মিডিয়া নিয়ে আলোচনাটি চলুক

মিডিয়া নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সুন্দর আলোচনা শুরু হয়েছে। বিষয়টির গোড়াপত্তন হয়েছে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মালিকরা যখন একটি সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন যে, প্রায় চারশো কোটি টাকার টেলিভিশন বিজ্ঞাপন বিদেশি টেলিভিশনে চলে গেছে এবং দেশি চ্যানেলগুলো এই অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।এদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে বাংলাদেশের টেলিভিশনের কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ দর্শকদের কিছু-কিছু মতামত পাওয়া যাচ্ছে। তারা বলছেন যে, আমাদের প্রোগ্রাম খুব মানসম্মত হচ্ছে না এবং সেকারণেই হয়তো বিজ্ঞাপন বিদেশি টেলিভিশনে চলে যাচ্ছে।

কয়েকটি উদাহরণ দেই।

আমার এক বন্ধু ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ভারতীয় চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন প্রচারে বাণিজ্যিক ও নীতিগত জটিলতা থাকতে পারে। সেটা সমাধানযোগ্য। কিন্তু আমরা দর্শকরা কোন চ্যানেলে কি অনুষ্ঠান দেখব, সেটা নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের শিল্পীদের কে দিয়েছে? ম্যাড়ম্যাড়ে ওয়ারি-ব্রাদার্স ইউনিয়নের হাডুডু মার্কা ফুটবল না দেখে, আমরা বার্সা-রিয়েল মাদ্রিদের এল ক্ল্যাসিকো দেখতে চাইতেই পারি। তেমনই ন্যাকা-ন্যাকা ভাঁড়ামো নাটক আর উঠতি মডেলদের সাতকাহন না দেখে চ্যানেল উল্টিয়ে রুচি ও পছন্দমাফিক অন্য কিছু দেখতেই পারি। তা বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, তেলেগু, আরবি, চায়নিজ যেকোনও ভাষায় হতে পারে। এটা দেশপ্রেম নয়,এটা নিছক বিনোদন।’

আবার আমার এক সাংবাদিক বন্ধু লিখেছেন, ‘অনেকেই বলছেন, টিভি অনুষ্ঠান ভালো হচ্ছে না। মেনে নিয়ে জানতে চাই, মুভি, থিয়েটার, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছবি আঁকা কি ভাল হচ্ছে? আগে ভালো হতো? কবে থেকে ভালো হচ্ছে না? কারণ কী?’

এমন অনেক উদাহরণ আছে।

এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলতে খুব ইচ্ছে করছে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঈদের দিন সন্ধ্যা। টেলিভিশন খুলে বসলাম। চ্যানেল বদলে মনস্থির করার চেষ্টা করছি যে, কোনটি দেখব। একটি চ্যানেলে দেখলাম কয়েকজন তারকা মিলে একটি গ্রুপ টক’শো হচ্ছে। দিলারা জামান, বিন্দু এবং আরও কয়েকজন। তারা বসে আলোচনা করছেন, কার স্বজনেরা কোথায় ঈদ করছে। দিলারা জামান বললেন, তার দুই মেয়ে। একজন থাকেন জাপানে এবং আরেকজন কানাডায়। তারা সবাই একে-একে তাদের স্বজনদের ঈদ করার কথা বললেন। আমি তখন নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, আমি কি জানতে চাই যে দিলারা জামানের মেয়েরা কোথায় ঈদ করছেন?’ উত্তর পেলাম- না, জানতে চাই না। অন্য কেউ নিশ্চয়ই জানতে চান। নাহলে টেলিভিশন চ্যানেল তা প্রচার করবে কেন? আরেকটি চ্যানেলে গেলাম। দেখি দু’জন সংগীতশিল্পী বসে আছেন। তাদের সঙ্গে আছেন দু’জন অ্যাঙকর। সংগীতশিল্পীরা আলাপ করছেন তারা দু’জন কত ভালো বন্ধু, তাদের বাবা-মায়েরাও কত ভালো বন্ধু ছিলেন। একই প্রশ্ন করলাম নিজেকে-আমি কি এগুলো জানতে চাই? নাহ! হয়তো অনেকে চান।

পরদিন অফিসে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানের নির্মাতাকে পেয়ে গেলাম। চ্যানেলটির অফিস ছিল আমার অফিসের ওপর তলায়। তার কাছে জানতে চাইলাম, এই অনুষ্ঠানের ধারণাটি তিনি কোথায় পেয়েছেন। তিনি জানালেন যে, যারা অনুষ্ঠান স্পন্সর করেছেন তারা দিয়েছেন। জানতে চাইলাম, ‘আপনারা রাজি হলেন কেন?’ তার উত্তর, ‘ভাই, অর্থ দিতে চাচ্ছে, না করব কেন?’ বুঝলাম সমস্যাটি কোথায়।

