টিটোর গপ্পোঃ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের স্মৃতি

আমার ছোটবেলায় দেখা অনেক কিছু এখন আর দেখি না। সামাজিক আচার, খাবারদাবার,উৎসব, গালগপ্পো এ রকম অনেক ব্যাপার স্যাপার মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার বাচ্চাদের সাথে কথা বলেই বুঝতে পারি – এক সময় এসব কেউ বিশ্বাস করবে না। জীবন্ত ফসিল হবার দায় থেকে লিখতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছি। শুরুটা কি দিয়ে করব?
ছোট বেলা থেকেই শুরু করি। আমি যে স্কুলে পড়া শুরু করি তার নাম- লোকমানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। লোকমানপুর হাইস্কুলের একটা চয়রি টিনের ঘরে ছিল স্কুলটা। চারদিকে খোলা একটা বড় ঘর। খয়ের গাছের আঁকাবাঁকা খুঁটি, উপরে পুরোনো ফুটো টিনের চাল। বৃষ্টি আসলে বই খাতা শুকনা কি চেষ্টাই না করতাম! ছোট বড় ওয়ান টুর ছুটি হলে থ্রি এসে ফাঁকা বেঞ্চে বসতো। তার আগে তারা ফোর এর সাথে কিভাবে ক্লাশ করতো এখনও ভেবে পাইনা। এক বার একুশে ফেব্রুয়ারিতে বুবুদের সাথে হাইস্কুলে গেছিলাম, খালি পায়ে। শপথ পাঠ শেষে কফিলুদ্দি বিস্কুট খেতে খেতে গিয়েছিলাম কৃষ্ণা ফার্ম। পথে দেখা সব পাদুকাধারিকে খালি পা করেছিলেন ৬ষ্ঠ- ৮ম শ্রেণির বুবুরা। সাইকেল আরোহীরাও রক্ষা পায়নি। বেশ মজা লাগছিল। তখন সবচাইতে বড় বিনোদন ছিল স্বাধীনতা দিবস উদযাপন আর তার প্রস্তুতি। লোকমানপুর স্কুলের বিএসসি জলিল স্যার ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণ। স্যার এখনও বেঁচে আছেন, শিক্ষকতা চলছে, মাথার চুলগুলো আর মনের জোশ হারিয়ে গেছে। নাচ গান নাটক এর রিহার্সেল গপগপ করে গিলতাম। অনুষ্ঠান স্কুল ফাণ্ড থেকেই করা হত। চাঁদাবাজি দেখিনি। সাতসকালে জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকা উত্তোলন। তার পর দৌড়, লাফ, মোরগ লড়াই, তিনপায়ে দৌড়, বস্তা দৌড়, ধিরগতিতে সাইকেল চালনা, বিস্কুট দৌড়, সুঁচে সুতা পরানো, মার্বেল চামচ দৌড়, মাথায় পানি ভরা কলস নিয়ে দৌড় এসব দেখতে দেখতে দুপুর। খাবার বলতে বরফ, কাঠি লজেন্স, বাদাম আর বিস্কুট।বরফ ছিল দুই রকম আলতা রঙা পানি বরফ আর সাদা দুধ বরফ। কাঠি লজেন্স হল বাঁশের কাঠিতে কটকটে গোলাপী রঙা মিষ্টান্ন। বিকালে সাংস্কৃতিক বা বিচিত্রা অনুষ্ঠান। কোন বড় কর্মকর্তা অতিথি হলে বুনোফুলের মালা দিয়ে বরণ এবং গম্ভীরার মাধ্যমে দাবি জানানো। লিচু চোর, কবর, মানুষ, নারি এসব কবিতার জয়জয়কার। “জলকে চললো কার ঝিয়ারি” কেউ না কেউ নাচবেই। আর এক জন মাইকে সেটা গাইবে। গায়ক গালাগাল ছাড়া অন্য পুরস্কার পাবে না কোনমতেই। অনুষ্ঠান কেমন ছিল সেই আলোচনায় দু মাস পার। আহা কেমন ছিল দিনগুলি।এখনকার স্বাধীনতা দিবস পালন হয় উপজেলা সদরে। লাখখানেক টাকার অনুষ্ঠান করতে বরাদ্দ হয়তো হাজার তিনেক। মার্চ পাস্ট করতে আসা ছাত্র ছাত্রীদের নাস্তার খরচ ও করা যায় না। স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করতে গিয়ে নির্বাহীদের মানিব্যাগ মোটাতাজা হয় এমন অভিযোগ বছরে দুবার হয় এখন। প্রবল শীত কিংবা প্রচণ্ড গরমে কচিকাচাদের সেলাম গ্রহণ করে তাদের ধন্য করা হয়। অতঃপর কিঞ্চিত কসরতের সাথে নৃত্য গীত। সেই নেত্তগীতের সাথে স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের সম্পর্ক কতটা থাকে তা নিশ্চয় করে বলতে পারি না। খরচাপাতি যতই হোক এখনকার অনুষ্ঠানের চেয়ে কাঠিলজেন্সের আমলের স্বাধীনতা দিবসের খেলা বা বিচিত্রা অনুষ্ঠান বহুগুনে ভাল ছিল। উপজেলা কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আমরা কতটা হারিয়েছি? এখন কোন স্কুলকে অনুষ্ঠান করতে বললে হয়তো লসের হিসাব দিয়ে অনুদান চাইবে। কখন যে হাতপাতা শুরু করেছি বুঝতেও পারিনি। অন্যের কিছু কেড়ে নেয়া বা করুনা গ্রহন করাটা সম্মানের মনে হয়। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আগের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে জয়বাংলা শব্দটাও শুনতে পেতাম না। একবার “জয়বাংলা বাংলার জয় ” মাইকে বাজানয় দপ্তরিকে
খুব ধমকেছিলেন এক স্যার। ঐ গান বাজালে না কি চাকরি চলে যাবে।এত সুন্দর একটা গান বাজালে চাকরি যাবে কেন? বুঝতে পারিনি কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহসও ছিলনা তখন।

