বলের বদলে গ্রেনেড (২য় পর্ব)

বলের বদলে গ্রেনেড (১ম পর্ব)

২।

কড়া নাড়ার পর চাচা নিজেই দরজা খুলে দিলেন।
-আরে, ডন ব্রাম্মান যে! সব খবর ভাল তো?

সুনীলদা এবং চাচা দুজনেই একসাথে হেসে উঠলেন। চাচা কেন সুনীলদাকে ‘ডন ব্রাম্মান’ বলে ডাকে তা কয়েকবার জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও অনিক সাহস পায় নি। নিশ্চয়ই কোন কাহিনী আছে! আজ কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে অবশেষে জিজ্ঞাসা করেই বসল,
-চাচা, আপনি সুনীলদাকে ‘ডন ব্রাম্মান’ বলে ডাকেন কেন?

চাচা এবং সুনীলদা ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় বসলেন। চাচা বললেন,
-তোর সুনীলদা আমাদের স্কুল এবং কলেজের সেরা ব্যাটসম্যান ছিল। ওর রান পাওয়া-না পাওয়ার উপর নির্ভর করত আমাদের দল জিতবে, না হারবে। সে সময় কেউ ভাল ব্যাট করলেই তাকে ব্র্যাডম্যানের সাথে তুলনা করাটা রীতি ছিল। সুনীলের কাস্ট ছিল ব্রাহ্মণ। ডন ব্র্যাডম্যান এবং ব্রাহ্মণ- এ দুটো মিলে হয়ে গেল ‘ডন ব্রাম্মান!’
-হা হা…কি সব দিন ছিল! সুনীলদাও গলা মেলালেন।
-তোর নামটা কে দিয়েছিল, রহমান নাকি চিন্ময়?
-এসব কাজ রহমান ছাড়া আর কে করবে? সবার নিক নেম দেয়াটা তো ধ্যান-জ্ঞান ছিল। ভাল কথা, তোর নামটা কি জানি ছিল??

হঠাৎ করে অনিকের দিয়ে তাকিয়ে চাচা নিজেকে সামলে নিলেন। মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে ওকে বললেন,
-অনিক, যা হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। আর তোর চাচীকে বল আমাদেরকে চা-নাস্তা দিতে।

‘যাহ! চাচার নিকনেমটা জানা হল না!’ মন খারাপ করে অনিক ভেতরে চলে গেল।

-তো কি মনে করে হঠাৎ? রাশেদ জিজ্ঞাসা করলেন।
-তুই নাকি অনিককে বিকালেও পড়ার জন্য বলে দিয়েছিস? এতে তো ওর প্র্যাকটিসের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
-এত ক্রিকেট খেলে লাভ কি? জীবনে তো আর টপ লেভেলে যেতে পারবে না। এরচেয়ে পড়াশুনায় মন দেয়াই ভাল না?
-মানে? টপ লেভেলে যেতে পারবে না কেন?
-বলতে চাচ্ছি কোনদিন পারবে পাকিস্তানের জাতীয় দলে খেলতে?
-পারবে না কেন? প্রথমে কয়েক মৌসুম কায়েদে-আজম ট্রফিতে ভাল করলে পশ্চিম পাকিস্তানীরাই ওকে নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগবে!
-তুই এত বোকা কেন রে, সুনীল? পাকিরা কি নিজেদের খেলোয়াড় রেখে অনিককে নেবে? দেশের কোন সেক্টরে ওরা বাঙ্গালিদের নিতে চায় না, ক্রিকেট কি করে আলাদা হবে? মনে আছে রকিবুল ছেলেটাকে নিয়ে কি করেছিল? নিউজিল্যান্ডের সাথে টুয়েল্ভথ ম্যান বানিয়ে রেখেছিল!!
-আমি বোকা নই, অন্ধও নই। তবে, মানুষের ভালোত্বের উপর আমার এখনো বিশ্বাস আছে। যাই হোক, রকিবুলের বয়স তখনো ১৭ বছরও হয় নি। ওকে ঐ বয়সেই টেস্টে নামিয়ে দেবে? ১৬ বছর বয়সে পৃথিবীর কয় জন খেলোয়াড় টুয়েল্ভথ ম্যান হিসেবে খেলেছে, বল দেখি? তুই এটাকে অপমান হিসেবে দেখছিস, আমি দেখছি প্রস্তুতি হিসেবে। আগামী মাসে ঢাকায় কমনওয়েলথ দল আসছে পাকিস্তান একাদশের সাথে খেলতে, সেটা তো নিশ্চয়ই জানিস? কিন্তু এটা কি জানিস ঐ ম্যাচে রকিবুলের খেলার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ?
-যতক্ষণ মাঠে না নামছে পাকিদের আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া অনিক এবং রকিবুলের ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। পাকিস্তান দলে এখন বেশ কয়েকজন স্পিনার আছে-পারভেজ সাজ্জাদ, মোহাম্মদ নাজির, আফতাব বালুচ…