তবে এর উল্টো দিকও আছে। আমি এক সময় এবিসি রেডিওতে কাজ করতাম। সেখানকার কথা বলি। বিজ্ঞাপনদাতারা এসে বলতেন, তারা কি করতে চান এবং আমাদের কাছ থেকে অনুষ্ঠানের আইডিয়া চান। আমরা সবাই মিলে সভা করে তাদেরকে জানাতাম। তা তাদের পছন্দ হলে স্পন্সর করতেন। আবার পছন্দ না হলেও মাঝে-মাঝে স্পন্সর করতেন। কারণ তাদের বাজেট খরচ করতে হবে। তারপর অনুষ্ঠান প্রচার হয়ে যেত।

কিন্তু আমরা কখনও অনুষ্ঠান নিয়ে শ্রোতাদের মতামত নেওয়ার কথা ভাবতাম না। রেডিওর একটি সুবিধা আছে। অনুষ্ঠান চলাকালীন শ্রোতারা অংশ নেন, এসএমএসের মাধ্যমে বা ফোন করে। আমরা মনে করতাম যে, তারা শুনছেন এবং পছন্দ করছেন। কিন্তু টেলিভিশনের কথা যদি ভাবি, তাহলে দেখা যাবে অন্য চিত্র। খুব কম অনুষ্ঠানই আছে যেখানে দর্শক অংশ নেন। আর নিলেও তা থেকে বোঝার উপায় নেই যে, বেশিরভাগ দর্শক অনুষ্ঠান পছন্দ করছেন।

আমি কয়েক বছর আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতাম এবং প্রায়ই বলতাম যে, আমাদের নিজেদের একটি সমীক্ষা চালাতে হবে আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে। পরামর্শ দিলাম যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাই এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জানতে চাই যে, তারা কেমন অনুষ্ঠান চান এবং আমরা যা প্রচার করছি তা তাদের ভালো লাগে কিনা। আমার কথা খুব একটা হালে পানি পেল না। বুঝলাম এ ব্যাপারে কেউ আগ্রহী নয়। আমরা আমাদের বুদ্ধিতে যা আসে তা প্রচার করি এবং ধরেই নেই যে, দর্শক তা পছন্দ করে দেখছেন। কিন্তু আসলেই দেখছেন কিনা তা আমরা জানছি না। আমার মনে হয় এভাবেই দর্শকদের একটা বড় অংশ ভারতীয় চ্যানেল দেখা শুরু করেছিলেন। দর্শকরা আমার চ্যানেল দেখতে চাইছেন কিনা তা আমরা জানার চেষ্টা করছি না। ভারতীয়রা হয়তো কোনও না কোনোভাবে করছে এবং তারা দর্শক যা চাইছে, তেমনটাই প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে প্রচার করছে।

অবশ্যই ভালো অনুষ্ঠান তৈরি করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রচুর অর্থ। আমি যে চ্যানেলে কাজ করতাম তারা দর্শকদের সরাসরি অংশগ্রহণে একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিল তা প্রায় চার বছর হয়ে গেল আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকারীর চাহিদা ছিল একটি গাড়ি, দু’টি ক্যামেরা এবং একটি এডিটিং প্যানেল, যা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ যোগান দিতে পারেননি। অনুষ্ঠানের আদলটা ছিল এমন, দর্শকরা তাদের জীবনের নানা ভোগান্তির কথা সরাসরি জানাবেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেবেন। আমি নিশ্চিত এ অনুষ্ঠান চালু হলে সারা দেশের দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়তো এটি দেখার জন্য। কিন্তু অনুষ্ঠানটি আলোর মুখ দেখেনি।

আমাদের দেশে চ্যানেলের সংখ্যার দিকে যদি নজর দেই, তাহলে দেখব প্রায় চব্বিশ-পঁচিশটি চ্যানেল দর্শকরা দেখতে পান। আরও বেশ কিছু চালু হওয়ার কাজ চলছে। সংখ্যা নিয়ে আমার প্রথম প্রশ্ন- এতগুলো চ্যানেল কি বাংলাদেশে প্রয়োজন আছে? দর্শক কি এতগুলো দেখবে? আচ্ছা ধরে নিলাম দেখবে। কিন্তু চ্যানেল পরিচালনার অর্থ আসবে কোথা থেকে? বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বাজার কি এতই বড় যে ত্রিশটি চ্যানেল টেকসই হবে? যখন একটি টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন ব্যবসার কোনও মডেল নিয়ে ভেবে করা হয় কিনা, তাও একবার আলোচনায় আসা প্রয়োজন।

