শালবন বিহার – কুমিল্লা

বাংলাদেশ তথা কুমিল্লা জেলার ‘আইকনিক ল্যান্ডমার্ক’ শালবন বিহার ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বিহারসমূহের মধ্যে অন্যতম। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শ্রমন, ভিক্ষু, আচার্য্য, সিদ্ধি-পুরুষদের মূলতঃ ধর্ম-চর্চ্চা কিন্তু পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কেও পড়াশুনার জন্য আবাসিক শিক্ষালয় হল বিহার। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বাংলার বিহার স্থাপত্যের অনুকরণে রচিত বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব নজরে পড়ে। সব বিহারগুলো একদিনে তৈরী হয়নি বটে তবে বুদ্ধদেবের জীবদ্দশাতেই বিহারের প্রচলন শুরু হয়। সাধারনতঃ বর্ষাকালে পর্যটনে বিড়ম্বনা, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈরীরূপ, বিরূপ আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় মহামতি বুদ্ধ কোনো না কোনো বিহারে অবস্থান করে জ্ঞান বিতরন করতেন। তাবৎ পৃথিবী যখন শিক্ষা-দীক্ষায় অনাগ্রসর ঠিক তখন বাঙলার রাজ্যসমূহ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক জ্ঞানের দীপ-শিখা জ্বালিয়ে মানব ইতিহাসের কান্ডারীর ভূমিকা পালন করেছে।

কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ি নামক ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণির প্রায় মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত শালবন বিহারের আশপাশ জুড়ে উনিশ শতকের গোড়ার দিকেও ছিল শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। বিশাল বঞ্চালের অহংকার অসংখ্য শাল আর গজারি গাছে পরিপূর্ণ ছিল এই জঙ্গল। সাধারনের কাছে বিহারের স্থাপত্যিক চিহ্ন যখন উম্মোচিত হওয়া শুরু করলো তখন তারা ভাবলো এটি কোনো রাজার বাড়ি হবে। স্থানীয়রা শালিবাহান নামের এক রাজার কথা শুনেছিলেন তাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকে। দু’য়ে-দু’য়ে চার মিলে গেলে – প্রাপ্ত ধ্বংসস্তুপের নাম ‘শালিবাহন রাজার বাড়ি’ নামে পরিচিতি পেয়ে গেল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে খনন কাজ পরিচালনা করা হলো – ততদিনে এটা যে রাজবাড়ি নয় বরং বিহার তা কেউ কেউ মেনে নিলেন। শালবনে শাল গাছের প্রাচুর্য্য আর শালিবাহান রাজার কারনে স্থাপত্যের নাম দাঁড়ালো ‘শালবন বিহার’। গ্রামের নাম শালবনপুর।

দেব রাজ বংশের ৩য় ও ৪র্থ নৃপতি যথাক্রমে রাজা আনন্দদেব ও তৎপুত্র রাজা ভবদেব এই বিহার প্রতিষ্ঠা করেন বলেই প্রচলিত মত রয়েছে। আমরা আগেই জেনেছি, দেব-বংশজাত নৃপতিরা ৮ম ও ৯ম শতাব্দীতে লালমাই অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে দাপটের সাথে রাজ্য পরিচালনা করেছিলো। রাজা আনন্দদেব শালবন বিহারের জন্য ভুমি দান করেছিলেন আর তার পুত্র ‘পরমসৌগত পরমভট্টারক পরমেশ্বর মহারাজাধিরাজ শ্রী ভবদেব’ বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন বিধায় তার নামানুসারে বিহারের নাম ‘ভবদেব বিহার/শ্রী ভবদেব মহাবিহার’ হয় যা আজ শালবন বিহার নামে সকলের কাছে পরিচিত। শালবন বিহারে যে সমস্ত পোড়ামাটির সীল পাওয়া গেছে সেই সবের মধ্যে বৌদ্ধ দেববংশীয় এই নৃপতিদের রাজকীয় প্রতীকচিহ্ন সম্বলিত একটি সীলে নাগরী বর্ণমালায় ‘শ্রীভবদেব মহাবিহারার্য ভিক্ষু সঙ্ঘস্য’ – লেখা থেকে এই অনুমান সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। সার্বিক বিবেচনায় তাই ধারনা করা হয় ৮ম শতকে এই মহাবিহার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে প্রাপ্ত বৈন্যগুপ্তের তাম্রশাসন ও কুমিল্লা জেলার গুনাইঘর নামক স্থানে প্রাপ্ত ফলকলিপির সাথে উপরে উল্লেখিত নাগরী লিপির সাদৃশ্য থাকায় অনেক প্রত্নবিদ মনে করেন এটি ৬ষ্ঠ শতক কিংবা তৎপূর্বেও নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। বিহারের নির্মাণকাল সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব না হলেও এটি যে হাজার বছরের প্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই।

