লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনঃ দাসের নাতি থেকে ব্যারন হয়েছিলেন যিনি!

[ব্যারন লিয়েরি নিকোলাস কনস্ট্যানটাইন ছিলেন বিধ্বংসী বোলার, বিদ্যুৎগতি সম্পন্ন ফিল্ডার এবং মারকুটে ও নির্দয় ব্যাটসম্যান! তাঁর টেস্ট পরিসংখ্যান তেমন সমৃদ্ধ নয় (১৯ গড়ে ৬৩৫ রান এবং ৩০ গড়ে ৫৮ উইকেট) যতখানি তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার (২৪ গড়ে ৪৪৭৫ রান এবং ২০ গড়ে ৪৩৯ উইকেট)। কিন্তু তাঁর অর্জন এবং অবদান শুধুমাত্র সবুজ মাঠের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ছিল! ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যের রেইস রিলেশনস এক্ট (Race Relations Act, বর্ণবাদ বিরোধী আইন) পাশ করানোর ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য! তিনি নাইটহুড উপাধি পাওয়ার পাশাপাশি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পিয়ার (Peer, ব্যারন হবার মাধ্যমে) অর্জন করেছিলেন। ক্রিড়া সাংবাদিক অভিষেক মুখার্জি তাঁকে নিয়ে এই লেখাটি ক্রিকেট কান্ট্রিতে লিখেছেন। আমি সেটার ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছি!]

লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনের পরিচয় নতুন করে দেয়ার কিছু নেই! মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন একজন দাসের নাতি এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, যিনি এমন এক দেশে ব্যারন উপাধি পেয়েছিলেন যেখানে জীবনের দীর্ঘ একটি অংশ বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন! খেলার মাঠে ছিলেন পুরাদস্তুর ক্যারিবিয়ান! ক্রিকেট বলকে নির্দয়ভাবে পেটাতে পারতেন, প্রচণ্ড গতিতে বল করতেন এবং সম্ভবত সেই সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডারও ছিলেন! উইজডেন লিয়েরি কনস্ট্যানটাইন সম্পর্কে লিখেছিল, তাঁর মুভমেন্ট এতটাই সাবলীল ছিল যে মনে হত তিনি রক্ত-মাংস নয়, যেন স্প্রিং ও রাবারের তৈরি! আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও নেলসন দলের হয়ে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে তাঁর পারফরমেন্স অনেকটাই লোককাহিনীর মত শোনায়!!

দ্যা ইম্প্যাক্ট ম্যান!
লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনের টেস্ট ক্যারিয়ার সাদামাটা হলেও মনে রাখতে হবে যে সেটা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের শুরুর দিকের কথা! তাছাড়া, ক্যারিবিয়দের প্রথম চারটি টেস্ট জয়েই তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য!

১৯২৯-৩০ মৌসুমে বোর্দোতে ইংলিশ দলের বিরুদ্ধে দারুণ বোলিং করেছিলেন! তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ ছিল ৪/৩৫ এবং ৫/৮৭! এরপর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি) অসিদের বিপক্ষে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছিলেন (১/২৮ এবং ২/৫০)। উল্লেখ্য, অসি ব্যাটিং স্তম্ভ অ্যালান কিপক্স-কে উভয় ইনিংস তিনিই আউট করেছিলেন। শুধু তাই নয়, অসাধারণ ফিল্ডিং-ও করেছিলেন।

তৃতীয় জয়টি এসেছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, কুইন্স পার্ক ওভালে। সেই ম্যাচে বল হাতে পাঁচ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৯০ ও ৩১ রানে কার্যকরী ইনিংস খেলেছিলেন। সবশেষে, স্যাবাইনা পার্কে চতুর্থ জয় ছিনিয়ে নেয়ার পথে ৩৪ রান করেছিলেন এবং বল হাতেও সফল ছিলেন (৩/৫৫ এবং ৩/১৩)।

লেব্রুন কনস্ট্যানটাইন
লিয়েরির বাবা লেব্রুনও খুব ভাল ক্রিকেটার ছিলেন। ১৯০০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে তিনিই সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের মাটিতে শতক করার (লর্ডসের মাঠে এমসিসি’র বিরুদ্ধে মাত্র ৯০ মিনিটে ১১৩ রান) গৌরব অর্জন করেন! জীবনে অসংখ্য ম্যাচ খেললেও মাত্র ৫৬টি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পেয়েছিল। সেগুলোয় তিনি ২৫ গড়ে ২৪৩৩ রান এবং ১৪ গড়ে ৪৬ উইকেট দখল করেছিলেন! দলের প্রয়োজনে তিনি উইকেট কিপিং ও করতেন। ক্যাচ ও স্ট্যাম্পিং মিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তাঁর শতাধিক ডিসমিসাল রয়েছে!

