নতুন বই নিয়ে আলোচনাঃ বসন্তদিন

বই পরিচিতিঃ
বই এর নামঃ বসন্তদিন
বই এর ধরণঃ পত্রালাপে গল্প
লেখকের নামঃ বরুণা ও প্রতিফলন
প্রকাশকের নামঃ তারিকুল ইসলাম
এক্সেপশন পাবলিকেশন্স,
ডন প্লাজা, ১০ম তলা
৯, বঙ্গবন্ধু এভিন্যু, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ শায়মা হক
উৎসর্গঃ “বসন্তপ্রেমী মানুষগুলোকে”
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭
মূল্য: ১৭৫.০০ টাকা

অন্তর্জালের সুবাদে পৃথিবী আজ মানুষের শুধু হাতের মুঠোতেই নয়, বলা যায় আঙুলের ডগায় চলে এসেছে। আঙুল দিয়ে কী বোর্ডের বাটন টিপে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে দু’জন বা ততোধিক মানব মানবী একে অপরকে দেখতে পারে, একে অপরের সাথে কথা বলতে পারে, মনের আবেগ অনুভূতি শেয়ার করতে পারে। ঠিক এমনিভাবেই অন্তর্জালে বিচরণের সময় একদিন বরুণা ও প্রতিফলন নামের দু’জন মানব মানবী একে অপরের গৃহকোণে প্রবেশ করে কথোপকথন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা একে অপরের মনের কোণেও একে অপরের জন্য একটা ভালবাসার আসন তৈরী করে নেয়। শুরু হয় তাদের ভালবাসার পথে হাঁটা- কখনো একসাথে, কখনো পৃথক পৃথক ভাবনায়। প্রাথমিক জানা-পরিচয় থেকে শুরু করে তারা কিছুটা দেখাদেখি, কিছুটা মাখামাখি করে এগিয়ে চলে। তাদের এই আবেগঘন আলাপচারিতার সূত্র ধরে শুরু হয় প্রেমের পত্রালাপ, সে পত্রালাপে উঠে আসে তাদের মনের আকুলি বিকুলি করা যত কথা। কখনো তা শুধুই প্রেমালাপ, কখনো আটোপৌরে জীবনের দৈনন্দিন কথকতা, আবার কখনো দুটো প্রেম প্রত্যাশী হৃদয়ের অনিবার্য বিয়োগাত্মক পরিণতির কথা ভেবে করা আহাজারি ও হা হুতাশ। দুটো বসন্তানুরাগী প্রেমাকুল হৃদয়ের টুকরো টুকরো এসব কথামালার সংকলন নিয়েই রচিত হয়েছে “বসন্তদিন”, যা পাঠকালে গ্রীষ্মের দাবদাহ কিংবা ঘনঘোর বর্ষার মাঝেও পাঠকের মন কল্পনায় এঁকে যায় এক প্রেমের রঙধনু।

ছদ্মনামে দ্বৈত লেখকের প্রকাশনা এই “বসন্তদিন”। লেখকদ্বয় বলেছেন ‘বসন্তদিন’ “না গল্প, না উপন্যাস। এটা পত্রালাপ। চিঠির ভাষায় কথামালার আলোকচ্ছটা”। যারা সামহোয়্যার ইনব্লগের নিয়মিত পাঠক, তারা হয়তো এসব পত্রালাপের সাথে আগেও কিছুটা পরিচিত হয়ে থাকবেন। দুটো অতৃপ্ত প্রেমিক হৃদয়ের ইচ্ছে আকাঙ্খার, চাওয়াটুকু পাওয়ার আনন্দ আর না পাওয়ার হাহাকার, ইত্যাকার অনুভূতির সন্নিবেশ ঘটেছে এসব পত্রালাপে। সুখের বিষয়, এগুলো কোন টীন এজ ক্রাশ এর মত ব্যাপার স্যাপার ছিলনা, পত্রালাপগুলোতে ছিল দুটো পরিণত প্রেমিক হৃদয়ের প্রতিফলন। কাকতালীয়ভাবে, এই গল্পের প্রেমিক প্রবরটির ছদ্মনামও ‘প্রতিফলন’।

আন্তর্জালিক কথোপকথনে নিজের নাম ধাম, পরিচয় ইত্যাদি গোপন রাখা কিংবা ছদ্মনাম ব্যবহার করাটা নতুন কোন ব্যাপার নয়। বরুণাও তাই করেছিল, যা সে প্রথমেই অকপটে স্বীকার করেছে এভাবেঃ “মিথ্যে নাম, মিথ্যে পরিচয়, সে আমি অবলীলায় বলতাম”। তবে পাঠকেরা অনেকেই ভীষণ মজা পাবেন এটা জেনে যে বরুণা একবার প্রতিফলনকে তার টেলিফোন নম্বর হিসেবে গুলশান থানার টেলিফোন নম্বরটি দিয়েছিল। অবশ্য সেটা দিয়ে সে যে কিছুটা দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতায় ভুগেছিল, বই এ তারও আভাস পাওয়া যায়। প্রতিফলন এতে কিছুটা দুষ্টুমি আন্দাজ করতে পারলেও নির্দ্বিধায় সে সেই নাম্বারে ফোন করেছিল, আর সেই কলটা রিসিভ করেছিলেন গুলশান থানার ডিউটি অফিসার স্বয়ং!