অনেক তো ইতিহাস কপচানো হলো, বোর লাগছে নাহ!! চলুনতো ফিরে যাই দেড় হাজার বছর অগে – ঘুরে আসি রাজা ভবদেবের বিহার থেকে… চলুন ঢুকে পড়ি বর্গাকার বিহার চত্বরের উত্তরের একমাত্র প্রবেশ পথ দিয়ে। প্রায় ২২.৫৬ মিটার চওড়া বিশাল এই প্রবেশ তোরণে ঢুকলেই হলঘর (আনুমানিক ২৩.০৬ মিটার লম্বা ও ৭.০১ মিটার চওড়া) আকৃতির এক কক্ষে গিয়ে পড়তে হবে। সাদামাটা ঘরটি দেখে বের হলে পর ফটকের উভয় পাশে একটি করে দু’টি ঘর দেখা যাচ্ছে নাহ! সেখানে নিরাপত্তা শান্ত্রীরা দিন-রাত অহর্নিশ পাহারা দিচ্ছে। যেভাবে বললাম সেভাবে চট করে কিন্তু তোরণ পেরোনো যাবে না – সিঁড়ি ভাঙতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে তোরনে উঠে আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে বিহার চত্বরে প্রবেশ করতে হবে। যে ইটের রাস্তা দিয়ে বাহির থেকে তোরণ পর্যন্ত হেঁটে আসলেন তাতে কিন্তু আাপনি প্রায় ৫৩.০৪ মিটার পথ অতিক্রম করে ফেলেছেন। খেয়াল করেছেন কি রাস্তাটি প্রায় ০.৯১ মিটার পরিমান প্রশস্ত ছিল। ইট-চুন-সুরকির গাঁথূনীতে তৈরী তোরনটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বেশ আগেই, অধুনা টেরাকোটা আর পোড়ামাটির ফলক দ্বারা নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে।

প্রবেশ তোরণ অতিক্রম করে বিহার চত্বরের নান্দনিক দৃশ্য, পরিপাটি স্থাপত্যিক বিন্ন্যাস আর বিশালতার যে হাতছানি আপনি এখন অন্তরে অনুভব করছেন তার জন্য কি আপনার পূর্ব-পুরুষদের জন্য কিঞ্চিৎ গর্ববোধ হচ্ছে…

আপনি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেখান থেকে সামনে তাকালেই দেখতে পাবেন বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরটি। ডানে কিংবা বায়ে তাকালে চোখে পড়বে ২.৬ মিটার চওড়া এক টানা বারান্দা। বারান্দার সাথে লাগোয়া ছোট ছোট ঘর। গুনে দেখুন ঘরের সংখ্যা ১১৫ টি। চলুন দরজা দিয়ে একটি ঘরে ঢুকে পড়া যাক। যারা এখানে লেখাপড়া করতেন তারা এই ঘরে পড়াশুনার পাশাপাশি বিশ্রাম ও রাতে ঘুমাতেন। প্রতিটি ঘর একই মাপের, চারিদিক সমান লম্বা (দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩.৬৩ মিটার) আর পাশাপাশি দু’টি ঘরের মাঝখানে যে দেওয়াল আছে তা ১.৫১ মিটার পরিমান প্রশস্ত। রাতের বেলা শ্রমণ/ভিক্ষুরা কূপি/প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করতেন। কূপি রাখার জন্য দেওয়ালে কুলুঙ্গি(খোপ) আছে। তাছাড়া বই-পত্র ও ব্যবহারের জিনিসপত্র রাখার জন্যও কুলঙ্গি আছে-সব মিলিয়ে প্রতি ঘরে ৩টি করে কুলঙ্গি আছে। আচ্ছা! ঘরে কোনো জানালা দেখছি না তো!!

