একজন মৌলিক ‘চাঁদ সদাগর’

[ কবির জন্মদিনে স্মরণ ও শ্রদ্ধা হিসেবে পুরোনো এ লেখাটাকেই সিসিবি-র ফোরামে শেয়ার করলাম ]

স্বপ্ন দেখার সক্ষমতাই সম্ভবত মনুষ্য জীবের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ স্বাতন্ত্র। স্বপ্ন দেখতে পারে বলে মানুষ নিয়ত নির্মাণ করে আপন স্বভাব, সভ্যতা, সৌকর্য; তার আপন প্রভায়। মানুষ মাত্রেই বলতে পারি স্বাপ্নিক। স্বপ্নদ্রষ্টা তাই হয়তো সবাই। কিন্তু স্বপ্নস্রষ্টা ক’জন! কবিরা সম্ভবত স্বপ্নস্রষ্টাদের মাঝে অগ্রগণ্য।

একজন সহজ সরল সাবলীল বিনয়ী মানুষ, একজন প্রেমিক পুরুষ, একজন উদ্বেল দেশপ্রেমী, একজন অন্তর্মুখী বিশ্বদ্রষ্টা, সর্বজনে বিকষিত একজন মৌলিক মানুষ — শামসুর রাহমান সেই দুর্লভ একজন যিনি নিদারুন দুঃসময়েও আমাদের স্বপ্ন দেখান। স্বপ্ন স্রষ্টাদের অন্যতম এই মানুষটি তাই সময়ে অসময়ে দুঃসময়ে নিয়ত নির্মাণ করে গেছেন অনাবিল শব্দসুর যা জীবনকে সব বৈরীতার মাঝেও নিরবধি বহতা রাখার স্বপ্নে মাতিয়ে রাখে। সেই স্বপ্ন কেবলি কল্পনার ডানায় ভর করে নয় জীবন ও যাপনের ঋদ্ধতাকে পুঁজি করে উন্মেলিত হয়েছে অগণন পাঠকের কাছে। পাঠকের হাত ধরে অনবরত পৌঁছে গেছে আপামর জনতার কাছে।

যে জীবনবোধ মানুষকে জাগরুক আর গতিশীল রাখে সভ্যতার সুশোভন পথে তাকে আমরা উন্মোচন করি যাপনের লহমায় লহমায়। শুধু সাধারনে তা থেকে অনুচ্চারিত কিংবা কখনো অননুধাবিত। স্বপ্নস্রষ্টারা আপন বিভায় সেসব বোধকে করেন উচ্চারণ। অগণন সাধারন তখন অবাক বিস্ময়ে ভাবে ‘আমারও তো ছিল মনে – সে কেমনে পারিল জানিতে’। যে স্বপ্নস্রষ্টা যত বেশী বিস্তৃত বলয়ে গড়বেন বিস্মিত সাধারনের বৃত্ত তিনি তত বেশী কালোত্তীর্ণ। এ সত্যের অপর পিঠের সত্য হলো এই যে, জীবন ও জগতের বিচিত্র মানব সমষ্টির যতো বেশী চরিত্র ও আঙ্গিক উঠে আসবে স্বপ্নস্রষ্টার খেরোখাতায় — তিনি ততো বেশী সামগ্রিক, ততোটা সামষ্টিক।

জন্মের শোণিতে সৃষ্টির উন্মাদনা নিয়ে আমাদের মাঝে অনন্য সাধারন মানুষটির অভ্যাগমন ঘটেছিলো ১৯২৯ এ। পারিবারিক ধারার বাইরে এসে অন্তর্গত উন্মাদনাই তাকে হাতে ধরিয়েছিলো কলম। ১৯৪৮ সালে কুড়িতে পা দেবার আগে কবিতায় তার প্রথম আবাদ। নলিনীকিশোর গুহের সম্পাদনায় সেই আবাদের প্রথম ফসল প্রকাশ। নিজেকে, নিজ পরিবার ও প্রিয় জন, নিজ কৃষ্টি, সমাজ ও মানুষকে উনি অবলীলায় তুলে এনেছেন হুবহু। সহজ, নিজস্ব ঢংয়ে। নিজ লেখার শক্তিমত্তা উপলব্ধি করবার পরম্পরায় সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ের রাবীন্দ্রিক বলয় থেকে বেরিয়ে এসে আপন সুরে কথা বলবার চেষ্টায়।