দাসের নাতি
লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনের প্রপিতামহ দাস ছিলেন। পিটার ম্যাসনের (লিয়েরির আত্মজীবনীর রচয়িতা) মতে ওঁর পিতামহ আফ্রিকা থেকে ক্যারিবিয় অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিল এবং সম্ভবত কনস্ট্যানটাইন পদবীটি মালিকের (Slave Master) কাছ থেকে ওঁদের নামের সাথে জুড়ে গেছে! ম্যাসনের ধারণা মালিকের নাম ছিল ফরাসি জমিদার জন বাপতিস্তা কনস্টান্টিন।

ওদিকে, তাঁর নানা আলি প্যাসকেলও দাস ছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় তাদেরকে দাস হিসেবে ধরে নিয়ে আসা হয়। কথিত আছে আলি সেখান থেকে কোন ভাবে মুক্ত হয়ে ত্রিনিদাদে পালিয়ে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

সুতরাং, লিয়েরি কন্সট্যানটাইন একদিক দিয়ে দাসের নাতি, আরেকদিক দিয়ে দাসের নাতির ছেলে (গ্রেট গ্রান্ড সন)!

ক্রিকেট পরিবার
লিয়েরির ভাই এলিয়াস এবং অসওয়াল্ড ওসি (Ossie)-ও ক্রিকেটার ছিলেন। অলরাউন্ডার অসওয়াল্ড ২১ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন, বেশিরভাগই ত্রিনিদাদের হয়ে। ওসি খেলেছেন দক্ষিণ ত্রিনিদাদের হয়ে, তবে সেগুলো প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায় নি। আরেক ভাই রডনি-ও টুকটাক ক্রিকেট খেলতেন, এমনকি তাঁদের বোন লিওনোরা-ও বাদ ছিলেন না!

ভিক্টর প্যাসকেল অর্থাৎ লিয়েরির মামাও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন! তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৯২৩ সালে ইংল্যান্ড সফরও করেছেন। সেই সফরেই লিয়েরি তারকা খ্যাতি লাভ করেছিলেন! মজার ব্যাপার হচ্ছে ছোটবেলায় ভিক্টর যখন লেফট-আর্ম স্পিন বোলিং এর অনুশীলন করতেন তখন কিপিং করতেন আনা প্যাসকেল, লিয়েরির মা!

বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ক্রিকেট
শুরুতে কনস্ট্যানটাইন শ্যানন নামের ছোট ক্লাবে খেলতেন। পোর্ট-অফ-প্রিন্সের ক্লাবটি মূলতঃ কৃষ্ণাঙ্গদের দল ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তারা কুইন্স পার্ক ওভালে খেলার সুযোগ পেতেন না! তারা খেলতেন বিস্তীর্ণ প্রান্তর অর্থাৎ সাভানা (Savannah)’র রুক্ষ মাটিতে। লেখক ম্যাসনের মতে জায়গাটি ছিল বিশাল, ছবির মত বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর, যেখানে সহজেই ডজনখানেক ক্রিকেট মাঠ এঁটে যাবে! পুরো এলাকায় হয়ত বা দু’টি বড় গাছ ছিল। চেঞ্জ রুম, ক্লাব হাউজ কিংবা রোদ থেকে বাঁচার জায়গা বলতে ঐ গাছগুলোই ছিল!

নিঃস্ব
ইংল্যান্ড ট্যুরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কনস্ট্যানটাইন এলাকার নামকরা লিগাল ফার্ম লিউইলিন রবার্টস এ চাকরি করতেন। যাই হোক, ট্যুর চলাকালীন বোর্ড থেকে প্রতি সপ্তাহে ভাতা পেতেন ৩০ শিলিং! সবচেয়ে দুঃখের বিষয়- ট্যুর শেষে জানতে পারেন বিরতির কারণে চাকুরিটি হাত ছাড়া হয়ে গেছে! জীবিকা নির্বাহের জন্য এ সময় একাধিক খণ্ডকালীন চাকরি করতে হয়েছিল (স্থায়ী এবং তুলনামূলক ভাল চাকরিগুলো শ্বেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দ ছিল!)। আর্থিক অবস্থার ক্রম অবনতির কারণে ১৯২৫ সালে বাবা-মা’র সাথে থাকা শুরু করেন!

