চুল সমাচার

ছোটবেলা থেকেই চুল আর চুল কাটানো আমার কাছে অনেক ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার। পাড়ার সেলুনে চেয়ারের উপর টুল পেতে বসার সময়টা থেকেই নাপিতের অভিযোগ আমি নাকি অনেক নড়াচড়া করি,আমার চুল নাকি অনেক শক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত বাবার সুবাদে প্রতিমাসে অন্তত একবার নিয়ম করে চুল কাটাতে হতো আমাদের দুই ভাইকে,তা আবার যেমন তেমন চুল কাটা নয়,একেবারে সেন্টিমিটার স্কেলের চুল কাটা। প্রত্যেকবার চুল কাটানোর পর আমাকে সজারুর মতো লাগতো,মনে মনে কষ্ট পেলেও ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না। মনে মনে বলতাম একদিন আমিও …

এরপর চলে আসলাম ক্যাডেট কলেজে। এখানের স্মৃতিও খুব একটা সুখকর না। আমরা যখন প্রথম কলেজে যাই তখন বার্বার শপ ছিলনা,ক্যান্টিনের সামনের খোলা জায়গাটুকুতে চুল কাটাতাম লাইন দিয়ে। সিনিয়র ভাইয়ারা আসলে জায়গা ছেড়ে দিতে হতো,কখনো কখনো সিনিয়র ভাইয়ারা আমাদের বসতে বলতেন নিজেরা না বসে,আমরাও মন ভরে দোয়া করে দিতাম ঐ ভাইগুলোর জন্য। ক্যাডেট কলেজের নরসুন্দর বশির ভাইয়ের কথা না বললে চুল সমাচারে অপূর্ণতা থেকে যাবে। মাসে দুইবার আসতেন বশির ভাই ও তার দল,অদ্ভুত এক বাঙলা এক্সেনটে কথা বলতেন।সম্ভবত উনারা বিহারী ছিলেন। ম্যানুয়াল এক ধরনের যন্ত্র দিয়ে প্রথমে ঘাড় আর কানের অংশটা চেঁছে ফেলতেন পুরোপুরি কিন্তু উপরের চুলগুলো আর কখনোই মিলত না এই নিচেরগুলোর সাথে। বশির ভাই ও তার সহকর্মীদের অদ্ভুত এক নেশা ছিল,মাড়ি আর ঠোঁটের মাঝখানে গুল দিতেন। গুলের ডিব্বায় তর্জনী ভরে “nutella”র মতো করে তুলে এনে,ওইটাকে গালের মধ্যে চালান করে আঙুলটাকে চেটে পরিষ্কার করে নিতেন। এরপর কখনো তোয়ালেতে মুছে কখনো আবার না মুছেই শুরু করতেন চুল কাটা। এই নেশার কারনেই কিনা জানি না মাঝে মাঝে উনাদের ভুল হয়ে যেত,ভয়াবহ ভুল । ২০-২৫ বছর চুল কাটার পরও কোন নাপিত যে চুলের একপাশটা কেটে অন্যপাশ কাটার কথা ভুলে যেতে পারে তা বশির ভাইকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

কলেজে ছোট চুল রাখতে রাখতে বড় চুলের প্রতি কেমন যেন একটা ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল তাই দেশ ছাড়ার সাথে সাথেই চুল কাটা বাদ দিয়ে দেই। একে তো এতদিনের সুপ্ত বাসনা পূরণ হচ্ছে অন্যদিকে অনেক টাকাও বেচে যাচ্ছিল। দুই বছরের চেষ্টায় চুল ঘাড়ে এসে পড়লো,সামারে দেশে গিয়ে কত্তগুলা ভাব নিয়ে চলতে পারবো তা ভেবে ভেবে আমি যখন আহ্লাদে আটখানা ঠিক তখনই আব্বাজান বললেন দেশে যাওয়ার আগে যেন দেখা করে যাই। কি আর করা দুই বছরে কষ্টের ফসল আধ ঘণ্টাতেই শেষ। এরপর আরেকবার চুল বড় করলাম,কিন্তু এবারও কেটে ফেলতে হলো। এবার নিজের বাবা নয় গার্লফ্রেন্ডের বাবার সাথে দেখা করতে হবে বলে।

যাই হোক মুল কথায় আসি,চুল বড় করাটাও অনেক ঝামেলার ব্যাপার। ক্যানসারের যেমন স্টেজ আছে বড় চুলেরও বিভিন্ন স্টেজ আছে। ক্যানসারের সবচে ভয়ঙ্কর স্টেজ হচ্ছে মেটাস্ট্যাটিক স্টেজ ৪(এই স্টেজে ক্যানসার ছড়িয়ে পরে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে,কোন চিকিৎসাতেই আর তখন মানুষ পুরোপুরি সেরে ওঠেনা)। আর চুল বড় করার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্টেজ হচ্ছে “আজিজুল হাকিম” স্টেজ। এই স্টেজে মাথার সব চুল এক দিকে চলে আসে,মাঝে মাঝে কপালের অর্ধেকটা ঢেকে দেয়,জল-তেল-জেল কোন কিছুতেই আর বশ মানতে চায় না। এই ভয়াবহ স্টেজটায় আছি এখন। ক্যানসারের‬ ঐ স্টেজে হয়তো রেডিওথেরাপি,কেমোথেরাপি দিয়ে কিছুদিন বাঁচানো যায় রোগীকে কিন্তু এই আজিজুল হাকিম স্টেজের কোন ওষুধ নাই,অপেক্ষা ছাড়া।

তখন আর এখন আমি 😀

hums

১,৩৪৬ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “চুল সমাচার”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)
    ২০-২৫ বছর চুল কাটার পরও কোন নাপিত যে চুলের একপাশটা কেটে অন্যপাশ কাটার কথা ভুলে যেতে পারে তা বশির ভাইকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

    =)) =)) =)) =))
    নাহ আমাদের এত বাজে অবস্থা ছিলো না। সুনীল ভাই ছিলা কাট দিতেন কিন্তু ভুইলা যাইতেন না।

    চুল বড় করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলাম কিন্তু ম্যাগী নুডলস টাইপের চুল বড় করা ঝামেলার বেশী। তার উপর এখন ভাইয়ার এখানে আছি তাই পারিবারিক চাপ অত্যধিক। যেকোন দিনই আমার মাত্র চারমাসের স্বপ্ন কুচি কুচি করে কেটে ফেলা হতে পারে! 🙁


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।