~ শিকড় থেকে শিখর যাত্রার ইতিবৃত্ত ~

পনেরো থেকে আঠারো শতকে বিশ্ব জিডিপির ঊনত্রিশ শতাংশের উৎস ছিল মুঘল সম্রাজ্যের ভারতবর্ষ। সেই ভারতবর্ষের জিডিপির আটষট্টি শতাংশ জোগান দিত বাঙলা। মুঘল সম্রাজ্যের বানিজ্যিক রাজধানী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী বৃহৎ এক শহর ঢাকাকে ঘিরে পূর্ব বাঙলা এমনই প্রণিধানযোগ্য ছিল প্রায় চারশো বছর ধরে।

ঊনিশ শতকে বৃটিশ শাসনাধীন হলো যখন তখনও বিশ্ব জিডিপির বাইশ শতাংশ জোগান দিতো ভারতবর্ষ। অথচ বৃটিশরা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে যায় তখন বিশ্ব জিডিপিতে তাদের ভাগ নেমে আসে দুই শতাংশেরও নীচে। ইংরেজদের অধীনে যাওয়ার পর থেকে সমৃদ্ধির চাকা স্থবির হয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে ঢাকা। ঔপনিবেশিক রাজধানী হিসেবে উত্থান, উত্তরোত্তর অর্জন এবং গুরুত্ববৃদ্ধির পাল্লায় কোলকাতার এগিয়ে যাওয়ার বিপরীতে ঢাকাকে ঘিরে পূর্ব বাঙলা ক্রমাগত পিছু হটে জৌলুস হারাতে থাকে।

ভারত ভাগ হবার সময় দুই বাঙলা এক থাকার প্রাথমিক প্রস্তাবনাকে নাকচ করে নিজেদের আগ্রহে ও সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যায় ভারতের অংশ। পূর্ববঙ্গ হলো নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ, পূর্ব পাকিস্তান। দুশো বছরের ইংরেজ শাসনামলে পিছিয়ে পড়া পূর্ব বাঙলার জনগোষ্ঠী নতুন দেশকে এগিয়ে নেবার জন্য নেতৃত্বের সক্ষমতা সম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলবার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন কিছু সংযোজন করবার কথা ভাবেন। পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের মাথায় পরিকল্পনা আসে নতুন ধরণের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়বার।

বিসমার্কের যুগে জার্মানিতে প্রথম প্রবর্তিত হয় এই নতুন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদিও রাজ পরিবার ও সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানদের পড়বার জন্যই বিশেষ এ স্কুল চালু হয় প্রথমে, পরে তার আঙ্গিক পাল্টাতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটা বিশ্বব্যাপী নজর কাড়লে অচিরেই নেপোলিয়ন তা চালু করেন ফ্রান্সে। তারপর এরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বৃটেনে। বৃটেনের সেই বিখ্যাত পাবলিক স্কুল ‘ইটন’ বা ‘হ্যারো’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আইয়ুব খান পরিকল্পনা করেন ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের হাসান আবদেল শহরে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম ক্যাডেট কলেজ। পরিকল্পনা মাফিক যখন পশ্চিমে আরো দুটা স্থাপনের অপেক্ষায় তখন অবহেলিত পূর্ব পাকিস্তানেও একটা ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের চিন্তা করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি আইয়ুব খান। ইতিমধ্যে উচ্চপদ সরকারী কর্মকর্তা, জননেতা, প্রণিধানযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও সেনা কর্তৃপক্ষ একদিকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের দাবী তুলছিলেন, তাদেরই কেউ কেউ এর বিরোধিতাও করেছিলেন। বলছিলেন নেতৃস্থানীয় মানুষদের সন্তানরা যখন বিদেশে পড়ছে তখন তারাই আবার এমন প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়ার যৌক্তিকতা কী।

ইস্ট পাকিস্তান পার্লামেন্টে চীফ মিনিস্টার আতাউর রহমান খানের উদ্যোগে অবশেষে প্রাদেশিক পরিষদে ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার উত্থাপিত প্রস্তাব গৃহীত হয় ১৯৫৭ সালে। ইতিপূর্বে উচ্চারিত ইঙ্গিতের সূত্র ধরে তৎকালীন চীফ মিনিস্টার ভারতে অধ্যয়নরত তাঁর দুই সন্তানকে, ওবায়েদূর রহমান খান (০৪/৫৫) ও জিয়াউর রহমান খান (০৫/৪৫), দেশে ফিরিয়ে আনেন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাবার জন্য। উদ্যোগীদের সমন্বয়ে একটা কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হলে তারা স্থান নির্ধারণ সহ বিবিধ বিষয় নিয়ে কাজ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। প্রাদেশিক পার্লামেন্টে ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্তে বিল পাশ হলে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় শিক্ষা খাতের বাজেট থেকে।