শেষ পর্যন্ত ত্রিনিদাদ লিজহোল্ডস নামক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তিনি স্থায়ী চাকরি পান। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মালিক এইচ সি ডব্লিউ জনসন ছিলেন একজন দক্ষিণ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ!

ক্ষেপা ষাঁড়!
১৯২৫-২৬ মৌসুমে এমসিসি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এসে দুইটি ম্যাচ খেলে। উল্লেখ্য, নবীন ওয়েলি হ্যামন্ড সেই দলে ছিলেন। এমসিসি উভয় খেলাতেই জয়লাভ করলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালই লড়াই করেছিল, বিশেষ করে প্রথম ম্যাচে। খেলায় তারা ৫ উইকেটের ‘সম্মানজনক পরাজয়’ বরণ করেছিল। ম্যাচের এক পর্যায়ে এমসিসি’র ক্যাপ্টেন ফ্রেডি ক্যালথর্প তার বোলারকে ক্যারিবিয় দলের ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে বাউন্সার দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল! অথচ সেসময় ক্যারিবিয় ক্যাপ্টেন হ্যারল্ড অস্টিনের বয়স ছিল ৪৮ বছর!

ঘটনাটি লিয়েরি কনস্ট্যানটাইন মোটেই সহজভাবে নিতে পারেন নি! পরের ইনিংসে ক্যালথর্প ব্যাট করার সময় একের পর ভয়ঙ্কর বাউন্সার দেয়া শুরু করেন! ঘটনা বুঝতে পেরে একজন সহ খেলোয়াড় দ্রুত তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে বলেন, ‘করছ কী তুমি? ক্যালথর্প শুধু এমসিসিরই ক্যাপ্টেন নন, একটি কাউন্টি দলেরও ক্যাপ্টেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ইংল্যান্ডের নামকরা অভিজাত লোক…যদি তিনি আঘাত পান তাহলে তার ফল কী হবে বুঝতে পারছ? তোমার জন্য আমরা কোন ঝামেলায় পড়তে চাইছি না!!’

সেরা সময়
স্পিনার্স ইয়ার্ন বইতে ইয়ান পেবলস লিখেছেন-তাঁর মতে লিয়েরির সেরা পারফরমেন্স ছিল ১৯২৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচে। লর্ডসে অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে তিনি ব্যাট হাতে উভয় ইনিংসে দলের সর্বোচ্চ ৮৬ এবং ১০৩ রান করেন (শতক করতে কাঁটায় কাঁটায় ৬০ মিনিট লেগেছিল!) এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে বল করার সময় ৫১ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট দখল করেন!

নেলসন, ফর এভার
লিয়েরি কনস্ট্যানটাইন ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে নেলসনের হয়ে খেলেছেন ১৯২৯ সালে থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত। এই সময়ে তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোট ৭ বার (এর মধ্যে ‘৩৪ থেকে ’৩৭ টানা চারবার!)। এছাড়া ’৩০, ’৩৩ এবং ’৩৯ এ রানার্স আপ।

নেলসনের হয়ে লিয়েরি রান করেছেন প্রায় ৩৬ গড়ে ৭,১১১ এবং বিশ্বাস্য ৯.৯৪ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৮৮৪ টি। সেই সময়ে তাঁর করা ৭৯৯ টি লিগ উইকেটের রেকর্ড এখনও অটুট রয়েছে। ৭৯ বার ৫ উইকেট দখল করেছিলেন, যা এখনও সর্বোচ্চ! (লিগে ব্যবহৃত প্রতিটি মাঠ এবং অংশ নেয়া সকল দলের বিরুদ্ধে-এটাও রেকর্ড!)।

নেলসনে খেলাকালীন তাঁর আরও অবিশ্বাস্য কিছু কীর্তি রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পারফরমেন্সটি করেন ১৯৩৪ সালে, অ্যাক্রিংটনের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে নেলসন মাত্র ১১৬ রানে অল আউট হয়। এরপর বল হাতে লিয়েরি আগুন ঝরা স্পেলে বিপক্ষকে আক্ষরিক অর্থেই একা গুঁড়িয়ে দেন। তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ ছিল ৬.৫-১-১০-১০! যার মধ্যে ৮ টিই বোল্ড! এখনও এটি ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের সেরা বোলিং ফিগার!

