আরআইপি

রঞ্জন ক্লাবের বারে এসে বসেছে মিনিট দশেক হয়েছে। আজ আসার ইচ্ছেই ছিল না। অথচ আজ তার মনের যা অবস্থা, তাতে বারে বসে স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করে বরং পান করলেই ভালো লাগত। তার পরও রঞ্জন আসতে চায়নি। দুপুর থেকে মনের ভেতর কান্না ভর করেছে। দুবার কেঁদেওছে। বেশ জোরেই। লাভ হয়নি। ভেবেছে নকীবের বাসায় গিয়ে ওর বৌয়ের সঙ্গে দেখা করে আসবে। রীমা এখন কী করছে, কে জানে! আবার ভাবল, কী হবে গিয়ে! নকীব যেখানে গেছে, সেখান থেকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কেউই তাকে রীমার কাছে, তার সন্তানদের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কাউকে না বলে, কিছু না বুঝতে দিয়ে হঠাৎ এমন করে চলে যাওয়াটা ঠিক ওর সঙ্গে যাচ্ছে না। তার পরও খবর এসেছে যে, তাদের সবার ছোটকালের প্রিয় বন্ধু নকীব চলে গেছে।

রঞ্জন সচরাচর এত তাড়াতাড়ি বারে ঢোকে না। প্রায় প্রতিদিনই সাড়ে ৭টায় আসে, জিমে গিয়ে ১ ঘণ্টা ট্রেডমিলে হেঁটে, স্নান সেরে তারপর পানশালার আড্ডায় বসে। প্রতিদিনই একই মানুষের সঙ্গে আড্ডা। সেই পুরনো কথার ফুলঝুরি। সাড়ে ১০টা অবধি অনেক রাজা-উজির মেরে তারপর বাড়ি ফেরে। আজকাল মদের আড্ডায় কথা হয় কম। বেশির ভাগ আড্ডাবাজ হাতের মুঠোয় ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রঞ্জনের ভালো লাগে না এসব। আড্ডা মারবি ক্লাবে এসে, তো আড্ডাই মার! ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলে বার কাউন্টারে গিয়ে একা একা ফোন ব্রাউজ কর।

আজ রোজকার টেবিলে বসেনি রঞ্জন। বার ওয়েটাররা সবাই জানে, সে কোন ড্রিংক নিয়ে বসে। আজ এ টেবিলের দায়িত্বে রয়েছে শান্ত। প্রথমেই সরিষার তেল আর পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে বাদাম মাখিয়ে দিয়ে গেছে। ২ মিনিট পরই দুই গ্লাসে দুটো বরফভর্তি ডাবল ব্ল্যাক রেখে গেছে। রঞ্জন সোডা নেয় না; শুধু বরফ। গ্লাস ধরে ঘূর্ণাকারে দোলাতে থাকে। বরফের সঙ্গে টিং টিং শব্দ হয়। তার ভালো লাগে।

‘স্যার, খাবার আর কিছু দেব?’— শান্ত এসে জানতে চায়।

রঞ্জন নিজেই আজ ফোনের দিকে চেয়ে আছে। নকীবকে নিয়ে আজ তার বন্ধুরা সবাই আলাপ-আলোচনা করছে। শান্তর দিকে একটি দৃষ্টিহীন চাউনি দিয়ে মাথা নাড়ে। নাহ্, আর কিছু খাবে না। সিগারেট ধরায়। দুটো টান দিয়ে আর ভালো লাগে না। গুঁজে দেয় অ্যাশট্রেতে। গ্লাস টেনে নিয়ে লম্বা একটি চুমুক দেয়। ফোন টেবিলে রাখে। আবার একটি সিগারেট ধরায়। তার চেনা টেবিলে লোকজনও আসতে শুরু করেছে। প্রতিদিনের টেবিলমেট হাসান সেদিকে যাওয়ার সময় ক্ষণিক দাঁড়ায়।

‘রঞ্জনদা, আজ আমাদের সঙ্গে বসবেন না?’