ঘরের পিছনের দেওয়াল বিহারের বাইরের দেওয়াল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তাই বেশ মজবুত করেই বানানো হয়েছিল এটি-প্রায় ৫ মিটার পরিমান চওড়া। প্রতি পাশে এই দেওয়াল ১৬৭-১৬৯ মিটার পরিমান লম্বা। ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দার মাঝখানে যে অপ্রশস্ত পথ আছে তা দিয়ে চলুন মাঠে নামা যাক। বিহারের মধ্যখানের প্রশস্ত এই উম্মুক্ত আঙ্গিনায় সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিন। নিঃরস তত্ত্ব কথা মন চাইলে শুনুন না হলে আঙ্গিনার মাঝখানের ‘সর্বোতভদ্র’ মন্দিরটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন… বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়বেন।

ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণির প্রত্ন-নিদর্শনের মধ্যে সরকারি পৃষ্টপোষকতায় প্রথম যে ৫টি স্থান চিহ্নিত করে পরিকল্পিতভাবে খনন কাজ পরিচালনা করা হয় তাদের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম। খনন পরবর্তীতে এই বিহারের স্থাপত্যরূপটি পর্যায়ক্রমে উম্মোচিত হতে থাকে। বিহারে দু’টি সময়ের বসতি গড়ে তোলা হয়েছিল, আদি বসতি আমলের(৭ম খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভে) অবকাঠামো কেমন ছিল তা সুস্পষ্টভাবে এখন আর বোঝা যায় না তবে ২য় বসতি আমলে(৮ম খ্রীষ্টাব্দ) কেন্দ্রীয় মন্দিরে ৬ বার আর মূল বিহারে ৪ বার সংস্কার/পুনঃনির্মাণ/নির্মাণ কাজ যে করা হয়েছিল, তা বোঝা যায়। অর্থাৎ প্রথম যখন নির্মাণ কাজ করা হয়েছিল তারপর আরো ৫ বার মন্দিরে ও ৪ বার বিহারে নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। প্রথম ২টি নির্মাণ যুগের কাজের চিহ্ন স্পষ্ট না হলেও পরবর্তী ৪টি নির্মাণ যুগের চিহ্ন বেশ স্পষ্ট। সভাবতই পরবর্তী নির্মাণ যুগে এসে পূর্ববর্তী নির্মাণ যুগের স্থাপনা/নিদর্শনসমূহ চাপা পড়ে গেছে। বিহারের গভীরে খনন করে প্রায় ৭.৬২ মিটার নীচে অকর্ষিত মাটির সন্ধানে পাওয়া গেছে।

যাহোক, বলছিলাম ‘সর্বোতভদ্র’ মন্দিরের কথা যেটি আসলে এই বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দির। ‘সর্বোতভদ্র’ বলতে বুঝায় – ধাপে ধাপে উঁচু হয়ে ওঠা গ্রীক ক্রস ভূমি পরিকল্পনায় তৈরী যে মন্দির। শালবন বিহারের এই মন্দিরটি ২য় বসতি আমলে তৈরী করা হয়েছে। সভাবতই এখানে সমবেতভাবে পূঁজা-অর্চনা ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হতো। ভিক্ষুদের ঘরের কোন কোনটিতে ইটের তৈরী বেদী রয়েছে – কে জানে হয়তো সেখানেও তারা পূঁজা করতেন। কেন্দ্রীয় মন্দিরটি ১ম ও ২য় নির্মাণ যুগে ক্রুসাকার আকৃতির ছিল, কিন্তু ৩য় নির্মাণ যুগে এসে তা আয়তকার রূপ ধারন করে। এই সময় এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ৫০.৯ মিটার ও ৩৩.৩৩ মিটার। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এই মন্দিরে তখন প্রবেশ করতে হতো এর উত্তরে অবস্থিত প্রবেশ পথ দিয়ে। ৪র্থ নির্মাণ যুগে মন্দিরের ভূমি পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে তা পুনরায় ক্রুশাকার রূপ দেয়া হয়। এই সময় মন্দিরগাত্রে বাঙলার শ্বাশত লোকজ সংস্কৃতির শিল্পমন্ডিত পোড়ামাটির নকশা করা ফলক দিয়ে মন্দিরকে আরো আকর্ষনীয় করে গড়ে তোলা হয়।