ভারত অভিজ্ঞতা
লিয়েরি ১৯৩৪-৩৫ মৌসুমে ভারতের মঈন-উদ-দৌলা গোল্ডকাপে অংশ নিয়েছিলেন। ২ ম্যাচে ১৫ উইকেট দখল করে নামের সুবিচারও করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে বোম্বের টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারেন নি। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র মুসলিম, হিন্দু, পার্সিয়ান কিংবা ইউরোপীয় হলেই খেলার সুযোগ মিলত। লিয়েরি কনস্ট্যানটাইন কোনটাই ছিলেন না! ১৯৩৭ সালে ‘এবং অন্যান্য’ শর্তটি জুড়ে দেয়ার পর থেকে শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান এবং অ-ইউরোপীয় খেলোয়াড়গণও খেলার সুযোগ পান।

চৈনিক অভিজ্ঞতা
নাহ, তিনি চীন দেশে ক্রিকেট খেলতে যান নি! তবে, লিয়েরির চৈনিক অভিজ্ঞতা ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে! কে, কবে, কিভাবে চায়নাম্যান বোলিং আবিষ্কার করেছে তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ বা দলিল নেই। তবে, সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত যে মতবাদ তার সাথে লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে! ১৯৩৩ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্টে ক্যারিবিয়ান লেফট আর্ম রিস্ট স্পিনার এলিস আচং ইংলিশ ব্যাটসম্যান ওয়াল্টার রবিনসকে আউট করেন। রবিন যেদিকে আশা করেছিলেন বল তার বিপরীতে টার্ন করেছিল এবং তিনি পরাস্ত হয়ে স্ট্যাম্পড আউট হন।

আউট হবার পর রাগে গজগজ করতে করতে সজোরে বলে ওঠেন, ‘কে ভেবেছিল শালার চায়নাম্যানের কাছে আউট হব?’

ততদিনে বর্ণবাদ, বর্ণবিদ্বেষের সাথে লিয়েরির ভালই পরিচয় হয়ে গেছে! রবিনস এর কথা শুনে তিনি ফট করে বলে ওঠেন, ‘কার কথা বলছ? বলটি নাকি বোলার?’

এরপর থেকে চায়নাম্যান (লেফট আর্ম রিস্ট স্পিনারে গুগলি) টার্মটি চালু হয়ে যায়! ঘটনা সত্যি নাকি নয়, সেটা দেখার বিষয় ইতিহাসবিদগণের!

ক্রিকেট ভক্তদের কাছে এই ইতিহাসটিই বেশি প্রিয়!

নিগার!
ইংল্যান্ডে বসবাসের শুরুর দিকে প্রতিনিয়তই তিনি বর্ণবিদ্বেষের শিকার হতেন। এ প্রসঙ্গে ম্যাসন (লিয়েরির আত্মজীবনী লেখক) ১৯৩৩ সালের একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন! চিঠির উপরে দারুণ সম্মান দিয়ে লেখা ছিল LN Constantine Esq., Professional, Nelson CC কিন্তু সম্বোধন ছিল ‘ডিয়ার নিগার’! আসলে সেই আমলে ইংল্যান্ডে কৃষ্ণাঙ্গদের ‘নিগার’ বা ‘ব্ল্যাক বাগার’ নামে ডাকা খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল!

লিয়েরি নিজেও অস্বস্তিকর স্মৃতি উল্লেখ করেছেন। একবার দুইটি শিশু তাঁর সাথে হ্যান্ডশেক করে, একজনের বয়স ৬ এবং অন্যজনের ৪ বছর। হ্যান্ডশেক শেষে ওদের বাবার দিকে ফিরে কথা বলার সময় শুনতে পান শিশু দু’টো নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। একে অন্যকে হাতের তালু ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলছে,
-আমার হাতে তো কিছু লাগে নি, তোমার হাতে কি (কালো রঙ) লেগেছে?

ইমমোরাল ইমপেরিয়াল
লিয়েরি কনস্ট্যানটাইন নামক বইতে লেখক জেরাল্ড হাওয়াট একটি হৃদয়বিদারক ও ঘৃণ্য ঘটনা উল্লেখ করেছেন। একবার লর্ডস এ লিয়েরির পরপর দুইটি খেলা ছিল। প্রথমটি একদিনের ম্যাচ, দ্বিতীয়টি দুই দিনের ম্যাচ।

লিয়েরি বেশ আগে থেকেই রাসেল স্কয়ারের ইম্পেরিয়াল হোটেলে দুইটি রুম বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ হোটেলে উপস্থিত হবার পর ম্যানেজার তাঁকে অবাক করে দিয়ে জানায় যে তাঁরা এক রাতের বেশি থাকতে পারবেন না! অথচ লিয়েরি চার দিনের জন্য রুম বুক করেছেন। এই কথা উল্লেখ করার পর ম্যানেজার উদ্ধতভাবে বলে ওঠে, ‘আমার যখন ইচ্ছে তোমাকে তাড়িয়ে দিতে পারি!’

