ঘুমন্ত শহরে, রূপালী রাতে

ভূমিকা
অনেক দিন পরে আমার ক্যাডেট কলেজের অনুজ যার ক্যাডেট নাম শফিক আর ডাক নাম অ্যাঞ্জেল । তবে ক্যাডেট নামের থেকে অ্যাঞ্জেল শফিক হিসাবে বেশি পরিচিতি। অনেকদিন পরে দেখা আর একই কলেজের প্রায় পিঠাপিঠি ব্যাচ তাই দীর্ঘদিন দেখা না হলেও হৃদয়ের এক আলাদা বন্ধনের সাথে জড়িত বলেই মন হতে দূরে যাওয়ার কোন উপায় নাই। শ্মশ্রুমণ্ডিত অ্যাঞ্জেল শফিকের দাড়িতে আবার হালকা পাক ধরেছে। এই লেবাসে অনেকদিন পরে দেখা বলে একটু চিনতে কষ্টই হচ্ছিল। কথা আর গল্পের মধ্যে কলেজের আর একজন তারই সহপাঠী রথিন এসে হাজির। আড্ডা আর তা যদি হয় একই ক্যাডেট কলেজের তখন ঘুরে ফিরে ওই সময়কার মজার মজার বিভিন্ন স্মৃতিচারণ। এরই মধ্যে আমি অ্যাঞ্জেলকে জিজ্ঞাসা করলাম যে “গান কি আর লিখিস না?“ অ্যাঞ্জেলের মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেল। তাই আর বেশি প্রশ্ন না করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম।
এল আর বি (LRB) ব্যান্ডের প্রথম হতে আজ পর্যন্ত যত গান বের হয়েছে তার মধ্যে হাতে গোনা অল্প কয়েকটি গানকে যদি নির্বাচন করা হয় তার মধ্যে অ্যাঞ্জেলের লেখা ঘুমন্ত শহরে একটি হবে তা হলফ করে বলে দেয়া যাই। এর আগেও যতবার অ্যাঞ্জেলের সাথে দেখা হয়েছে ততবারই এই চমৎকার একটা গানের পিছনের পটভূমি জিজ্ঞাসা করবো করবো করে আর করা হয়ে উঠেনি। তাই আজকে সুযোগটা নষ্ট না করে অ্যাঞ্জেলকে জিজ্ঞাসা করলাম “ তোর এই গানের পিছনের পটভূমিটা কি”? উল্লেখ্য এল আর বি (LRB) ব্যান্ডের অ্যাঞ্জেল শফিকের এই গানটা ছাড়াও আরও কিছু সুন্দর ও উল্লেখযোগ্য গান আছে। আমি কোন প্রফেশনাল লেখক নয় মনের খোরাকের জন্য মাঝে মাঝে লেখা। তাই পাঠক আশা করি ভুলগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কথা না বাড়িয়ে অ্যাঞ্জেলের মুখ হতে এই চিরসবুজ “ঘুমন্ত শহরে” গানের পিছনের পটভূমিতে বিচরণ করে আসি।

