আহারে সোনালী দিন !

বেজোড় ক্যাডেট নাম্বার হলেও হিউম্যানিটিজে পড়ার সুবাদে সাড়াটা ক্যাডেট লাইফ বি ফর্মেই কাটাতে হয়েছে। মাঝে মাঝে তিন জনের জন্য ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহৃত ছোট্ট খুপড়িটিও বিশাল মাঠ মনে হত স্কেল আর কাগজ দিয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য। ঘুমের জন্য ওই রুম টার চেয়ে শান্তির জায়গা মনে হয় নিজের হাউজের রুমটাও ছিল না। রাতে তো ঘুম আসে না, ঘুম আসে টিচার দেখলে। আর সেই সময়ে ওই ছোট্ট রুমটার বিকল্প আর কোথাও ছিল বলে মনে হয় না। একদিন ভিপি স্যার তিনবার ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলেন। অবশ্য ডাকার ৩ মিনিট অতিবাহিত হবার আগেই আবার আমরা নিদ্রাদেবীর কোলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজ অফিসে বসে ভাবি, আহা ! বড় সুখের দিন পার করেছি ! নিদ্রাদেবীর কথা চিন্তা করতেও বুকের পাটা লাগে।

এমনি এক ক্লাস টুয়েল্ভএর বি ফর্মে। সময়কাল সম্ভবত ২০০৫ এর শেষের দিকে অথবা ২০০৬ এর প্রথমে। তখন দুনিয়ার তাবৎ প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বীরদর্পে কলেজ শাসন করছি। নিজেকে প্রেসিডেন্ট বুশের চেয়েও বড় ক্ষমতাধর মনে হত। রাজ্য শাসনে নিজের অবস্থান আলাদা করতে নিজেদের রুমে তালা লাগাই, রাত বিরেতে হাউসের বাইরে ঘুরে বেড়াই, স্টাফরা সমীহ করে চলেন, কোন সমস্যায় প্রিন্সিপাল স্যার প্রিফেক্টদের ডেকে কথা বলেন, দাবী আদায়ে হাঙ্গার স্ট্রাইক করে বসি। আহা কি রঙের দুনিয়া!  দুনিয়াটা যে সেই ৩৬ একরে বাঁধা পড়েছে। সেই রাজ্যে যে সুলতান মাহমুদ অথবা চেঙ্গিস খানদের মত দুই একজন হানা দিত না, তা নয়। তখন নিজেকে মুষিকের চেয়েও অধম মনে হত। তেমনি মুষিক ছানার অনুভূতি দিতে রোবট খ্যাত বাতেন স্যার বি ফর্মের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই বলে, তোমাদের সব রুমের নাম্বার একেকটা কাগজে লিখে সেই কাগজ দিয়ে রুমের চাবি মুড়িয়ে এখানে দিয়ে যাও। চাবি চাইবার অর্থ আমরা ততদিনে খুব ভালো ভাবেই জেনে গিয়েছি। সবার চোয়াল তখন মাটির সাথে গড়াগড়ি খেতে দেখে স্যার আবার তাড়া দিলেন, কি ব্যাপার তাকিয়ে আছো কেন? চাবি দাও।  ধাতস্থ হতে কিছুক্ষন সময় লাগলেও রিএক্ট করতে সময় লাগেনি। একেকজন মিনিমাম দুই থেকে তিনটি করে রুমের চাবি এবং কোথায় কি আছে সেই ইনফর্মেশন নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে দৌড় হাউসের দিকে। সামনের দুই তিন সারিতে যারা বসেছিল তারা নড়তে পারেনি।