‘না হাসান, আমার স্কুলের বন্ধুরা আসবে আজ। আমাদের এক বন্ধু চলে গেছে; সবাই শোক-মিলন করবে।’

হাসান বোঝে না ঠিক। মনে করে, এখানে এলে সবাইই কিছু কথা অন্যভাবে বলে। একটা হাসি দিয়ে রোজকার টেবিলের দিকে চলে যায়। রঞ্জন আর তার দিকে তাকায় না। আঁধার করে পানশালায় বসা কোনোদিনই ভালো লাগেনি তার। সবাই অন্ধকারে বুঁদ হতে কেন যেন পছন্দ করে। আলোয় যেন মাতাল হওয়া যায় না! সঙ্গে বসা কারো চেহারাই ভালো করে দেখা যায় না। সে মনে করে, অন্ধকারে কিছু করতে চাওয়ার অর্থই হচ্ছে লুকিয়ে কিছু করা। বিয়ের রাতে তার স্ত্রীকেও বাতি নেভাতে দেয়নি রঞ্জন।

পানশালায় বসে সে তার সাথিদের সবার চুমুক দেয়া দেখে। একেকজন একেক ভঙ্গিতে পান করে। সে মনে করে, পান করায় এক ধরনের শিল্প থাকতে হবে। স্টাইল থাকতে হবে। কেউ সেই শৈল্পিক মানদণ্ডে পিছিয়ে থাকলে তার সঙ্গে রঞ্জনের বসে আড্ডা দিতে ভালো লাগে না।

আজ তার নজর বারবার ফোনের পানেই চলে যাচ্ছে। ভাইবারে বার্তা ঝরনার মতো বয়েই চলেছে। দুপুর থেকে সবাই একনাগাড়ে ‘রেস্ট-ইন-পিস’ আর ‘ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন’ বলে ইনবক্স ভরিয়ে দিয়েছে।

‘হি ওয়াজ সাচ আ গ্রেট সোল!’

‘আই উইল মিস ইউ, মাই ডিয়ারেস্ট ফ্রেন্ড।’

‘আরআইপি, মাই ফ্রেন্ড; আই উইল টেরিবলি মিস ইউ।’

‘রেস্ট-ইন-পিস’।

‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া…’

‘মে আল্লাহ গ্র্যান্ট হিম জান্নাহ্।’

এ দেশে আগে সবাই বেহেশতকে আরবিতে জান্নাত বলত, এখন জান্নাহ্ কেন বলে? সে চিন্তা করে।

‘দেয়ার ওন্ট বি অ্যানাদার সোল লাইক নকীব। হি শিওর ইজ নাউ লুকিং অ্যাট আস ফ্রম জান্নাহ্।’

এমন বার্তার বন্যা বয়েছে সারা দুপুর। এখন একটু কমেছে। রঞ্জন কিছুই বলেনি। তার বলার কিছু নেই। কিছু খুঁজে পায়নি। আরআইপি ও ইন্নালিল্লাহি বলতে মনে টানেনি। মনে হয়েছে, তার বন্ধু তাকে একা করে দিয়ে চলে গেল; চলে গিয়ে সে নিজেও একা হয়ে গেল। এ কথা কেন ভাবছে সে? শুধু ভাবলেই হলো? গেল ১০ বছর তো নকীব একাই ছিল! তার কোনো খোঁজ রঞ্জন করেনি। বন্ধুর এমন সময় গেছে যে, তার পাশে দাঁড়ানো জরুরি ছিল। কেউ দাঁড়ায়নি। অন্তত রঞ্জন কখনো শোনেনি কেউ নকীবের সাহায্যে এগিয়ে গেছে। কয়েকজন ফোনটোন করেছে অবশ্য। তবে সাহায্যের মতো সাহায্য কেউ করেনি। অনেকের কাছে চাকরি চেয়েছিল সে। অনেক দিন কোনো চাকরি ছিল না। তা না থাকারও কারণ আছে। সাত-আট বছর ধরে সে নানা বিপজ্জনক নেশাদ্রব্যে গ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এ বছরগুলো রীমাই সংসার চালিয়েছে তার সামান্য চাকরি দিয়ে।

রঞ্জন কেন ভাবছে, নকীব একা হয়ে গেছে? সে তো একাই ছিল! রঞ্জনকে নকীব গত ১০ বছর পাশে পায়নি। কাউকেই পায়নি। সেও তো নকীবকে ছাড়া একাই ছিল। জীবনে নকীবের প্রয়োজন বোধ করেনি। আজ কেন মনে হচ্ছে, দুজন দুজনের কাছ থেকে একা হয়ে গেল?