বুঝাই যায়, কথা বলার তর্কাতর্কিতে প্রতিফলনের চেয়ে বরুণাই বেশীরভাগ সময়ে জয়ী হতো। তাই প্রায় শুরুতেই প্রতিফলনের প্রশ্নঃ “তুমি কি এখনো কোন কথা মাটিতে পড়তে দাও?” তাদের মধ্যে যতই ঝগড়া ঝাটি হোক না কেন, তাদের মন মানসিকতায়, আচার আচরণে মিল ছিল প্রচুর, যেন একে অপরের পরিপূরক। বরুণার ভাষায়- “তুমি যেন আমার ঠিক একটা ‘পুরুষ’ সংস্করণ”। উভয়ের কথোপকথন ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, শাণিত, এবং প্রায় সময়েই, যুক্তিযুক্ত। তবে তাদের পত্রালাপেই বুঝা যায়, বরুণা প্রেমময়ী তো ছিলই, সেই সাথে ছিল ভীষণ জেদীও। আর জেদীদের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, কোন বিষয়ে যুক্তিতর্কে পয়াজয় অবশ্যম্ভাবী জানলে তখন আর যুক্তির তোয়াক্কা করেনা, বরুণার মধ্যেও সে প্রবণতা ছিল। তবে দেশের শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির জ্ঞানে ওরা উভয়েই আলোকিত ছিল। তাই তাদের যুক্তি তর্ক, আলাপন, রুটিন কথোপকথন, পত্রালাপ, বার্তা বিনিময়, সবকিছুই হতো পরিশীলিত ভাষায়, কখনো গানে গানে, কখনো কখনো কবিতার চরণে চরণে। এ ব্যাপারে তারা অকাতরে এবং অনায়াসে রবীন্দ্রাশ্রয়ী ছিল, কারণ রবীন্দ্র রচনাবলীর অলিগলি তাদের উভয়ের বেশ চেনা ছিল। নজরুলের প্রেমের গানগুলোও তাদের মুখস্থ ছিল। তাই টেক্কা দিয়ে একে অপরের সাথে কথোপকথনে রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমের কথা, গানের কথা উদ্ধৃত করতো। কথায় আছে, মানুষ প্রেমে পড়লে দার্শনিক হয়ে যায়। ওরাও মাঝে মাঝে নিজেদের ভাবাবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কিছু দার্শনিক উক্তি ব্যক্ত করতো। যেমনঃ

প্রতিফলনঃ এই দেখা না দেখার অনুভূতিটাই বেঁচে থাকা। এই জার্নিটুকুই জীবন। জীবন থেকে পালানোর প্রয়োজন নেই। পালানো যায় না (পৃষ্ঠা-১৭)।
ভালবাসা জিনিসটা এমন যে নিজেকে খালি প্রকাশ করতে চায়, ঘোষিত হতে চায় পৃথিবীর কাছে (পৃষ্ঠা-৪৪)।
ততদিন পর্যন্ত আমরা দুজন আমাদের একান্ত পৃথিবীতে ভালবাসার স্বপ্নকাজল মেখেই থাকবো সবার সাথে (শেষ কথা)।

বরুণাঃ “হার মেনেছি মিটেছে ভয়, তোমার জয় তো আমারই জয়” (পৃষ্ঠা-২৩)।
ভালবাসার মানুষের সবকিছুই ডিফারেন্ট। একদম আলাদা অন্যদের থেকে (পৃষ্ঠা-২৯)।
আমার গন্ডীবদ্ধ পৃথিবী থেকে, বিদ্রোহের কোন সুযোগ নেই (পৃষ্ঠা-৩৩)।
ভালবাসাটা লুকিয়ে রাখতে হয় কখনো সখনো… কিন্তু ভালবাসার দ্যুতি কি সত্যি লুকানো সম্ভব? ফাঁক ফোকর গলে ঠিকই সে বের হবার চেষ্টা চালায় (পৃষ্ঠা-৪৬)।
ভালবাসা আছে বলেই আজও চাঁদ-সূর্য ওঠে, ফুল ফোটে, পাখিরা গান গায় (পৃষ্ঠা-১০৪)।

যাহোক, পুনরায় ফিরে আসছি বইএর পেছন-প্রচ্ছদে প্রদত্ত লেখকদ্বয়ের কথায়ঃ ‘বসন্তদিন’ “না গল্প, না উপন্যাস। এটা পত্রালাপ। চিঠির ভাষায় কথামালার আলোকচ্ছটা”। যারা গল্প বা উপন্যাস ভালবাসেন, এ বইটা না গল্প, না উপন্যাস হলেও, তারাও এ বইটি পড়ে আনন্দ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস, কারণ এতে গল্প এবং উপন্যাস উভয়েরই উপাদান রয়েছে, প্রকৃত এবং উপযুক্ত কলেবরে তা প্রকাশিত না হলেও।

ঢাকা
২৬ আগস্ট ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৫,২৫১ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।