বাবা-মা চিরদিনই বাবা-মা

আমার বাবা ঝিনাইদাহ ক্যাডেট কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর অবদান আমার জীবনে অনেক। তবে তাঁকে আজ শিক্ষক-রূপে চেনাতে চাইছি না। বাবা-রূপে চাইছি।
আমরা যখন খেলতাম তিনিও প্রায়ই আমাদের মাঝে থাকতেন, খেলতেন। বেশ কয়েকটি খেলায় তিনিও খুব ভাল ছিলেন। ডিউটি মাস্টারদের ক্যাডেটদের মাঝে থাকতেই হত। শুধু সে কারণেই তিনি আমার আশে-পাশে ঘোরাঘুরি করতেন তা নয়। তিনি কাছে থাকতেন তাঁর ছেলে খেলছে বলেও। ব্যপারটি আমি প্রথম টের পাই দশম শ্রেনীতে পড়ার সময়।
আন্তঃহাউস বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা চলছে। আমি খেলছি। তিনিও আছেন মাঠের কিনারে। খেলতে খেলতে হঠাৎ টের পেলাম যে আমার বাবাও আমার শারীরিক নড়াচড়ার সাথে তাল মিলিয়ে তাঁর শরীরও নড়াচ্ছেন। মনে হচ্ছে আমি নয়, তিনিই আমার হয়ে খেলছেন। কিছুদিন পর ভলিবল। মাঠের কিনারে তিনি। এই খেলায় অনেক উঁচুতে লাফিয়ে উঠে নেটের ওপর দিয়ে চাপ মারার একটি ব্যপার ছিল। আবিস্কার করলাম যে আমি চাপ মারতে গেলে তিনিও মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে চাপ মারার একটি ভঙ্গিমা করতেন। আমার বন্ধুদের কাছে কানতে চাইলাম আমার বাবা আসলে কেমন ভঙ্গিমা করেন। তারা জানালো তিনি এ কাজটি খুবই আবেগের সাথে করেন। মনে হয় তিনি যেন তাঁর শক্তিটুকুও তাঁর সন্তানের মাঝে চালনা দিতে চান। আমার একটি ছবি আছে যেখানে আমি বর্ষা নিক্ষেপ করছি। ছবিতে তাঁকেও দেখা যাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু দাঁড়িয়ে নয়; তিনি তাঁর শরীর বাঁকিয়ে আমার বর্ষা ছোঁড়ার সাথে তাল মেলাচ্ছেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তিনি চাইছেন তাঁর ছেলে যেন আরো জোরে ছুঁড়তে পারে তাই মানসিক ভাবে তাঁর শক্তিটুকুও আমার মাঝে বইয়ে দিতে চাইছেন।
ব্যপারটি আমার কাছে এত ভাল লাগতো যে এই ইদ্রীস স্যার কাছে থাকলে আমার মনোবল দ্বিগুন হয়ে যেত। হয়তো বাবা বলেই তা হত। বুঝতাম বাবা-মায়ের মানসিক সমর্থন সন্তানের জন্য প্রচন্ড একটি শক্তি যা তাদের কাজেও প্রতিফলিত হয়। আমার বাবা যে আমায় তাঁর মানসিক বল আমার মাঝে পুরে দিতেন তা আমি সারাজীবন টের পেয়েছি। আমার বন্ধুর বাবাদেরও আমি লক্ষ্য করেছি। তারাও একই ভাবে তাঁদের মানসিক শক্তি তাদের সন্তানদের মাঝে রোপণ করার চেষ্টা করতেন। অবশ্য এক-এক জনের ধরন ছিল এক-এক রকম।
আমি যখন পড়াশোনায় বা খেলাধুলায় খুব ভাল করতাম, স্পষ্ট বুঝতে পারতাম বাবা মাথা উঁচু করে হাঁটতেন। আমার সার্থকতা যেন তাঁরই। কোন কিছু না পারলে তাঁর মন খারাপ হত।
অনেক কাল পর আমি নিজে যখন বাবা হয়েছি, আমি একই রকম করে আমার সন্তানদের মাঝে আমার মনের শক্তিটুকু তাদের অজান্তেই তাদের মাঝে চালনা করে দিই। এই মানসিক বলের খেলাটি সারাদিনমান চলতে থাকে। এই শক্তি প্রচ্ছন্ন ভাবে বোঝা যায় না; একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়। আমার স্ত্রী যখন আমাদের সন্তানদের ধরে দোয়া পড়ে তাদের কপালে ফুঁ দেয়, তখন আমার মন থেকেও একটি ফুঁ তাদের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়; তারা টের পায় না; আমার স্ত্রীও না।
বাবা-মায়ের দোয়া করার প্রথা শুধু একটি যুগের মধ্যে আবদ্ধ নয়। হাজার বছর আগেও ছিল, হাজার বছর পরও থাকবে। এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক। এ এক চিরকালীন সম্পর্ক!