ক্লাস সেভেন থেকে টুয়েলভ, এই ছয় ক্লাসে পড়াশোনার আয়োজন নিয়ে শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও অন্যান্য বিবিধ বিষয়ের প্রশিক্ষণ প্রাধান্য সমান গুরুত্বে পাশাপাশি রেখে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতায় আত্মবিশ্বাসী তারুণ্য গড়ে তোলবার লক্ষ্যে নির্ধারিত হয় এর শিক্ষা কার্যক্রম। ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা একটা পূর্ণাঙ্গ মেধাভিত্তিক প্রার্থী নির্বাচনের নিরপেক্ষ প্রথা। যেখানে শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে ভর্তিচ্ছু ছাত্র বাছাই নয়, পিতা মাতার আয় ও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় ও নির্বাচিত ছাত্রের মেধা অনুপাতে তার শিক্ষাক্রমের ফিসটাও নির্ধারিত হয়। এমন সুন্দর নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক মেধাবৃত্তি ব্যবস্থার নজির আর কোথাও নেই।

কমিটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় দশ মাইল উত্তরে পাহাড় সমুদ্র সমতটের অপূর্ব সমন্বয়স্থল ফৌজদারহাটে ১৭৬ একর জায়গা নিয়ে শুরু হয় এর সুবিশাল নির্মাণযজ্ঞ। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওমর এণ্ড সন্স কে দেয়া হয় প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থাপনাগুলো নির্মাণের কাজ। ডিফেন্স কনট্রাক্টর হিসেবে ওমর এণ্ড সন্স এর সুনাম তাদেরকে নির্বাচনের যোগ্যতা বিবেচনায় এ কাজ তারা পায়। জাভাইদ সাকলাইন জাইদী (০৮/২৩৭) এর বাবা তখন ওমর এণ্ড সন্স এর রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। প্রথমে নির্মাণ শুরু হয় একটা হাউস (নাম রাখা হলো তার ইস্ট হাউস)। সেই সাথে টিচিং ব্লক, প্রসাশনিক ভবন (প্রিন্সিপাল অফিস ভবন), ডাইনিং হল, হাসপাতাল। মাঠ, ধানি জমি, পাহাড় এসব থেকে বৃটেনের পাবলিক স্কুল আদলে একটা আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা খুব সহজ ব্যাপার ছিলো না। তবু কলেজ চালু করবার তাগিদে সব কাজ এগোচ্ছিলো জোর গতিতে।

নির্মাণ কর্মী ও কর্মকর্তা, দেখভালের কর্মকর্তা কর্মচারী সবাই অনেক দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন পানি ও বিদ্যুৎ বিহীন একটা বিরান প্রান্তরে কাজ করতে গিয়ে। প্রাথমিক অবস্থায় এবং এমন কি কলেজ শুরু হবার পরও নিকটবর্তী এক ফ্যাক্টরি থেকে ট্যাংকারে করে পানি এনে মেটানো হতো পানির চাহিদা। সিএণ্ডবি থেকে ধার করা জেনারেটর দিয়ে সীমিত অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিলো অনেকদিন পর্যন্ত। সেই সিএণ্ডবি-র চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান তখন এ এফ এম এ হ্যারিস (১১/৩৯৫) এর বাবা। ইস্ট হাউস (পরবর্তীতে বাবর হাউস থেকে রবীন্দ্র হাউস) এর দক্ষিণ দিকে টিচার্স কোয়ার্টার্স শুরু যেখান থেকে সেখানে পর পর তিনখানা বাসা আর তার বিপরীতে তিনখানা বাসা নিয়ে চালু হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রথম আবাসন ব্যবস্থা। সাকুল্যে ছয় বাসায় থাকতেন প্রথম বারো জন শিক্ষক (কেউ কেউ পরিবার সহ, কেউ একা), যাদের নিয়ে শুরু হয় কলেজ। আরো থাকতেন অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরাও। প্রিন্সিপালের বাংলো বলতে প্রথমে ছিলো শুধু দুই রুমের এক বাসা।

টিচিং ব্লক বলতে শুধুমাত্র দোতালার আর্ট গ্যালারি আর তার নীচের অংশটুকুন। এটুকু নিয়েই শুরু। এরপর নির্মিত হয় কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্স গ্যালারি দুটো। তারও পরে এই দুই অংশ সংযোজিত হবার রুমগুলো। ক্রমাম্বয়ে টিচিং ব্লকের বাকি অংশ। অডিটোরিয়াম ও বর্তমান লাইব্রেরি স্থাপনা বাদে। অডিটোরিয়াম স্থাপিত হয় ১৯৬০ সালে। প্রথমে লাইব্রেরি ছিল এখনকার ইনফরমেশন সেন্টার-এর রুমটায়। ডাইনিং হলে ছাত্ররা যখন প্রথম খাওয়া দাওয়া শুরু করে তখন তার দুই পাশের দেয়াল উঠেছে মাত্র, ছাদ হয়নি। তার বদলে ছাউনি হিসেবে ত্রিপল টানা ছিল। একই সময়ে, নির্মাণপর্বের প্রথম ভাগেই নির্মিত হয় হাসপাতাল। বর্তমান হাসপাতালের ডাক্তার চেম্বার, অফিস, এসিস্ট্যান্ট ও নার্সদের রুম, ওটি এই অংশটুকু প্রথমে নির্মিত হয়। তখন কোনো রোগী থাকার বেড সুবিধা নিয়ে ওয়ার্ড বা কেবিন কিছু নির্মিত হয়নি। সেইসব হয়েছে পরবর্তীতে, ধাপে ধাপে। প্যারেড গ্রাউণ্ডের বদলে তখন টিচিং ব্লকের সামনে ছিল দু’টা স্ট্রিপ। ধোপিঘাটে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানিতে ধোয়া হতো সবার কাপড়। ডাইনিং হল ও কলেজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বয়, বেয়ারার, বাবুর্চি নিয়োগ দেয়া হয় ইবিআরসি থেকে। হিলাল আহমেদ চৌধুরী (১৩/৫০৪) এর বাবার সহযোগিতায় এর ব্যবস্থা হয়।

