পুরনো সেই দিনের কথা

বাবা-মা নিয়ে ক্যাডেটদের আদিখ্যেতা করতে নেই। ছোটবেলা থেকে নিজে এবং আশেপাশের পরিস্থিতির জন্য আমরা শিখেছি কিভাবে কলেজে যাওয়ার মুহূর্তে ট্রেন ছেড়ে দেবার সময়ে হাত ধরে মায়ের কয়েক পা এগিয়ে আসা আর অশ্রুসজল চোখ দেখে নিজের চোখের জল কিভাবে সবার অলক্ষ্যে মুছে ফেলা। এরপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নেওয়া কেউ দেখে ফেলল কিনা। আর তার ১০ মিনিট পরে সবার সাথে গল্প করতে শুরু করা। বাসার জন্য খারাপ লাগাটা আমরা প্রকাশ করতাম এই জেলখানাতে ঢুকতে হয় বলে কষ্ট হিসেবে ।
জীবনের কোথাও যখন কেউ বাসার কথা বলে মন খারাপ করে তখন বেশিরভাগ ক্যাডেটরাই হয়ত সেটাকে পাত্তা দেয় না টিজ করে ,তাই শুনতে হয় আমরা নাকি ছোটবেলা থেকে বাইরে থাকি বলে বাসার প্রতি টান কি জিনিস বুঝিনা। তাই আমাদের খারাপ লাগা বাসার প্রতি টান থেকে যায় সবার অনাবিষ্কৃত , আমরা যে একে লুকিয়ে রাখতে শিখেছি ছোট বেলা থেকে। আমরা আসলে কি করি যখন খারাপ লাগে খুব যখন খুব ইচ্ছা করে মায়ের হাতের আদর পেতে কিংবা বাবার বকা খাওয়ার লোভ শত পোলাও কোর্মা খেলেও মিটেনা?বাসায় ফোন দেই কিন্তু কখনো বলা হয়ে উঠেনা মা খুব মনে পড়ছে। তার বদলে বার বার জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন? কি করছেন? ঘুরে ফিরে কথা এগুলোই নতুন কোন কথাও আসে না।

আমি কখনোই বাবার আদরের ছেলে ছিলাম না। মাঝের ছেলে নাকি একটু বেয়াড়া হয়। তা ছিলাম মনে হয় কারণ মনে আছে আব্বুর মাইর খেয়ে অন্য ভাইদের মত আমি কিছুক্ষণ পরে নরমাল হয়ে যেতাম না বরং অনেকক্ষণ ধরে সেটার আক্রোশে চুপ করে দূরে থাকতাম। বেশির ভাগ সময়েই ভাত খেতে চাইতাম না ফল আরেক প্রস্থ উত্তম মধ্যম।
আমার বাবার কথা যখন বলি তখন আমি খুব নির্লিপ্ত ভাবে বলার চেষ্টা করি। কারণ খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার সম্বন্ধে গল্প করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। যখনই কথা হয়েছে আশেপাশের সবাই এমন করুণ করে মুখ করে মনে হয় আমাকে খুব একতা দুঃখ দিয়ে ফেলেছে। আমার মনে হত বাবাকে হারিয়েছি ঠিক আছে কিন্তু খুব সহজ ভাবে বাবার কথা বলার অধিকারটুকে কেড়ে না নিলেই হত। দেখতাম আব্বুর কোন কথা বলছি সবাই খুব বিব্রত হয়ে যাচ্ছে। আব্বু আমাকে মেরেছে সেটা বলার পর দেখি সবাই স্বান্ত্বনা দেয় ভালোর জন্যই। আরে আমার ও তো স্মৃতি রোমন্থন এর ইচ্ছা জাগতে পারে। ছোটবেলার এইসব ঘটনা তাই কাউকে বলতে পারিনি। অনেকে ভাবে আমার বাবার প্রতি আমার অনেক রাগ মোটেও সত্য নয়। এটা আমি জানি আমি হয়ত তার সবচেয়ে আদরের ছেলে ছিলাম না তবে এটাও আমি জানি আমার যা কিছু অর্জন যা কিছু ভালো জিনিস সবই এই মানুষটার ইচ্ছা এবং কষ্টের ভবিষ্যত।