সুনীলদা মুখ খুলতে যাচ্ছে দেখে রাশেদ চাচা বাঁধা দিয়ে উঠল।
-আমি জানি তুই কি বলতে চাইছিস। বলবি তো এরা কেউই লেগ স্পিনার না বা অত মেধাবী না…
-নাহ। এরকম কিছু বলতে চাই নি। বলতে চাচ্ছিলাম তুই তো ভালোই খোঁজ রাখিস!! হ্যাঁ, ওদের মধ্যে পারভেজ সাজ্জাদ খুবই ভাল-নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম সেরা লেফট আর্ম স্পিনারদের একজন। কিন্তু ওর বয়স কিন্তু প্রায় ত্রিশ হয়ে গেছে। অনিক যতদিনে পোক্ত হবে ততদিনে ও অবসর নিয়ে ফেলবে। তাছাড়া তুই যাদের নাম বললি তাদের মধ্যে আফতাব একটু ব্যাট করতে পারে, বাকিরা তো জেনুইন বোলার! এই দিক দিয়ে অনিক কিন্তু এগিয়ে আছে-ও একজন অলরাউন্ডার! তাছাড়া ওর ফিল্ডিংও অনেক ভাল। অনিককে আমি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সোবার্স হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখি।
-আরে ব্যাটা, শুধু স্বপ্ন দেখলেই তো হবে না! মুশতাক মুহাম্মদ এবং ইন্তিখাব আলমও তো ব্যাটিং এর পাশাপাশি লেগ স্পিন করে। আরেকজন লেগ স্পিনার অলরাউন্ডারের খানা আছে নাকি? ওদিকে মাজিদ খানও নিয়মিত অফ স্পিন বল করে। এক দলে তুই কয়জন অলরাউন্ডার নিবি?
-চাইলে বলতে পারতাম ওরা ব্যাটিং অলরাউন্ডার আর অনিক বোলিং অলরাউন্ডার। তা না করে তর্কের খাতিরে তোর যুক্তি মেনে নিচ্ছি। এবার বল আগামী ৭-৮ বছর পর এরা কি কেউ থাকবে? এবং ততদিনে অনিক ওর সেরা ফর্মে পৌঁছে যাবে।
-এত বছর পরের কথা বলছিস, দেখ তখন পাকিস্তানই থাকে কি না…