মন্দিরের নীচের সারিতে সেই সব টেরাকোটার চিত্রফলকসমূহের নমুনা এখনো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। এই সময় উত্তর দিকের প্রবেশ পথের কোনরূপ পরিবর্তন না করে ২.১২ মিটারের একটি প্রদক্ষিন পথ রাখা হয়। তখন প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫১.৫১ ‍মিটার করে। ৫ম নির্মাণ যুগে আবার ৩য় নির্মান যুগের মতো মন্দিরের আকৃতি আয়তকার করা হয় কিন্তু এই সময় তা আয়তনে ছোট হয়ে আসে। ধারনা করা হয় মন্দিরটি বহুতল বিশিষ্ট ছিল। উত্তরের প্রবেশ পথের সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমে হল ঘর ও পরে দক্ষিণে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হতো। গর্ভগৃহের পাশে বেশ কয়েকটি খাবারের ঘর ছিল। খাবার ঘরে বসার ব্যবস্থা ও কুলুঙ্গি ছিল। ৬ষ্ঠ নির্মাণ যুগের হাল যে কিরূপ ছিল তা বোঝার কোন উপায় আজ আর নেই কেননা সে সব আলামত বেশ আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং, এখন আমরা মন্দিরের যে রূপ দেখতে পাচ্ছি তা মূলতঃ ৫ম নির্মাণ যুগের।

ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন!! চলুন উত্তর-পূর্ব কোণায়… হ্যাঁ, এটি একটি কূপ – চোখে মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে নিন, স্বচ্ছ-শীতল-টলটলে পানি মুখে দিয়ে শরীরটা কেমন জুড়িয়ে গেল নাহ!!! বিহারে বসবাসকারী ও এখানে আগত অভ্যাগতরা এই পানি প্রতিদিন ব্যবহার করতেন। ইট ও কাঁদা মাটির গাঁথুনীতে তৈরী কূপটি দেখেছেন কি বিশাল, এর ব্যাস কিন্তু প্রায় ৭ মিটারের মতো। কূপের পাশাপাশি বিহার চত্বর সংলগ্ন একটি দিঘী (শালবন রাজার দিঘী) ছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ধারনা করি কূপের পানি খাবার জন্য আর গোসলসহ আনুসঙ্গিক কাজ করার জন্য দিঘী ব্যবহার করা হতো।

আমাদের দক্ষিণে দেখুন একটি ছোট মন্দির আর ঐ কেন্দ্রীয় মন্দিরের পশ্চিম দিকেও আছে আরেকটি মন্দির। দু’টো মন্দিরই আয়তকার। পশ্চিম দিকের মন্দিরটি দু’কক্ষ বিশিষ্ট ও পূর্বমূখী। এই মন্দিরের পশ্চিমের ঘরটি ছিল গর্ভগৃহ-মানে সেখানে বিগ্রহ রাখা হতো। ঘরদু’টোর চারিদিকে হেঁটে হেঁটে চলুন দেখা যাক। বলে রাখা ভাল উভয় মন্দিরই পরবর্তীকালে তৈরী করা হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের ঐ বর্গাকার ঘরটিও আরেকটি মন্দির। আসলে কেন্দ্রীয় মন্দিরের চারপাশ জুড়ে আপনারা ৭টি ছোট ছোট মন্দির দেখতে পাচ্ছেন। আর ঐগুলো? ওসব নিবেদন-স্তুপ, ৬টি আছে। সমাহিত করার বৌদ্ধধর্মীয় আচারের অংশ হিসাবে এখানে বৌদ্ধগুরুদের অস্থিধাতু, তাদের মন্ত্রযুক্ত সীল ও মাটির পাত্রে রাখা লিপি রেখে দেওয়া হয়েছে। শুনেছি বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সমাধিক্ষেত্রেও নাকি এখানে রয়েছে।

