নান্দাইল দিঘী – জয়পুরহাট

সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে জুড়ে অসংখ্য নাম জানা-না জানা পুকুর-দিঘী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সব দিঘীই আবার সকলের কাছে সমানভাবে পরিচিত বা জনপ্রিয় নয়। সাধারনতঃ বিনোদন, বনভোজন আর বৈকালিক ভ্রমণের সুবিধা-সম্বলিত অল্প কিছু দিঘীই এই তালিকায় স্থান করে নিতে পেরেছে। পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের নান্দাইল গ্রামের ‘নান্দাইল দিঘী’র যেমন রয়েছে ঐতিহ্যময় ইতিহাস তেমনি রয়েছে এর অপরিসীম প্রত্ন-মূল্য। নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার আলতা দিঘী কিংবা দিনাজপুরের রামসাগর আজ যেমন সকলের কাছে সুপরিচিত তেমনি ‘নান্দাইল দিঘী’ সকলের মনে এখনো তেমনভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। দিঘীটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আয়তন – এটি লম্বায় এক কিলোমিটারের অধিক। দীর্ঘ দিঘীর সংখ্যা বাংলাদেশের সব স্থানে সচারচর দেখা যায় না। সকলের অগচরে থেকে যাওয়া দিঘীটি যথার্থ সম্মানতো পায়ইনি বরং আজ তা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।

১৬১০ খ্রীঃ রাজা নন্দলাল দিঘীটি খনন করান বলে স্থানীয়রা জানালেন। কে ছিলেন এই রাজা নন্দলাল … মৌর্য্য সাম্রাজ্যের (৩২২ -১৮৫ খ্রীঃপূঃ) প্রথম নৃপতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, নন্দ রাজবংশকে হটিয়ে ৩২২ খ্রীঃপূঃ মগধ (বর্তমানে ভারতের বিহার)’র পাটলীপুত্র’কে রাজধানী করে বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। শুধুমাত্র নন্দ রাজবংশের ‘নন্দ’ আর দিঘী খননকর্তা নন্দলালের নামের মিল দেখে অনেকেই সম্ভবতঃ মনে করেন যে, নন্দ বা মৌর্য্য বংশের নন্দলাল(?) দিঘীটি খনন করেছেন। আদতে নন্দলাল নামে বাঙলায় বিখ্যাত কোনো নৃপতির নাম এ যাবৎ আাবিষ্কৃত হয়নি। ধারনা করি কোন স্থানীয় সামন্ত ছিলেন এই নন্দলাল।

এলাকাবাসীর পানীয় জলের কষ্ট নিবারন ও কৃষকদের সেচ সুবিধার জন্য দিঘীটি খনন করা হয়। রাজা নন্দলাল যখন দিঘী খনন করান তখন এর আয়তন ছিল ৯০০ একর আর জলকরের আয়তন ছিল প্রায় ৩০০ একর। ‘বাংলাদেশ জাতীয় বাতায়ন’ অনুযায়ী দিঘীর বর্তমান আয়তন ৫৯.৪০ একর। ৫,০০০ শ্রমিক দ্বারা আয়তকার দিঘীটি এক রাতে খনন করা হয় বলে জনশ্রূতি আছে। দিঘীটি এতটাই লম্বা যে, এক পাড় থেকে আরেক পাড় প্রায় দেখাই যায় না। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ দিঘীর পূর্ব-পশ্চিম পাড়দ্বয়ের দূরত্বও যে কোনো বড় দিঘীর দৈর্ঘ্যের তুলনায় কম নয়। পাড়সহ উত্তর-দক্ষিণে ১.২৫ – ১.৩৯ কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ৪৫০ – ৫৫০ মিটার। গভীরতা আনুমানিক ১৫ মিটার। দিঘীতে নিশ্চই ঘাট ছিল কিন্তু আজ তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

