সাগরদিঘী – টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপেজলার লোহানী গ্রামে সাগরদিঘী নামে ঐতিহাসিক এক দিঘী রয়েছে। এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ন্যায় সমতল নয় বরং এর সাধারন ভূমি উচু, টিলার মতো বা পাহাড়ী। বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূমি গঠনের আদি নিদর্শন মধুপুর-ভাওয়াল গড়ের এক অংশ এটি। ধারনা করি এখানকার সভ্যতার ইতিহাসও তাই বেশ প্রাচীন। গ্রামের পূর্ব দিকে রয়েছে সনাতনী ধর্মের রাধা-কৃষ্ণের তমালতলা, গুপ্ত-বৃন্দাবন আর পশ্চিম পাশে রয়েছে বেহুলা-লক্ষীন্দরের পদ্মদিঘী, লক্ষীন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগরের বাড়ী ইত্যাদি। দিঘীর নিকটে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এই সব ধর্মীয় স্থাপনাসমূহের উপস্থিতি প্রমান করে যে, এক সময় এখানে একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল। সম্ভবতঃ সেই সময় সাগরদিঘী খনন করা হয়। পরবর্তীকালে সাগরদিঘীর কল্যাণে প্রাচীন লোহানী গ্রামের নাম বদলে সাগরদিঘী হয়ে যায়।

সাগরদিঘী টাঙ্গাইল জেলার একটি প্রত্নতাত্বিক দ্রষ্টব্য। ২,০০০ জন শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রায় ২ বছর যাবত চেষ্টা করে দিঘীটি খনন করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রায় ৪০ একর আয়তনের বিশাল দিঘীটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আনুমানিক ৪০০ মিটার ও ২৮০ মিটার। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ দিঘীর জলকরের আয়তন প্রায় ১২.৮০ একর আর বাকীটা পাড়। দিঘীটির পাড়সমূহ বিশেষ করে পশ্চিম পাড় খুবই প্রশস্ত ছিলো এবং এখনো তা যথেষ্ট পরিমানে প্রশস্ত আছে। পশ্চিম পাড়ে দালানকোটা ও বাঁধানো ঘাট যে ছিল তার প্রমান পাওয়া যায়। অসংখ্য প্রাচীন ইট, ইটের টুকরো, প্রাচীন স্থাপত্যের ভিত্তিমূল ও মাটির পাত্রের ভাঙ্গা অংশ এই পাড়ে এখনো দৃশ্যমান। স্থানীয়দের বিশ্বাস এই সব ভাঙ্গা/ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোটার মধ্যে ছিল রাজার রাজবাড়ীটি। পশ্চিম পাড়ের পুরাতন ঘাটের উপর নতুন করে ঘাট বাঁধা হয়েছে। দিঘীর গভীরতা আগে আরো বেশী ছিল নিশ্চয় কিন্তু এখনো তা প্রায় ১০ মিটারের মতো বিদ্যমান। এই দিঘীর ‍বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর পানি অন্য জলাশয়ের পানি অপেক্ষা খানিকটা বেশী ঠান্ডা।

কথিত আছে, ৮ম খ্রীঃ রাজা মহীপাল দিঘীটি খনন করান। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় যে, পাল নৃপতি রাজা মহীপাল (প্রকৃত ইতিহাসানুযায়ীঃ ৯৮৮ – ১০৩৬ (আনুমানিক) খ্রীঃ – ১ম মহীপাল আর ১০৭২ – ১০৭৫ খ্রীঃ – ২য় মহীপাল রাজত্ব করেন) উত্তরবঙ্গ থেকে বিতারিত হয়ে উত্তর রাঢ়ে প্রত্যাগমন করেন এবং চন্দনবাটি নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। নতুন রাজধানীতে গমনের প্রাক্কালে তিনি রাজ সভাসদসহ এই পথে গমন করছিলেন। রাজার সৈন্যবহর যখন পথ ধরে যাচ্ছিল তখন পথি মধ্যে এক ব্রাহ্মণ সন্তান রাণীকে দেখতে রাস্তার ধারে একটি গাছে উঠেছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ সন্তানের বিধিবাম! অকস্মাৎ গাছ থেকে পড়ে গিয়ে সে যুবক মৃত্যূ মুখে পতিত হয়। রাজা ব্রাহ্মণ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন। অগত্যা কি আর করা! কুল-পুরোহিতের কাছে রাজা এর বিহিত চান। পুরোহিত নানা শাস্ত্র ঘেটে রাজাকে জানান যে, যেহেতু রাজ মহিষীর রূপ-লাবণ্যই এই হত্যার মূল কারণ তাই রাজাকে প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ একটি দিঘী খনন করে দিতে হবে। তবে শর্ত হলো ব্রাহ্মণ সন্তানের মৃত্যূস্থান হতে পায় হেটে রাণীকে রাজধানীর পথে যেতে হবে আর সেই দৈর্ঘ্য বরাবর হবে দিঘীর দৈর্ঘ্য। সাথে সাথেই রাজ আজ্ঞা জারি হয়ে গেল। যথা সময়ে দিঘীও খনন করা সম্পন্ন হলো। কিন্তু দিঘীতে তো পানি ওঠে নাই। এখন কি করা! রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হলেন যে, এলাকায় সাগর নামের এক ধর্মপরায়ন কুমোর আছে, তাকে এসে দিঘীর তলদেশ থেকে এক কোদাল মাটি তুললে পর দিঘীতে পানির দেখা মিলবে। খুঁজে পেতে ধরে আনা হলো কুমোরকে। সাগর এক কোদাল মাটি কাটতেই হুড়হুড় করে পানি ওঠা শুরু করলো কিন্তু বেচারা সাগর পানিতে ডুবে মারা গেল। তার স্মরণে রাজা দিঘীর নাম রাখলেন সাগরদিঘী। স্থানীয়রা কেউ কেউ ‘সাগর কুমোরের দিঘী’ নামেও ডেকে থাকেন।

