আনন্দ আশ্রম-

কুমিল্লায় এসে যখন পৌঁছলাম চারিদিকে তখন স্বরস্বতী পুজার আমেজ। গত রাতে জগন্নাথ হলে গিয়ে ঘুরেছি অনেক। আগে প্রতি বছর অনেকটা সময় কাটতো ওখানেই। আর এবারে হুট করে ঘুরে আসা খানিকটা, অতিথির মত আলগোছে। চারুকলা প্রতিমা বসায় পুকুরের মাঝে, চিরকালই, সেখানে গিয়ে প্রতিবারের মতই মুগ্ধতা একরাশ। অনেক অনেক ছবি। তারপরে, মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে জগন্নাথের মাঠে। সেখানে পুরনো অনেক বন্ধু, আলিঙ্গন, উচ্ছ্বাস। আবারও অনেক অনেক ছবি।

ওখান থেকে বেরুতে বেশ রাত হয়ে গেল। আমাদের দুজনের বাড়ি ফিরতে মন চাইছিলো না কিছুতেই। ইচ্ছে হচ্ছিলো, সেই আগের মত একজন রোকেয়া হলে, অন্যজন অমর একুশে হলের দিকে ছুট লাগাই। কিন্তু মাঝখানে ছয়টা বছরের আঁচড়, তার ফলাফল, আমরা শাহবাগের মোড়ে এসে সিএনজি বা ক্যাবের অপেক্ষায়, গন্তব্য পল্লবী।

কিন্তু কুমিল্লায় এসে যখন নামলাম, চারদিকে তখন ঢাক আর ঢোলের শব্দ। প্রতি বছরের মতই ঠিক আমাদের বাসার সামনেই একটা মন্ডপ। প্রতিমা অবশ্য নেই এখন আর। ট্রাকে করে ঘুরতে চলে গেছে সেটা। আমিও যেতাম একসময়। সেটা অবশ্য বহু আগের কথা। আগেরদিন প্রায় সারারাত মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে- যেখানে লেখা থাকত- বাণী সংঘ, বা স্মৃতি সংঘ- ঢোলের বাড়ির সাথে উদ্দাম নাচতাম মন্ডপে। বাসা থেকে কেউ ডাকতে এলে এক দৌড়ে পালিয়ে যেতাম অনেক দূর, তারপর সরে গেলে, আবার এসে জমতাম মন্ডপে।
তারপরদিন ট্রাকে করে ঘোরাঘুরি, কাঁচা পাকা বরৈ কুড়ানোর দিন শেষ তখন আমাদের, আমরাই বরং ছিটাতাম বরৈ আশপাশের বাড়িগুলোর দিকে। কখনও কখনও বরৈ শর্ট পড়ে গেলে কাঁচা টমেটো।

আমরা আসবো বলেই কি না, আমাদের বাড়িতে এখন বৈশাখী মেলার সাজ। কত কত চেনা মুখ, কত যে তারা আপন। যেদিকে চোখ ফেরাই সেখানেই স্বস্তি আর আনন্দ।
আগেরবার যাদের ছোট দেখেছিলাম, তারা সবাই বড় হয়ে গেছে, এবং তাদের জায়গা দখল করতে চলে এসেছে আরও কিছু ছোট ছোট মুখ।

এখানে সকাল হলে পরে বিশ্রি শব্দে কোন এলার্ম বেজে ওঠে না, সত্যি সত্যিই কাক ডাকে। কিন্তু ডাকলেই বা তাদের পাত্তা দেয় কে? আমি নির্বিঘ্নে গায়ের লেপ আরও ভাল করে মুড়িয়ে নিই গায়ে। বাইরে শীতের হিম, গেটের ওপাশে কোন এক অস্থির রিকশাওয়ালা শুধু শুধুই বেল বাজাচ্ছে। ছোট্ট লোহার প্যাঁচানো সিঁড়িটা বেয়ে আম্মা আস্তে আস্তে উঠে আসে দোতলায়, আমার দরজায় শব্দ হয় ধুম ধুম, বাবা, উঠ এইবার।
আমি বহু কষ্টে মাথা বের করি লেপের তলা থেকে, আহ, যাওতো আম্মা, আমি ঘুমাবো আরও।
আম্মা হাসে কেবল। তারপর টুকটুক করে আবার নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে। এতদিন বাদে বাড়ি ফেরার আনন্দ শীতে জমাট বেঁধে একগাদা ঘুম হয়ে নেমে আসে তখন আমার চোখে, আমি শান্তিতে পাশ ফিরে শুই।

২,৩৭১ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “আনন্দ আশ্রম-”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ছয় বছরে এই অবস্থা, ষাটে কি হবে তোমার?

    উল্টাও হতে পারে, অনুভুতিরা মরে যাবে, অস্ট্রেলিয়ার পরিচ্ছন্ন জীবনে জন্য হাসফাস করবে মনটা দেশে আসলে, কি বল


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    এতদিন বাদে বাড়ি ফেরার আনন্দ শীতে জমাট বেঁধে একগাদা ঘুম হয়ে নেমে আসে তখন আমার চোখে, আমি শান্তিতে পাশ ফিরে শুই

    ওঠ ব্যাটা ... ম্যালা কাম বাকী ...
    (তোর লেখা যেই রকম হওয়ার কথা, সেই রকমই হইছে)


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    কুমিল্লা নামটা শুনলেই নষ্টালজিক হয়ে পরি। জীবনের তিনটা বছর কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায় কেটেছে। অনেকদিন ধরেই জানতে ইচ্ছে করছিলো কুমিল্লায় সেই আগের মতো পুজোর ধুম চলে কিনা। তোমার লেখা পরে মনে হলো চলে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : টিটো রহমান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।