একদিকে যখন ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হলো, কমিটি বিবিধ বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা পেশ করলো পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের কাছে। তখন একদিকে যেমন নির্মাণকাজ চলছিলো নির্ধারিত স্থান ফৌজদারহাটে, পাশাপাশি প্রথমে শিক্ষক নিয়োগ এবং পরে ছাত্র ভর্তির প্রকৃয়াও চলমান হয় ১৯৫৭ সালেই। সে বছরই ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে আগ্রহী ছাত্রদের ভর্তি পরীক্ষা হয়, সেভেন থেকে টুয়েল্ভ, ছয় ক্লাসে ভর্তির জন্য। এই নতুন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেবার জন্য কমিটির সবাই সুচিন্তিত ভাবে স্থির করেন কিংবদন্তী বৃটিশ হেড মাস্টার হিউ ক্যাচপোলকে।

আইয়ুব খান প্রস্তাবের অন্য কোথাও সেভাবে দ্বিমত না করলেও প্রিন্সিপাল পদের জন্য প্রস্তাবিত নাম পালটে দিলেন নতুন এক নাম। তার সিদ্ধান্তে নিউজিল্যাণ্ডের লেফটেনান্ট কর্নেল এবং বৃটিশ এয়ার ফোর্সের উইং কমাণ্ডার জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য পর্যবেক্ষক এবং আরো অনেক দায়িত্ব ও গুণাবলির অধিকারী উইলিয়াম মরিস ব্রাউন নির্ধারিত হলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ-এর প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে। গাজা স্ট্রীপে অবস্থান করবার সময় আইয়ুব খানের সাথে দেখা হয়েছিলো জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মরিস ব্রাউনের। সেই সূত্র ধরে এই গুণী মানুষটার অভাবনীয় সম্পৃক্ততার সূত্রপাত হলো বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের সাথে।

মোটামুটি ভাবে অসম্পূর্ণ ও আংশিক সম্পন্ন অবকাঠামো নিয়ে ১৯৫৮ সালের ২৮ এপ্রিল, বৈশাখের রৌদ্রকরোজ্জ্বল উত্তপ্ত এক দিনে, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের। তদানীন্তন পাকিস্তানের জিওসির পক্ষ থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কোরবান আলী উদ্বোধন করলেন সমবেত সূধী ও গুণীজনদের কাছে ক্যাডেট কলেজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে। তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রথম উপাধ্যক্ষ জনাব মইদুল ইসলাম। উদ্বোধনী দিনের অন্য উল্লেখযোগ্য অংশটি ছিলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর জন্য নির্বাচিত ৫৯ জন ছাত্রের কলেজে যোগদান পর্ব। পরে সে বছরই বাকি চার ক্লাসেও ছাত্ররা ভর্তি হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে অবকাঠামোগত নির্মাণ কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয় হাউস নির্মাণ হলে তার নাম হয় ‘ওয়েস্ট হাউস’ যা পরবর্তীতে শাহজাহান হাউস ও বর্তমানে নজরুল হাউস নামে পরিচিত। তৃতীয় হাউস নির্মিত হলে বাকি দুটারও নাম পালটে নতুনটার নাম রাখা হয় ‘আকবর হাউস’ যার নাম বর্তমানে ‘শহীদুল্লাহ হাউস’। কিয়দ বিরতির পর সবশেষ হাউস নির্মাণ করা হলে তার নাম হলো আইয়ুব হাউস, পরে এর নাম হয় ‘ফজলুল হক হাউস’।

এইসব যখন চলছে একের পর এক, তার ভিতরই ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলেজে আসেন লে. কর্নেল উইলিয়াম মরিস ব্রাউন ও তাঁর স্ত্রী মিসেস বেরিল ব্রাউন। কর্নেল ব্রাউন দায়িত্ব নেবার পর তিনি ব্রিটিশ শিক্ষকদের আগ্রহী করে তোলেন ফৌজদারহাটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে। সেই প্রচেষ্টার সাফল্যসূত্র ধরে প্রথম আসেন মি. এস.এল. ক্রফট, যিনি পড়াতেন ইংরেজি। এরপর আসেন মি. ও.এন. বিশপ, পড়াতেন সাইন্স এবং মি. হ্যারি শাট, পড়াতেন ইংরেজি। আসেন স্কটিশ মি. ম্যাকবেথ, যিনি পড়াতেন ফিজিক্স। এছাড়া বেশ কয়েকজন ভি.এস.ও. (ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিস) তাদের পড়াশোনার পরের ধাপে ভর্তির আগে এক বছরের শিক্ষা-বিরতি নিয়ে সেই সময়কালের জন্য ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে এসে ছাত্রদের সাথে থেকে তাদের বিবিধ শিক্ষা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। হাউস টিউটরের দায়িত্বও পালন করেছেন।

