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে? রাজ বংশের শেষ মহারাজ জগদীশনাথ পূর্বে হারিয়েছিলেন তার প্রিয় রাণীকে, অতপরঃ বালক পুত্র জলধিনাথের অকাল প্রয়াণে এতটাই মুষড়ে পড়েন যে, যখন তিনি রাজবাড়ি ত্যাগ করেন তখন রাজবাড়ির সকল জিনিসপত্র প্রতিদিন যেমন থাকে তেমনই ছিল। এমনকি শোবার খাটের মশারীটাও সেভাবেই ঝুলছিল। নিঃস্ব, রিক্ত, কপর্দকশূণ্য অবস্থায় রাজবাড়িকে পিছনে ফেলে রাজা বেড়িয়ে পড়েন বিশাল এই পৃথিবীর আদিম ক্রোড়ে … অকষ্মাত মহা-শূণ্যতা গ্রাস করে রাজবাড়িকে। দিন শেষে নেমে আসে ঘন অন্ধকার … চিরদিনের মতো ঘোর অমাবশ্যার গহীন তিমিরে ডুবে যায় সময়ের মাত্র তিন শতাব্দী।

—————————————— চলবে

১৭ জুন ২০১৬/খোলাহাটি

দিনাজপুর – দিনাজপুর রাজবাড়ি

৪ টি মন্তব্য : “দিনাজপুর – দিনাজপুর রাজবাড়ি”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    সমাপ্তিটুকু ("অবশেষে") খুবই ভালো হয়েছে। এরকম একটা লেখা তৈরী করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, সেজন্য তোমাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
    প্রতিটি ছবির নীচে কিছু কথা লিখে দিলে ভাল হতো। সেটা এখনো করা যায়, এডিট অপশনে গিয়ে।
    :clap: :clap: :clap:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।