বিহারের কার্যক্রম শুরু হবার পর পরই ভিক্ষুগণ নিজেদের ঘরেই নিজেরা রান্নার ব্যবস্থা ও আহারাদি সম্পন্ন করতেন। কিন্তু বিহারের পরিসর ও কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে (সম্ভবতঃ শেষ নির্মাণ যুগে) আবাসিকদের খাবারের সুবিধার জন্য বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে খাবার ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চলুন এখন সেখানে যাওয়া যাক। দেখতেই পাচ্ছেন, খাবার ঘরটি এক কক্ষ বিশিষ্ট ও আয়তকার, এখানেই দলগতভাবে সবাই খাবার গ্রহণ করতেন। পিছনের দিকে যে দু’টি ঘর দেখতে পাচ্ছেন সেখানে রান্না-বান্নার সরঞ্জামাদি সাজিয়ে রাখা হয়েছে, ভাগাড় ঘরও আছে আর এখানে রান্নাও করা হতো। আমরা কিন্তু বিহারের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে চলে এসেছি। এপাশ দিয়ে বের হওয়া যাবে না, তাই ভিক্ষুদের ঘরের সামনের টানা বারান্দা ধরে চলুন উত্তরের সেই প্রবেশ পথ দিয়ে বের হয়ে যাই।

বিহার চত্বরে প্রবেশ করার আগে বিহারের বাহিরের দিকে মানে মূল বিহারের উত্তর-পশ্চিম কোণায় আরো একটি মন্দির আছে, ঢোকার সময় খেয়াল করেছিলেন নিশ্চয়। না করলেও অসুবিধা নেই, এই মন্দির ও বিহারের পাকা সংযোগ পথ ধরে চলুন এখন সেখানে যাওয়া যাক। এই মন্দিরটিও কিন্তু বর্গাকার। পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলুন ঐ চত্বরে যাওয়া যাক। চত্বর পার হলে পর মন্দিরের গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহটি আয়তকার এবং এর চারিদিকে ১.১ মিটার পরিমাপের প্রদক্ষিণ পথ দিয়ে দর্শনার্থী/পূজারীরা চলাচল করতে পারেন। মন্দিরের দেওয়ালগুলো বেশ চওড়া। মন্দিরটি বৌদ্ধমন্দির হওয়া স্বত্তেও এর স্থাপত্যশৈলী হিন্দুরীতির মতো। শুধু তাই নয়, শালবন বিহারের পোড়ামাটির ফলকচিত্রে বিষ্ণু, রাধাকৃষ্ণ, হরগৌরী, বসুদেব, সূর্য, গণেশ ও গহদ্ধাত্রীসহ বেশ কিছু হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। এই মন্দির কেনো মূল বিহারের বাহিরে, কে এবং কারা এটি ব্যবহার করতেন-তা গবেষণার দাবী রাখে। শালবন বিহারের প্রধান আরাধ্য মূর্তি কি ছিল তাও আমি জানতে পারিনি।

বিশ্বের তাবৎ বৌদ্ধবিহারের মধ্যে বাংলার বৌদ্ধবিহারসমূহের স্বতন্ত্র্যতা লক্ষ্যণীয়। আর তা হলো এর কেন্দ্রীয় মন্দির। অষ্টম শতকের স্থাপত্যশৈলীতে কেন্দ্রীয় মন্দিরের এই নকশা কালজয়ী। বলা চলে বাংলার এই কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধারনা বাংলার বাহিরে সম্প্রসারিত হয়েছিল বিধায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও বিশেষ করে ভারত (বিহার প্রদেশের বিক্রমশিলা মহাবিহার), মায়ানমার/বার্মা (পাগানের ‌‌অনন্তপন্ন/আনন্দ বিহার), ইন্দোনেশিয়ায় (প্রমবনম-এর লেরো জোনগ্রাং মন্দির, চন্ডি সেবু মন্দির; জাভা-এর কলসন, বোরোবুদরি) এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। মূলত জয়পুরহাট জেলার পাহাড়পুরের সোমপুর বৌদ্ধবিহার এক্ষেত্রে যে মাইলফলক রচনা করেছে তা প্রনিধানযোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলার অন্যান্য বিহারসমূহে এমনকি লালমাই-ময়নামতির বিহারসমূহও তা অনুকরণ করেছে। আনন্দ বিহার, রূপবান মুড়া বিহার-মন্দির কিংবা ভোজ বিহার এক্ষেত্রে উদাহরন হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। শালবন বিহারের বাইরের মন্দিরটি তাই খানিকটা ব্যাতিক্রম।

সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন বিহারটির আদলে নওগাঁর পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার নির্মিত হয়েছিল বলে অনেক পন্ডিত মনে করেন। ৮ম শতাব্দীতে রাজা ভবদেব মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বটে, তবে তিনি যে পুরোনো কোনো মন্দিরের ভিত্তির উপর তা পূর্ননির্মান করেননি তা স্পষ্ট করে বলা যায় না। তথাপি বিহারটি ১৪শ খ্রীঃ পর্যন্ত কুমিল্লায় মুসলিম অধিকারভূক্ত হওয়ার আাগ পর্যন্ত টিকে ছিল বলে মনে হয়।

১৯৫৫ খ্রীঃ তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ কর্তৃক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খনন কাজ করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় খনন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। খননের ফলে এখান থেকে প্রস্তর যুগের হাতিয়ার, বৈন্যগুপ্তের তাম্রলিপি, দেবখড়গের তাম্রলিপি, খড়গ তাম্রলিপি, বলভট্ট তাম্রলিপি, আনন্দদেবের তাম্রশাসন, ভবদেবের তাম্রলিপি, ২টি দেববংশীয় তাম্রলিপি, ১৮টি সোনার মুদ্রা (বাগদাদের খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহর মুদ্রাসহ), ৩৫০টির বেশী রূপা ও তামার মুদ্রা, সোনা-রূপা-তামার অলংকার (যেমনঃ আংটি, কানের দুল, হাতের চুড়ি), রূপার খন্ড, লোহার কড়ি, পেরেক, বড়শি, দা, ছুরি, কাঁচি, কোদাল, খন্তা, শিল-নোড়া, জাতাকল, অসংখ্য মূল্যবান পাথরের গুটিকা, মাটির ভাঙ্গা পাত্র, থালা-বাসন, দোয়াত, প্রদীপ, পোড়া কাঠ-কয়লা, ছাই, মূর্তি, হিন্দু দেবতা গণেশ মূর্তি, সূর্য, পোড়ামাটির চিত্রফলক (যোদ্ধা, গায়ক, বালক-বালিকা, নর-নারী, গন্ধর্ব, অপ্সরা, মকর, কীর্তিমুখ, কিন্নর-কিন্নরী, পদ্মফুল, গাছের পাতা, নর্তক, মল্ল, সিংহ, হাতি, হরিণ, বণ্যশূকর, বানর, ঘোড়া, মহিষ, রাজহংস, ময়ূর, সাপ, নেউল, মাছ, কচ্ছপসহ কল্পিত জন্তু), সীল, ব্রোঞ্জের দ্বারা নির্মিত স্মারকাধার ও ১৫০টির বেশী বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি (যথাঃ বুদ্ধ, ধ্যানীবুদ্ধ/তথাগত অমোঘসিদ্ধি, বোধিসত্ব, তারা, ৪ হাত বিশিষ্ট সর্বাণী, মুঞ্জুশ্রী, জম্ভল, প্রজ্ঞাপারমিতা উল্লেখযোগ্য), ব্রোঞ্জের স্তুপ-প্রতিকৃতি ইত্যাদি অসংখ্য মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে।

শালবন বিহারে প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুদ্রা গুপ্ত আমলের এবং ১৭৫টি হরিকেল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাপ্ত মূর্তিগুলো গুপ্ত ও পাল আমলের মধ্যবর্তী সময়ের বা ৭ম/৮ম শতাব্দীর। এসবই এই বিহারের প্রাচীনতা ও গৌরবের স্মারক। আরেকটি বিষয়ও এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচীন বাঙলার প্রায় অধিকাংশ মূর্তি গড়া হয়েছে ভারতের রাজমহলের পাথর দিয়ে, কিন্তু কুমিল্লার মূর্তিগুলো বিস্ময়কর ও ব্যতীক্রমভাবে কুমিল্লা-চট্টগ্রামের স্থানীয় পাথর দিয়ে তৈরী।

প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত বাংলার এই বিরাট পুরাকীর্তিকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩৭ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর একটি বিনোদন কেন্দ্র। প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় দেখার পাশাপাশি বৈকালিক ভ্রমণ, ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো, ময়নামতি জাদুঘর পরিদর্শন কিংবা সময় কাটানোর জন্যও এই স্থান অনন্য। তাই সারা বছর জুড়েই দেশী-বিদেশী পর্যটকে এই স্থান মুখরিত থাকে। ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণির প্রত্নস্থানগুলোকে সম্মন্বিতভাবে পর্যটক-বান্ধব করে গড়ে তুলতে পারলে এক দিকে যেমন দেশের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে তেমনি বিশ্ব দরবারে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সকলের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে।