ঢাকা শহরে ৪৬ মাহুতটুলির নানা বাড়ীতে জন্মে নগর কেন্দ্রিক জীবন অধিকতর যাপন করলেও গ্রাম বাংলা, আপামর মানুষ ও বিস্তীর্ণ প্রকৃতি অনাবিলভাবে উঠে এসেছে তার লেখায়। উঠে এসেছে চিরায়ত পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিপূণ প্রতিবাদ।

শব্দের নিপূণ কারিগর কেমন অবাক অবলীলায় খেলা করেছেন শব্দের অপূর্ব বিন্যাস নিয়ে। কতো সহজে উঠে এসেছে শহর-গ্রাম, শ্রমিক-ভাবুক-প্রেমিক-বিপ্লবী সবার কথা এক কাতারে এক কবিতায়, কতো অনায়াসে বিস্তৃত করেছেন বিষয় আঙ্গিক — সমগ্র জন ও জনপদে, তার প্রমাণ রেখেছেন অগণন কবিতা ও লেখায়। চাষী, কেরানী, কামার, কুমোর, ছাত্র, তরুণী, মাঝি ও রোগী ……. শহর, প্রান্তর, নদী, নগর, সমাজ ও সময়, সংকট, সম্ভাবনা, সংশয়, সমাধান — সবকিছু কতো সহজে শোভা পেতে পারে এক ক্যানভাসে জীবন ও যাপনের তাবৎ দৃশ্যপটে; তার অপূর্ব অসংখ্য নজীর থেকে একটি ধরা যায়— কবিতা ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’।

যে দৃশ্যটাকে আমরা সবাই দেখছি সেই দৃশ্যের অন্তরালে অনন্য আবিষ্কারে তার জুড়ি নেই। তাঁর লেখায় দৃশ্যের ভেতরে দৃশ্যের অভূতপূর্ব আবিষ্কার আমাদের মোহিত করে বার বার। সেই সাথে কখনো কখনো যুক্ত হয়েছে অভাবনীয় বলিষ্ঠ কল্পনাশক্তি, অনন্য উপমা। যেমনটা পাওয়া যায় শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করে লেখা কবিতা ‘হরতাল’-এ।

“… …
মায়ের স্তনের নিচে ঘুমন্ত শিশুর মতো এ-শহর অথবা রঁদার
ভাবুকের মতো;
দশটি বাক্সময় পঙ্ক্তি রচনার পর একাদশ পঙ্ক্তি নির্মানের আগে
কবির মানসে জমে যে স্তব্ধতা, অন্ধ, ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্র
থাবা থেকে গা বাঁচিয়ে বুকে
আয়াতের নক্ষত্র জ্বালিয়ে
পাথুরে কন্টকাবৃত পথ বেয়ে ঊর্ণাজাল-ছাওয়া
লুকানো গুহার দিকে যাত্রাকালে মোহাম্মদ যে স্তব্ধতা আস্তিনের ভাঁজে
একদা নিয়েছিলেন ভ’রে,
সে স্তব্ধতা বুঝি
নেমেছে এখানে।
… …
এঞ্জিনের গহন আড়াল থেকে বহুদিন পর
বহুদিন পর
অজস্র পাখির ডাক ছাড়া পেলো যেন।
সুকন্ঠ নিবিড় পাখি আজো
এ-শহরে আছে কখনো জানিনি আগে।
… …
হেঁটে যেতে যেতে
বিজ্ঞাপন এবং সাইনবোর্ড গুলো মুছে ফেলে
সেখানে আমার প্রিয় কবিতাবলির
উজ্জ্বল লাইন বসালাম;
প্রতিটি পথের মোড়ে পিকাসো মাতিস আর ক্যান্ডিনিস্কি দিলাম ঝুলিয়ে।
… …
জীবিকা বেবাক ভুলে কাঁচা প্রহরেই
ঘুমায় গাছতলায়, ঠেলাগাড়ির ছায়ায় কিংবা
উদাস আড়তে,
ট্রলির ওপরে
ডনস্তরঙ্গ বাসের গহ্বরে,
নৈঃশব্দের মসৃন জাজিমে।
বস্তুত এখন
কেমন সবুজ হ’য়ে ডুবে আছে ক্রিয়াপদগুলি
গভীর জলের নিচে কাছিমের মতো শৈবালের সাজঘরে।”