পটভূমি
তখন ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, শীতের তীব্রতা কমে এসেছে। না শীত না গরম এই রকম একটা আবহাওয়া বিরাজ করছে। ভোর পাঁচটার সময় দেখা করতে বলছে। জীবনে প্রথম প্রেমে পড়া ও প্রথম ডেটিং বলে সারারাত কত কিছু আকাশ-কুসুম জল্পনা আর কল্পনা করে দুই চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। একটু পর পর তন্দ্রা ভেঙ্গে ঘড়িতে সময় দেখছি যেন জীবনের প্রথম এই দেখা হওয়ার সন্ধিক্ষণ কোনভাবে মিস না করে ফেলি।
সকাল পাঁচটার হয়তো কিছু আগে জগিংয়ের কথা বলে চুপি চুপি ঘর হতে বের হলাম। আমার বাসা ও তাদের বাসার ব্যবধান- মাঝে শুধু একটা ছোট্ট খেলার মাঠ। বাসার পিছনে কীর্তনখোলা নদীর বিস্তৃত জলরাশি। আমি চুপি চুপি তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত। মনে করেছিলাম সকাল পাঁচটার সময় চারিদিকে হালকা আলো ছড়ায়ে ফর্সা হতে থাকবে প্রকৃতি। চারদিকে অন্ধকার, রূপালি থালার মতো মস্ত বড় চাঁদ জ্বলজ্বল করছে, চাঁদের এই গায়ে মাখানো আলো কীর্তনখোলা নদীর বিস্তৃত জলরাশির উপরে পড়েছে, নদীতে মৃদুমন্দ ঢেউয়ের উপর চাঁদের রূপালি আলো পরাতে যেন আরও বেশি চিক চিক করছে ফলে অন্ধকার রাত হয়ে উঠছে রূপালীয়। চারদিকে বাতাসে ভেসে আসছে শিশির ভেজা শোধা মাটির গন্ধের সাথে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ।
ঘুমন্ত শহরে, আমি ধ্রু ধ্রু বুকে অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেগে আবিষ্ট হয়ে গায়ে শীতের চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষায়, এই রূপালি রাতে।

অপেক্ষারত আমি তখন স্মৃতির রুমালে আলতো করে ঘষে তাজা করি- ফেলে আসা কিছু মিষ্টি স্মৃতি। একই শহরের মধ্যে হাত বাড়ানো দূরত্বে তার বসবাস। নব্বই বা একানব্বই সালের প্রথমে সবে নাইন হতে ক্লাস টেনে উঠেছি। আমি ও সে একই ক্লাসের সহপাঠী। আমার চলাফেরা ক্যাডেট কলেজের বন্ধী জীবনে আর সে বাহিরে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি। একই শহরে, একই পাড়ায় ও পাশাপাশি বাসা থাকাতে দুজনে বেড়ে উঠেছি সময় ও বয়সের হাত ধরে। ক্যাডেট কলেজ ছুটির সময়ে একই সাথে টিচারের কাছে কোচিং করা, মাঝে মাঝে রিকশায় করে বাসায় পৌঁছায় দেয়ার সময় টুকটাক কথা বলা। সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় পড়াশুনার বিভিন্ন বাহানাতে তার কাছে যাওয়া। কেন যেন শুধু এক পলক দেখার জন্য বাসার চৌকাঠে বসে কত সময় কাটিয়ে দিয়েছি তা জানি না। এই আমি, সময় ও বয়সের সাথে সাথে কল্পনাতে ভালোবাসার বীজ বুনি। সেই বীজ হতে এক সময় কখন যেন ভালোবাসার ডাল-পালা তার প্রতি মেলতে থাকে। আমার মনের মধ্যে চেপে রাখা ভালোবাসার কথা তবুও বলতে পারি না। কি এক অজানা ভয়ে বলতে গিয়েও আবার ফিরে আসি। মনের মাঝে প্রতিনিয়ত নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধ করি। যদি আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে মুরুব্বীদের নালিশ করে বা কোন সিনক্রিয়েট করে বসে। এর থেকেও বড় ভয় ছিলও- যদি আমার এই ভালোবাসাকে সে প্রত্যাখ্যান করে তা হলে নিজেকে তার সামনে দাঁড় করানো হবে অনেক অনেক লজ্জার ব্যাপার আর তাই এই শহর ছেঁড়ে অন্যত্র পালানো ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না। একদিন সব ভয়ডর রেখে একটা চিঠি লিখে ফেললাম।