বন্ধুর চলে যাওয়ার খবর শুনে কেউ রীমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যায়নি। স্বনন যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অফিসের কাজে আটকে গেছে। আজকালকার অফিসগুলোও তেমন। শুধু রক্তের সম্পর্কের মানুষ চলে গেলে ছুটির অনুমতি মেলে, বন্ধু তো অনেক দূরের মানুষ। আর সবাই নিজের কাজেই ব্যস্ত ছিল। রঞ্জনের ফ্যাক্টরি গাজীপুরে। সেখানে বসেই ভাইবার বার্তায় জেনেছিল নকীবের খবর। সেখান থেকে আসতে-যেতেই অনেক সময় লেগে যায়। তবে ইচ্ছে করলে তখনই বেরোতে পারত। ততক্ষণে আবার তাদের শোক মিলনের খবরও এসে গেছে। তাই বেরোয়নি। বন্ধুদের কষ্টপাতের আড্ডায় যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল।

‘হু ওয়ান্টস টু গো টু দ্য ক্লাব টু মোর্ন নকীবস ডিমাইজ?’ আইয়ুব লিখেছিল, ‘চল, আমরা সবাই ওকে স্মরণ করি।’

ব্যস্ রাজি হয়ে গেল জনাসাতেক। ক্লাব ছাড়া বন্ধু স্মরণের ভালো স্থান আর কটি আছে? সবাই আসছে ক্লাবে। হাতের কাজ সেরে আসবে। রাত ৮টা বাজবে সবার।

ফোন হাতে নিয়ে বার্তাগুলোর দিকে আবার তাকাল রঞ্জন। একজন লিখেছিল, ‘আমরা নকীবের জন্য কিছু করিনি, করতে পারিনি। আমাদের কিছু করা উচিত ছিল। খারাপ লাগছে এখন।’

আরেকজন এ কথার ভয়ানক বিরোধিতা করে উত্তর দিয়েছে, ‘করব কী করে? তাকে সাহায্য করার মতো অবস্থা ছিল? নেশা করে শরীর-মন দুটোই ধসিয়ে ফেলেছিল। যে চাকরিটা করত, তা দিয়েছিল কে? আমিই দিয়েছিলাম। সেটাও চালাতে পারেনি নেশার কারণে।’

উত্তরটা রঞ্জনের ভালো লাগেনি। কথা অবশ্য সত্য। এ বয়সে আর কী করে পাশে দাঁড়ানো যায়? চাকরি পাইয়ে দেয়াই তো বড় কাজ। কে কাকে চাকরি দেয় আজকাল! রঞ্জনের মনে পড়ে যায় তাদের স্কুলের আরেক বন্ধু আকরামের কথা। ভুলেই গিয়েছিল। আকরাম থাকে শৈলকুপার এক গ্রামে। পড়াশোনায় এগোয়নি, ডাক্তারি শিখে গ্রামেই চর্চা করে। ফোন করেছিল তার ছেলের ব্যাপারে। ছেলে ইনটারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছে, সেনাবাহিনীতে পাঠাতে চায়। সুপারিশ করার জন্য ফোন করেছিল। কাজের চাপে ভুলেই গেছে। আজ সবাই আসছে। দুজন সার্ভিং ব্রিগেডিয়ারও আসবে; বলে দেখবে তখন।

আরেকবার হুইস্কিতে চুমুক দিল। এখনো সইছে না। ভাইবারে টক্ করে শব্দ হলো। দিদার লিখেছে, ‘স্টার্টেড ফ্রম ধানমন্ডি, জ্যামপ্যাক্ট রাস্তা; কামিং’।

সঙ্গে সঙ্গে সেলিমের উত্তর, ‘অ্যাম ভেরি নিয়ার, উইল রিচ সুন।’