অনন্য সৃষ্টির উন্মাদনা আজন্ম তাকে তাড়িত করেছে বলেই সম্ভবত ইংরেজীতে অনার্স পড়তে শুরু করে এক বছর পর তা বাদ দিয়ে পরে ডিগ্রী পাশ করেন। পুনরায় ইংরেজী সাহিত্যের অনুরাগে ইংরেজীতে মাস্টার্স করতে গিয়ে প্রথম বর্ষ উত্তীর্ণ হয়েও আর শেষ করেননি। মর্নিং নিউজ এ সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে আবার গিয়েছিলেন রেডিওতে। পরে ফিরে আসেন মর্নিং নিউজ-এ। দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীতে দৈনিক বাংলায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ অলংকৃত করেছেন সাপ্তাহিক ’মূলধারা’র সম্পাদক পদ।

কর্মজীবনের দায়িত্বের দায়বদ্ধতা তাকে প্রতিনিয়ত সম্পৃক্ত করেছিল দেশ জাতি ও সমাজ সমষ্টির নিত্যদিনের সুখ, অসুখ, দুঃখ, বঞ্চনা, শাসন, শোষণ, সংগ্রাম, যাতনা সবকিছুর সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তৎপরবর্তীকালীন সময়, বঙ্গভঙ্গ, স্বাধীন রাষ্ট্র, পতাকা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি – এসব ঘিরে সব সচেতন মানুষই যখন আলোড়িত এবং নিত্য দিনের যাপনে আন্দোলিত। তেমনি একটা সময়ে লেখালেখির উন্মাদনা আর অতি-অনুভূতিময় একজন কবির সহজাত মনস্তাত্ত্বিক সম্পৃক্ততা যৌক্তিক বলেই অনুমিত। তবে তার সোচ্চার কন্ঠস্বরের রকমফের সমাজ-সমষ্টির কাছে সবকিছু ছাপিয়ে একজন সচেতন স্বপ্নস্রষ্টার দায়বদ্ধতার বহিপ্রকাশ। সেই দায়বদ্ধতার প্রমাণ— ‘বরকতের ফটোগ্রাফ’, ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘মানুষ’, শহীদ জননীকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তুমি বলেছিলে’, ‘সম্পত্তি’, ‘গেরিলা’, ‘এখানে দরজা ছিলো’, ‘স্যামসন’, ‘সফেদ পাঞ্জাবী’, ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘পথের কুকুর’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘শহীদ মিনারে কবিতাপাঠ’, ‘মাস্টারদার হাতঘড়ি’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘চিড়িয়াখানার কিউরেটার সমীপে’, ‘এই যে শুনুন’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ …. এমন অজস্র কবিতা, অগণন লেখা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই নরম মনের মানুষটি শত্রুহন্তা হবার মতোন কাজ না করলেও চালিয়ে গেছেন এই মাত্র বলা তালিকার মতোন শক্তিমান উদ্দীপনাময় কবিতার নির্মাণ। ছদ্মনামে সেসব ছাপানোয় ছিলেন সচেষ্ট। যুদ্ধ শিবিরে হাতে হাতে চলে যেতো সেসব কবিতা; যা সকল যোদ্ধা ও শরণার্থীদের মুখে মুখে তখন উচ্চারিত হতো প্রতিনিয়ত।