বাবা আমায় খুব বেশি শাষন করতেন না। তিনি জানতেন যে আমি হয়তো তাঁর বেশির ভাগ উপদেশই শুনব না। তাই অনেক কথা তিনি আমার বন্ধুদের মাধ্যমে আমায় জানাতেন। তবে আমি আশা করতাম তিনি যেন আমায় সরাসরি বলেন।
আমরা দু’ভাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, বাবা তখন ঢাকার মোহাম্মাদপুর প্রিপারেটরী স্কুলের অধ্যক্ষ। স্কুলের ভবন তোলার দ্বায়িত্য তাঁর হাতে। এক রাতে খবর এল কারা যেন ভবন নির্মাণের জন্য রাখা ইট চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা তখনই ছুটলেন। আমরা দু’ভাই তাঁকে থামিয়ে বললাম, ‘আপনি একা যাবেন না; আমরাও যাব; কেউ যানে না সেখা কি অপেক্ষা করছে’। বাবার চেহারায় এমন একটি তৃপ্তি উদ্ভাসিত হল যে তা বলে বোঝানো যাবে না। তাঁর পাশে হাঁটতে পেরে দু’ভাইয়ের জীবন সার্থক মনে হয়েছিল।
আরেকটি গল্প বলি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে। বই পড়তাম অনেক। একবার ১৪০০ পৃষ্ঠার একটি ইংরেজী উপন্যাস শুরু করেছি। এত ভাল লাগছিল যে বাড়ি থেকে কোথাও বেরুচ্ছিলাম না। ক্লাসেও যাচ্ছিলাম না। ঘুম নেই, শুধু খাওয়া-দাওয়া করছিলাম আর পড়ছিলাম। এভাবেই তিনদিন-তিনরাত কাটিয়েছি। বাবা ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখতেন আমি পড়ছি, আপিসে যাওয়ার সময় দেখতেন আমি পড়ছি, আপিস থেকে ফিরে দেখতেন আমি পড়ছি। তিনদিনের মাথায় তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। বললেন, ‘তুমি যাও তো; বাইরে থেকে বেড়িয়ে এস; তোমায় সারাদিন পড়তে দেখতে আর ভাল লাগছে না’। তিনি আমায় বুঝিয়েছিলেন যে তিনি বিরক্ত, তবে তার চেহারা দেখা বুঝেছিলাম আমার পড়া দেখে তিনি একটি অন্যরকম সুখ পেয়েছিলেন।
আমি হেসে, বই বন্ধ করে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম!
মা অবশ্য চাইতেন আমি বাড়িতেই থাকি; বই নিয়েই থাকি। তাঁর কাছে এসে বইটি পড়ি। মাঝে-মাঝে করতামও তাই। তিনি যখন হেঁসেল ঘরে ব্যস্ত, আমি দরজায় পিড়ি নিয়ে বসে পড়তাম; তাঁর ভাল লাগতো।
মায়ের কথাতো বলে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীর কোটি-কোটি সন্তানের কাছে জানতে চাইলেই সবাই একবাক্যে বলবে যে তাদের মায়েরা তাদের সবচেয়ে প্রিয়, জীবনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি, মা’ই সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছেন। এর চেয়ে বড় সত্য আর পৃথিবীতে দু’টি নেই।
বাবাকে এক-এক জন এক-এক রকম করে পেলেও, মাকে সবাই ঠিক একভাবেই পায়। তাঁদের কোন রকমফের নেই। মা চিরন্তন। মায়ের কথা মনে হলেই মনের ভেতর একটি গান ঘুরপাক খেতে থাকেঃ ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না, এমন দরদী ভবে কেউ হবে না আমার মা, মা’গো…’ বাড়ি ফিরতে রাত হলে, বাবা না খেয়ে, রাত জেগে বসে অপেক্ষা নাও করতে পারেন, তবে মা এ ব্যপারে অবিচল; সন্তান বাড়ি আসবে, তারপর তাঁর শান্তি। সন্তানের প্রতিটি কাজের সঙ্গে মায়ের প্রচ্ছন্ন অবদান।