বিকালে কোচিং শেষে এক সাথে ফেরার সময়, আমতা আমতা করে ওকে বলেই ফেললাম যে, “তোমার জন্য একটা চিঠি লিখেছি।“ অতিরিক্ত স্নায়ুবিক চাপে হরবর করে যা বলার না তাও বলে ফেললাম। আরও বললাম-“যদি তুমি আমার চিঠি পড়ে তোমার উত্তর “হ্যাঁ” হয় তা হলে তুমি তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেক। আর যদি তোমার উত্তর “না” হয় দয়া করে কিছু বলতে হবে না তুমি ঘরের ভিতরে চলে যেও, আমি বুঝে নিব।“ একটা লাজুক দুষ্ট মাখা একগাল মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল “দাও! তোমার চিঠি”। আমি বললাম এক মিনিট ওয়েট করো, বলেই এক দৌড়ে বাসা হতে চিঠি এনে তার হাতে দিয়েই না তাকিয়ে দ্রুত বাসার সামনে দাঁড়ালাম। এ যেন কেমন দম বন্ধ ছটফটানি আর অস্থির অবস্থায় আমি তার বাসার পানে চেয়ে আছি তার উত্তরের অপেক্ষায় ।আমি দেখতে পেলাম সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে হাতের মধ্যে চিঠিটা নিয়ে কিছুটা সময় অপেক্ষা করে এক দৌড়ে বাসার ভিতরে চলে গেল। আমি কষ্টে, লজ্জায়, সং-বেদনহীন, বোবা মানুষের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন গোধূলি বিদায়ের পালা,পাখিরা সব নীড়ে ফিরছে। আমাকে মা এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে, ডাক দিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে পড়ার জন্য তাগিদ দিল। পা আড়ষ্ট হয়ে আটকে গেছে,গলার কাছে কষ্টটা দলা পাকিয়ে আছে। কি করবো, কি করা উচিৎ, আমি পরাজিত এক সৈনিক। খুব ইচ্ছা করছে জোরে জোরে কেঁদে বুকের চাপা কষ্টটা কমাতে।
আমি তাদের বাসার দিকে তাকানো হতে বিরত হয়ে আমার বাসার দিকে ঘুরে চলে যাব। ঠিক ওই সময়েই দোতালা বাসার করিডোরে তাকে দেখতে পেলাম। মনে হল সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু সময় আগে দিক হারা,পথ হারা নাবিক। আর এখন সেই আমি যেন সাগরের বিশাল জলরাশির আর তার উন্মত্ত ঢেউয়ের মাঝে ভালোলাগার উন্মাদনায় মত্ত নাবিক। বিকালের গোধূলির যে নীলিমা তখনও সম্পূর্ণ মুছে যাইনি।

দূর হতে মনে হোল তার মুখে গোধূলি লগ্নের নীলিমার সবটুকু রঙের রক্তিম ছোঁয়ার পরশ। এ যেন এক অন্য অনুভূতি, এ যেন এক অন্য রকম ভালোলাগা, এ যেন চঞ্চল হরিণীর ন্যায় লাফাতে ইচ্ছে করা। বড় ইচ্ছে করছে, পৃথিবীর সকলকে চিৎকার করে জানিয়ে দেই “আমি তোমাকে, শুধু তোমাকে ভালোবাসি”। আমার বাসার চৌকাঠে দাড়িয়ে আমি তার চঞ্চলতা আর মহনীয়টা দেখছি। প্রথম ভালোবাসার মোহে এমনি আবিষ্ট আমি যে খেয়াল করিনি কোন সময় সে এসে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমার হাতে ছোট একটা কাগজের চিরকুট বা চিঠি দিয়ে কানের পাশে সুরেলা বাঁশির মত বলল “কালকে সকাল পাঁচটার সময় দেখা করো” বলেই প্রজাপতির মতো উড়ে এসে ছোঁয়ার আগেই ঘাস ফড়িঙয়ের মত উড়ে গেল।