অন্য আরেকটি জনশ্রূতি থেকে জানা যায়, পাল নৃপতি ধর্মপালের পুত্র প্রজাবৎসল রাজা সাগর পাল (জানা মতে এই নামে কোনো পাল নৃপতি নেই) আনুমানিক ১৫০০ খ্রীঃ দিকে (১২ শতকের শেষার্ধেই পাল শাসনের অবসান হয়) প্রজাদের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার জন্য দিঘী খনন করান। কিন্তু দিঘীতে পানি না ওঠায় তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। রাতে রাজা স্বপ্নে দেখেন যে, তার প্রিয়তমা রাণীকে যদি দিঘীতে নামানো হয় অথবা (অন্য মতে) রাণী যদি নিজের প্রাণের বিনিময়ে এক কলসী পানি দিঘীর তলদেশে ঢেলে দেয় তাহলে দিঘীতে পানি উঠবে। রাণীকে স্বপ্নের কথা জানালে রাণী সহাস্যে রাজার কথায় রাজী হয়ে যান। ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে গ্রামের সাধারন জনগনের উপস্থিতিতে যথাসময়ে রাণী দিঘীতে নামেন… আর ওমনি হুড়হুড় করে দিঘীর তলদেশ ভেদ করে পানি উঠতে থাকে। পাড়ে অপেক্ষামান প্রজাসকল উলুধ্বনি দিয়ে রাণীকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন কিন্তু ভাগ্যের লীলা বোঝা বড় দায়। রাণীর অত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে প্রাণ পায় দিঘী। এতে প্রজা সকলের পানির কষ্ট দূর হয় বটে কিন্তু রাণীর শোকে রাজার মন অশান্ত হয়ে পড়ে, তিনি সন্ন্যাস ধারন করে বনবাসে চলে যান। গ্রামের মানুষেরা তাই রাজার নামে দিঘীর নাম রাখে ‘সাগর দিঘী’। প্রজা সাধারনের বিশেষ করে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস রাতের আধারে রাণীর আত্মা এখনো দিঘীর পাড়জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। রাণীর আত্মাকে শান্ত রাখতে কিংবা রাণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাই গ্রামের মানুষেরা পূজার ব্যবস্থা করে থাকেন। সাগর রাজার নামে নাকি সাগরের মতো বিশাল বলেই এই দিঘীর নাম সাগরদিঘী – এখনো এই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি।

সময়ের সাথে সাথে দিঘীর জৌলুস হারিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে কিছু কাল আগেও সাগরদিঘীর পরিবেশ আজকের মতো এতটা করুন ছিলোনা। আজ দিঘীর এমন জরাজীর্ণ দশা হবার আগে প্রথম দিকে এর পানি খাবারের জন্য, পরে গোসলের জন্য এবং তারপর আনুসঙ্গিক কাজে ব্যবহার করা হতো। ভ্রমণ পিপাসুরা বিস্তৃত দিঘীর কোল ঘেঁষে প্রকৃতির নয়নাভিরাম শোভা প্রাণ ভরে উপলব্ধি করতেন। শীতের মৌসুমে পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকতো গোটা দিঘী। কিছু কাল আগেও সবুজে সবুজে ভরপুর ছিল যে পাড়সমূহ আজ তা বে-দখল হয়ে গেছে। প্রশস্ত পাড়ের কারনে আর ক্রমবর্ধমান জনসবসিতর চাপে দিঘীর উত্তর পাড়ে সাগরদিঘী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, দক্ষিণ পাড়ে ১৯৭৫ খ্রীঃ প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাগরদিঘী দাখিল মাদ্রাসা ও মুরগীর খামার, পশ্চিম পাড়ে এলজিইডির অস্থায়ী বাংলো ও মুরগীর খামার আর পূর্ব পাড়ে সাগরদিঘী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। পাড়গুলো শুধু দখলই হয়নি বরং কোন কোন স্থান কেটে, গর্ত আর বিকৃত করে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে … মানুষের কি অসীম শক্তি।