কথাটা শুনে রাশেদ চাচার দিকে ঝট করে তাকালেন সুনীলদা। কথাটা হালকা চালে বললেও দুজনেই জানে ওটা মোটেও হালকা নয়। দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে কেউই নিশ্চিত নয়।
-ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস, রাশেদ। নতুন কোন খবর আছে? ঢাকার কি অবস্থা? গত কয়েক দিন ধরে কোন খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে না…
-ঘটনা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বঙ্গবন্ধু বলেই দিয়েছেন ক্ষমতায় বসার পর ৬-দফা বাস্তবায়ন করবেন। ওদিকে ভূট্টোসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী পশ্চিম পাকিস্তানী নাকি কিছুতেই তা হতে দেবে না। ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের নতুন এম পি’দের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে। ৬ দফা এবং ১১ দফা মিলিয়ে পাকিস্তানের পরবর্তী শাসনতন্ত্র বানাবে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু ঐদিন আরও কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলেই দাবী আদায় হয় না, আরও সংগ্রাম করতে হবে! আওয়ামী লীগের প্রতি কর্মীকে ইউনিয়ন ও মহল্লায় দুর্গ গড়ে তোলার কথাও বলেছেন। আমার মনে হয় পশ্চিমের ওরা কোন ষড়যন্ত্র করছে। আর এটা শেখ সাহেব টের পেয়ে এরকম বলেছেন।
-ঘটনা তো তাহলে মোটেও সুবিধের মনে হচ্ছে না! ওরা কি আদৌ আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেবে?
-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিল জানিস তো? বঙ্গবন্ধুকে নাকি বলেছে সে নিজে ৬ দফার বিরোধী নন। কিন্তু অন্যরা ঝামেলা করছে। অন্যদের দোহাই দিয়ে নিজের কথাই বলেছে কি না কে জানে? ওর কথার তো কোন ভরসা নেই।
-তাহলে শেষ পর্যন্ত সবকিছু কোন অবস্থায় আছে?
-২৬-২৭ তারিখের দিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকায় আসার কথা। শেখ সাহেবের সাথে নাকি মুখোমুখি মিটিং করবে। খালি টালবাহানা! এত মিটিং এর কি দরকার বুঝতে পারছি না। ক্ষমতা দেবে কি না, সরাসরি বলে দিলেই পারে! খালি খালি ঝুলিয়ে রাখছে!!
-তারমানে ভুট্টোর সাথে মিটিং এর পর সব কিছু বোঝা যাবে?
-সবাই তো সেরকমই ভাবছে।
-হুম!
-এদিকে টুকু সাহেব তো ছেলেপেলেদের ট্রেনিং করানো শুরু করেছেন!
-টুকু মানে কি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর লিডার কামরুজ্জামান টুকু’র কথা বলছিস?
-হ্যাঁ, ওর কথাই বলছি। অবশ্য খুব গোপনে কাজ করছে, তবে পুলিশে আছি তো- অনেক গোপন তথ্যও কানে আসে।
-পাকি পুলিশরা কিছু বলে না?
-ওদের পর্যন্ত খবর পৌঁছুতে দিই না। পুলিশে আমাদের একটা বাঙ্গালি গ্রুপ আছে, আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করি এসব খবর যেন উপর মহলে না যায়। সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব আর কি…
-তোকে নিয়ে তো আমার রীতিমত গর্ব হচ্ছে! তা টুকু’রা কি ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
-ইসলামাবাদ কমিউনিটি সেন্টারে সিটি কলেজের স্কাউটদের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ চলে। শেখ আফজাল ওদের প্রশিক্ষণ করায়। ওদের সম্ভবত ২০ টি ডামি রাইফেল আছে। এছাড়াও বয়রা বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের পাশের মাঠে এবং খালিশপুর শ্রমিক ময়দানে ডাঃ আমান উল্লাহ কাজী, হুদা সাহেব, ইলিয়াস খানরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। খালিশপুর জুট মিলের শ্রমিক এবং এলাকার উৎসাহী তরুণরা ওদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

-বলিস কি! এ তো রীতিমত যুদ্ধের প্রস্তুতি!
-আরও আছে…বটিয়াঘাটা এলাকায় একটি বাড়িতে কয়েকজন মিলে বোমা বানানোর অনুশীলন করে এবং বানায়ও। আমাদের তথ্য অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর আব্দুল মান্নান, সরদার নূর নেওয়াজ, তপন কুমার মণ্ডল জ্যোতি…এরা বোমা বানানোয় নেতৃত্ব দিচ্ছে।
-খাইছে!
-সেদিন আমরা উপর মহলের চাপে পড়ে রেইড করতে গিয়েছিলাম। দেখেও না দেখার ভান করে চলে এসেছি। রিপোর্টে লিখেছি- ‘সন্দেহজনক কোন কিছু খুঁজিয়া পাওয়া যায় নি’… হা হা!
-হা হা হা! সুনীলদাও উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।

ততক্ষণে অনিকের চাচী কাজের লোক দিয়ে সিঙ্গারা এবং চা পাঠিয়ে দিয়েছেন। দুই বন্ধু দেশের আলোচনা আপাতত বাদ দিয়ে গরম গরম সিঙ্গারা খেতে শুরু করলেন।