মায়াবী অন্ধকারে তার বাসার সামনে অপেক্ষারত আমি স্মৃতি রোমন্থনে মগ্ন। হটাত টুক করে একটি আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি ফিরে আসি বাস্তবে। সামনের দোতলা ঘরের দরজাটা সামান্য একটু খুলে মানবীয় একটা ছায়া খুব সাবধানে বের হয়ে এলো। এ যেন নিঃশব্দে পদচারণ, এই যেন সদ্য পদার্পণ-রত কিশোর ও কিশোরীর এক জনের কাছে আর এক জনের নিঃশব্দে ভালোবাসার আত্মসমর্পণ। এই যেন চঞ্চল কিশোর আর কিশোরীর জীবনে প্রথম প্রেমের ভালোলাগা আর ভালোবাসার বাঁধন হারা উচ্ছলতার নিঃশব্দ আচরণের কারণ- কোন ভাবেই ঘুমন্ত শহরের ঘুম ভেঙ্গে বাধ না সাধে জীবনের এই মাহেন্দ্রক্ষণের।

অপলক আমি তার দিকে তাকিয়ে, এ যেন স্বপ্নের মাঝে বিচরণ। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে চাঁদটা অন্য দিন হতে বড় আর তার থেকে ঠিকরে পড়া দ্যুতি অন্যদিনের থেকে বেশি উজ্জ্বল। বিশাল এই চাঁদের রুপালি দ্যুতি এই অন্ধকার রাতকে করে তুলেছে রুপালিয়। এই সময়ই রূপালি চাঁদ আর রূপালিয় রাতের মিশ্রণের দেবী আমার সামনে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিল। এই প্রথম আমার ভালোবাসার মানুষের হাতটা ধরতে যাওয়ার আগে হৃদয়ের মাঝে অন্য রকম কম্পন, এ যেন অন্য শিহরণ, আর এই অব্যক্তয় ভালোলাগা শিহরিত স্পর্শের অনুভূতিতে দুজন দুজনের হাত বেঁধে ফেলেছি, হেঁটেছি শব্দ-হীন, বাক্য-হীনভাবে এক অজানার পথে। এ যেন সিঞ্চিত ভালোবাসার এক শীতল উষ্ণ ছোঁয়া, এ যেন কম্পিত শিহরণে অদ্ভুত ভালোলাগার এক লজ্জার আবরণে চলা, এ যেন কথা না বলেও স্পর্শের মাঝে, ভালোবাসার সরল বাঁধনে নিঃশব্দে সব কথা বলা। এ যেন নীল কুয়াশার চাদরের উপর দিয়ে শিশিরের আলতো ছুঁয়ে দেয়া, এ যেন রাতের পথিকের উৎসুক চাহনির মূল্য হীনভাবে পথ চলা, এ যেন ঘুমন্ত শহরের নিয়ন আলোর বিচ্ছুরণ আর রুপালি চাঁদের মিশ্রণে রুপালিয় এক মায়াবী রাতের প্রাণবন্ত সাদর সম্ভাষণ। নিষ্পাপ এই চঞ্চল, চপল কিশোর আর কিশোরীর ভালোবাসার রঙে রাঙানো ভেলায় ভাসছে প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্ত।

ওই সময়ের মানে নব্বই সালের প্রেক্ষাপটে এই চিঠি,এই ঘুরে বেড়ানো,ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুজনের কথা বলা আর চোখে পড়ার মত হটাত এই প্রাণবন্ত দুইজনের চলা ফেরা,এই ঘোর লাগা আবেগি সময়ে তখন বাস্তব হতে স্বর্গে বিচরণ। পাড়ার সবার মুখে মুখে কান কথা গেল রটে এবং দুই পরিবারে মুরুব্বীদের বা বড়দের চোখে অপরিপক্ব বয়সের এই ভালোবাসা যেন এক মহাপাপের কাজ। ফলে যথারীতি দুই পরিবারের কাছে এই বয়সে অপরিপক্বতার “ভালোবাসা মহাপাপে” এক সময় ঝড় আসে। এই ঝড় সামাল দিয়ে চেয়েছি দূর হতে আরও দূরে তোমাকে সাথে নিয়ে যাব আমাদের দুজনের কল্পিত স্বপ্নিল ঠিকানায়। অকারণে, অবিবেচকের মত প্রতিনিয়ত তুমি তোমার আর আমার ভালোবাসাকে ইচ্ছাকৃত-ভাবে দূরে ঠেলে দিয়েছ। আমি যতবার কাছে আসতে চেয়েছি ততবারই বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে সরিয়ে দিয়েছ যোজন যোজন মাইল দূরে। আমার ভালোবাসার সরল বাঁধন যতবারই চেয়েছি বাঁধতে আর ততবারই কোন কারণ ছাড়াই দিয়েছ ঠেলে দূর থেকে আরও দূরে। একই শহরে,একই বৃত্তে, আর হাত বাড়ালেই যেখানে তোমাকে ছোঁয়া যেত সেই তুমি আর আমি আজ ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। তুমি যেমন আছো আমার স্মৃতিতে, আমি জানি ঠিক তেমনি আমিও আছি তোমার স্মৃতিতে।

