প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন (গল্প অথবা সত্যি!)  

– মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

“কোনো এক অন্ধকারে আমি

যখন যাইব চলে — আরবার আসিব কি নামি

অনেক পিপাসা লয়ে এ মাটিরতীরে

তোমাদের ভিড়ে!

কে আমারে ব্যথা দেছে — কে বা ভালোবাসে —

সব ভুলে, শুধু মোর দেহের তালাসে

শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে

এ মাটির পরে

আসিব কি নেমে!” – জীবনানন্দ দাশ

 

আমার নিজের গ্রাম সম্পর্কিত অধিকাংশ স্মৃতিই আমার টীন (TEEN) হয়ে ওঠার পূর্বের। অর্থাৎ তের বছর বয়সেরআগের। ক্যাডেট কলেজ থেকে আমি ছুটিতে বাড়িতে ফিরতাম ৪/৫ বার। প্রতি বছরে। সংখ্যাটা এখনও তাই  আছে! শুধুমাত্র ‘বছর’ শব্দটা প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে যুগ দ্বারা। এক সময়ে ‘যুগ’ শব্দটা প্রতিস্থাপিত হবে ‘রজত জয়ন্তী’, ‘হীরক জয়ন্তী’ ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ ইত্যাদি উজ্জল আলোকিত শব্দমালা দ্বারা! এক সময়ে অনন্তকাল!

 

সমশের চোর আমাদের বংশের আত্মীয়। আমাদের বংশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কুমার পাড়া  গ্রামের দুই প্রান্তে অবস্থান করে। দুই সূর্য দীঘল বাড়িতে। আমাদের বাড়ি গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে। ঝাড় কাটা স্কুলের সন্নিকটে। সমশের চোরদের বাড়ি গ্রামের পূর্ব প্রান্তে। তালুকদার বাড়ির  সন্নিকটে। আমরা ছোটরা তাকে ডাকি সমশের চাচা! বড়রা তাকে সমশের চোর বলেই সম্বোধন করে। তিনি কিছুই মনে করেন না!কারণ ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময়ে ছাত্রদের কর্তৃক চোর নিধনের একটা অভিযান চলেছিল আমাদের এলাকায়। এই সময়েও আমাদের গ্রামের ছাত্রেরা সমশের চোরের ওপরে কাউকেই হাত তুলতে দেয়নি। চোর হিশেবে অভিহিত করলেও পড়শিরা যে তাকে মায়া করে তা তিনি জানেন।

 

জন্মস্থানের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভালবাসা অথবা অন্য কোন অজ্ঞাত কারণে সমশের চোর কখনই আমাদের গ্রামে চুরি করতেন না! দূরের গ্রামে যেয়ে চুরি করে আসতেন। ধরা পরলে পিটুনি দেবার আগেই স্বীকার করতেন চুরির কথা। বলতেন যে তিনি ঝাড় কাটা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাচাতো ভাই! ঝাড় কাটা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এলাকার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এলাকার শিক্ষিত/অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর ছাত্র! সুতরাং  প্রতিবারেই সমশের চোর জিনিস ফিরিয়ে দিয়ে মুক্তি পেয়ে যান!

 

মুক্তি পেয়ে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর  ঝাড় কাটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে অপদস্ত করেন। তিনি সম্পর্কে তার দূরসম্পর্কের বড় ভাই। ধর্মীয় এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে উপদেশ বানী শোনানো হয়। তবে ফলাফল শুন্য!  এক থেকে দেড় মাস পর পর সমশের চোর  পুনরায় চুরি করতে যেয়ে ধরা পরে! মহিষ বাথান, গুনারিতলা, জোর খালী ইত্যাদি প্রান্তবর্তী এলাকায়। ফিরে আসে একই পদ্ধতিতে!

 

সমশের চোরের কুঁড়ে ঘর। সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। স্ত্রী তালুকদার বাড়ির আশ্রিতের সন্তান। গ্রামের লোকজনের ধারণা সমশের চোর ঘুমায় টাকার বিছানার ওপর! আমরা শিশুরা মাঝে মধ্যেই সমশের চোর বা তার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তাদের ঘরে  প্রবেশ করি। লুকিয়ে লুকিয়ে। ছেঁড়া তোষক উলটিয়ে দেখি! কিন্তু কখনই কিছুই পাইনা। শোনা যায় সমশের চোর যাদু জানে! ফলে তার ঘরে ঢুকে  কিছুই পাওয়া যায় না! সব টাকা অদৃশ্য হয়ে থাকে!