৩।

শনিবার বলে আজকে ক্লাবের সবাই সকাল বেলা প্র্যাকটিস করতে চলে এসেছে। দিনের শুরুতেই অনিক ব্যাটিং করল। ও মেরে খেলতে পছন্দ করলেও আজকে সুনীলদার নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি শট গ্রাউন্ডে খেলতে হয়েছে, অর্থাৎ কোন বল উড়িয়ে মারতে পারবে না। শুধু কামাল ভাই এর একটি শর্ট পিচ বল পুল করার সময় ব্যাটের উপরের কানায় লেগে উঠে গিয়েছিল, এছাড়া প্রতিটি শট গ্রাউন্ডেই ছিল। অনিকের জন্য আজকের প্র্যাকটিস মোটামুটি সফলই বলা যায়।

এই মুহূর্তে ওরা ক্লাবের মধ্যে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। সুনীলদার যে কাজের ছেলেটি আছে সে বিশাল ডেকচিতে করে শরবত তৈরি করেছে। সবাই আরাম করে শরবত খাচ্ছে।

-আগামী রোববার যশোরের জাগরণী ক্রীড়া চক্র আমাদের সাথে প্রীতি ম্যাচ খেলতে চায়। দু-একদিনের মধ্যে আমি প্লেয়িং ইলেভেন এর নাম ঘোষণা করব। এবার বল-আগামী রোববার কার কার সমস্যা আছে? মানে, রোববার আসতে পারবি না-তোদের মধ্যে এরকম কেউ আছে?

কামাল ভাই, লুৎফুল এবং আনিস হাত তুলল। কামাল ভাই বাগেরহাট যাবেন, তার মামার বিয়ে। লুৎফুল এবং আনিসের বাসায় সমস্যা-এজন্য আসতে পারবে না।

-সমস্যা নেই। আমাদের দলে চারজন জেনুইন ব্যাটসম্যান, তিনজন পেসার, একজন লেফট আর্ম স্পিনার, দুইজন অলরাউন্ডার এবং একজন উইকেট কিপার থাকবে। আমি আর শাহিন মিলে দল ঠিক করে তোদের সবাইকে জানিয়ে দেব। তবে, রোববার কিন্তু তোদের সবাইকেই আসতে হবে। আর তোদের পোলাপানদেরকেও বলে দিস। সাপোর্টের দরকার হবে।

-ওদের দল কেমন, সুনীলদা? অনিক জিজ্ঞাসা করল।

-শুনেছি বেশ ভাল। ওদের দুজন ব্যাটসম্যান আছে আগামী মৌসুমে ঢাকায় খেলার জন্য ডাক পেয়েছে। এছাড়া বোলিং এটাকও নাকি যথেষ্ট ভাল। দলের কোচ নাহিদ আমার পরিচিত। ওর ভাষ্য অনুযায়ী দুই দলের মধ্যে ভাল প্রতিযোগিতা হবে। ও তোদের প্র্যাকটিস দেখেছে। আমাদেরকে অবশ্য একটু এগিয়ে রেখেছে। তবে, সেটা আমাকে সম্মান করেও বলে থাকতে পারে!

-আমাদের মিস গাইড করার জন্যও বলে থাকতে পারে। শাহিন ভাই বললেন।
-হ্যাঁ, তাও হতে পারে। দেখা গেল আমরা ওদের হালকা ভাবে নিয়েছি, অথচ ওরা যথেষ্ট শক্তিশালী!! ম্যাচে জেতার এটাও একটা স্ট্র্যাটেজি। তবে, আমরা নাহিদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে নিজের স্বাভাবিক খেলাটাই খেলবো, ঠিক আছে? আর অনিক, আগামী ম্যাচেই তোকে গুগলি করা শুরু করতে হবে, মনে থাকবে?

অনিক মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
– খুব তো গুগলি করা শিখেছিস, এবার বল তো দেখি গুগলি আবিষ্কার কে করেছিলেন?

সবাই মুখ চাওয়া-চায়ি করতে লাগল। এ কেমন কথা? গুগলির আবিষ্কারক!