তোমার কি মনে পড়ে? বিকাল বেলাতে তোমার বাসার পিছনে নির্জন নদীর পারে হেঁটেছি তোমার পাশে পাশে আবার কখনও তোমার হাতটা ধরে। মাঝে মাঝে উদ্দাম হাওয়া আর আমি বলতাম দুষ্ট হাওয়া এসে তোমার খোলা চুলগুলোকে অগোছালো করে দিত আর তুমি প্রাণপণ তা ঠিক করতে চেষ্টা করতে। আমি আনমনে তোমার ওই চুল ঠিক করা দেখতাম, তুমি কপট রাগ করতে আর বলতে “কি দেখ এত?”

তোমার কি মনে পড়ে? কীর্তনখোলা নদীর পাশে সবুজে ঘেরা পার্কে তোমাকে নিয়ে কতবার গিয়েছি। পাশাপাশি বসে কথা বলার সময় নদীর দুষ্ট হাওয়াতে তোমার ওই অবাধ্য চুল উড়ে এসে পড়ত আমার মুখে। তুমি প্রাণপণে চেষ্টা করতে অবাধ্য চুলকে শাসন করতে আর আমি তার থেকে বেশি মনে মনে চাইতাম তোমার ওই অবাধ্য চুলের স্পর্শ আমার মুখে। আজও আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি ওই অবাধ্য চুলের স্পর্শ ।

তোমার কি মনে পড়ে? বিভিন্ন নোট খাতার বা বইয়ের মধ্যে চুপিচুপি করে চলত তোমার আর আমার ভালোবাসার চিঠির আদান প্রদান।তুমি মাঝে মাঝে চিঠির মধ্যে পাঠাতে গোলাপের পাপড়ি,আর গোটা গোটা হাতের লেখা চিঠির কথা মালা আজো আমাকে ভাবায়,আমাকে কাঁদায়। সময়ের স্রোতে আমি নিজেকে বিন্দু বিন্দু করে,গভীর হতে গভীরভাবে আমার সবটুকু ভালোবাসাকে উজাড় করে তোমায় সঁপেছিলাম।