 

শেষবার ব্যাপারটা ঘটেছিল অন্যভাবে।১৯৭৪ সন। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। একদিন প্রাতে ঘুম থেকে জাগার পর আমরা জানতে পারলাম সমশের চোর গ্রামের তালুকদার বাড়িতে চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়েছেন। ঘটনাটি চুরি বিষয়ে তার কর্তৃক অনুসৃত দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত! নিজ গ্রামে সমশের কখনোই চুরি করেন না!

 

আমরা যখন তালুকদার বাড়িতে পৌঁছলাম তখন সকাল ১০ ঘটিকা। সকাল থেকে উক্ত সময়  অবধি সমশের চোরের মুখে গামছা বেধে ওপর থেকে বদনা দিয়ে পানি ঢালা হয়েছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করার উপক্রম করে স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সমশের চোরকে কোনোভাবেই স্বীকার করানো যাচ্ছে না। তালুকদার বাড়ির যুবকেরা খুবই উত্তেজিত!

 

স্বীকার করানোর দ্বিতীয় পর্ব। নতুন পদ্ধতি। কুইনাইনের মতন অব্যর্থ। উঠোনের ওপরে কয়েকটা বাঁশ পরস্পরের সমান্তরালে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তার ওপরে সমশের চোরকে আড়াআড়িভাবে শুইয়ে দেয়া হল। চিৎ করে। অতঃপর তার বুকের ওপরে তিন চারটা বাঁশ স্থাপন করে বাঁশগুলোর দুই পাশে গ্রামের দুষ্ট কিশোরদের বসিয়ে দেওয়া হল।চাপে পাঁজরের হাড় সহ পেটের নাড়ীভুঁড়ি বের হয়ে যাবার অতিক্রম।  কিন্তু সমশের চোরের এক কথা,“আমি নিজের গ্রামে  চুরি করি না!”  বরং চিৎকার করে আবারো জানান দিলেন রাতে নিজ বাড়িতেই রাত কাটাচ্ছিলেন। শেষ রাতের দিকে তালুকদার বাড়ির ছেলেরা তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ধরে নিয়ে গেছে।

 

সন্ধ্যার দিকে তাকে আমাদের বাড়িতে আনা হল। আমাদের ঘরের পাশের দক্ষিণ মুখী ঘরটাতে  তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হবে। আগামীকাল সকাল ১০ ঘটিকায় পুনরায় সালিশ বসবে।  সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে! এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার দুই চোখ উপড়ে নেয়া হবে। বড় তালুকদারের নির্দেশ। আমি ভীষণ শঙ্কিত। সুখ নগরীতে আমার নানা বাড়ির পাশে একটা অন্ধ ভিখারী সারাদিন কাল রঙের গগলস পড়ে থাকে। তার চোখ এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। সমশের চাচার ভবিষ্যৎ আমাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে।

 

পরের দিন সুবহে সাদেকের সময়। দক্ষিণের ঘর তালাবদ্ধ। সবাই সকালের নামাজে মসজিদে  পড়তে গেলো। ফিরে আসার পর জাফর চাচা তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। ভীষণ অবাক হয়ে ফিরে এলেন ঘরের ভেতর থেকে! সমশের চোর ভেতরে নাই! ঘরের চাবিও জাফর চাচার বালিশের নীচেই রাখা ছিল। সমশের চোর তাহলে পালাল কি করে? সেকি আসলেই যাদু জানে?  চাচাস্ত্রীর দিকে সন্দেহের চোখে তাকান! স্ত্রীর মায়ার শরীর। রাতের বেলায় তাকে দরজা খুলে ছেড়ে দিয়েছে  কিনা কে জানে! গ্রামের মহিলা মহলে সমশের চোর খুবই জনপ্রিয়। সবারই ফাইফরমাশ খাটেন তিনি। মুখে সারাক্ষন একটা মৃদু হাসি লেগে থাকে। কে বলবে তিনি একজন চোর?

 

সমশের চোরকে আমরা আর কোনোদিন দেখিনি। শুনেছি তার স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। সমশের চোর চলে গিয়েছিলেন রংপুর জেলায়। অভিবাসন। কাউনিয়া রেল ষ্টেশনে পকেট মারতেন। সিঁদ কাটা চোরের সর্বশেষ পরিণতি! অতঃপর একবার পকেট মেরে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ার সময়ে ট্রেন লাইনের নীচে তার ডান পা কাটা পড়ে। সবই শোনা কথা। এরপর সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি। অন্তত আমাদের এলাকায়।

 

২০১৫ সাল। তিন যুগ পরে সমশের চোর আজ বাড়িতে ফিরছেন! যখন চলে গিয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। এক টগবগে যুবক। সবাই ভুলে গেছে তাকে। কারো স্মৃতিতেই নেই তিনি! তার কুঁড়েঘরের জায়গায় অন্য শরীকের ঘর। তার স্ত্রীর খবর কেউ জানে না। এমনকি তালুকদার বাড়ির সেই যুবকেরাও না! উনারা এখন এলাকার বর্ষীয়ান মানুষ। মাতব্বর!