সাগরদিঘীর দক্ষিণ-পূর্বে আরেকটি দিঘী আছে যা এই দিঘীর প্রায় দ্বিগুন আয়তনের (২৫ একর)। রাজা বনরাজ পাল (পাল নৃপতিদের তালিকায় এই নাম নেই, হতে পারে স্থানীয় কোনো পাল সামন্ত এরা) দিঘীটি খনন করেছিলো বলে দিঘীর নাম ‘বইন্যাদিঘী’। বনরাজ পাল রাজা সাগরপালের পুত্র। বাবার কীর্তিকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য বনরাজ দিঘীটি খনন করেছিলেন। পুত্রের বাহাদুরী পিতা বরদাস্ত করতে পারলেন না, তাই পুত্রকে শায়েস্তা করতে নিষ্ঠুর পিতা পুত্রের প্রাণ কেড়ে নিলেন – স্থানীয়দের কাছ থেকে এমন জনশ্রূতি জানা গেল। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ দিঘীটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আনুমানিক ৬০০ মিটার ও ২০০ মিটার। পাড়গুলো প্রশস্ত এবং গাছ-গাছালীতে পরিপূর্ণ। পাড়ে কোনো বাঁধানো ঘাট নেই তবে আগে ছিল কিনা তা জানা গেল না। গভীরতাও এখন খুব বেশী নয় বলেই মনে হয়। দিঘীদ্বয় সংস্কার করা হয়েছিল বলে মনে হয় না।

আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক এই সব অমূল্য নিদর্শনগুলো ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। সাগরদিঘীর পাড়গুলোর হালফিল দশা দেখলে কে বলবে এক কালে এখানেই ছিল দারুচিনি, কর্পুর, এলাচ, তেজপাতা গাছের সুবিন্যাস্ত বাগান, রাস্তার পাশের ঝাউ ও পাম গাছের সারিবদ্ধরূপ আর ফুল বাগানের অপরূপ সমাহার। ছিল প্রাচীন আমলের অট্টালিকা, নবাবী আমলের কাচারী ভবন – সেই সব নান্দনিকতা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। জনমুখে সাগরদিঘীর কথা জানলেও বইন্যাদিঘীর তেমন পরিচিতি নেই – অথচ পাশাপাশি অবস্থিত দিঘী দু’টোকে কেন্দ্র করে অনায়াসে গড়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।

————————————————————————————————————————————————

৩০ নভেম্বর ২০১৭/ঘাটাইল

তথ্যসূত্রঃ

১. উইকিপিডিয়া

২. বাংলাট্যুরটুডে.কম.বিডি

৩. টাঙ্গাইল প্রতিদিন, মো খায়রুল ইসলাম

৪. সাগরদিঘীদাখিলমাদ্রাসা.এডু.বিডি

৫. কালের স্বাক্ষী ঘাটাইলের ‘সাগরদিঘী’, ভালুকা.কম

৬. টাঙ্গাইলে ঘুরে বেড়ানো, ০৮ আগষ্ট ২০০৮ খ্রী, ট্যুর.ডট.কম

৭. কিংবদন্তির সাগরদিঘি, খান মাহবুব, দৈুনক প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারী ২০০৯ খ্রীঃ/

৮. দেশ জুড়ে যা দেখার আছে, দৈনিক যুগান্তর, ১০ আগষ্ট ২০১২ খ্রীঃ/

৯. ৬৪ জেলা ভ্রমণ, লিয়াকত হোসেন খোকন, পৃঃ ১৬৭/১৭০/

১০. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ৫৫৮/

১১. বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও পুরাকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ১৯৭/

২ টি মন্তব্য : “সাগরদিঘী – টাঙ্গাইল”

    • কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

      পর্যটনের জন্য স্থানটি এখনো প্রস্তুত নয়। তবে বাংলাদেশের একটি প্রত্ন নিদর্শন দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না, বিশেষ করে চলতি পথে কিংবা পরিকল্পিতভাবে বেড়াতে যাওয়া উচিত আমাদের সকলের।
      এখানে নৌকার চল নেই।
      পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র ও এলজিইডির নিজস্ব বসার স্থান ব্যবহার করতে পারবে।
      তোমার মন্তব্য ও আগ্রহের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।