লিয়েরি তৎক্ষণাৎ ঘটনাটি আর্নল্ড ওয়াটসন নামক এক ভদ্রলোককে জানান, তিনি শ্রম মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ভদ্রলোক নিজেই চলে আসেন। ম্যানেজারের ওয়াটসনকে জানায় লিয়েরি তাঁর পরিবারসহ শুধু রাত কাটাতে পারবে, পরদিন সকালে চলে না গেলে তাদের লাগেজ বাইরে ফেলে দেয়া হবে!

এই বাজে ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে সে জবাব দেয়, ‘আমাদের হোটেল নিগ্রোদের জন্য নয়!!’ উল্লেখ্য, লিয়েরি ততদিনে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, অর্থাৎ তিনি পুরাদস্তুর বৃটিশ সিটিজেন! লিয়েরি আর কোন কথা না বলে শেষ পর্যন্ত বেডফোর্ড হোটেলে উঠেছিলেন।

এই ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তুলেছিল এবং এটা নিয়ে ইংল্যান্ডের হাউজ অব কমন্স এ-ও ঝড় উঠেছিল। লিয়েরি শেষ পর্যন্ত ইমপেরিয়াল হোটেলের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এবং বলা বাহুল্য-মামলায় জিতেছিলেন!

রাজনৈতিক মোহ
১৯৫৪ সালে লিয়েরি হঠাৎ করেই ‘নিজ দেশ’ ত্রিনিদাদে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মতে এটা ছিল ‘দেশের প্রয়োজনে’! অবশ্য, সে সময় ত্রিনিদাদ বেশ অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে সর্বসম্মতিক্রমে পিপলস ন্যাশনাল মুভমেন্ট (পিএনএম) দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ নির্বাচনে নিজ এলাকা তুনাপুনা থেকে নির্বাচিত হন এবং সরকার গঠন করার পর যোগাযোগ, কর্ম এবং পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু, কিছুদিন পর তাঁর রাজনীতির মোহ কেটে যায়। অবশেষে, ১৯৬১ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে লন্ডনের ত্রিনিদাদ ও টোবাগো হাই কমিশনার হয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।

অবশ্য, রাজনীতিতে থাকলেও সেসময়টুকুতে ক্রিকেট থেকে নিজেকে দূরে রাখেন নি। নিয়মিত দলের খোঁজখবর রাখতেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রথম স্থায়ী কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে ফ্রাঙ্ক ওরেলকে দায়িত্ব দেবার ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম ভূমিকা ছিল।

সম্মাননা
হাই কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে লন্ডনে যাওয়ার এক বছরের মাথায় তাঁকে ‘নাইটহুড’ প্রদান করা হয়। জীবনের বাকিটা সময় তিনি লন্ডনেই ছিলেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে ‘পিয়ার’ (Peer,ব্যারন হবার মাধ্যমে) অর্জন করেন।

১৯৭১ সালের ১ জুলাই মারা যাবার পর তাঁর মরদেহ ত্রিনিদাদে নেয়া হয় এবং পিতৃস্থান আরুকা’য় তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছিল। ত্রিনিদাদ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে মরণোত্তর ‘ট্রিনিটি ক্রস’ পুরষ্কারে ভূষিত করা যায়- যা কী না ত্রিনিদাদের সর্বোচ্চ সম্মাননা!

গত ২১ সেপ্টেম্বর ছিল এই মহান মানুষটির ১১৬ তম জন্মবার্ষিকী। একাধারে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ও ক্রিকেটারদের অধিকার আদায় আন্দোলনের অগ্রদূত স্যার লিয়েরি নিকোলাস কনস্ট্যানটাইন, ওরফে ব্যারন কনস্ট্যানটাইনকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসার সাথে স্মরণ করছি।

৪ টি মন্তব্য : “লিয়েরি কনস্ট্যানটাইনঃ দাসের নাতি থেকে ব্যারন হয়েছিলেন যিনি!”

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।