অনেক অনেক দিন আগে আমাদের বাসায় মিলিটারি রুল ছিল। যদিও জানতাম না এটা মিলিটারি রুল আমরা ভাবতাম সব বাসা বুঝি এরকম। আব্বু অফিস থেকে আসলে বাসা চুপচাপ হয়ে যাবে রাতের ৯টার দিকে ভাত খেতে হবে এরপর দশটার খবর যখন খেলার খবরে চলে যাবে তখন টিভি অফ হয়ে সবাইকে শুয়ে পড়তে হবে লাইট অফ করে দিয়ে। নিজেদের আলাদা রুম ছিল না বলে বাপের অজান্তে কিছু করার কোন উপায় ছিলনা। ন্যাশনাল সাদাকালো ১৪ ইঞ্চি একমাত্র বিনোদনের জিনিসটি অতি সযতনে আব্বুর রুমেই রাখা থাকত। তাই আমার আম্মুকেও সাড়ে দশটার ছায়াছন্দ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হত কখন আব্বু ঘুমিয়ে পড়বে। পরবর্তীতে বড়ভাই এর সাহস আরেকটু বেড়ে যাওয়ায় যার রুপান্তর দেখেছিলাম সাড়ে দশটার কি এক ইংরেজি সিরিয়াল দেখার চেষ্টায়। ওর লজিক অবশ্য ভালই ছিল ইংরেজি ভাল করার চেষ্টা।

আমার একটা জিম ঘড়ি ছিল (গিফট অফ দ্যা মেজাই দ্রষ্টব্য) । আব্বুর এই ঘড়িটি অতি সযতনে এই ২০০৮ সাল পর্যন্ত রক্ষা করে এসেছিলাম। একবার এক ছিনতাইকারী সেটা হাতে নিয়ে নেবার পরও অনুনয় করে ফিরিয়ে এনেছিলাম। ২০০৮ সালে সিংগাপুর বিমানবন্দরে অযু করতে গিয়ে সেটা ভুলে রেখে এসে যখন হারিয়ে ফেললাম , সেদিন থেকে পৃথিবীর সব মানুষ সিংগাপুরকে সভ্য দেশ বললেও আমি কখনো তা মনে করব না। ৫ মিনিটের মধ্যে ঘড়ি গায়েব হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে প্রথম যেদিন জাপানে নামি সেদিন ও একই কাজ করেছিলাম। কিন্তু ১৫-২০ মিনিট পরে আবার সেই যায়গায় গিয়ে দেখেছিলাম আমার ঘড়িটি সেখানেই পড়ে আছে। ঘড়িটি আমার অনেক প্রিয় একটি জিনিস ছিল। আমার বাবার একমাত্র স্মৃতি ধরে রেখেছিল। আজও কোন ছবিতে যখন ঘড়িটি দেখি আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে হাত চলে যায় আমার বাহাতে যেখানে সেদিন পর্যন্তও সবসময় সে ঘড়ির অস্তিত্ব ছিল। তারপর থেকে আর হাতঘড়ি পড়িনা। অন্য ঘড়ি পড়লে সেটার কথা আরো বেশি করে মনে পড়বে। যতদিন হাতে থাকত ঘড়িটি আমি খুব কম সময়ই খেয়াল করতাম যে এটা আমার আব্বুর ঘড়ি , হারিয়ে যাবার পর যখনই ঘড়ি দেখার কথা মনে করে হাতের দিকে তাকাই ততবার মনে হয় এখানে আবার আব্বুর ঘড়িটা ছিল।

মাকে ধন্যবাদ দিলাম কিছুদিন আগে এই যে নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিতে পারি, সবাই অনেক সফল ভাবে সব কিছুর জন্যই। ফোনে কথা বলতে বলতে বললাম সব কিছুর জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মা। আমার মা এরকম কথা শুনে অভ্যস্ত নয়। থতমত খেয়ে বলল আমি কি করলাম। কোনদিন তো তোকে পানিও এগিয়ে দিতে পারিনি। আমি তো কাছেই ছিলাম না সে সুযোগও মাকে দেইনি, কিন্তু মাকে তো কখনো আর বলা হয়নি যখনই কোন সাফল্যের পিছনে ছুটেছি সবার আগে মাথায় এসেছে একজন আছেন যিনি সব সুখ জমিয়ে রেখেছেন আমাদের এই সফলতা শোনার জন্য। একা একা এত গুলো বছর সন্তানদের টিকিয়ে সবাইকে এখন পর্যন্ত সফল করে রাখার পিছনের এই অবদান কে কখনো মুখ দিয়ে স্বীকার করা হয়নি। তাই কেউ যখন বলে কিভাবে পড়ায় মন বসে , আমি নিজে একটি কথাই বলি আমি জানতাম আমার পড়তে বসা, সফলতার জন্য সংগ্রাম, সফলতা সব কিছু একটি কারণেই কারণ আমার বাবা আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখত আর আমার মা সেই স্বপ্ন পূরণের আশায় দিন গুনে। সে কথা বুঝে ফেলাতেই আমার যত সমস্যার শুরু আমি না পারি ফাঁকি দিতে না পারি সব ছেড়ে দিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে।

৮,৬৯১ বার দেখা হয়েছে

৬৭ টি মন্তব্য : “পুরনো সেই দিনের কথা”

  1. রকিব (০১-০৭)

    অনেকদিন পর লিখলেন, খুব ব্যস্ত ছিলেন??