দিঘীর পাড় পাহাড় সমান উঁচু ছিল কিন্তু কাল পরিক্রমায় তা আজ ভূমি সমান্তরাল। বাংলাদেশের দিঘীসমূহের মধ্যে সম্ভবতঃ এই দিঘীর পাড়ই সব থেকে চওড়া ও উঁচু। দূর থেকে দেখলে পরিত্যাক্ত কোন ঢিবি বলে ভুল হওয়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আজ চারিদিকের পাড়গুলোর ভীষণ করূণদশা – ৪০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্ন-নিদর্শনটির গৌরব এই পাড়গুলো আজ হুমকির সম্মুখীন। প্রথমে উত্তর ও দক্ষিণ পাড় দখল হয়ে বসতি গড়ে তোলা হয় আর তারপর সুপরিকল্পিতভাবে পাড়ের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে বিরানভূমিতে পরিনত করা হয়েছে। পাড়ের মাটি কাটার ফলে কোনো কোনো জায়গায় বিশাল খাদের সৃষ্টি হয়েছে। পাড়ের মাটি ও পাড় ব্যবহার করেই তৈরী করা হয়েছে চলাচলের জন্য রাস্তা। দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে ‘নান্দাইল দিঘী মহাবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে – আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র মহাশয় আজ বেঁচে থাকলে বাঙালীর বিদ্যানুরাগের এহেন উৎসাহে নিশ্চই ভিমরী খেতেন!!

মাত্র ৮০-৯০ বছর আগেও স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। জঙ্গলের কোনো চিহ্ন আজ আর কোথাও নেই, চারিদিকে শুধু চাষের জমি। নান্দাইল দিঘীকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রীঃ) থেকেই সরকারিভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও আজও তা আলোর মূখ দেখেনি। স্থানীয় উদ্যোগে দিঘীতে নৌকা-ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে এবং তা বেশ জনপ্রিয়। ইদানিং ভ্রমণকারীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে দ্রূতই জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

জানা যায়, ১৯৭৬ খ্রীঃ দিঘীটির একবার সংস্কার করা হয়েছিল। সংস্কারকালে বেশ কয়েকটি পানির পাম্প লাগানো হয়েছিল কিন্তু দিঘীর সব পানি উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি – কেননা পানির পরিমান অনেক বেশী ছিল। এখন এখানে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হয়। এক সময় শীতকালে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটতো। হয়ত সেই দিন আর বেশী দুরে নয় যেদিন শীতের পরিযাযী পাখিদের মতো এই দিঘীটিও সব হারিয়ে কেবল নাম-সর্বস্ব অবস্থায় সরকারি কাগজে-কলমে টিকে থাকবে।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূমির লাল মাটির বাঁধনে, নান্দাইল দিঘী নিশ্চই অতীতের কোনো সম্মৃদ্ধ নগর বা জনপদের নিঃসঙ্গ স্বাক্ষী। দিঘীর পাড়ের প্রাচীন ইটের টুকরো হয়তো সেই সব নিদর্শনের সবশেষ টিকে থাকা অংশ। দিঘীতে বেশ কিছু মূর্তি ও মূর্তির ভাঙ্গা অংশ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা জানালেন যে, বিষ্ণু, লক্ষী, কালী, গণেশ, নারায়ণ, বাসুদেব, সরস্বতী ইত্যাদি মূর্তি তারা নিজ চোখে দেখেছেন। সীতাহার, কণকরায়, চন্দ্রহার নামের বিশাল আয়তনের আরো তিনটি দিঘী নান্দাইল দিঘীর পাশে থাকা, দিঘীর নামেই গ্রামের নাম নান্দাইল হওয়া, এসবের অর্থতো এই হতে পারে যে – এখানে নগর সভ্যতা থাকার আমাদের যে আশংকা তা সত্য!

———————————————————————————————————————————————– 

১২ আগষ্ট ২০১৭/ঢাকা-১২৩০

 

তথ্যসূত্রঃ

১. পাড় কেটে অবাধে মাটি বিক্রি নান্দাইল দিঘির অস্তিত্ব বিপন্ন, দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ আগষ্ট ২০০৬ খ্রীঃ/

২. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন

৩. দেশ জুড়ে যা দেখার আছে, দৈনিক যুগান্তর, ১০ আগষ্ট ২০১২/

৪. প্রাচীন বাংলার পথ থেকে পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ২৭৭-২৮১/

৫. আন্তঃজাল (Internet)

২ টি মন্তব্য : “নান্দাইল দিঘী – জয়পুরহাট”

মওন্তব্য করুন : mustafizur rahman

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।