(১০/০৬/২০১৫)

© মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান

১০,১৪৩ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “টিটোর গপ্পোঃ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের স্মৃতি”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂

    ওয়েলকাম ব্যাক, ভাইয়া! আশা করি এখন থেকে নিয়মিত লেখালেখি করবে সিসিবিতে।

    ছেলেবেলার সুরভি ফিরে ফিরে আসে মনে! তোমার স্মৃতিচারণ পড়ে ভাল লাগলো।

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    খুব ভালো লাগলো মোস্তাফিজ ভাই। ইতিহাসকে তুলে নিয়ে আসলেন আর শেষ লাইনে এলো ইতিহাসের দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস।

    ডায়াবেটিস নিয়ে মোটেও ঘাবড়াবার কিছু নেই। নিয়ম মেনে চললে দেখবেন আগের চেয়ে ভালো আছেন।

    জবাব দিন
    • টিটো মোস্তাফিজ

      আমার লেখার চাইতে তোমার মন্তব্য সুন্দর নূপুর। আমি আসলে মানসিকতার বিবর্তন বুঝাতে চাচ্ছিলাম। লেখাটা শেষ করতে পারিনি। অসমাপ্ত অংশ অন্য কারও চোখে বা লেখায় পাব আশা করি। নিউরনে ঝড় উঠাতে পারলে ভাল হত কিন্তু অতটা জোর নেই আমার 🙁
      ডায়াবেটিস নিয়ে আমার পরিবারে মা * ম শুরু হয়ে গেছে :(( শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা :hatsoff:


      পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

      জবাব দিন
  3. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    চমৎকার। আমাদের ছোটবেলায় কিছুটা ছিল বোধ করি। এখনকার অবস্থা জানি না।

    আপনার লেখা পড়ার সময় শৈশব দেখতে পাচ্ছিলাম।

    ডায়াবেটিকে ঘাবড়াবেন না ভাই। ইয়ে, আমি কিন্তু ডাক্তার নই। 😛


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : অরূপ (৮১-৮৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।