 

সমশের চোর ফিরছেন কুমার পাড়ায়। তার জন্মভূমিতে। এই ভূমিকে ঘিরে তার কত স্মৃতি! ঝাড় কাটা স্কুলের ফুটবল মাঠ, তেঘরিয়া বাজারের ঝুড়িযুক্ত বিশাল বটগাছ, গ্রামের প্রায়ান্ধকার বাঁশঝাড়, ধুলিময় পথ, ঝাড় কাটা নদীর ঘোলা জল- সব তার এক এক করে মনে পড়তে থাকে! অস্পষ্টভাবে স্ত্রীর মুখও মনে পড়ে! সেকি এখনো তার জন্যে অপেক্ষা করছে? গ্রামের লোকজন যদি তার চোখ উপড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিতো, তবে তিনি কখনই পালিয়ে যেতেন না।

 

মেলান্দহ বাজার রেল ষ্টেশন। ছোটবেলায় ঝাড় কাটা নদী পেরিয়ে গ্রামের ধুলিময় রাস্তা দিয়ে ৯ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মেলান্দহ বাজারে আসতেন। মাটির তৈরি প্রাকৃতিক পথটা এখন বন্ধ। পথের জায়গা জুড়ে ফসলের মাঠ। মেলান্দহ বাজার থেকে ভিন্ন একটা রাজপথ দিয়ে এখন টেম্পুতে অথবা বাসে করে লোকজন মাহমুদ পুর হয়ে ঝাড় কাটা যাচ্ছে! সমসের চোর ক্রাচে ভর করে সামনের দিকে অগ্রসর হন। রেলের চাকার নিচে তার একটা পায়ের পুরোটাই হারিয়ে গেছে। এই স্মৃতিটাও এখন সমশের চোরের নিকট অস্পষ্ট। শুধু মনে আছে গ্রামের কথা! সমশের চোর সিদ্ধান্ত নেন ছোটবেলার মাটির তৈরি পথেই গ্রামে ফেরার। শৈশবের স্মৃতি মাখানো পথে।ফলে রাস্তার বদলে তাকে অনুসরন করতে হয় শুন্য এবড়ো থেবড়ো ফসলের মাঠ, ক্ষেতের আল ইত্যাদি।

 

শীর্ণ শরীর ক্ষেতের উঁচুনিচু চিকন আলের ওপরে ভারসাম্য রাখতে  ব্যর্থ হলে কয়েকবারই তিনি পাশের ধান ক্ষেতের কাদার ভেতরে পড়ে যান। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। ভয় কাজ করছে তার মনের ভেতর। যদি কুমার পাড়ায় তার ফেরা না হয়!

 

রাতের ধূসর মাঠ। ক্রাচে ভর দিয়ে দুর্বল শরীরটাকে টানতে টানতে এক সময়ে তিনি মাহমুদ পুর অতিক্রম করেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মাহমুদপুরের শেষপ্রান্তে মাটির তৈরি বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ। পূর্বে ছিলোনা। বাঁধ পেরুতেই ঝাড় কাটা নদীর শীতল বাতাস তার মুখে এসে লাগে। এই প্রথমবারের মতন তার চোখ দুটো ঈষৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নদী পার হলেই তার স্বপ্নের শৈশব, কৈশোর আর গ্রাম! তার ভীষণ পিপাসা পায়। নদীর জল তাকে টানতে থাকে। টলমল পায়ে সমশের চোর নদীর জলের দিকে এগিয়ে যান! বছরের এই সময়ে নদীতে পানি নেই বললেই চলে।

 

পর দিন সকাল। নরম আলোয় ঝাড় কাটা নদীর দুই তীর আলোকিত। চিরকালের মতন।   কয়েকজন দিনমজুর অবাক চোখে আবিষ্কার করে নদীর পাড়ের নীচে একজন আগন্তুক ব্যক্তিকে।  চিৎ শুয়ে আছেন।শীর্ণ শরীর। বয়স ৬০, ৭০, ৮০ যে কোনটাই হতে পারে! শরীরের অর্ধেক ঝাড় কাটা নদীর স্বচ্ছ জলে ডুবে আছে। তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ স্থির। সূর্যের সোনালী আলো তার মুখ  উজ্জ্বল করে রেখেছে!  দুই তিনটা শঙ্খচিল উড়ছে নদীর অনেক ওপর দিয়ে।

 

একটু সামনেই কুমার পাড়া গ্রাম!

৫,৩২৫ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “প্রত্যাবর্তন”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।