মনে পড়ে ১৯৮৪-৮৫ সালের কথা। উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছি। বাবা তখন দেশে নেই, নাইজেরিয়ায় গেছেন চাকরি নিয়ে। আমরা থাকি আমাদের নানাবাড়ি কুষ্টিয়ায়। আমি একাই সব স্থানে যেতে পারি – ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর। কিন্তু মা আমায় একা ছাড়েন নি। তিনি এই সবগুলো স্থানে আমায় নিয়ে গেছেন। নিজের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা আর দেয়া হয় নি, কিন্তু ছেলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য তিনি সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। এখন বুঝি তিনি তখন আমার আবার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আমরা যে সময়টিতে বেড়ে উঠছিলাম তখন আমাদের মায়েদের সংসারে সরাসরি অর্থনৈতিক অবদান রাখার সুযোগ অনেক কম ছিল। তাঁদের বেশিরভাগই হোম-ম্যানেজমেন্টে ব্যস্ত থাকতেন। আমার বাবা ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক হওয়ায় তাঁর সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হত। পালা-পার্বনে আমারদের জন্য নতুন কাপড় কিনতে পারতেন না। আমাদের বাড়ির আঙ্গিনাতেই বাবা সব রকমের শাক-সব্জি ফলাতেন। সেই শাক-সব্জি আমার মা প্রতিবেশিদের কাছে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করে আমাদের জন্য নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করতেন।
এখন ব্যাপারটি আমার মনে হলেই মন আনন্দে ভরে যায়। কে বলেছে আমার মায়ের সরাসরি অবদান ছিল না? এ বুদ্ধিটিতো বাবার মাথায় আসে নি!
আজকাল আমার কেন যেন মনে হয় আধুনিক বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের বন্ধুদের সাথে খুব বেশি চেনেশোনা নেই। ছেলেমেয়েও খুব একটা তাদের বন্ধুদের সাথে মা-বাবার পরিচয় করিয়ে দেয় না। আমাদের সময় ব্যাপারটি ছিল একেবারেই অন্যরকম। আমাদের বন্ধুদের বাবা-মা – বিশেষ করে – মায়ের সাথে আমাদের ছিল অতল পরিচয়। বন্ধুর মা আমাদের সাথে নিজের মায়ের মত আচরণ করতেন, নিজের মায়ের মত শাসন করতেন। আমরা বন্ধুর বাড়ি গিয়ে কখনও ড্রইং-রুমে বসতাম না। হয় বন্ধুর ঘরে, না হয় বন্ধু বাড়ি না থাকলে তার মায়ের সাথে একেবারে হেঁসেল ঘরে, যেখানে মা রান্নার কাজে ব্যস্ত। হেঁসেলে পিড়ি পেতে বসলেই বন্ধুর মায়ের রান্নার কড়াই থেকে খাবার উঠিয়ে খেয়েছি কতবার তার ইয়ত্তা নেই। বন্ধুর মা যাবতীয় ঘর-সংসারের আলাপ আমাদের সাথে করতেন। এই ঘর-সংসারের আলাপের একটি বড় প্রভাব আমাদের জীবনে পড়েছে তা আমরা এখন টের পাই।
ক্যাডেট কলেজ যখন ছুটি হত; আমার বন্ধুরা যারা ঢাকা-চট্টগ্রাম যাবে তারা খুব সকাল-সকাল চলে যেত, কিন্তু যারা যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা ও ইশ্বরদি যাবে তারা সবাই আমাদের বাড়ি এসে ভিড় করতো আমার মায়ের হাতের রান্না খাবে এবং বাড়ির পরিবেশে আড্ডা মেরে তারপর রওয়ানা দেবে। মা তৈরীই থাকতেন। বন্ধুদের জন্য নানা রকমের পিঠা-পুলি, পরাটা-মাংস বানিয়ে রাখতেন। মা এমনটা বহুবার ক্যাডেট কলেজে প্যারেন্টস্ ডে’তেও করেছেন। আমার বন্ধুদের অনেকের বাবা-মায়ের প্যারেন্টস্ ডে’তে ছেলেকে দেখতে আসা সবসময় সম্ভব হত না। মা তাদের জন্যেও প্রচুর খাবার-দাবার বানিয়ে আমায় দেখতে আসতেন।
মাকে নিয়ে শুধু আনন্দের কথাই বলে যাচ্ছি। তিনি আমায় অনেকবার অনেক কষ্টের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সাহায্য করেছেন, সে কথাগুলো আজ বলবো না। সেগুলো আরেক দিনের জন্য রেখে দিলাম। কিংবা হয়তো বলবোই না।
বাবা কি মা, তাদের দু’জনের আবেগ এবং সন্তানদের আগলে রাখার পন্থা আমাদের কাছে দু’রকম মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁরা দু’জনেই সন্তানের জন্যই বাঁচেন, উপার্জন করেন, কষ্ট করেন – তাঁদের নিজেদের জন্য নয়।
তাঁদের অবদান যে নিঃস্বার্থ তা আমরা সময়কালে বুঝি না, সময় শেষ হলে বুঝি।

