চারপত্র মুড়া – কুমিল্লা

ছোট একটি ইমারত, অন্য সব স্থাপনার তুলনায় চোখে পড়ার মতো নয় – অথচ এর মাঝেই লুকিয়ে ছিল অমূল্য সব তথ্য, ধূলো-মাটির পাজরে আকড়ে থাকা বাংলার এক অজানা ইতিহাস। স্থাপনাটি একটি মন্দির কিন্তু এর গঠন, স্থাপত্যশৈলী, ভূমি পরিকল্পনা ও আকার-আকৃতি বাঙলার সর্বজনীন মন্দির-স্থাপনার তুলনায় ভিন্নধর্মী। তাই বাংলাদেশের প্রত্ন-ইতিহাসের বিস্ময় জাগানিয়া এই মন্দির বেশ কয়েকটি কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ময়নামতি সেনানিবাসের ভিতরে ও ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণির উত্তরাংশে ১০.৬ মিটার উঁচু এক পাহাড়ের উপরে প্রাচীন বাঙলার এই মন্দিরটি অবস্থিত। ৪টি স্তম্ভের উপর স্থাপিত মন্দিরটির লম্বা ছাদের নীচে দু’টি অংশ, যার একদিকে খোলা বা অফসেট। এদিক দিয়েই মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে তাই মন্দিরটি পূর্বমূখী। প্রবেশ পথ পার হলে প্রথমে যে অংশ তা মন্ডপ আর বরাবর এগোলে অপর প্রান্তের অপ্রশস্ত কক্ষটি গর্ভগৃহ। ইট আর কাঁদা-মাটির মজবুত গাঁথুনীতে তৈরী মন্দিরটি পূর্ব-পশ্চিমে আনুমানিক ৩২ মিটার লম্বা আর উত্তর-দক্ষিণে ১৬.৭৬ মিটার চওড়া। মন্দিরের বাহিরের অংশে অর্থাৎ দেওয়ালে ইট দ্বারা সূক্ষ জ্যামিতিক নকশা তৈরী করে খুব সহজেইে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই সবই প্রাচীন বাঙলার স্থাপত্যকলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৫৫-৫৬ খ্রীঃ দিকে তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ কর্তৃক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মন্দিরে খনন কাজ পরিচালনা করা হলে টেরাকোটা ফলক দ্বারা সুশোভিত স্থাপনাটিতে ৩টি নির্মাণ যুগের অস্তিত্ব বের হয়ে আসে।

সেই সাথে গর্ভগৃহ থেকে একটি ব্রোঞ্জের শবাধার/স্মারকধার/রত্নপাত্র ও ধাতুর তৈরী চারটি ফলকলিপি/রাজকীয় তাম্রশাসন মঞ্জুরি/দানপত্র আবিষ্কৃত হয়। ৪টি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে বিধায় এর নাম চারপত্র মুড়া। এটি কিন্তু এর আসল নাম নয়। তাম্রলিপি ৪টির ৩টি চন্দ্র বংশীয় রাজাদের আর ১টি দেব বংশীয় রাজাদের। এর ২টি মহারাজাধিরাজ লড়হচন্দ্রের, ১টি মহারাজাধিরাজ গোবিন্দচন্দ্রের ও অপরটি মহারাজ বীরধর দেব (১২/১৩ শতকের স্থানীয় হিন্দু নৃপতি) এর। শেষেরটি বাদে বাকী ৩টির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। উল্লিখিত রাজারা দেবপর্বতে/পট্টিকেরা নগরীর লড়হমাধব/বিষ্ণু মন্দিরের জন্য এইসব দানপত্র প্রদান করেছিলেন। তাই এখানে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনসমূহ, তাম্রলিপির ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা, রাজাদের দানপত্র ইত্যাদি পর্যবেক্ষনে অনুমিত হয় যে স্থাপনাটি একটি বিষ্ণু মন্দির। মন্দিরটি কে নির্মাণ করেছিলেন তা নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে কেউ কেউ মনে করেন চন্দ্র বংশীয় রাজা লড়হচন্দ্র (১০০০-১০২০ খ্রীঃ) এর নির্মাতা। সার্বিক বিবেচনায় ধারনা হয় এটি খ্রীষ্টীয় ১১/১২ শতকের কোনো নিদর্শন।