বাকহীন দুই সদ্য কিশোর কিশোরীর রুপালী চাঁদের উজ্জ্বল দ্যুতির আলোতে হাত ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে থাকা, জীবনে প্রথম ভালোবাসার মানুষের সাথে চুপিচুপি সবার চোখের আড়ালে ঘুমন্ত শহরে মাঝে নিজেকে অন্যভাবে পাওয়া, জীবনে প্রথম ভালোবাসার শিহরিত স্পর্শ, উৎসুক কোন রাত জাগা পথিককে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে, শহরের নিয়ন আলো মাড়িয়ে দুজনে দুজনের হাতে হাত রেখে উদ্দেশ্যহীনভাবে কোন নির্জন গন্তব্যর দিকে এক অব্যাখ্যায় অনুভূতির সাথে চলতে থাকা আর সেই সাথে চাঁদের উজ্জ্বল মায়াময় রুপালী আলোতে চোখে ভাসে তোমার সারা মুখ জুড়ে লজ্জা-স্নাত রক্তিম আভা।
আজও আমার হৃদয়ে চির সবুজ সেই মায়াবী রুপালী রাতের প্রথম ভালোবাসার স্মৃতি।
জীবনের ব্যস্ততম স্রোতে গা ভাসিয়ে তোমায় ভুলতে চেয়েও না ভুলতে পারার কষ্ট।। আমার খোলা জানালা দিয়ে ঘরের মাঝে খেলা করে রূপালী আর মায়াবী স্নিগ্ধ আলো কিন্তু তুমি থেকেও নাই কেননা তোমাদের বাড়িটা আজও আছে দৃস্টির কাছাকাছি। সময় অসময়ে তোমাকে এক ঝলক দেখার জন্য বাসার চৌকাঠে বসে কত সময়ই না ব্যয় করেছি। তোমার অভাবে অস্থির আমি বড় একা, বড় বেশী নিঃসঙ্গ আর সজল চোখের পাতা নিয়ে সেই একই চৌকাঠে বসে বিনিদ্র যাপন করি আর স্বপ্নের জাল বুনি, হয়ত ভুল ভেঙ্গে তুমি আসবে ফিরে আমার এই আঙিনায়… তোমাকে জানাবো আমার শেষ কথা যদি হয় দেখা এই রূপালী রাতের উজ্জ্বল দ্যুতিতে। তুমি আছো, তুমি থাকবে, আমার স্মৃতির ভালোবাসার সেই ঝলমলে রূপালী রাত হয়ে হৃদয়ের ঘুমন্ত শহরে….

গানের কথাগুলো

ঘুমন্ত শহরে, রূপালী রাতে,

স্বপ্নের ও নীল চাদর বিছিয়ে,

কষ্টের শীতল আবরণ জড়িয়ে

আমি আছি, আছি, তোমার স্মৃতিতে

ভালবাসার সরল বাধন ছিঁড়ে,

চলে গেছ এই হৃদয়টাকে ভেঙ্গে

তুমি আমি একই শহরে

তবুও একাকী ভিন্ন গ্রহে।

মনে পরে সেই নিয়ন জ্বলা রাতে,

অনন্ত প্রেম দিয়েছি উজাড় করে,

নিঃসঙ্গ নিশি পথিক পেছনে ফেলে

পথ হেঁটেছি বাধা দুটি হাতে।

দূর আধারের ভালবাসায় হারাতে,

ছুটে ছিলাম সেই রূপালী রাতে।

এই রাতে সব প্রেম হারিয়েছি অকারণে

নিশি-ব্যস্ত মানুষ হয়েছি কেমনে?

সমুদ্র কোলাহলের মত অবিরাম ক্ষণে

নগরের যত বিষাদ আমাকে ভর করে

দরজার চৌকাঠকে পিড়ি বানিয়ে,

বিনিদ্র জেগে আছি এই রূপালী রাতে।

ঘুমন্ত শহরে, রূপালী রাতে,

স্বপ্নের ও নীল চাদর বিছিয়ে,

কষ্টের শীতল আবরণ জড়িয়ে

আমি আছি, আছি, তোমার স্মৃতিতে

ভালবাসার সরল বাধন ছিঁড়ে,

চলে গেছ এই হৃদয়টাকে ভেঙ্গে

তুমি আমি একই শহরে

তবুও একাকী ভিন্ন গ্রহে।

 

৮,৬৪৭ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “ঘুমন্ত শহরে, রূপালী রাতে”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    অনেক দিন পর মোকাররম ভাই।
    ঘুমন্ত শহরে গানটি যেকোন তরুণ-তরুণী-মধ্যবয়সীদের প্রিয় গান। এল আর বি র ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান।
    এনজেল শফিক ভাই, সাইফুল্লাহ রথিন ভাই এর সাথে আড্ডা আর সর্বোপরি গান এর পিছনের কথা সামনে নিয়ে আসার জন্য সাধুবাদ।