হাউসে এসে তালা খুলেই আগে একটানে বোর্ডপিন দিয়ে লাগানো টেবিল ক্লথ সরিয়ে দেখি ২০-৩০ টা গ্রামীন ফোন, বাংলালিঙ্ক, একটেলের রিচার্জ কার্ড। সবগুলো নিয়ে টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিলাম। ট্রাভেল ব্যাগ তখন রুমেই রাখি। সেটা খুলে ক্যামেরা রেখে এলাম টয়লেটের ফ্ল্যাশের উপরে। মানিব্যাগ বের করে টাকাগুলো পলিথিনে ভরে ফ্ল্যাশের ভিতরে। আর মানিব্যাগ নিজের পকেটে রাখলাম। হাউস থেকে বের হলে পকেট তো আর কেউ চেক করবে না। পার্সোনাল ড্রেস যেগুলো ছিল, সেগুলো রেখেই এলাম। দেখলে দেখুক। মোবাইলের চার্জার জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। পরে তুলে আনা যাবে। এসব করতে দেড় থেকে দুই মিনিট টাইম লেগেছে বড়জোর। তারপর মোবাইল টা পকেটে নিয়ে এক ভোঁদৌড়। উদ্দেশ্য যত তাড়াতাড়ি আবার একাডেমি ব্লকের ফর্মে পৌছানো। বের হয়ে দৌড় দিয়ে ডাইনিং হল পার হয়ে দেখি মুক্তমঞ্চের সামনে কিছু ক্যাডেট ব্যান্ড পজিশনে। তাঁর সামনে সিংহমূর্তি ধারন করে তাকিয়ে আছে ঠিক আমিসহ আরো যে দুই একজন আছে তাদের দিকে। যা হবার তা তো হয়েই গেছে ভেবে দৌড় রেখে হাটা শুরু করলাম। এখন পকেটে যা আছে তাই নিয়ে আবার টেনশনে পড়ে গেলাম। মানিব্যাগ আর মোবাইল। কি করি? পাশে তাকিয়ে দেখি গোলাপ গাছের নিচে কিছু ভাঙ্গা কাপ-পিরিচ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ঝটপট তা সেই ভাঙ্গা পিরিচ দিয়ে ঢেকে রেখে কত নং গাছের নিচে রাখলাম হিসেব করেই হাটা দিলাম। ওহ ফাক। পকেটে এখনো মানিব্যাগ। এবার আরেকটা গোলাপ গাছের নিচে মানিব্যাগটা ছুড়ে দিতেই হসপিটাল থেকে মেজর মাহবুব স্যারের চিৎকার, এই ছেলে দাড়াও। আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম, আমি শ্যাষষষষষ… স্যার কাছে এসে গাছের নিচ থেকে মানিব্যাগ তুলে নিয়ে ভিতরে দেখেন তিন চারটা অব্যবহৃত রিচার্জ কার্ড। (সাথে ৫-৬টি সিম কার্ড ছিল, যা স্যার তখনো দেখেন নি) স্যারের আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না যে, এই ছেলের রুমে কি আছে। স্যার অতিদ্রুত আমার রুম নং লিখে নিলেন। তারপর যেতে বলতে দেরি ছিল, হাটা শুরু করতে একমুহুর্তও দেরি করিনি। এসে দেখি হ্যান্ডস ডাউন হওয়া অভাগাগুলো আমাদেরই ফ্রেন্ড, আমার আগেই হয় হাউস থেকে বের হয়ে অথবা একাডেমি ব্লক থেকে বের হয়ে এডজুটেন্টের হাতে ধরা পরেছে। কি আর করা, নিজেও যোগ দিলাম (দিতে হলো আর কি 😛 ) তারপর এডজুটেন্ট একটু সরে যেতেই স্টাফকে বললাম, এত নং গাছের নিচে মোবাইল আছে, নিয়ে আপনার কাছে রাখেন স্টাফ। স্টাফ খুঁজে এসে বলে, ওই গাছ কেন আশেপাশের কোন গাছের নিচেও মোবাইল নাই। আমি তো থ। আইতে আইতে মোবাইল গায়েব? :O

পরে অবশ্য আমি ওইটা পেয়েছিলাম। স্টাফ গাছের নিচেই দেখেছে আসলে কিন্তু পিরিচের নিচে আর দেখেনি। ফর্মে ফিরে এসে দেখি তিতুমীর হাউসের পোলাপান নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন ফিসফাস করছে। পাত্তা দিলাম না। হয়তো এমন কিছু হবে যা কাউকে বলতে চায়নি। যাউকগা, থাক। গোপনই থাক। তারপর একাডেমী টাইমের পর হাউসে এসে আসার পর দেখি, আমার রুম পুরা লন্ডভন্ড, বইয়ের ফাকে ফাকে পর্যন্ত চেক করা হয়েছে। ফলাফল, আমার রুমমেটের অতি সিকিওর যায়গায় রাখা ক্যামেরাটা ধরা পড়েছে। কিছু মোবাইল কার্ড এবং বিভিন্ন কোম্পানীর ৫-৬ টি সিম কার্ড (মানিব্যাগের সাথে) ছাড়া সব ঠিকঠাক আমার। সেগুলো জমা রাখা হলো হাউস স্টোরে। সেদিনই প্রয়াত হাউস বেয়ারার মনির ভাইয়ের সাথে ভালো সম্পর্কের খাতিরে আরেকজনের অপ্রয়োজনীয় ২-৩ টি সিমকার্ড লক করে রেখে এলাম আর আমার কয়েকটা নিয়ে আসলাম। পরের দিন পড়লাম মাইনকার চিপায়। পৌরনীতির এক স্যারের (নাম বলছি না) সুন্দরী মেয়ে থাকার দরুন রাত বিরেতে ফোন যেত স্যারের নম্বরে। সে ফোন মেয়েই ধরুক আর মেয়ের বাপই ধরুক, ফোন করা থেমে যেত না। আমার কাছে এতগুলো সিম পাওয়ার পর, স্টাফ লাউঞ্জের আলোচনার টপিক, এই ছেলে নিশ্চিত মোবাইল ফোনের ব্যবসা করত। :/ আর সেই স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর মোবাইলে রাত বিরেতে অনেক গুলো নম্বর থেকে যাওয়া কল গুলোর হোতা আমি। কিন্তু সরাসরি না ধরে তো আর কাউকে চোর বলা যায় না। তাই স্যার আমার অজান্তে সিম গুলোর নং বের করতে গিয়ে দেখেন সেগুলো লক করা। অগত্যা তাঁর ভুল ভাঙ্গানোর জন্য সবগুলো সিম আবার খুলে দিতে হলো।