 

চন্দ্রবংশীয় রাজাদের কথা আমরা খানিকটা জানতাম কিন্তু তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু আমাদের জানা ছিল না। এখানে প্রাপ্ত তথ্য থেকেই মূলতঃ আমরা এই রাজবংশ সম্বন্ধে জানতে পারি। প্রাপ্ত তাম্র্রলিপি পাঠে এই রাজ বংশের বংশানুক্রম, সামরিক অভিযান, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে যতটা জানা সম্ভব হয়েছে তা তৎকালীন অন্য কোনো সূত্র থেকে হয়নি। বলা চলে একটি গোটা রাজবংশের কুল-ঠিকুজী জানা গেছে এখান থেকে।

ময়নামতি-লালমাই পাহাড় শ্রেণির প্রত্ন-নিদর্শনের মধ্যে প্রথম যে ৫টি স্থান চিহ্নিত করে পরিকল্পিতভাবে খনন কাজ পরিচালনা করা হয় তাদের মধ্যে চারপত্র মুড়া অন্যতম। তথাপিও খননের আগেই এর পূর্বদিকের অংশটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। পশ্চিমদিকের অর্থাৎ গর্ভগৃহের দিকটি কম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এবং তা সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ায় আমরা এখন তা দেখতে পাচ্ছি। যদিও এখানে খুব অল্প সংখ্যক প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে কিন্তু তা যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

——————————————————————————— 

০৭ ডিসেম্বর ২০১৭/ঢাকা-১২৩০/

তথ্যসূত্রঃ

১. প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে ভ্রমন, খান মাহবুব, দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুন ২০১২ খ্রীঃ/

২. প্রত্নতাত্ত্বিক ঐম্বর্য্যে সম্মৃদ্ধ কুমিল্লা, ০৪ ফেব্রূয়ারী ২০১৪ খ্রীঃ/

৩. ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার এক ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকীর্তির নাম, রমজান বিন মোজাম্মেল, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ আগষ্ট ২০০৭ খ্রীঃ/

৪. রূপবান মুড়া ময়নামতি লালমাইর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, খায়রুল আহসান মানিক, দৈনিক ইত্তেফাক, ০৩ ফেব্রূয়ারী ২০০৭ খ্রীঃ/

৫. চারপত্র মুড়াঃ বাংলার ইতিহাসের গৌরবময় নিদর্শন, খায়রুল আহসান মানিক, দৈনিক ইত্তেফাক/

৬. কুমিল্লার চারপত্র মুড়া বাংলার গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক, খায়রুল আহসান মানিক, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৬ খ্রীঃ/

৭. কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু, মো. লুৎফুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ জানুয়ারী ২০১৬ খ্রীঃ/

৮. মহাস্থান ময়নামতি পাহাড়পুর, ডক্টর নাজিমুদ্দিন আহমেদ, পৃঃ ৬৭/

৯. বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও পুরাকীর্তি, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ১৪৭/

১০. Early Terracotta Figurines of Bangladesh, Saifuddin Chowdhury, পৃঃ ১৩০-১৩২/

১১. গ্রাফোসম্যানের ভ্রমণ ব্যবস্থাপনা, ড. ছন্দশ্রী পাল, পৃঃ ৯৪/

১২. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃঃ ৩৯৯/

১৩. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃঃ ৬০/১১১/১২৯-১৩১/১৩৬/

১৪. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃঃ ৬৬৩-৬৬৪/

১৫. উইকিপিডিয়া/বাংলাপিডিয়া/প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর/বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন/

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।