-গুগলি কি কোন দেশ-মহাদেশ নাকি যে আবিষ্কার করতে হবে? ফোড়ন কাটল দীপ্তদা।
-তো? এটা কি আসমান থেকে হঠাৎ করে পড়েছে বলে মনে হয়?? সুনীলদা বললেন।
-আমার মনে হয় অস্ট্রেলিয়ার কেউ-ই হবে… বিজ্ঞের মতন বলল শারেক। ওদের তো প্রচুর নামকরা লেগ স্পিনার ছিল।
-তোর কথা অর্ধেক সত্য, শারেক। সুনীলদা জানালেন। এটা ঠিক অসিদের ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক গ্রেট লেগ স্পিনার আছেন- হারবার্ট হরডার্ন, আর্থার মেইলি, ক্ল্যারি গ্রিমেট, বিল ও’রাইলি, রিচি বেনো…অনেকেই! অবশ্য, ক্ল্যারি গ্রিমেট অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেললেও আসলে ছিলেন নিউজিল্যান্ডে!
-বল কি, সুনীলদা! এটা কিভাবে সম্ভব? দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নাকি তেমন ভাল নয়! অনিক অবাক হয়ে গেল!
-এটা নিয়ে দু’টো গল্প প্রচলিত আছে। এক, ঐ সময় নিউজিল্যান্ড টেস্ট খেলতো না বলে তিনি অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী হয়েছিলেন- যাতে টেস্ট খেলতে পারেন। দুই, গ্রিমেট যখন ছোট ছিলেন তখন আর্থার মেইলি অসি দল নিয়ে নিউজিল্যান্ডে খেলতে গিয়েছিল। সে সময় মেইলির কাছে গ্রিমেট লেগ স্পিনের ব্যাপারে টিপস চেয়েছিলেন। মেইলি নাকি তাঁকে পাত্তা না দিয়ে কথাই বলেন নি। এতে গ্রিমেট ক্ষেপে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেন একদিন নিজেই অসি দলে দলে খেলবেন!
-আমার তো দ্বিতীয় কারণটাই বেশি পছন্দ হচ্ছে- বেশ থ্রিলিং ব্যাপার!! শারেক বলল।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
-কারণ যাই হোক, ক্ল্যারি গ্রিমেট যখন অস্ট্রেলিয়ায় গেলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর। আর শেষ পর্যন্ত যখন অসি দলে জায়গা পেলেন ততদিনে বয়স হয়েছে ৩৩ বছর!
-৩৩ বছর বয়সে অভিষেক?? সবাই অবাক হয়ে গেল।
কাইয়ুম ফোঁড়ন কেটে বলল,
-অনিক, তোর তো তাহলে এখনো অনেক আশা আছে রে…

সবাই আরেক দফা হেসে উঠল।

-যা বলছিলাম, সুনীলদা বলতে লাগলেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে তিনি ৩৭ টি টেস্ট খেলেছেন। উইকেট নিয়েছেন ২০০ প্লাস! এখন পর্যন্ত এত কম টেস্টে কেউ ২০০ উইকেট দখল করতে পারেন নি। বলের উপর তাঁর অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। তিনি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছে আড়াই শ’র কাছাকাছি, বল করেছেন ৭০ হাজার ওভারেরও বেশি। কিন্তু কোনদিন ওয়াইড বা নো বল করেন নি!! তাহলে বোঝ- কি রকম নিয়ন্ত্রণ ছিল!!
-খাইছে! আমার আমাদের অনিক দিনের প্রথম বল ওয়াইড না করে শুরুই করতে পারে না। আবার কাইয়ুমের মোক্ষম খোঁচা!
-কাইয়ুম আজকে কিন্তু তোর খবর আছে। কৃত্রিম ঝাঁঝের সাথে বলল অনিক!
জবাবে কাইয়ুম জিহ্বা ভেংচি দিল।