প্রাজ্ঞ কর্নেল ব্রাউন গোটা কলেজের নিয়ম নীতি যেমন যত্নে সাজাচ্ছিলেন নিত্য দিনের পরিচর্যায়। খুঁটিনাটি কোনো কিছুই তাঁর মনযোগ এড়িয়ে যেতো না। ছুরি-চামচ-কাঁটা ব্যবহার থেকে শুরু করে কথা বলবার সময় কোন দিকে কিভাবে তাকাতে হবে, দাঁড়াতে হবে; এসব বিষয়ও বাদ যায়নি। তিনি কলেজের প্রথম মোটো ঠিক করেন ‘লাভ ইওর কান্ট্রি, টেল দ্য ট্রুথ, এণ্ড ডোন্ট ডোডল’। কর্নেল মরিস ব্রাউন তার নিজের ঠিক করা মোটোটাকেই পরে সংক্ষিপ্ত করে নির্ধারণ করেন ‘ডিডস, নট ওয়ার্ডস’। এই মোটোর সাথে পরিপূর্ণ ভবে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনবোধ আর চরিত্র নির্মাণের এক প্রাণবন্ত কারখানা গড়ে তোলাই সত্যিকারের ব্রত ছিলো কর্নেল মরিস ব্রাউনের। এ সত্যটা মর্মে মর্মে জানে তারা, যারা তাঁর সরাসরি সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছিলো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে।

ড. বদরুল মিল্লাত ছিলেন ফৌজদারহাটে নিযুক্ত প্রথম শিক্ষক। তারপর জনাব এ.টি.এম. নাসির। ১৯৫৮ সালেই কলেজের প্রথম এডজুটেন্ট হিসেবে কলেজে যোগ দেন বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন মাশুর-উল হক। যিনি পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে থাকা অবস্থায় অবসর নেন। পরে কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকা সময়ে মারা যান। প্রথম লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কলেজে যোগ দেন জনাব আক্কাস আলী। যিনি পরবর্তীতে শিক্ষক পদে নিয়োগ পান এবং অনেক বছর শিক্ষকতা করে অবসর নেন।

ছাত্রদের সন্তানের মতোন যত্নে ও ভালবাসায় গড়েছেন কর্নেল ব্রাউন। নিজে চট্টগ্রাম স্টেশনে চলে যেতেন ছুটি ফেরত ছাত্রদের রিসিভ করতে। তাদের সাথে উষ্ণ করমর্দন করে বাড়ি ছেড়ে আসার কষ্টকে যেনো মুছে দিতে চাইতেন। কলেজে বাসে করে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে কলেজে আসতো ছাত্ররা তখন। উনার পাশাপাশি মিসেস ব্রাউনও বহুভাবে ছাত্রদের দেখভাল করেছেন আপন সন্তানের মতো। কর্নেল ব্রাউনের উদ্যোগে কলেজ লাইব্রেরিতে বৃটেন থেকে আসতো অমূল্য সব বই। তাঁর সুবাদেই ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটানিকার পঞ্চম ভলিউমে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের নাম মুদ্রিত হয়ে কলেজের নামটাতে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুরভি জুড়ে দিয়েছিলো।

পরিকল্পনা ছক অনুযায়ী প্রতি ক্লাসে পঞ্চাশ জন হিসেবে প্রথম পূর্ণ ব্যাচ কলেজে ভর্তি হয় ১৯৬৩ সালে। তার আগে ক্লাসগুলোতে পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ সংখ্যায় ছাত্র না থাকলেও শিক্ষা ও আনুসাঙ্গিক কর্মকাণ্ডের কোথাও কিছুমাত্র অবহেলা তো ছিলোই না বরং সে সময়টায় কর্নেল ব্রাউনের ঐকান্তিক বিরামহীন প্রচেষ্টা এবং তার সঙ্গে প্রাজ্ঞ শিক্ষক ও প্রসাশনিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারখানা ‘ফজা ফ্যাক্টরি’ চলছিলো পূর্ণোদ্যমে। দেশের সেরা ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করবে ফৌজদারহাটের ক্যাডেটরা, সেই ইচ্ছায় কর্নেল ব্রাউন নিজ উদ্যোগে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজকে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে না রেখে ঢাকা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করেন।