আমি কয়েক বছর আগে নেপালে গিয়ে দেখি ‘কেয়ার ওয়ার্ল্ড’ নামে ভারতীয় একটি চ্যানেল চলছে। সে চ্যানেলের কনটেন্টে শুধুই স্বাস্থ্যবিষয়ক খবর। টকশোগুলোও স্বাস্থ্য নিয়ে। পুরোপুরি একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক চ্যানেল। বেশ অনেকক্ষণ ধরে সেই চ্যানেলটি দেখলাম। প্রচুর বিজ্ঞাপন। আমাদের এখানে টিভি চ্যানেলের উদ্যোক্তারা চব্বিশ ঘণ্টা খবর অথবা খবর এবং অনুষ্ঠান ও শুধু অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু ভাবেন না বলেই আমার মনে হয়। আমরা শুধু নিউজ, প্রোগ্রাম আর মিক্সড এই চিন্তা করছি। স্বাস্থ্য আছে, খেলা আছে, ব্যবসা আছে, সংগীত আছে- অনেক রকমের বিষয়ভিত্তিক চ্যানেলের কথা ভাবছি না। আমার মনে হয় এদিকে উদ্যোক্তাদের একটু নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

বিজ্ঞাপনের আলোচনা করতে বসলেই আরেকটি বিষয় সবার নজরে আসা জরুরি বলে আমি মনে করি, তা হচ্ছে সংবাদ মাধ্যম এবং ব্যবসায়ীমহল তথা বিজ্ঞাপনদাতাদের সম্পর্ক। আমার মনে হয় দু’টি একে-অপরের পরিপূরক।একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাজারে পরিচিত করতে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো একটি প্রধান মাধ্যম। আবার একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবটুকু আয়ই আসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। মিডিয়া চায় তার কনটেন্ট নিয়ে যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, ততই তার সফলতা এবং মঙ্গল। আবার এদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য যত বেশি ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় ততই তাদের প্রসার। কোনও বিজ্ঞাপনদাতা যদি মনে করেন আমি অমুক মিডিয়াতে অর্থ দিচ্ছি, তাই আমার কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি মিডিয়া প্রকাশ করতে পারবে না। এই ভাবনাটি ঠিক কিনা আমি সবার কাছে জানতে চাই। আবার কোনও বিজ্ঞাপনদাতার কাছ থেকে বিজ্ঞাপন কমে গেলে কোনও মিডিয়া প্রতিষ্ঠান যদি তাকে চাপে রাখার জন্য কিছু খবরা-খবর প্রকাশ করার হুমকি দেয়, তাও যুক্তিপূর্ণ কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বিজ্ঞাপন কমে গেলেই কোনও কোনও মিডিয়া প্রতিষ্ঠান মারমুখী হয়ে ওঠার এমন অনেক উদাহরণ আছে। এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছুলে এক ধরনের শত্রুতা তৈরি হয়। আমার মনে হয় এই দুই সেক্টরের সম্পর্কের যেন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ।

এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। সংবাদ মাধ্যম বা মিডিয়া, যাই বলুন না কেন, আমরা দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকরা মনে করি- এই মাধ্যম সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ছোটবেলায় শুনতাম এই মাধ্যমকে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলা হয়। এই মাধ্যমকে ‘চার স্তম্ভ’ হিসেবে চালিয়ে যেতে হবে।আমাদের এই ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। অনেক দিয়েছে। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে, এই মাধ্যম আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর। আরও যেতে হবে এবং সে কারণেই আমি মনে করি, মিডিয়া নিয়ে এ আলোচনাটি চলুক। তাহলে আমাদের মিডিয়াই উপকৃত হবে।

http://www.banglatribune.com/columns/opinion/165095/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A1%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%81%E0%A6%95

৫,০৩৩ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “মিডিয়া নিয়ে আলোচনাটি চলুক”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    চমৎকার বিষয়।
    ভবিষ্যতে আলোচনা টা কি চ্যানেল ধরে ধরে করবেন?
    খুব ভালো হয়।

    আপনার লেখা পড়ে মনে হলো, টিভি চ্যানেল গুলা চাইলে ফেসবুক বা টুইটারে একটিভ হতে পারে।
    অনুষ্ঠান চলাকালে দর্শক যাতে মন্তব্য করতে পারে সে ব্যবস্থা থাকা উচিত।
    নিজেদের পক্ষে যায় সেসব মন্তব্যগুলো টিভিতে দেখালো কোণায়।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. আপনি অনেক ‍সুন্দর লিখেছেন, যেখানে ভারতের একটি চেনেলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই নতুন মুভি রিলিস হয়, সেখানে বাংলাদেশে তো ভাল মানের মুভিই হয় না . আমি একবার একটা টিভি শোতে শোনলাম যে তারা একটা মুভি রিলিজ করছে ছবিটা অনেক ভাল হলে গিয়ে দেখবেন ব্লা ব্লা কিন্তু যখন রিলিস হল, ছবি তো না নাটকও এর চাইতে ভাল হয়

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আরাফাত

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।