আমার মাথায় তখন ঘুরছে প্রিন্সিপাল স্যারকে কি বলবো? এতগুলো কার্ড আর সিম পাওয়ার পরও যদি বলি যে , আমার কাছে মোবাইল ফোন নেই তাহলে নিশ্চিত আমাকে পাগল ঠাওরাবে। যুক্তি তো আমার কাছেই ধোপে টিকছে না। আমার জন্য শাপেবর হয়ে আসলো আরেক বন্ধু জাহিদ। সে তখন হসপিটালে। বেচারা ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টের পায় নাই। পরেরদিন এটেন্ডেন্ট এসে তা নিয়ে সোজা, মেডিকেল অফিসারের রুমে। সেটাও প্রিন্সিপাল পর্যন্ত গেল। জাহিদ এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার মোবাইলের কথা বলবো না। বলবো, জাহিদের টাতেই সিম কার্ড তুলে কথা বলেছি। সাথে কার কার সাথে কথা বলেছি সেটারও একটা লিস্ট মনে মনে তৈরি করে নিলাম। প্রিন্সিপাল স্যার ডাকার পর প্ল্যান মাফিক সবকিছু হল। আমার নিরীহ গোবেচারা দৃষ্টিতে সব কথা গড়গড় করে স্বীকার করে নেয়াতে স্যার ভেবে নিলেন, আমি সত্যি কথাই বলেছি। কিন্তু জাহিদকে স্যার বলে দিলেন, তোমার জরিমানা করছি এই জন্য যে, তুমি মাহমুদুলের মোবাইল গোপন করাতে সাহায্য করেছ। তাঁর দিন কয়েক পরে হাউসে ইডি সমেত জরিমানা এবং প্যারেন্টস কলের নোটিশ ঝুললো। আমার নামের পাশে সিম কার্ড এবং ক্যামেরা রাখার দায়ে ৩০০০ টাকা জরিমানা, ৩ টা ইডি এবং প্যারেন্টস কল (যতদূর মনে পড়ে)। আমার রুমমেটের ক্যামেরার জরিমানাও আমাকে ??? :O 😛 😛 আমার রুমমেট তখন খুশিতে বগল বাজাচ্ছে।

যাই হোক ফিরে যাই মূল ঘটনায়। রুমে ফিরে কার ক্ষতিগ্রস্থতা কতটুকু তা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করছি। কার কার রুমের দরজার তালা ভেঙ্গেছে, লকারের তালা ভেঙ্গেছে, কি কি প্রশাসনের হাতে পড়েছে তাঁর হিসেব নিকেশ চলছে।  হঠাৎ করে তিতুমীর হাউসে দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনে উৎসুক হয়ে কান খোলা রাখলাম। ওটা আসলে সেলিব্রেশন ছিল। কানের পাশ দিয়ে একটা বুলেট বের হয়ে যাবার সেলিব্রেশন।  যখন খবরটা পেলাম নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। এ কিভাবে সম্ভব? ….. নম্বর রুমের চাবি সবার আগে দিতে হয়েছিল স্যারের হাতে। এবং রুমের জিনিস পত্রের দায় দায়িত্ব কে কে নিবে সেই হিসাব চলছিল একাডেমি ব্লকে যেটাকে পাত্তাই দেইনি। সেই রুমের দরজাই কেউ খোলেনি। এই আনন্দ কোথায় রাখবে তারা? কেননা রুম খোলা হলেই, স্যার রা দেখতে পেতেন মোবাইল, ওয়াকমেন, সিগারেট কিংবা কার্ড নয় আস্ত একটা ৮ ইঞ্চি টিভি, একটা ডিভিডি প্লেয়ার, মুভির ডিভিডির পাশেই ‘বিশেষ’ ক্যাটাগরি।

১,৮৮৭ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “আহারে সোনালী দিন !”

  1. নাসিম (২০০০-০৬)

    যা কখনও ভুলে যাবার নয়। তিতুমির হাউসের উৎসবটা সেদিন আসলেই ছিল বিরাট কিছু। যে দুই রুমে সব কিছু ছিল সেই দুই রুমই কেউ খুলতে পারেনি ......... আর মজার ভিতরে ছিল আমাদের এক গোবেচারা ......... প্রিফেক্টের বালিশের নিচ থেকে চটি বই পাইয়া হউস মাস্টারের হতাশা.........


    যেমন আছি, তেমনই ভালো।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।