শুধু পড়াশোনা নয়। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সুইমিং পুল (তখন খোলা ও গ্যালারি ছাড়া), এথলেটিক্স গ্রাউণ্ড, রাগবী মাঠ, ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, টেনিস এসব খেলাধুলার আয়োজন করবার পাশাপাশি গড়া হয় জিমনেশিয়াম। নির্মাণ কাজের সিমেন্ট রাখার ঘরটাকে পালটে তৈরি হয় স্কোয়াশ কোর্টও। কলেজে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য বৃটেন থেকে অভিজ্ঞ লোক আনিয়ে নিশ্চিত করেন এমন ব্যবস্থা যেনো পাহাড়ি ঢল নেমে বৃষ্টির পানি কোনো ভাবে কলেজকে কিছু সময়ের জন্যও নিমজ্জিত করতে না পারে। গোটা কলেজে, এমন কি নীচু যে খেলার মাঠগুলো, সেখানেও, এই বিপত্তি না ঘটবার নিশ্চয়তা বিধান করবার লক্ষ্যেই তার এই আয়োজন।

তখন বিকেলে ছাত্ররা অনতিদূরে কলেজের সামনের সমুদ্রপাড়ে খেলতে যাওয়া এমন কি সাঁতার কাটার চল ছিলো। একবার হাঙ্গর (শার্ক) দেখা যাওয়ার খবর শোনা গেলে এটা বন্ধ করে দেন কর্নেল ব্রাউন। শুরুর সময়ে যখন কলেজে মসজিদ নির্মিত হয়নি, তখন কর্নেল ব্রাউন মুসলিম ছাত্রদের জন্য শুক্রবারে কলেজের বাইরে গ্রামের মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ পড়বার নিয়ম করেছিলেন। খ্রিস্টান ছাত্ররা চট্টগ্রাম শহরের চার্চে যেতো রোববারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করতো ছাত্ররা।

সে বছর, ১৯৬০ সালের এপ্রিলে প্রথম ব্যাচের ২৭ জন ছাত্র প্রথম পাস আউট করে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বের হয় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে। এদের ১৬ জন যারা ঢাকায় থাকতেন তারা সে বছরই গড়ে তোলেন (ইপিসিওবিএ) ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ ওল্ড বয়েজ এসোসিয়েশন। প্রথম ব্যাচের আবু নাসের হায়দার ছিলেন প্রথম প্রেসিডেন্ট (যিনি ১৯৬৩ সালে অকালপ্রয়াত হন) এবং প্রথম ব্যাচের আব্দুর রব ছিলেন প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি। তৎকালীন শিক্ষক মিস্টার এণ্ড্রুর বাসায় এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলে হতো তাদের বিভিন্ন সভাগুলো। পরবর্তীতে নাম পালটে এই সংগঠন হয় (ফকা) ফৌজদারহাট ওল্ড ক্যাডেটস এসোসিয়েশান। আজ সেই সংগঠনটিই ‘ওল্ড ফৌজিয়ান্স এসোসিয়েশন’ নামে সুপরিচিত। এর চিরচেনা প্রতীকটি তৈরি হয় নিজাম এম সেলিম (০৯/২৯৬) এর পরিকল্পণা অনুযায়ী ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস-এর মাস্টার্স ছাত্র এনায়েত হোসেন এর হাতে এর প্রথম নকশা আঁকা হয়। রঙ নির্ধারিত হয় খাকি।

ছাত্রদের উৎকর্ষের জন্য, খেলাধুলায় উৎসাহ দেবার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে অলিম্পিক সোনা জেতা পাকিস্তান হকি দলের খেলোয়াড়দের কলেজে এনে ছাত্রদেরকে খেলার টিপস দেবার পাশাপাশি সোনা জিতবার উইনিং গোল করা হকিস্টিকটা কলেজকে উপহার পাইয়েছেন কর্নেল ব্রাউন। ১৯৬২ সালে সফররত ইংল্যাণ্ড ক্রিকেট দলকে খেলার মাঝে বিরতির দিনে কলেজে এনেছেন। ওরা কলেজের ছাত্রদের ব্যাটিং এবং বোলিং প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ছাত্রদের সব বিষয়ে উদ্দীপ্ত করা এবং আরো উৎকর্ষের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে যতোভাবে পেরেছেন করে গেছেন কর্নেল ব্রাউন। এইসব করার ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছে কলেজের বিভিন্ন রীতি ও ঐতিহ্য। আমরা এর কতোটা ধরে রাখতে পেরেছি বা কতোটা এগিয়েছি সেটা আজকের বিবেচ্য।

১৯৬০ সালে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে অগণিত মানুষ মারা যায় ও গৃহহীন হয়। তখন এক সপ্তাহের জন্য কলেজের ক্লাস ও নিয়মিত কর্মকাণ্ড স্থগিত করে মৃত মানুষের দাফন ও গৃহহীনদের ঘর-বাড়ি নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল গোটা কলেজের সব ছাত্র ও শিক্ষকদের। পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষাই শুধু লক্ষ্য ছিলো না কর্নেল ব্রাউনের। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন মানুষটি। তাঁর সঙ্গে ছাত্রদের গড়ে উঠেছিল অনন্য বন্ধুত্ব। যা তাঁর চলে যাবার পর বহু বছর ধরে অটুট ছিল। তাঁর যাবার পাঁচ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বন্দী ছাত্রকে মুক্তি দেবার জন্য, তাকে বিদেশের স্কলারশিপে পড়তে যাবার সুযোগ গ্রহণ করবার সুবিধা দিতে পাকিস্তান সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন ছাত্রদের সাথে তাদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত জীবনের উত্তরণের লক্ষ্যে নিয়মিত পরামর্শ ও সহযোগিতা করে গেছেন আমরণ।

