এক সম্পাদকের গল্প

বেশ কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় আমার সাথে এক হৃদরোগ ডাক্তারের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তিনি এক নামকরা হৃদরোগ হাসপাতালের হার্টের চিকিৎসক। তাঁর বন্ধু আমার পরিচিত। বন্ধুর সাথে এসেছিলেন আমাদের ক্লাবে। অনেক কথা হল তাঁর সাথে। আমি আগে সাংবাদিকতা করতাম জেনে তিনি এক পর্যায়ে একটা বিজ্ নেস কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আমিও কিন্তু একজন সম্পাদক’। চোখ বড়-বড় করে কার্ডটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে লেখা আছে তিনি এক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক।
উৎসুক নয়নে তাঁর দিকে চাইলাম। ‘আপনি হার্টের ডাক্তার; আবার সম্পাদক। ব্যপারটি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি সাঙ্গাবাদিকতাও করছেন। কেন?! সখে?!’ আমি জানতে চাইলাম।
‘সে এক লম্বা ইতিহাস’, তিনি বললেন।
আমিও নাছোড়বান্দা। চেপে ধরলাম তাঁকে। বলতেই হবে কেন তিনি সম্পাদক হয়েছেন।
তিনি শুরু করলেন।
“আমি ঢাকায় যেই ভবনে থাকি, যেই ভবনে আমি ফ্ল্যাট কিনেছি, সেখানে একজন পুলিশ অফিসার এবং একজন এনবিআর’এর অফিসারও থাকেন। তাঁরাও সেখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এই ভবনের সোসাইটির প্রেসিডেন্ট আমি; বেশ কয়েক বছর ধরেই আমি প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা ওঁনাদের পছন্দ ছিল না। পছন্দ না হলেই তাঁরা আমায় হুমকি দেয়া শুরু করতেন। পুলিশ অফিসার বলতেন আমায় গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেতে তাঁর দশ মিনিট লাগবে। এনবিআর’এর অফিসার বলতেন তাঁর কথা না শুনলে তিনি আমার ফাইলপত্র বের করে আমায় আদালতে নিয়ে যাবেন। মহা বিপদ! আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল; কিছুই ভাল লাগছিল না। ভয়ে-ভয়ে দিনানিপাত করছিলাম।। একদিন আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে গেলাম সাহায্যের জন্য। সব বললাম। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, মাসে-মাসে একলক্ষ টাকা খরচ করতে পারবি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘পারবো; কেন’? সে বলল, ‘শোন, অনলাইন পত্রিকা বের কর, তুই সম্পাদক হয়ে যা; চারজন ছেলেকে চাকরি দিয়ে রাখ; ওরা সারাদিন বিভিন্ন অনলাইন বা হাইব্রীড অনলাইন পত্রিকা থেকে খবর নিয়ে একটু অন্যরকম করে প্রকাশ করে দেবে; পত্রিকা চলবে – তোর সম্পাদনায়। তোর কিছু করতে হবে না। ওরাই করবে। তারপর এই পুলিশ এবং এনবিআর’এর অফিসারদের তোর কার্ড দেখাবি। দেখ কি হয়।“
‘তারপর কি হল?’ আমি জানতে চাই।
হৃদরোগ ডাক্তার উত্তর দিলেন, ‘ভাই, যখন ঐ পুলিশ অফিসার ও এনবিআরের অফিসারকে জানালাম যে আমি সম্পাদক হয়েছি, তাঁদের ব্যবহার রাতারাতি বদলে গেল। আর তাঁরা আমায় কোন হুমকি দেয় না। সবসময় আমার খবরা-খবর রাখেন। কোন ব্যপারে আমার সাথে মতবিরোধ হয় না। আমি খুউব খুশি। আমার একলাখ টাকা খরচ হচ্ছে – হোক; আমার শান্তি’তো ফিরে এসেছে! কেমন হয়েছে ভাই কাজটা?’