> > > > > >

“বরং হাসলে আমি ঠোঁট থেকে সহজ
রোদ্দুর ঝরিয়ে হাসবো প্রতিবার,
‘দূর ছাই’ বলে কাউকেই
কখনো দূরে সরিয়ে দেবো না।”
— বরং

নিজেকে নিপূণ প্রতিবিম্বিত করেছেন সহজ সরল শান্তিপ্রিয় মানুষটি তাঁর নিজেরই কবিতায়। বাস্তবিকই নিতান্ত সাদামাটা একজন মানুষ, ছিলেন অবারিতদার। তাঁর জীবন যাপন ও আচরণের মতোন সহজাত ছিল তাঁর কন্ঠ ও কলম। এর মানে নির্বিকার সবকিছু মেনে নেয়ার মানুষ ছিলেন তিনি — এমনটা নয়। নিজের বেলায় যেমনটা নীরব ছিলেন, সমষ্টির স্বার্থে ছিলেন বিপরীত সরব। আর তাই এই মাটির মানুষটিই জাতির দুর্দিনে পিড়ীত হয়ে লিখেছেন —

“বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
… … …
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
… … …
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।”
— আসাদের শার্ট

কিংবা আরও তীব্র প্রতিবাদ উদ্দাম প্রতিরোধ উচ্চারণ তাই অবলীলায় নিসৃত হয়েছে তার সজাগ সচল কলম থেকে দুর্মর সময় সন্ধিক্ষণে। অস্তর্গত প্রতিবাদী মানুষটি তাই অনন্য এক নেতার মতোন নির্মাণ করেছেন মাতা ও মৃত্তিকার আর্ত হাহাকার জনপদ ও মানবতার মোক্ষম শ্লোগান —
“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন?
… …
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।”

সমগ্র জাতির প্রতিবাদী মুখে মুখে অনর্গল উচ্চারিত হয়েছে এই তীব্র শব্দচয়ন। প্রতিবাদী শেনিতকে করেছে বর্ধিষ্ণু বেগবান। মানুষের মিছিল অমন অমোঘ শব্দের ধারে হয়েছে ধারালো — শক্তিমান। এমন একজন সাহসী সময়ের কবিকে পাবার মতোন সৌভাগ্য বরপুষ্ট পৃথিবীর ক’টা দেশ! কতোটা জনপদ! এমন গৌরব পরেছে গলায় সে সৌভাগ্য ভূভাগে ক’জনার! অমন সোজাসাপ্টা তীব্র প্রতিবাদ ও উদ্দীপনা সঞ্চারণের পাশাপাশি নির্বিকার সুবিধাবাদী নাগরিক জীবনের ছবি ও তুলে এনেছেন অনাবিল দক্ষতার। যেনো সমাজকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আয়নার সামনে।

“… …
খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু’ বেলা
পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনি কথা শুনছি।
ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি।”
— দুঃস্বপ্নে একদিন

শামসুর রাহমানের উপলব্ধি, সামাজিক যাতনা ও কলুষতার উন্মোচন তার ভিত মেলেছিলো সম্ভবত কৈশোর থেকেই। তাই তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ‘মা’ কে নিয়ে লেখার মধ্য দিয়েও ফুটে উঠেছে ব্যক্তি, পরিবার ও প্রিয় মানুষ ছাড়িয়ে সামাজিক সংকট, সংশয়, পশ্চাৎপদতার অবিমিশ্র স্ন্যাপশট।

“যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
… …
যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!”
— কখনো আমার মাকে