শুরু থেকেই শরৎকালে স্টেপল চেজ-এর আয়োজন ছিলো কলেজে। এক্সকারশানের প্রাথমিক ফর্ম ছিলো ‘আউট-ওয়ার্ড বাউণ্ড ট্রেনিং’। তখন রাঙ্গামাটি গিয়ে ক্যাম্পিং করে থাকতে হতো কয়েক দিনের জন্য। ক্যাডেটদের দৈনন্দিন নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার সুবিধা দিতে প্রতি হাউসের রিডিং রুমে চালু করা হয় “অনার্স শপ”। একটা বোর্ডে পণ্য তালিকা ও মূল্য লেখা থাকতো। যার যা প্রয়োজন দাম পরিশোধ করে কিনে নিতো নিজে নিজেই। মাস শেষ কখনো কখনো সেখানে উদ্বৃত্ব টাকা পাওয়া যেতো, কখনো কম পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর প্রত্যেক ক্যাডেটকে একটা ‘সেলফ এসেসমেন্ট ফাইল’ দেয়া হতো। তাতে ছাত্ররা নিজেই নিজেকে মূল্যায়ন করে জমা দিতো কর্তৃপক্ষকে। কর্তৃপক্ষ পরে তা কলেজের পক্ষ থেকে করা মূল্যায়নের সাথে মিলিয়ে দেখতো। দুয়ের মাঝে তফাৎ থাকতো যৎসামান্যই।

প্রতিষ্ঠালগ্নে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে নিয়োগের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো আইয়ুব খানের। বিসমার্ক যুগের জার্মানির সেই স্কুলের আদলের চিন্তা চেতনার বিপরীতে কলেজে চালু হয় ‘ক্যারিয়ার ব্যুরো’। যার দায়িত্বে থাকতেন একজন প্রভাষক। যে উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের নিজ নিজ যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের পন্থা নিয়ে সার্বিক নির্দেশনা ও সহায়তা দেয়া। এই ব্যুরো থেকে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার তথ্য এবং পরামর্শও দেয়া হতো। এসব কিছুর জের ধরে ১৯৬৩ সালে, যে বছর প্রথম পূর্ণ ব্যাচ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলে প্রথম স্থান সহ প্রথম দশ জনের মধ্যে পাঁচ জনই ছিলো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের। একই ধারাবাহিকতার শুরু হয় উচ্চ মাধ্যমিকেও।

নানান প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে ধাপে ধাপে নির্মিত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ দিনে দিনে এক এক করে যেমন গড়ে তুলেছে এক একটা ভবন আর স্থাপনা। সেই রকমই দিনে দিনে এর অর্জন স্বৌকর্য ছড়াতে থেকেছে প্রোজ্জ্বল আলো। নির্মাণপর্বে ১৯৬০ সালে তৈরী হয় অডিটোরিয়াম। তারপর একে একে প্যারেড গ্রাউণ্ড, বর্তমান লাইব্রেরি ভবন, টিচিং ব্লকের পশ্চিম অংশ, টিচারদের ও স্টাফদের থাকবার কোয়ার্টারগুলো। ডেইরি ফার্ম, বেকারি গড়ে ওঠে ১৯৬৫-৬৬ সালের মধ্যে। শেড সহ সুইমিং পুলের বাকী স্থাপনা, মসজিদ তৈরী হয় ১৯৬৬-৬৮ সালের মধ্যে। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর প্যারেড গ্রাউণ্ডের শোভা বর্ধন করে যুক্ত হয় কামান দুটো।

মানুষ গড়ার এই কারখানায় গড়ে উঠেছে আমলা, মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ, উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, প্রতিরক্ষা বাহিনীর মেধাবী ও চৌকষ কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, লেখক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, গবেষক থেকে সর্বস্তরে নেতৃত্ব প্রদানকারী মানুষ। কর্নেল ব্রাউন একের পর এক সাফল্যে কখনোই অবাক হতেন না। কেননা তিনি জানতেন এটাই হবার। সব সাফল্য অর্জনের মুঠোয় ধরা দেবে ফৌজদারহাটের ছাত্রদের, এটাই তার স্বাভাবিক চিন্তা ছিল।

ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের প্রথম পুনর্মিলনীর আয়োজন হয় ১৯৬৫ সালে। ২০-২২ নভেম্বরের এই পুনর্মিলনী আসলে শুধুই পুনর্মিলনী ছিল না। সেই আয়োজনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো ক্যাডেট কলেজের প্রথম ও প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ কর্নেল ব্রাউন-এর বিদায় পর্ব। তাঁর সন্মানে প্রদত্ত ফেয়ারওয়েল ডিনার দিয়ে ‘হি ওয়াজ আ ভেরি গুড ফেলো, সো সে অল অফ আসÕ গানের ভিতর দিয়ে শেষ হয় প্রথম পুনর্মিলনী।