আমি বললাম, খুব ভাল করেছেন ভাই।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এমন ডাক্তার-সম্পাদক দেশে কতজন থাকতে পারে। দু’বছর আগে শুনেছিলাম বাংলাদেশে নাকি অনলাইন নিউজ-পোর্টালের সংখ্যা প্রায় পনেরো’শ! এর মধ্যে গোটা দশেক পোর্টাল ছাড়া আর কারোই নিজের মত করে সংবাদকর্মী নিয়োগ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগই কপি-পেইস্ট করে সংবাদ পরিবেশন করেন – এই ডাক্তার-সম্পাদক পত্রিকার মত।
আমাদের এই ডাক্তার-সম্পাদক চারজন ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন যারা সারাদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশঙ্গুলোর ওয়েবসাইট ঘেঁটে সংবাদ কপি করে পেইস্ট করে এবং তারপর মূল সংবাদের টেক্সটির ভাষা একটু এদিক-ওদিক করে মূল সংবাদের ছবি অথবা গু গ্ল থেকে ছবি বের করে প্রকাশ করে দেয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সারা বাংলাদেশে যদি সত্যিই পনেরো’শ অনলাইন সংবাদ পোর্টাল থাকে, তাহলে সেগুলোর সম্পাদক কারা? তাঁরা কতদিন সাংবাদিকতা করার পর সম্পাদক হয়েছেন? তাঁরা কি আমাদের এই ডাক্তার-সম্পাদকের মত হঠাৎ করেই একদিন সম্পাদক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এই পনেরো’শর অর্ধেকও যদি তাই হয়, তবে আমাদের মাঝে প্রচুর এমন ডাক্তার-সম্পাদক, ব্যবসায়ী-সম্পাদক, আইনজীবি-সম্পাদক, এমন’কি পুলিশ-সম্পাদকও থাকতে পারেন।
ঠিক আছে; সম্পাদক হতে অসুবিধে নেই, কিন্তু সম্পাদক হতে যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, তা কতজনের আছে? আর একটা অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে কপি-পেইস্ট করে খবর প্রকাশিত করলেই যদি সম্পাদক হওয়া যেত, তাহলে আমাদের আলামগীর হোসেন, তৌফিক খালিদী, জুলফিকার রাসেল – এরা তবে এতোদিন কেন এতো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন? আমাদের মূলধারার পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করনগুলোর সম্পাদকরাই বা এতোদিন কি করলেন? তাঁরা এতো কষ্ট করে অর্থ খরচ করে সংবাদকর্মী ও সাংবাদিক নিয়োগ দিয়ে সাংবাদিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন কেন?
প্রশ্ন আরো রয়ে যায়। যাঁরা কপি-পেইস্ট করে সংবাদ পরিবেশন করছেন, তাঁদেরই বা উদ্দেশ্য কি? সখ? শুধু সখের বসে এ’কাজ বোধহয় সম্ভব নয়। অন্য কোন উৎসাহ নিশ্চয়ই তাঁদের মনে কাজ করে। ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি যে পত্রিকা প্রকাশ করতে গেলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এই অনলাইন পত্রিকাগুলো কি অনুমোদনপ্রাপ্ত?
কাগজে ছাপা প্রত্রিকায় — অথবা সাংবাদিকতার রীতিনিতী মেনে যে পোর্টালগুলো সাংবাদিকতা করছেন — যদি ভুলবসত কোন খবর ছাপা হয় তাহলে তা তাঁদের নজরে এনে প্রতিকারের একটি ব্যবস্থা করার যায়। আর এই কপি-পেইস্ট করা পোর্টালগুলোর বেশিরভাগেরই কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। সংবাদ প্রতিনিধি না থাকার কারণে তাঁদের ভুলের সংখ্যা বেশি। সাংবাদিকতার রীতিনিতী না থাকার কারণে সংবাদের ব্যাকরণ মেনে চলার প্রয়োজন হয় না।
আমাদের এই ডাক্তার-সম্পাদক কিন্তু জানেন না তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় কি প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর শুধু প্রয়োজন ‘সম্পাদক’ লেখা বিজনেস কার্ডটি। এই ডাক্তার-সম্পাদকের গল্পটি বললাম একারণে যে, কষ্ট করে কাঠ-খড় পুড়িয়ে যাঁরা পত্রিকা সম্পাদনা করছেন তাঁরা যেন এ ব্যাপারটির কোন সুরাহা করতে পারেন।

৪,৩৫৪ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “এক সম্পাদকের গল্প”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।