    আমারো প্রশ্ন শফিক ভাই গান লেখেন না ক্যানো আর!!!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    এল আর বি র আরো অনেক অনেক ভালো ভালো গান বাপ্পী (৭ম) ভাই এর লেখা।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. খুব ভাল লাগলো ঘুমন্ত শহরের পেছনের ইতিহাস জানতে পেরে।ভবিষ্যৎ এ আরও লিখা দেখতে চাই।মোকাররম ভাইকে ধন্যবাদ তার সুন্দর এবং নস্টালজিক লিখার জন্য।

    জবাব দিন
  4. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    মোকাররম, বন্ধু অসাধারন লাগল পড়তে। এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেলতে মন চাইছিল। তা পারিনি কিন্তু পড়া শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্থি পাচ্ছিলাম না। কি যে মনোমুগ্ধকর, মন ছুয়েঁ যাওয়া তোর লেখা.... গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের এত অতি চেনা যে সব কিছু চোখের সামনে ভাসছিল, মনের গহীন থেকে উপলব্ধি করলাম। শফিক যে সাডা জাগানো এ গানের স্রষ্টা তা জানতাম, কিন্তু নেপথ্যের কাহিনীটা জানতাম না, অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুঁটিয়ে তুললি তুই। ভাল থাকিস বন্ধু।

    জবাব দিন
  5. আজিজুল হাসান দুলু

    অসাধারন লেখা। গানের পটভূমি একটি গল্পে রুপ নিয়েছে। এত আবেগ দিয়ে পটভূমি লেখা যায় না পড়লে বুঝতে পারতামনা।
    তবে অর্থমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারে যারা এত ভাল লেখা আপলোড দেবে তাদের ১৫% ভ্যাট দিতে হবে।

    জবাব দিন
  6. অনবদ্য!
    বিষয়বস্তু, লেখনী ও পরিস্ফুটন প্রশংসার দাবী রাখে।
    নিঃসন্দেহে লেখক তার পরিবেশনায় পাঠক দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। পেশাদারিত্ব কাকে বলে জানিনা, তবে লেখাটাকে হয়ত 'কথাশিল্প' বলা যেতে পারে।

    দোস্ত, তোর সহজাত এহেন মেধাচর্চার সমৃদ্ধ-ভবিষ্যৎ কামনা করছি।

    জবাব দিন
  7. মোস্তফা জামাল (১৯৮৫-৯১)

    অনবদ্য কথাশিল্প!
    বিষয়বস্তু, লেখনী ও পরিস্ফুরণ প্রশংসার দাবী রাখে।
    লেখক সার্থক যখন তার লেখা পাঠক মনোযোগ আকর্ষণে সফল।
    বন্ধু, তোর সহজাত এহেন মেধাচর্চার সমৃদ্ধ-ভবিষ্যৎ কামনা করছি।

    জবাব দিন
  8. জিহাদ (৯৯-০৫)

    এই গান শুনলে কলেজের কথা মনে পড়ে। মোটামুটি সব ব্যাচই ব্যান্ড শো তে এই গানটা পারফর্ম করতো। কিন্তু এর লিরিকস যে একজন এক্স ক্যাডেট এর লেখা সেটা জানতাম না। আচ্ছা, শেষ পর্যন্ত তাদের কি আর একসাথে থাকা হয়নি? গানটা কোন ক্লাসে থাকতে লেখা? কীর্তনখোলার পাড় থেকে উঠে আসা একজনের সাথে এল আর বি র যোগাযোগটাই বা কিভাবে হলো? প্রশ্নের উত্তরগুলো জানার জন্য মনটা উশখুশ করছে!