কর্নেল ব্রাউন চলে গেলে তাঁর পর ১৯৬৬ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে এসেছিলেন লে. কর্নেল. এন.ডি. হাসান। সেসময় যোগদান সূত্রে তাঁর সন্তানকে সরাসরি ক্লাস টেনে ভর্তি করা নিয়ে কলেজে প্রতিবাদ হয় ছাত্রদের ভিতর থেকে। দক্ষ হাতে সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় দ্রুততার সাথে। সে সময় পর্যন্ত খোয়ার আগে বলা হতো ‘ফর ফুড, ফ্রেণ্ডস এণ্ড ফেলোশিপ উই থ্যাঙ্ক দ্য গড’। নতুন অধ্যক্ষের প্রথম দিনেই সেটা পালটে চল হলো ‘বিসমিল্লাহ’ বলার। তিনি দ্রুত একজন ইমাম নিয়োগ দিলেন কলেজে। গ্রামের মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যাওয়ার নিয়ম বন্ধ করে জিমনেশিয়ামে মাগরেব-এর নামাজ পড়বার প্রথা চালু করলেন।

ভিএসও’রা তখনও আছেন। ভিএসও মিস্টার ওয়াটসন তখন আইয়ুব হাউসের হাউস টিউটরের দায়িত্বে। ১৯৬৬ সালের বসন্তের রঙিন কোনো এক দিনে কলেজে প্রথম চালু হলো দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতা। মিস্টার ওয়াটসন ভালো আঁকিয়ে, কলেজ ছুটি হলে বাড়তি অবসর সময় তাঁর কাটতো দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকে। তাঁর তত্বাবধানে আইয়ুব হাউস প্রথম সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হলো। এর আগে ১৯৫৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তালিকায় যুক্ত হয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা। কোনো এক শনিবারে আয়োজিত সে প্রথম বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় আকবর হাউস, সেরা বক্তা আকবর হাউসের এ কে এম আব্দুর রব। এভাবেই একে একে কলেজে শুরু হয় সাহিত্য ও শিল্পমনা ছেলেদের বিকাশের এক এক অধ্যায়।

সব আয়োজনে ছাত্রদের পাশে ছিলেন দেশ বরেণ্য মেধাবী ও প্রখ্যাত নানা মানুষ, যাঁরা শিক্ষক হিসেবে অলৌকিক মানিক্যের মতোন জ্ঞান আর প্রজ্ঞা বিলিয়েছেন তাঁদের ছাত্রদের মাঝে। নাম বললে তাঁদের প্রত্যেকের নামই বলতে হয়, একথা নিশ্চিত। তাঁদের অনেকেই ছেড়ে গেছেন আমাদের। কর্নেল ব্রাউনও গেছেন ১৯৭৫ সালে। যাঁরা বেঁচে আছেন বর্তমানে তাদের মধ্যে জনাব আবুল আশরাফ নূর একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। ফৌজদারহাট থেকে উনি বদলি হন অন্যান্য ক্যাডেট কলেজে। পরবর্তীতে অধ্যক্ষ পদে থেকে অবসরে যান।

ফৌজদারহাটের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দশ বছরের মধ্যে এদেশে স্থাপিত হয় দ্বিতীয় ক্যাডেট কলেজ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। এর দুই বছরের মধ্যে চালু হয় মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ (পরবর্তীতে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ) ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ।

এই সাফল্য ধারাবাহিকতার অনন্য কলেজটিকেও পরোক্ষভাবে আক্রান্ত হতে হয় ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। ১৯৭২ সালে তৈরি করা হিসাব অনুযায়ী ১০ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যের সম্পদ খোয়া যায় এবং বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশের বীর মুক্তিসেনাদের তালিকায় নাম লেখায় অর্ধশত ফৌজিয়ান। দেশের জন্য আত্মত্যাগ করে গোটা জাতির সাথে কলেজকে গৌরবান্বিত করেন আটজন ফৌজিয়ান। স্বাধীনতার পরে কর্তৃপক্ষের এমন কি শিক্ষকদের একাংশ চাইছিলেন এটাকে একটা সাধারণ সরকারী কলেজে রূপান্তরিত করতে। সেটা যদিও খুব একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী হয়নি।

