নিহোন এর দিনলিপিঃ শেষ পাতা

২৮.০২.২০০২

০৭.৫০ খুব ক্ষুধা লেগেছে। অথচ কাংগোফু ( নার্স) এখনও খাবার নিয়ে আসেনি। ০৮.১৫ কলম হাতে নিয়ে ডায়েরীর পাতা উল্টাতে শুরু করতেই দরজায় নক। : হাই : ওহাইও গোজাইমাছ (সুপ্রভাত) : ওহাইও গোজাইমাছ : দোজো ( খাবার এনেছি, প্লিজ খান) জাপানীদের সামনে একটা জাপানী শব্দ বললেই ওরা মনে করে খুব ভাল জাপানী ভাষা জানি। তখন সমানে জাপানী ভাষায় বকবক করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বলতে হয় ওয়াকারি মাছেন ( বুঝিনা ), নিহোংগো ওয়াকারি মাছেন ( জাপানী ভাষা বুঝিনা)। প্রত্যেক দিনের মত আজ সকালে কয়েকবার ওয়াকারি মাছেন বলতে হয়েছে। রাতে ঘুমাতে পারিনি। সম্ভবত দেশে ফেরার টেনশনে। পরশুদিন শুনেছিলাম আজ বৃষ্টি হতে পারে। সকাল থেকেই দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে না। বাইরে নিশ্চয় বেশ ঠাণ্ডা । রুমে অবশ্য এয়াকন আছে, অসুবিধা নাই। বৃষ্টি সম্ভবত হিয়াকু ইয়েন শপে যেতে দিবে না। ০৯.০৫ অনেক লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। তাই নাস্তা করে একটু ঘুমাতে গেলাম। আজ নাস্তার পর ওষুধের শেষ ডোজটা খেয়েছি। ১২.৩০ হসপিটাল থেকে ছাড়া পেলাম ১২.৪৫ ডলার কেনার জন্য ব্যাংকে গেলাম। ডলার কিনে আবার বিক্রি করলে বোধ হয় বেশ লস হবে। তাই হসপিটপালে ফিরে এলাম ১৩.৩০ টায়। ১৩.৪৫ সাদাকো মিউরার সাথে ট্যাক্সি করে ওসাকা ষ্টেশনে গেলাম। আজব ব্যাপার। ট্যাক্সিতে জিপিআরএস। একটা মনিটরে শহরের ম্যাপ আর তাতে একটা ছোট বৃত্ত ট্যাক্সির অবস্থান বুঝাচ্ছে। জাপানে আসার পর শেষবার অবাক হলাম। ১৪.২০ রিমঝিম বাস যোগে কানসাই বিমান বন্দর অভিমুখে যাত্রা। বাসের মধ্যে সাদাকোর সাথে ইংলিশ নিয়ে দুই কথা হয়ে গেল। দামী জিনিসকে ওরা ভেরিয়েবলস বলছিল। আমি বল্লাম কথাটা ভুল। এটা ভেলুয়েবলস হবে। সাদাকো বল্লো আপনারা বাংলাদেশী ইংলিশ বলেন। আমি বল্লাম বাংলাদেশী ইংলিশ বলে কোন ইংলিশ নাই। আপনারা জাপানী ইংলিশ বলেন। ভেরিয়েবল একটা ম্যাথমেটিকাল টার্ম, অন্য রাশির মান পরিবর্তন হলে এর মান পরিবর্তন হয়। নিহোংগোতে গজগজ করছিল সাদাকো। অনেক দিন আমার দেখভাল করেছে মেয়েটা। তাই “চুদাইছি মাছ” মানে excuse me বলে প্রসংগ পরিবর্তন করলাম। ওর রুপ, গুণ আর সহৃদয়তার প্রশংসা করলাম। আর প্রবল বৃষ্টিতে ঝাপসা দৃষ্টিতে দৃশ্যমান প্রকৃতিও যে অপরুপ তাও জানিয়ে দিলাম। ১৫.৩০ কানসাই বিমান বন্দরে পৌছালাম। বিমান বন্দরে ওমিয়াগে মানে উপহার খুজছিলাম। প্রিয় ভাইঝি নোসিন তারান্নুম এর ছবি দেখিয়ে সাদাকোকে বল্লাম এই কাওয়াই কোদোমোর ( cute baby) সুন্দর উপহার নিতে হবে। সাদাকো মিটিমিটি হাসে আর বলে তিতো ওজিসান, তিতো ওজিসান (uncle tito) [ আমার প্রথম কবিতার নাম তিতো ওজিসান ]। ১৮.