গৃহবন্দী নারীকে সমাজ কতোটা নিঃসংগ দ্বীপান্তরের ঘেরাটোপে রেখেছিল বাস্তবে, কতোটা ঝিনুক, কতোটা গভীর বেদনায় বাংলার নারী নিয়ত গড়ে গেছে সমাজ সভ্যতার সোপান। সন্তান ও সভ্যতার জন্য কতোটা অকাতরে বিলিয়ে গেছেন নিজেকে আর অন্যরা কতোটা নির্বিকার করেছে দিন সুখে যাপন। সেসব আড়াল দৃশ্য দেশের বিবর থেকে শুধু নয়— দেশ ছাড়িয়ে মানব সভ্যতার আঙ্গিকে আন্তর্জাতিকতায় অন্য দেশ অন্য সমাজের অন্ধকার গভীর থেকেও তুলে এনেছেন আপন বোধের বিস্তৃতিতে। যেমন ‘ম্যানিলা, শোনো’ কবিতায়। যে জটিল নেকাব উন্মোচন তিনি করেছেন তা সহজ সাবলীল সংগত সাজাবার দায়িত্ব সমাজে সবার। তাঁর কাজ তিনি করে গেছেন — কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাবার।

শুধু এটুকুতেই শেষ নয়। স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামের সংকট, সম্ভাবনা ও প্রতিবাদ অনায়াসে, নির্ভীক উঠে এসেছে তার কলমে তীব্র সাহসী শব্দচয়নে। যখন স্তাবকের দল ভারী হচ্ছিল স্বৈরাচারের দোসর হবার লোভ প্রলোভনে লেলিহান সর্পজিহ্বার মতো। তখন সমষ্টির দায়ভার মেনে নিয়ে ছেড়েছেন পদ মোহ, অর্থ বিত্ত বেসাত। তীব্র কটাক্ষে বুনন করেছেন শব্দবান —

“আপনি খেয়াল-খুশির খেয়া ভাসালেই
নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে না সূর্যোদয় কিংবা পূর্ণিমা,
প্রেমিক প্রেমিকার চুম্বন।
আপনি প্রাণভরে গার্ড অব অনার নিতে পারেন আর
একজন কবিকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন
ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে,
বহ্ন্যুৎসব করতে পারেন তার গ্রন্থরাজি দিয়ে,
পারেন আপনি পারেন
তবু তার কবিতাবলী বন্দুকের ধমককে
উপক্ষো ক’রে ঈগলের মতো উড়তে থাকবে,
উড়তে থাকবে, উড়তে থাকবে।”
— এই যে শুনুন

এমন সংকট সময়ে ভুল মানুষের ভুল কর্মকলুষতায় সমাজ সমষ্টির ক্ষয়ে হয়েছেন আহত, পিড়ীত। নিজের আক্ষেপকে করেছেন সর্বজনে উন্মোচিত। সচেতন মানুষকে যেনো তা নাড়া দেয়, পীড়া দেয়। কষ্টার্জিত মানচিত্র ও পতাকার জন্য ত্যাগের মহিমা ভূলুন্ঠিত হবার দৃশ্য যাতনা চিহ্নিত করেছেন অগণনের কাছে, লিখেছেন —

“উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।
— উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

প্রতিবাদ, বিবমিষা, সব কিছুর পাশাপাশি স্বপ্নস্রষ্টা শামসুর রাহমান চিরকাল ছিলেন আশাবাদী। জীবনবোধের তীব্র উদ্দীপ্ত অনুভূতি অভাবনীয় স্পর্ধায় উচ্চারণ করে গেছেন কবিতায়-লেখায় অযুত মানুষের সাহস ও প্রেরণার আধার বানিয়ে। যা কিনা এক লহমায় উজ্জ্বীবিত করে প্রতিটি পাঠককে। যে সময় ও প্রেক্ষিতে এর রচনা — সে সময়কার মানুষের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া তাই খুব সহজেই অনুমেয়।