রঞ্জনের মনে হলো, এ কষ্টপাত করতে সবার ধেয়ে আসা নকীব কাছেই দাঁড়িয়ে দেখছে। কে কোন ড্রিংক নিয়ে বসতে পারে, সে চিন্তা একবার মাথায় খেলে তার। এ ক্লাবে এলে তার সব বন্ধুই প্রথমে বাদাম-মাখানি আর চিকেন ফ্রাই চায়। অনেকে পরোটা নেয় ভুনা মাংস দিয়ে। ওরা আজো কি তা-ই করবে? ভাবে সে। সে নিজেই বা কী করছে? শোনামাত্র ধাই করে চলে এল ক্লাবে! মনটাকে একটু দমিয়ে অন্যভাবে আজকের সন্ধ্যার পরিকল্পনাটি করতে পারত! অন্তত রীমার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারত। কোনো সাহায্য লাগবে কিনা তা জেনে আসত! গেল না। এল এমন এক কষ্ট মিলনে, যেখানে টুং-টাং গ্লাসের শব্দ হবে, ভুউশ্-ভুউশ্ ধোঁয়া উড়বে, কেউ কেউ চপ চপ করে খাবার চিবোবে আর অনেকে হে-হে করে হাসবে।

না! সে ভুল ভাবছে। সবাইই হয়তো অতিনিষ্ঠায় নকীবকে স্মরণ করবে। আজ কিছু খাবে না, পান করবে না, হাসবে না। ওয়েটার শান্ত এলে তাকে বলবে, ‘আজ আমাদের বন্ধু চলে গেছে, আজ আমরা কিছু চাই না, শুধু তাকে মনে করতেই এখানে এসেছি। শান্ত, তুমি আর এ টেবিলে এসো না, আমরা একটু একা থাকতে চাই।’

সে নিজেই পানীয় নিয়ে বসেছে। কেন ভাবছে, তার বন্ধুরাও তা-ই করবে? নিজেকে ছোট মনে হলো রঞ্জনের। মনের ভেতর এক অচেনা মাতম মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কেন আজ পানশালায় এল সে? আরেকবার কান্না পেল। ওরা সবাইই বা কেন আসছে এখানে? পান করলে কি তাহলে দুঃখ আরো বেদনার্ত হবে? আরো জমাট বাঁধবে? শোক আরো গভীরতর হবে?

নানাবাড়ির বন্ধু মজিদের কথা মনে পড়ে। দুঃখী মানুষ ছিল মজিদ। বাবা চলে যাওয়ায় আর স্কুলে যেতে পারেনি। সৎ বাবার আড়তে সারা দিন কাজ করতে হতো। কাজ শেষ হলে প্রতিদিনই স্টেশন রোড থেকে দেশী মদের বোতল কোমরে গুঁজে নদীর ধারে বন্ধুদের সঙ্গে বসত। গাঢ় অন্ধকারে আশপাশের কেউ দেখত না, উঠতি বয়সের কয়েকজন ছেলে মদ গিলছে। অন্ধকারে মজিদের চেহারা দেখা যেত না, শুধু ওর গলা শোনা যেত। ভরা গলায় সে দুঃখের বর্ণনা দিত। রঞ্জন বুঝত, মদ মজিদের অন্তর্জ্বালা উসকে দিত।

সেই থেকেই সে জানে, এ কড়া তরলটি পান করলে কষ্ট প্রকাশ আরো প্রজ্বলিত হয়। নাকি এ এক ধরনের কষ্টবিলাস?

‘কি রে!’ ভাবনায় বাধা পড়ে রঞ্জনের। সেলিম কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি সে। ‘একা একাই সব মেরে দিচ্ছিস, একটু সামলে টান! রাত তো অনেক বাকি! আরো সবাই আসছে।’

সেলিমের গলা শুনে রঞ্জনের ভাবনাটি পরিষ্কার হয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় নিমেষেই। ঘণ্টা বাজিয়ে শান্তকে ডাকে। সে কাছে এলে বিল দিতে বলে। সেলিমকে বলে, ‘দোস্ত, তুই বস, আমি চলে যাচ্ছি; ভালো লাগছে না। আরেক দিন হবে।’

সেলিম অবাক হয়। এমন রাতে কি এভাবে চলে যেতে হয়।

রঞ্জন ঠিক করে ফেলেছে। এখন আজিমপুরে যাবে সে। আর কিছু না পারুক, বন্ধুর কবরের পাশে দাঁড়িয়েই বলবে, ‘রেস্ট ইন পিস, মাই ফ্রেন্ড।’

৬,৬৯৭ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “আরআইপি”

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।