-তোরা কথার মাঝে ঝামেলা করিস না! সুনীলদা মৃদু ঝাড়ি দিলেন। সবাই চুপ করে গেল। কি জানি বলছিলাম?
-গির্মেট কোন এক্সট্রা দেয় নি…কথা ধরিয়ে দিতে গেল মৃদুভাষী নয়ন।
-গির্মেট না রে গাধা, গ্রিমেট! গ্রি মে ট! এসময় আরেক গ্রেট লেগ স্পিনার বিল ও’রাইলি জাতীয় দলে ঢোকার পর গ্রিমেটের সাথে দারুণ এক জুটি গড়ে উঠেছিল। ও’রাইলি ছিলেন খ্যাপাটে স্বভাবের, জোরে সাথে বল করতেন। উইকেট না পেলে চিল্লা-পাল্লা করতেন। এদিকে গ্রিমেট ছিলেন শান্ত, চুপচাপ। ধীরে ধীরে ব্যাটসম্যানকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে আউট করতেন। ওঁদের একসাথে বলা হত টাইগার এন্ড ফক্স। বিল ও’রাইলি ছিল বাঘের মতন ক্ষিপ্র, ক্ল্যারি গ্রিমেট ছিলেন শিয়ালের মতন চালাক! দুজনে মিলে ইংলিশদের অনেকবার নাস্তানাবুদ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্রিমেটের জন্ম হয়েছিল ২৫ ডিসেম্বর, মানে খ্রিস্টানদের বড় দিনে। এজন্য বিল ও’রাইলি একবার বলেছিলেন নিউজিল্যান্ডের তরফ থেকে ক্ল্যারি গ্রিমেট ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পাওয়া সবচেয়ে বড় ক্রিসমাসের উপহার! হা হা…

– ঐ সময়ে অসিদের দলে ব্র্যাডম্যান ছিলেন না? জ্ঞানী শারেক মুখ খুলল।
-ঠিক। কিন্তু গ্রিমেটের সাথে ব্র্যাডম্যানের গ্যাঞ্জাম ছিল, ব্র্যাডম্যান মুখে বিল ও’রাইলি এবং ক্ল্যারি গ্রিমেটের প্রশংসা করলেও দুজনের কাউকেই দেখতে পারতেন না। এই দুজনও সবসময় ব্র্যাডম্যানের পিছে লেগে থাকতেন।
-কিন্তু গুগলির কি হল? অনিক জিজ্ঞাসা করল।
-আরে তাই তো! শুরু করলাম গুগলি দিয়ে কথা চলে গেল কোন দিকে…গুগলির আবিষ্কার করেছেন বারনার্ড বোসানকেট নামের একজন ইংরেজ ক্রিকেটার। প্রথমে মিডিয়াম পেসার ছিলেন, পরে লেগ স্পিন করা শুরু করেন। আমাদের অনিকের মতন!
-আরে, অনিক! হবে মামা…হবে হবে… পেছন থেকে আবার কাইয়ুমের গলা।
-সুনীলদা, আমি কি কাইয়ুমকে একটা কিল মারতে পারি? সেনাবাহিনীর অফিসারদের মতন কায়দা করে পারমিশন চাইল অনিক।
-হ্যাঁ, পারিস। মুচকি হেসে বললেন সুনীলদা।