    আমার বাবা আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখত আর আমার মা সেই স্বপ্ন পূরণের আশায় দিন গুনে। সে কথা বুঝে ফেলাতেই আমার যত সমস্যার শুরু আমি না পারি ফাঁকি দিতে না পারি সব ছেড়ে দিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে।

    এই লাইনকটা হঠাৎ থমকে দিলো। বোধহয় আবার নতুন করে ভাবতে হবে; কী করছি, কি করা উচিৎ !!


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    😐 :thumbup: :salute: :thumbup: 😐


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  3. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    কী লিখবো অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম। কিছু খুঁজে না পেয়ে মনে হলো মনের সব অনুভূতিই বা প্রকাশ করতে হবে কেন। কিছু না হয় নাই লিখি। ভালো থেকো। যতোটা ভালো থাকা যায়।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  4. ভাইয়া কি লিখলেন।।ক্যাডেটরা আসলেই মা বাবাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না। তাই বলে আমরা আবেগহীন বা পাথর নই। ভাবতেছি আম্মুকে আপনার লেখাটা লিঙ্ক দিয়া আপনার উপর দিয়ে চালায় দিব নাকি???? 😀 😀 😀

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    তপু, অনেক দিন পর দেখলাম... অসাধারন প্রত্যাবর্তন :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  6. আছিব (২০০০-২০০৬)

    খুব সুন্দর ভাই।আপনি যেভাবে বললেন,সে ভাবে মাঝে মাঝে ভাবি,আবেগ আসে কখনও,কখনওবা আসে না।কিন্তু মা-বাবাকে ঠিকই ভালোবাসি,হয়ত প্রকাশ করতে পারি না।
    আসলে ভাই,যাদেরকে আসলেই ভালোবাসি,তাদের ''ভালোবাসি'' বলাটা কঠিন!!
    ভালো থাকবেন ভাই,আন্টিকে সালাম,আঙ্কেলকেও :salute:
    বুঝতে পারছি না,রেটিং হচ্ছে না কেন!কোনভাবেই রেটিং করতে পারছি না,গতকয়দিন ধরে মাঝে মাঝেই এমন হচ্ছে।

    জবাব দিন
  7. তৌফিক (৯৬-০২)

    ক্যাডেট কলেজে দেখে আসছি সবাই ইমোশন লুকায়। ডিফেন্স মেকানিজম হলো গিয়ে হিউমার। আমার ক্ষেত্রে অবস্থা আরো গুরুতর, কেউ যদি আমার পা খুলে হাতে ধরায়ে দেয়, আমি নিশ্চিত সেইটা নিয়েও আমার মাথায় একটা জোক খেলে যাবে।

    লেখা আন্তরিক হইছে। থিসিস জমা দিয়া দিছস? কামরুল তপু, এম এস সি?? 🙂

    অভিনন্দন।

    জবাব দিন
  8. ইমরান (১৯৯৯-২০০৫)

    " আমি নিজে একটি কথাই বলি আমি জানতাম আমার পড়তে বসা, সফলতার জন্য সংগ্রাম, সফলতা সব কিছু একটি কারণেই কারণ আমার বাবা আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখত আর আমার মা সেই স্বপ্ন পূরণের আশায় দিন গুনে। সে কথা বুঝে ফেলাতেই আমার যত সমস্যার শুরু আমি না পারি ফাঁকি দিতে না পারি সব ছেড়ে দিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে। "

    একেবারে মনের কথাগুলা লিখছেন ভাইয়া.....


    রঞ্জনা আমি আর আসবো না...

    জবাব দিন
  9. জাফর (৯৫-০১)
    বাসায় ফোন দেই কিন্তু কখনো বলা হয়ে উঠেনা মা খুব মনে পড়ছে। তার বদলে বার বার জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন? কি করছেন? ঘুরে ফিরে কথা এগুলোই নতুন কোন কথাও আসে না।

    :boss: :boss:

    সবার অনুভূতি একই রকম।

    জবাব দিন
  10. মুরাদ (৯০-৯৬)
    তাই কেউ যখন বলে কিভাবে পড়ায় মন বসে , আমি নিজে একটি কথাই বলি আমি জানতাম আমার পড়তে বসা, সফলতার জন্য সংগ্রাম, সফলতা সব কিছু একটি কারণেই কারণ আমার বাবা আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখত আর আমার মা সেই স্বপ্ন পূরণের আশায় দিন গুনে। সে কথা বুঝে ফেলাতেই আমার যত সমস্যার শুরু আমি না পারি ফাঁকি দিতে না পারি সব ছেড়ে দিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে।

    :thumbup:


    শামীম মুরাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইফতেখার (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।