“… … তোমার কান্নার পরে দেখি
কষ্টি ধোয়া রক্তগোলাপের মতো ফুটে আছো তুমি।
… … … … …
এখন লুকাতে চাই আমি
আরো অনেকের মতো মেঘের আড়ালে,
মেঘনার তলদেশে, শস্যের ভেতরে রাত্রিদিন।
এই উল্টোরথ দেখে, শপথ তোমার
প্রেমের, আমার আজ বড় বেশী দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে।”
— দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে

“ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি
লাশ নেবো না।
নইতো আমি মুদ্দোফরাস। জীবন থেকে
সোনার মেডেল,
শিউলি ফোটা সকাল নেবো।
ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার আমি
গোলাপ নেবো।
— ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা

এতোটা জীবনমুখী। এতোটা প্রেমের ও প্রতিবাদের কবিতা। এতো অনুভূতির এমন সহজ সম্মিলন — এমন উজ্জীবনী সৃষ্টিই সম্ভবত যুগের সৃষ্টি, শাশ্মত সৃষ্টি। সবকিছু ছাপিয়ে সোচ্চার জীবনের প্রতি তার প্রেম। জীবনকে এতোটা ভালোবেসেছেন বলেই সম্ভবত মৃত্যুর কথা, মৃত্যুচিন্তা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বার বার উচ্চারিত হয়েছে তার লেখায়।

“পুরোনো গলির মোড়ে, টার্মিনালে দর দালানের
ছায়াচ্ছন্ন কোনে
কপট বন্ধুর মতো অপাদমস্তক রহস্যের টোগা প’রে
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। … …”
— আঘাটায়

অবাক করা সব দৃশ্যকল্পের পাশাপাশি শামসুর রাহমান মনে করতেন কবি একজন শব্দের কান্ডারী। আর একজন শব্দের কান্ডারী সাফল্যে প্রতিভাত হতে চাইলে তাকে হতে হবে যথাযথ শব্দের ভান্ডারীও। শব্দের অফুরন্ত ভান্ডার তাই বারংবার উন্মোচিত হয়েছে তার লেখায়। সেই সাথে সতর্কভাবে প্রয়োগ করেছেন নিজস্ব শব্দ, অজস্র নিজস্ব শব্দ। বার বার ব্যবহার করেছেন অনবদ্য প্রয়োগে সেসব নিজস্ব শব্দকে তিনি অনাবিল দক্ষতায়। শব্দকে নিয়ে খেলেছেন অনায়াসে। সর্বজনবোধ্য ভাষায় ও প্রয়োগে। তার কবিতা কিংবা লেখা পড়তে গিয়ে বোধগম্যতার কষ্টে অভিধান নিয়ে মাতবে পাঠক — এমনটা তার কাম্য ছিল না। তাই অনায়াসে পাঠক পড়ে নিতে পারে, একাত্ম হতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তিনি ছিলেন এক অভাবনীয় মসি সাধক।

তাঁর এই সফল চেষ্টা খুব সহজভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ে গেছে পুরোধা ব্যক্তিত্বের অবস্থানে। সাধারণের কথা — সবার কথা নিরন্তর তুলে এনেছেন অবিরাম — তাই তিনি অনায়াসে হয়েছে সর্বজন গ্রাহ্য ও নন্দিত। এর সার্থকতায় তার প্রায় শতেক গ্রন্থের সাফল্য তাঁকে দিয়ে তাবৎ সম্মাননা পুরষ্কার সর্বোপরি করেছে কালোত্তীর্ণ। অনায়াসে তাই ছাড়তে পেরেছেন মোহ — পদ, এড়াতে পেরেছেন প্রলোভন। নির্বিকার মিশে যেতে পেরেছেন জাতীয় কবিতা পরিষদ কিংবা এমনতরো সমষ্টির শিরোনাম কন্ঠস্বরে।

