অশনি সংকেত-১

গত কয়েকদিন ধরেই দেখছি রাজনৈতিক অসহনশীলতার চুড়ান্ত মাত্রা। তাও আবার এমন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যাকে চাইলেই ঘায়েল করে ফেলা যায়। অন্তত বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায়। নির্দোষ স্লোগানে। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর স্লোগান আমি রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের মিছিলে শুনেছি। সিরাজগঞ্জে। ‘চাইয়া দ্যাখ খালেদা, আইতাছে তোর বাপেরা’। সেই তুলনায় সনাতনের, ‘ছি ছি হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না’ তো নির্দোষ স্লোগান। লজ্জার অনুভূতি তখনই হয় যখন ব্যক্তি নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী সাব্যস্ত করে। স্লোগানে লজ্জার অভিব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লজ্জা দেবার চেয়ে নিজের অপরাধকেই মুখ্য করা হয়েছে। জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার যে আপোষহীন চরিত্রের প্রকাশ গত কয়েক বছরে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রের অঙ্কন করেছেন তিনি জামায়াতের বি টীম হেফাজতের সাথে আঁতাত করে। তাদের অযৌক্তিক, অবিবেচনা, মধ্যযুগীয় ধারনা প্রসূত দাবীর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন মৃণাল হকের ভাষ্কর্য সরিয়ে। প্রকৃতপক্ষে এটি ‘আত্নসমর্পণ’। ভোটের রাজনীতির শ্যামও রাখতে চেয়েছেন, কূলও রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হল। হেফাজতের আত্নবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে তোলা হল। তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এয়ারপোর্ট রোডের লালন ভাষ্কর্য সরিয়ে যে প্রবঞ্চনা করেছিলেন জনগনের সাথে, তার খেসারত সারাজীবন দিতে হবে জাতিকে। আলোচিত ভাষ্কর্য পুনঃস্থাপনে তিনি হেফাজতেরও বিশ্বাস হারালেন, এদেশের চিন্তাশীল, প্রতিবাদী, শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল মানুষেরও আস্থা হারালেন। কেউ এখন তাকে বিশ্বাস করবেন না। অবশ্য বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই বিশ্বাসের বালাই ই নাই, ব্যালট বাক্স তো কোন ছার! মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা প্রধানমন্ত্রীর উপর ভরসা করে যে ভুল করেছেন তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র সেই স্লোগান। জাতিকে এগিয়ে নেবার জন্য যে প্রজ্ঞা, সাহসী নেতৃত্বের প্রয়োজন একজন নেতার কাছ থেকে তা প্রমানে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার লজ্জা এ দেশের বিবেকবান প্রত্যেকটি মানুষ বহন করে।

‘ঐতিহ্যবাহী’ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব বেশিরভাগ সময় এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তথাকথিত ‘মেধাবী’ দের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বের কাছ থেকে একটি স্লোগানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হুমকি, ধামকি, মিটিং মিছিল, অশ্রাব্য গালাগালি, স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে রুচিহীন বিষোদগার ছাত্রলীগের সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধাশীলতা এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। অতীতের কোন অরাজনৈতিক, অন্যায় অবিচারের প্রতিও তারা মুখ খোলেন নাই। নির্লজ্জ রকমের নিষ্পৃহ ছিল এই সংগঠন। পক্ষান্তরে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ সরকার বিরোধী মিছিলের একটি স্লোগানকে কেন্দ্র করে তাদের আস্ফালন, কুকুরের মত পিটিয়ে মারার হুমকি এই ছাত্রনেতাদের আসল চরিত্র প্রকাশ করে। নিজ স্বার্থ হাসিলে সন্ত্রাস এবং স্তুতি ঐতিহ্যের বাহিরে তারা যে এখনো আসতে পারেন নি তার উদাহরণ মাত্র।

আমার জানা মতে, বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইনের কোথাও বলা নাই যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার জন্য আছে কালো আইন ৫৭ ধারা, আর অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে রোধ করার জন্য আছে এক ঝাঁক সন্ত্রাসী এবং চাটুকার। এই চাটুকার শ্রেনী ব্যাপক অনুভূতি প্রবণ। সংবেদনশীল। তেতুলিয়ায় কে না কি বললো, মামলা হলো টেকনাফে। রাজনৈতিক পুলিশবাহিনী তো আছেই।

হুমায়ুন আজাদ ‘নারী’ বইয়ের চতুর্থ সংস্করণের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, ‘প্রতিবাদে আমাদের কোন সরকারই বিচলিত হয় না, অটলতায় তারা অদ্বিতীয়’।

শক্তিশালী বিরোধীদল গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য, অসীম ক্ষমতার যথেচ্চাচার রোধ করবার লক্ষ্যেই প্রতিবাদ। বাংলাদেশের কাগুজে বিরোধীদল এখন কৌতুকমাত্র। ৯ বছরের শাসনে গঠনমূলক সমালোচনা, প্রতিবাদ যা করার তা একমাত্র শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ই করেছে। যদিও সংখ্যায় তারা যৎসামান্য। প্রতিবাদের মুখোমুখি না হতে হতে তারা এতটাই সংবেদনশীল হয়েছে যে এই লঘু সম্প্রদায়ের একটি স্লোগানেই তাদের নেত্রী অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়। অথচ এই ৫৭ হাজার বর্গমাইলে প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুভূতি, সৌন্দর্যানুভূতি। খর্ব হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার। গোটা বাংলাদেশকেই এক কারাগারে পরিণত করেছে। স্লোগানের বিপরীতের রাজনৈতিক দলের আস্ফালন এক অশনি সংকেত মাত্র। ভবিষ্যতের পথ নিকষ কালো। উত্তরনের পথ রুদ্ধ।

৫,৫৮১ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “অশনি সংকেত-১”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    গোটা বাংলাদেশকেই এক কারাগারে পরিণত করেছে। স্লোগানের বিপরীতের রাজনৈতিক দলের আস্ফালন এক অশনি সংকেত মাত্র। ভবিষ্যতের পথ নিকষ কালো। উত্তরনের পথ রুদ্ধ। - একদম শেষের এই কথাগুলো ভীতিকর এবং অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। দেশের আম জনতা কি রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে? রাজনীতি কি দিনে দিনে তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে?

    জবাব দিন
    • মাহমুদুল (২০০০-০৬)
      একদম শেষের এই কথাগুলো ভীতিকর এবং অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক।

      সত্যি বলতে কী, আমি দেশটাকে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখি না। সম্ভব না। আফ্রিকার কোন দেশ পরাক্রমশালী কোন দেশ হতে পারে বিশ্বাস করি। কিন্তু এই দেশের মানুষ সভ্য হবে, নিদেনপক্ষে অপরাধীর চোখে চোখ রেখে তার অপরাধের কথা বলবে বিশ্বাস করি না। দেশের রাজনীতিবিদদের চোখের পর্দা হবে, চাটুকার রা কম তৈল মর্দন করবে এইটা বিশ্বাস করি না।

      দেশের আমজনতা আর রাজনীতি নিয়ে ভাবে না। নিজের আখের গুছোনোতে সবাই ব্যস্ত। রাজনীতিকে এখন 'সাধারণ' মানুষ বিষ্ঠার চেয়ে বেশি ঘৃণা করে। জনবিচ্ছিন্ন তো অবশ্যই। তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না বলে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।


      মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।