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
    • মোকাররম আহমেদ (৮৫-৯১)

      প্রিয় জিহাদ, তোমার মন্তব্য জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ। অ্যান্জেল শফিক পৈতৃকভাবে বরিশালের। বাবা একজন উচ্চ পদস্হ সরকারি চাকুরীজীবি ছিলেন।
      ঢাকার মগবাজার এলাকা বাংলাদেশের এক সময় বাংলা গানের তীর্থ ভূমি ছিল। অ্যান্জেলের জীবনের একটা সময় হতে অদ্যাবদি এই তীর্থ ভূমিতে সবার সাথে কম বেশী চলাফেরা তার থেকেও বর কথা লেখার প্রতি তাঁর নেক/আগ্রহ যা আরোও সুন্দর করেছে "এবি" সুর।
      কিছু জিনিস, কিছু স্মৃতি থাকে যা তুলে রাখে অতি যতনে, অতি সংগোপনে, যার উত্তর সেই জানে.... যে ভাবে তুমি কল্পনা করে নিতে পার...

      জবাব দিন
      • In class IX, i first heard "ঘুম ভাঙা শহরে" on btv band show performed by AB (lyric by Shahid M Jongi) on behalf of Souls. That was just few moments before  AB left the band Souls. The was sole creation of AB. No bangla songs have ever moved me like this song. Countless guitar tracks by AB along with the voice & tune that held me spellbound... specially that was 1st of guitar progression based song that i still sing in my mind.

        Then I just thought in my fragile young child's egg shell mind that আহা এই মিউজিসিয়ান তারকার সাথে এমন একটি গান কোনদিন করতে পারলে যে কারো জীবনে গান শোনা সার্থক হতো....But that's not literally possible rather was just the dream imagination like we have many where sky is limit.

        ...yet Allah is most kind and one day "ঘুমন্ত শহরে" was born. Though "ঘুম ভাঙা শহরে" is forever the #1 track of my soul, একটি কিশোর ছেলে একাকী স্বপ্ন দেখেছিল...
        greatful to Allah & thankful to AB as that dream came true....

        জবাব দিন
    • মোকাররম আহমেদ (৮৫-৯১)

      এ্যাঞ্জেল, মানুষ গান লেখে কিন্তু খুব কম সৌভাগ্যবান মানুষ থাকে যাদের গান সব প্রজন্ম শুনে। তুই সে দিক থেকে একজন সৌভাগ্যবান মানুষ। গল্পের ছলে বা আড্ডার মাঝে তোর এই গানের পিছনের ঘটনা শুনে আমার যেমন ভালো লেগেছে ঠিক তেমনি যারা পড়েছে তাদেরও ভালো লাগার কথা। যদিও বা আমি কোন প্রফেশনাল লেখক না তবুও বলতে পারি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখি নাই। পাঠকরাই একমাত্র বলতে পারবে কতটুকু সার্থক এই লেখা। ভালো থাকিস।

      জবাব দিন
  9. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অনেক কিছুর পিছনের গল্পগুলি এরকম চমকপ্রদ।
    কিন্তু "পেছনের গল্প" বলে সেগুলি চিরটা কালই লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যায়।
    এই গল্পটার সৌভাগ্য যে সে তোমার হাতে পড়ে আলোর মুখ দেখলো।
    আর কাজটা যে খুবই মুন্সিয়ানার সাথে করেছো, সেটা বলতেই হচ্ছে...

    এরকম আরও কোনো গল্প পেলে শুনিও।
    অপেক্ষায় থাকবো.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • মোকাররম আহমেদ (৮৫-৯১)

      পারভেজ ভাই কাম বড় ভাই,
      আচ্ছালামুয়ালাইকুম। আমি অন্য ব্লগে আমার অন্য লেখা পড়ার অনুরোধ করছিলাম কিন্তু দেখলাম আপনি পড়েছেন ও মন্তব্য করেছেন। এই জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আবারও যদি এই রকম লেখার সুযোগ পাই তা হলে অব্যশই চেষ্টা করবো তা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। অনেক শুভেচ্ছা রইল।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তফা জামাল (১৯৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।