তুমি বিনয়ের বিভায় লিখেছো তোমার কবিতায় ‘একজন কবির প্রয়াণ’। আজ লাখো মানুষের সশ্রদ্ধ সালাম তাই এর বিপরীতে তোমাকে জানায় সজল বিদায়ী অভিবাদন। বিদায় বন্ধু তোমায় এই ক্ষণিকের পৃথিবী থেকে বিদায়। তুমি তো চিরভাস্মর কালের ভেলায়। আজ তোমার ভাষায়ই তোমায় বলা যায় —
‘পৃথিবী আনন্দময় বস্তুত এখনো। সুর কাটে
মাঝে মধ্যে, তবু এক দীপ্তিমান উল্লসিত সুর
বয়ে যায় সবখানে। শুধু আমি মানুষের হাটে
একাকী বিষণœ ঘুরি এবং যখন যেখানেই
যাই, সত্তা জুড়ে বাজে সর্বক্ষণ আর্ত অশ্বক্ষুর
কেননা আমার বিশ্বে আজ আর সে নেই, সে নেই।
— একটি অনুপস্থিতি

> > > > > >

সে নেই! কে নেই! তোমার দেরাজ, টেবিল, স্রোতস্বিনী কলম, অনুসন্ধিৎসু চোখের জামা, জোড়া চশমা। শব্দ শৈলীর বুননে সাজবে বলে অপেক্ষমান লেখার খাতার সাদা পাতা। সফেদ পাঞ্জাবী, সোনালী চুলকে তোমার দোলনায় দোলানো বারান্দা থেকে জান্লা গলে ছুটে আসা অবাধ্য বাতাস। তোমার নিপূণ আঙুল স্পর্শধন্য অপেক্ষমান চায়ের পেয়ালা, মদির গেলাস। মধ্যরাতে ঝপঝপ শব্দ তুলে অবিরাম নিত্য নতুন কবিতার লাইন ছাপার জন্যে অপেক্ষমাণ অগণন পত্রিকার ছাপাকল। উৎসুক তৃষিত পাঠক। তোমার বন্ধু সুহ্নদ আড্ডায় অপেক্ষমান — তোমার সুগন্ধি আর গায়ের ঘামের ককটেল গন্ধ মাখা — অপেক্ষমান ঘরের, চেনা রেস্তোঁরার, পুরোনো আড্ডা সভার, কাতর চেয়ার।

এখনও সবাই নিরবচ্ছিন্ন প্রতীক্ষায়। তুমি কি বিমুখ করবে তোমার শহর, চেনা রাজপথ, উদার আকাশ, প্রতিবাদী রোদ, আনমনা মেঘ, চতুর চড়–ই, গায়ক কোকিল, ফুটপাথে ঘুমন্ত শিশু, মধ্যরাতের নির্ঘুম নৈশপ্রহরী, বেজান শহরের তাবৎ লাইপোষ্ট, কবিতার উৎসবে অপেক্ষমান মাইক্রোফোন, সামিয়ানার নীচে সাজানো চেয়ারে অপেক্ষাতুর উৎকর্ণ শ্রোতা। সবাইকে এবার তুমি কী সত্যিই বিমুখ করবে!

তোমার প্রয়ানে শহীদ মিনার যেমন সেজেছিল ফুলেল শয্যায় তেমনই কি তুমি চিরকালের মতোন গিয়েছো নিদ্রায় তোমার প্রিয়তম মানুষ মায়ের কোলে। সেখানে তোমার জন্য প্রতিদিন পৃথিবীর সমস্ত গোলাপ উৎসর্গ করবে বাংলার সলজ্জ সকল তরুণী, যুবা, জায়া, ভাগিনী, মাতা। প্রতিদিনের সবগুলো ফুটন্ত রজনীগন্ধা নিয়ে সকল প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধারা কি জানাচ্ছে স্বাগত। কেউ কেউ সোৎসাহে পাঠ করছে তোমার কবিতা! যাদের জন্যে তোমার কলম সময়ে নিত্য ঝরিয়েছে রক্তবন্যা তাঁরা কী সবাই উল্লাসের করতালি মেখে তোমাকে জানায়েছে অভিবাদন!