চট করে পেছনে গিয়ে ধুপ করে কাইয়ুমের পিঠে কিল বসাল অনিক। আস্তে মারলেও ‘ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে’ বলে চিৎকার করে উঠল ও। অবশ্য কেউই পাত্তা দিল না। সুনীলদা আবার শুরু করলেন,
-বোসানকেট যখন অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করতেন তখন টুইস্ট-টোস্টি নামের একটি খেলা খেলতেন। খেলাটিতে টেনিস বল এবং বড় টেবিল ব্যবহৃত হয়। নিয়ম হচ্ছে টেবিলের উপর বল ড্রপ করে অন্য প্রান্তে থাকা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে হবে। একবার হাতের কব্জির মোচড়ে এমন একটি বল করলেন যা দেখতে লেগ স্পিনের মত হলেও তা বাঁক খেলো অফ স্পিনের মতন। এটা ১৮৯৭-৯৮ সালের ঘটনা। এর কয়েক বছর পর তিনি নেটে গুগলির প্র্যাকটিস করা শুরু করেন। অবশেষে ১৯০০ সালের লীগের এক খেলায় প্রথম বারের মতন গুগলি বল করেন।
-তার মানে এর আগে কেউ গুগলি করত না? অনিকের অবাক প্রশ্ন!
-করত, তবে কেউই জেনে-শুনে করত না। হয়ত আন্দাজে হয়ে যেত। বারনার্ড বোসানকেটই প্রথম নিজের ইচ্ছায় গুগলি করা শুরু করেন।
-তখনকার খেলোয়াড়রা নিশ্চয়ই চমকে গিয়েছিল? শাহিন ভাই জিজ্ঞাসা করলেন।
-শুধু চমকেই না, ক্ষেপেও গিয়েছিল। সবাই এটাকে সন্দেহের চোখে দেখত এবং অনেকেই এটাকে অনৈতিকও বলত। প্রথম দিকে উদ্ভাবকের নামের সাথে মিল রেখে একে বলা হত ‘বসি’ (Bosey)। তবে, অস্ট্রেলিয়ার সবাই এই বলকে মনে করত ধোঁকাবাজি এবং এর নাম দিয়েছিল রঙ ‘আন (Wrong’un)। সে আমলে অস্ট্রেলিয়ার সমাজ ব্যবস্থা এমন ছিল যে অপরাধী, বিবাহ-বিচ্ছেদকারী এবং সমকামীদের রঙ’আন বলা হত। তারমানে বুঝতেই পারছিস গুগলিকে সবাই কি নজরে দেখত??
-অনিক তুই রঙ ‘আন! এবার টুটুল ভাই খোঁচা মারলেন।
-সুনীলদা!! সবাইকে থামান বলছি! অনিকের অসহায় কণ্ঠ!
-এই তোরা চুপ করবি?? যা বলছিলাম, ধীরে ধীরে বোসানকেটের কাছ থেকে প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা, পরে অসিরাও গুগলি করা শিখে গেল। অবশ্য, এটার নাম গুগলি হয়েছে আরও অনেক পরে। কিভাবে হয়েছে তা অবশ্য কেউ নিশ্চিত নয়। যাই হোক, প্রথমদিকে যাকে সবাই চিটিং বলে সন্দেহ করত সেই গুগলিই এখন যে কোন লেগ স্পিনারের প্রধান অস্ত্র!
-বাহ! দারুণ গল্প। অন্য বলগুলোরও কি এরকম ইতিহাস আছে? শাহিন ভাই জিজ্ঞাসা করলেন।
-নিশ্চয়ই আছে। যেমন, লেগ স্পিনারদের আরেকটি প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ফ্লিপার। যেটা পিচে পড়ে সোজা এগিয়ে যায়-অনেকের মতে এটা আবিষ্কার করেছে ক্ল্যারি গ্রিমেট।
-পেসারদের এরকম কোন গল্প নেই? নিজে পেসার বলেই হয়ত সুমন জানতে চাইল।
-পেসারদের মধ্যে প্রথম কে কবে কোন ধরনের বল করেছেন তা বলা খুব কঠিন হয়ে যাবে। তুই বল, কে প্রথম ইয়র্কার বা বাউন্সার দিয়েছে তা কি জানা সম্ভব?

-তা অবশ্য ঠিক! সুমন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

-তবে, আমার মনে হয় ওয়াইড বলের জনক মনে হয় আমাদের অনিক, তাই না সুনীলদা? অনিকের বেস্ট ফ্রেন্ড বলেই কি না কে জানে, কাইয়ুম সবসময়ই ওকে খোঁচাতে থাকে।

এবার আর অনিক চুপ করে বসে থাকল না। চট করে কাইয়ুমকে ধরতে গেল। কাইয়ুমও প্রস্তুত ছিল। এক লাফে দরজা দিয়ে বের হয়ে সোজা রাস্তায় চলে গেল।
-তোরাও বের হয়ে যা। আজকের মতন ছুটি, বিকালে প্র্যাকটিস হবে না। আমি বিকালে থাকব না, রূপসার ঐ পাড়ে যাব। কালকে তো রোববার, সকালে সবাই ঠিক সময় মত চলে আসিস।
একে একে সবাই বিদায় নিয়ে যার যার বাসার দিকে রওনা হয়ে গেল।

দূরে দেখা গেল মাঠের মধ্যে অনিক তখনো কাইয়ুমকে ধাওয়া করে চলেছে…

৪ টি মন্তব্য : “বলের বদলে গ্রেনেড (২য় পর্ব)”

মওন্তব্য করুন : সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।