তথাপি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার ইতি টানবার এক প্রস্তাব উত্থাপিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে। ১৯৭২ সালে এমন প্রস্তাবের কথা জানতেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে ফৌজিয়ানরা। গড়ে ওঠে ‘সেইভ ক্যাডেট কলেজ মুভমেন্ট’ বা ‘কিপ ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পেইন’। জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর সহমর্মী ভূমিকায় উদ্যোগী ফৌজিয়ানরা এ প্রস্তাব রহিত করে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় ও সংসদীয় কিছু সদস্যের বিরোধিতা নাকচ করে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষ ব্যবস্থা চালু রাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেন। সে সময় এজি অফিসে দায়িত্বের সূত্রে সহায়তা করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
ক্যাডেট কলেজকে তখন প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখার সিদ্ধান্ত হলেও অনুরোধ বিবেচনায় তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। অচিরেই এর ছাত্রদের সাফল্যের উদাহরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এদেশে একে একে গড়ে ওঠে ছেলেদের আরো পাঁচটা এবং মেয়েদের একটা ক্যাডেট কলেজ। বেশ কিছু বছরের বিরতির পর স্থাপিত হয় আরো দুটা মেয়েদের ক্যাডেট কলেজ।

বর্তমান সময়ে এসে দীর্ঘ ছয় দশকের সীমানায় দাঁড়িয়ে আমাদের খুব ভাববার দরকার সেই শুরু থেকে যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে যে সব কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে সত্যিকারের বিশ্বমানের নাগরিক গড়ে তুলবার জন্য দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো ক্যাডেট কলেজকে। সেই বিবেচনায় আমরা আজ আসলে কোথায় অবস্থান করছি। বিশ্ব মানের বিপরীতে এক সময়ের দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আজ দেশের ভিতর অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে সত্যিকার অর্থে কোন অবস্থানে বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে অর্জিত গৌরব ও সন্মানজনক অবস্থানকে আমরা কতোখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি কিংবা পারিনি; কতোটুকু পারবো কি পারবো না। আগের সব ভালো নিয়ম রীতিগুলো চালু করা বা সমুন্নত রাখা শুধু নয়, যুগপোযোগী উন্নয়নও ঘটাতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক মান বিবেচনায়। নীতি নির্ধারকদের মাঝে যখন প্রাক্তন ক্যাডেটদের ছড়াছড়ি তখন সেই লক্ষ্যে যা কিছু করণীয় তা আমাদের পেরে উঠতে কতো দেরী আর !

পৃথিবীতে সব বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ, এদের সার্বিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় এবং অগ্রণী ভূমিকা রাখে তাদের এলামনাই (প্রাক্তন ছাত্ররা)। তা সেটা কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত উৎকর্ষ যাই হোক না কেন। নিয়মিত ভাবে আধুনিকীকরণের ভিতর দিয়ে যেতে হয় একটা সত্যিকারের সেরা প্রতিষ্ঠানকে। সেটার অনুপস্থিতি তাকে সেই সেরা জায়গায় থাকবার অনুমোদন দেয় না। পিছিয়ে পড়তে হয় তাকে। আমাদের প্রাক্তন ছাত্রদেরও কর্তব্য সেই লক্ষ্যে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজকে দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচয়ে বিনা তর্কে আসীন রাখবার লক্ষ্যে অবদান রাখা। ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থাকে মোটা দাগে নয়, সুদূরপ্রসারী, বিস্তারিত ও অবকাঠামোগত বিবেচনায় সর্বাগ্রে এগিয়ে নেবার পথ প্রশস্ত ও সুদৃঢ় করবার প্রচেষ্টায় অংশীদার হওয়া।

পূনর্মিলনীর সূত্র ধরে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে অতীত দেখার সুযোগ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে অতীত-বর্তমানের ভালো মন্দের তুলনামূলক চিত্রটাকে। সেই চিত্র অনায়াসে যে বীক্ষণ তৈরী করে এবং এই রকম একটা সম্মিলনকে ঘিরে যতো প্রাক্তন ছাত্রের সমাগম ঘটে, সবাই মিলে প্রিয়প্রাঙ্গনটিকে আরো উঁচুতে তুলে ধরবার ভূমিকা রাখবার নিয়ম নীতি নির্ধারণে এর চাইতে ভালো সুযোগ ও প্রেক্ষিত আর কি বা কখন !

পুনর্মিলনীকে ঘিরে তৈরি হোক আমাদের দায় ঘুচিয়ে ‘আলমামাতের’কে অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠানের সামাজিক অবস্থান ও ঐতিহ্যে সবার সামনে থাকবার পথ মজবুত করবার সুযোগ ও পন্থা।

সব প্রাক্তন ও বর্তমান ক্যাডেটদের জন্য তিন উল্লাস ! সব ক্যাডেট কলেজের জন্য তিন উল্লাস ! ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য তিন উল্লাস !

লুৎফুল হোসেন
০৮ নভেম্বর ২০১৭

(লেখাটি সদ্য সমাপ্ত ফৌজদারহাটের হীরক জয়ন্তী পুনর্মিলনী উপলক্ষ্যে মুদ্রিত প্রকাশনায় ভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত।)

৮,১৫৩ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “~ শিকড় থেকে শিখর যাত্রার ইতিবৃত্ত ~”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    অনবদ্য.... অসম্ভব ভালো, সুগঠিত, তথ্যসম্বলিত, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেন্দ্রীক লেখাটার জন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাই। আপনার আশা আর আমাদের কামনার প্রতি একাত্মতা ঘোষনা করি আমরা সবাই।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।