তোমার সাজানো বর্ণমালা খুঁড়ে বাংলা ভাষাভাষীরা অনাদিকাল ধরে খুঁজে নেবে তোমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, অভিমান, প্রতিবাদ, প্রেম, চেনা গন্ধ, নম্রতা মাখা চুল ও চোখ, ঋজু কন্ঠস্বরে কবিতার উচ্চারণ — প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা-মধ্যরাত-ভোর সারাক্ষণ খুঁজে নেবে দীপ্যমান, তোমাকে — শামসুর রাহমান।

১৯ ও ২০ আগষ্ট ২০০৬
উত্তরা, ঢাকা।

২,৯৪৮ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “একজন মৌলিক ‘চাঁদ সদাগর’”

  1. ওমর আনোয়ার (৮২-৮৮)

    লুৎফুল ভাই, দারুণ লেখা হয়েছে একটা। নিরীক্ষাধর্মী, সহজ, গভীরতাসম্পন্ন লেখা। আমার মনে হয়েছে এটা আপনারই প্রকাশিত কোনো বই থেকে উদ্ধৃত। আরো লিখতে থাকুন।


    Pride kills a man...

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      মানুষটা আসলেই আদ্যোপান্ত একজন কবি। আর সেই শৈলী তাঁর এমনই রপ্ত ছিলো যে, আমার কেবলি মনে হয় যদি তাঁকে বাজারের ফর্দ লিখতে বলা হতো ওখানেও ছন্দের কারুকাজ আর কবিতার আমেজ অনায়াসে পরিস্ফুট হতো।
      এমন কাউকে পাওয়া এক জীবনে আর হবার নয়। স্মরণ ছাড়া তবে আর থাকে কি বন্ধু !

      জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    কি সুন্দর ও সাবলীল গতিময়তায় কবি কে স্মরণ!!!!
    নিরীক্ষাধর্মী লেখা হলেও কবির প্রতি ভালোবাসার ঘ্রাণ ছড়ানো প্রতি পরতে পরতে।
    :boss: :boss: :boss:


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শামসুর রাহমান আমাদের চৈতন্যের কবি। ছোটবেলা থেকে, বলা ভালো ক্যাডেট কলেজ থেকে, কবি আমাদের সকল কর্মকান্ডে কিভাবে ব্যাপৃত হয়ে গেছিলেন টের পাইনি। আমাদের ব্যাচের প্রথম মঞ্চস্থ অনুষ্ঠানের নাম ছিল -- নিরালোকে দিব্যরথ। তাঁর কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদের বিশাল রেপ্লিকা করে মঞ্চের প্রধান অলঙ্করণটি তৈরি হয়েছিল।

    আরো পরে ফাহমুন নবী আবৃত্তি আর অভিনয় করেছিল --- স্যামসন। এখনো গায়ে কাঁটা দ্যায়। এছাড়া শ্লোগানে প্রেমে দ্রোহে কতবার কবি এসেছেন!
    লুৎফুল ভাই, এ পাঠ যে কি ভালো লাগলো! সিসিবির ভাঁড়ার সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো।

    আমার অহংকার হয় যে, আমি শামসুর রাহমানের সৃষ্টিশীলতা প্রত্যক্ষ করেছি কবির জীবদ্দশায়। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত এ এক অপূর্ব শ্রদ্ধাঞ্জলি। অতি চমৎকার!
    "তাই তিনি অনায়াসে হয়েছে সর্বজন গ্রাহ্য ও নিন্দিত" - এখানে কথাটা "নিন্দিত" ঠিক আছে, নাকি নন্দিত হবে?

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।