৯,৩৯০ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “বাবা-মা চিরদিনই বাবা-মা”

  1. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    "বাবাকে এক-এক জন এক-এক রকম করে পেলেও, মাকে সবাই ঠিক একভাবেই পায়। তাঁদের কোন রকমফের নেই। মা চিরন্তন।"
    কথা টা অনেক ভাল লেগেছে। আসলেই সত্যি। 🙂


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন
  2. ইকরাম ভাই সত্যিই অনেক সুন্দর একটা লেখা। বাবাকে নিয়ে আমরা অনেকেই তেমন একটা উপলব্ধি করি না কিম্বা অনুভব করিনা যতোটা না মা কে নিয়ে করি। এক কথায় অপূর্ব লেখনি।

    জবাব দিন
  3. অনেক ভালো লেগেছে। নিজেকে মাঝে মাঝে গুলিয়ে, মিলিয়ে ফেলেছি। আমার বাবাও শিক্ষক ছিলেন। রাশভারী বাবার ভালবাসাটা ঐ বয়সে টের পাইনি। এখন খুব বুঝি। ধন্যবাদ ভাই - মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে।

    জবাব দিন
  4. আবু হাসান মেহেদী/৩০তম/বকক

    ‘আপনি একা যাবেন না; আমরাও যাব; কেউ যানে না সেখা কি অপেক্ষা করছে’।
    আপনারাও সত্যি অনেক ভালো সন্তান
    দেশের সকল সন্তারেরা যদি এমন ভালো হতো, তাহলে হয়তো কোন Old home এর প্রয়োজন পড়তো না

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।