কালপুরুষ

ক্লাস এইটে থাকার সময় হঠাৎ করে আমাদের ব্যাচের আকাশে ধূমকেতুর মত কতিপয় মহান কবির আবির্ভাব হল। তারা একেক জন একেক ডাইমেনশনের কবিতা লিখে বাংলার কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এদের মধ্যে রাসেল ছিল চারন কবি। যেকোনো বিষয় নিয়ে যেকোনো সময়ে খাতা কলমের ধার না ধেরে চোখের নিমিষে কাব্য রচনা করতে পারত আমাদের এই চারন কবি। জামান এবং হাসান ছিল সত্যেন্দ্রনাথ ঘরানার কবি, ছন্দ না মিলিয়ে তারা কোনো লাইন লেখাকে কবিতার অবমাননা মনে করত। “তুমি চিনি আমি শরবত, তুমি পাহাড় আমি পর্বত” টাইপ কবিতা হলেও ছন্দ মেলানো তাদের চাই ই চাই।

খুরশিদ শুরুতে ছিল আধুনিক ধাচের জীবনমুখী কবি। আমার জীবনে পড়া অন্যতম স্মরণীয় কবিতা তার রচনা। এই কবিতার দুটি লাইন কবির ইন্টেলেকচুয়াল কপিরাইট স্বীকার করে এখানে উল্লেখ করছি
“নেই আশা নেই ভালোবাসা,
কাম নাই তাই কুত্তা খেদাই”
এমন জীবনমুখী কবিতা আমি আমার জীবনে আর আর দেখেছি বলে স্মরণে পড়ে না । আজ এই প্রবাসে বসে বিদেশীদের অবসরে কুত্তা খেদানো দেখে এখোনো সম্মানে এই খেয়ালি কবির প্রতি মাথা নুয়ে পরে। কিন্তু কবির মন যেন নারীর মনের মতই – ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কিছুদিন পড়ে খুরশীদ মধুসুদন ঘরানার কবি হয়ে গেল। সে বলতে লাগল সনেট ছাড়া অন্য কবিতা লিখে তার মেধার যথাযথ ব্যাবহার হচ্ছে না। তাই সে আমাদের হুমায়ুন আহমদের উপন্যাসের মত সমানে সনেট উপহাড় দিয়ে যেতে লাগল। সনেটের অন্তমিল “ক,খ,ক,খ,ক,খ,খ,ক,,,,,” বাদেও তার কবিতায় আরো রহস্য ছিল। তার সনেটের ১৪ টি লাইনের প্রথম বর্ণটি মিলে একটি অর্থপূর্ণ বাক্য হত (বেশিরভাগ সময় সেটি হত তার পছন্দের মানুষের নাম)।

আমি ছিলাম সুকুমার ঘরানার ছড়াকার। বন্ধুদের জন্মদিনে আমি ছড়া লিখে উপহাড় দিতে লাগলাম। এর মধ্যে আল-মামুন, ওই যে যার সাথে জিন থাকত বলে তার রুমমেট দাবি করেছিল, তার জন্মদিনে আমি একটি মহান ছড়া লিখেছিলাম যা আজো মনে আছে –
“আল মামুন দেখতে কালো,
মনটা কিন্তু বড্ড ভালো
কাজের বেলায় আন্ডা
খায় শুধু মন্ডা” (এমন আরো ৪২ টির মত লাইন )

সাইমুম আর তানভীর ও বেশ দারুন সব কাব্য রচনা করেছিল। তবে আমাদের মধ্যে খাটি কবি যদি কেউ থেকে থাকে সে ছিল আতিক (এখোনো আছে , মাঝে মাঝে ফেসবুকে তার উর্বর মস্তিস্কের নির্দশন আজো দেখা যায়)। আতিক ছিল শান্তিনিকেন ঘেষা কবি। ভাষার শুদ্ধতাই ছিল তার মূল লক্ষ্য।

এমন অনেক প্রতিভাবান কবির কবিতা নিরবেই ঝড়ে যাচ্ছিল দেখে আমাদের ২ ব্যাচ সিনিয়র আসিফ ভাই এর হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। তিনি নিজ পৃষ্ঠপোষকতায় (সামান্য কুপনের বিনিময়ে) আমাদের মধ্যে থেকে সেরা সাত জন কবির কবিতা নিয়ে একটি মিক্সড কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন – নাম “কালপুরুষ”| তিনি মনে করতেন আমারা সাত কবি, আকাশের কালপুরুশ নক্ষত্রদের মতই কাব্য আকাশে জ্বলজ্বল করব। “কালপুরুষ” কাব্যগ্রন্থটি আমাদের কলেজে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। বাংলার বাঘা বাঘা পন্ডিত স্যারেরা যেমন রফিক কায়সার (পরে মির্জাপুরের প্রিন্সিপাল) আমাদের প্রতিভার ভুয়সি প্রসংসা করেন। পরে ২১ শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে কলেজ থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় কবিতা সেকসনে কবিতা কম পড়লে আমাদের কবিতাগুলে আংশিক পরিমার্জনা করে আবার ছাপানো হয়।

আজো গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে ভাবি, কী ফালতু কাজেই না আমি আমার বিরল প্রতিভা ব্যয় করছি। বাংলার কাব্যাকাশে তাকালে আজ আর কোনো কালপুরুষ দেখা যায় না । সাধের বাংলা ভাষা , তুমি আসলেই দুর্ভাগা।

২,৮৯৯ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “কালপুরুষ”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    খুরশীদের এই ব্যাপক প্রতিভার কথা তো জানা ছিল না দোস্ত! কুত্তা খেদানোর কবিতাটা জটিল হইছে। 😀

    কেমন আছিস রে? এখন কি কাব্যের পিছনে তোর প্রতিভা ব্যয় করিস? 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।