 ———————————————————————————————————————————————–

২৩ নভেম্বর ২০১৭/

ঢাকা-১২৩০/

 

তথ্যসূত্রঃ

১. বেড়ানোঃ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির নগরী কুমিল্লা, দৈনিক আমার দেশ, ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ খ্রীঃ/

২. Department of Archaeology of Bangladesh

৩. প্রত্নতাত্ত্বিক ঐম্বর্য্যে সম্মৃদ্ধ কুমিল্লা, ০৪ ফেব্রূয়ারী ২০১৪ খ্রীঃ/

৪. স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লা, দৈনিক আমার দেশ, ১১ নভেম্বর ২০১৩ খ্রীঃ/

৫. দেখুন ময়নামতিকে, মোহাম্মদ উল্লাহ রিপন/

৬. লালমাই সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন, দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ নভেম্বর ২০১৪ খ্রীঃ/

৭. কোটবাড়িতে দেখে আসুন ঐতিহাসিক নিদর্শন, শ্যামল রুদ্র, দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ জানুয়ারী ২০০৪ খ্রীঃ/

৮. ঘুরে আসুন কুমিল্লা, সাহেদ ইব্রাহীম, দৈনিক প্রথম আলো/

৯. মেতে উঠুন ময়নামতিতে, অনন্যা গোস্বামী, দৈনিক প্রথম আলো, ১২ জুন ২০০৭ খ্রীঃ/

১০. প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, পৃ ১১৪-১১৫/

১১. ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার এক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকীর্তির নাম, রমজান বিন মোজাম্মেল, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ আগষ্ট ২০০৭ খ্রীঃ/

১২. প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে ভ্রমন, খান মাহবুব, দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুন ২০১২ খ্রীঃ/

১৩. রূপবান মুড়া ময়নামতি লালমাইর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, খায়রুল আহসান মানিক, দৈনিক ইত্তেফাক, ০৩ ফেব্রূয়ারী ২০০৭ খ্রীঃ/

১৪. মনোলোভা শালবন বিহার, গাজীউল হক, দৈনিক প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারী ২০১৫ খ্রীঃ/

১৫. কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু, মো. লুৎফুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারী ২০১৬ খ্রীঃ/

১৬. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ৬৩১-৬৪৪/

১৭. মহাস্থান ময়নামতি পাহাড়পুর, ডক্টর নাজিমুদ্দিন আহমেদ, পৃঃ ৬৪/৬৭-৭০/

১৮. বাংলাদেশের সন্ধানে, মোবাশ্বের আলী, পৃঃ ২১৫/

১৯. বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও পুরাকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৮২-৮৩/৮৭/১৪৪-১৪৬/

২০. Coins From Bangladesh, A guide to The Coins of Bengal Especially Circulated in Bangladesh, Bulbul Ahmed and AKM Shahnawaz, পৃঃ ১৬/১৯/

২১. Early Terracotta Figurines of Bangladesh, Saifuddin Chowdhury, পৃঃ ১৩০-১৩৩/

২২. পুরাতত্ত্বের বাংলাদেশ ঐতিহ্যের বাংলাদেশ, মোহা. মোশাররফ হোসেন, পৃঃ ১৫৬/

২৩. বাংলাদেশের প্রথম ও প্রাচীন, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ১৭১-১৭২/

২৪. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ২২৫/

২৫. প্রাচীন বাংলার প্রত্নকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৪২-৪৩/

২৬. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ১০৫/১০৭-১১০/১৪০/

২৭. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃঃ ৫৩/৫৭/৩৯৮-৪০১/

২৮. Terracotta Ornamentation in Muslim Architecture of Bengle, Muhammad Hafizullah Khan, পৃঃ ৬৫/

২৯. উইকিপিডিয়া/বাংলাপিডিয়া/বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন

৯ টি মন্তব্য : “শালবন বিহার – কুমিল্লা”

মওন্তব্য করুন : কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।