০০ বড় লাগেজ চেক ও ওজন করাতে সিকিউরিটিতে প্রবেশ করলাম। সাদাকোর সাথে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। ওর কাছে বিদায় নেয়ার সময় আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সাদাকো বল্ল- কী ? দুঃখ ?! তখন বুঝতে পারলাম খুব খারাপ লাগছে। ট্রেনিংয়ের দুই সপ্তাহ পার হবার পর থেকে দিন গুনছিলাম দেশে ফেরার জন্য ক্ন্তিু এখন মনে হচ্ছে যদি একদম না ফিরতে পারতাম। এই বিদেশীনিকে ছেড়ে যেতে এত কষ্ট লাগছে কেন ? মাথার মধ্যে কিছু পোকা কিলবিল করে উঠলো। জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে না হলেও অন্তত কপালে চুমু দিয়ে বলতে ইচ্ছা হল- ওয়াতাশিহা আনাতাও আইসতেরে। কিন্তু আমি সাদাকো মিউরার হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে বল্লাম-তোমাকে খুব মনে পড়বে। ইরো ইরো আরিগাতো গোজাইমাস্তা। ওকিনি, ওকিনি মাইদো। সবকিছুর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। বাংগুরাদেস নো কিতে কুদাসাই। বাংলাদেশে এসো। সায়োনারা। তার পর স্বপ্ন থেকে বাস্তবে আসার জন্য মনোরেলে উঠলাম। ১৮.৩০ বিমানের দিকে রওনা হলাম। ১৮.৫৫ বিমান চালু হল। জায়গা পেলাম ডান সাইডে কিন্তু জানালার কাছে সীট না পেয়ে বেশ রাগ হচ্ছিলো। সামনে ও পাশে হাফ প্যান্ট পরা সুন্দরী কিশোরী সহযাত্রী থাকা সত্ত্বেও। ১৯.১৫ উড়োজাহাজ আকাশে উঠলো। আকাশ থেকে জাপান দেখব। সম্ভবত শেষ সুযোগ কিন্তু উপায় নাই। এলিয়েন বিজিং (বিজিং= সুন্দরী) এক মনে জানালার বাইরে দেখছে। একটু পর পর সামনের মেয়ে গুলো বলছে “দাইজো বু” “দাইজো বু”। গাইজিন (বিদেশী) এর পাশে তাদের বান্ধবী কোন সমস্যায় পড়েনি তো! তাদের এই দুশ্চিন্তা সামান্য কটা জাপানী শব্দের পুঁজি নিয়ে সহযাত্রীর সাথে আলাপ জমানোর সম্ভাবনা সমূলে বিনাশ করে দিল। বিমানটা ব্যাংককের কাছাকাছি এলে সবগুলো একসাথে সুগোই সুগোই রব তুললো। অবাক / ওয়াও এর কাছাকাছি হবে শব্দটা। অন্ধকারে নিচের ঘরবাড়ি থেকে আসা আলো সত্যিই ওরকম শব্দ মুখ থেকে বের করা মত। যাই হোক ব্যাংকক বিমান বন্দরে পৌঁছালাম ০০.৪২ টায় অর্থাৎ ব্যাংকক সময় রাত ১০টা ৪২ মিনিটে। রাত ১১.৩০ হোটেল লুই ট্যাভার্ন ডে রুমে উঠলাম। জাইকা থেকে সকালের নাস্তাসহ ভাড়া পরিশোধ করা ছিল। কিন্তু পাসপোর্ট অথবা ৫০ ডলার জামিন দিতে হবে। থাইল্যাণ্ড গুণ্ডাপাণ্ডার দেশ এই বিবেচনায় পাসপোর্ট জমা না দিয়ে ৫০ ডলার জমা দিলাম। কর্তৃপক্ষ একটা নাস্তার কুপন দিয়ে জানালো সকাল ৬টা থেকে ১০টার মধ্যে নাস্তা খেতে হবে। হোটেল ছাড়ার সময় চেক আউট করে ডলার ফেরত দেয়া হবে। দেশে ফিরতে হলে টিকিট কনফার্ম করতে হবে কিন্তু টিজি কাউন্টার জানালো ১ মার্চ সকাল ৪টার আগে টিকিট কনফার্ম করা যাবে না।ঘুমাতে যাবার আগে একটু আঁতলামি করতে ইচ্ছা হল। এয়ার পোর্টে বিশাল এক দান বাকশোতে একটা এক টাকার কয়েন ফেলে দিলাম। ও হো বাকশো নয় ওটা ছিল মস্ত একটা কাঁচের বোল। দানের টাকা কড়ি গোনার সময় দাতাকে আঁতেল না আবাল ভাববে কে জানে !

[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ তানভীরের মন্তব্য (ভাষাগত সমস্যাদি মানুষকে কতটুকুন ভোগাতে পারে সেটা বোঝার জন্য জাপান ও চীনগেলেই হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যায়…. :no:
তবে কিছু না বোঝাতে পারার শেষে মেজাজ মর্জি খারাপ হলে আমার মনে হয় মায়ের ভাষায় কিছু উপাদেয় গালি নাদিলে কারো মেজাজ ভালো হয় না….) পড়ে মনে হল শব্দ পরিবর্তনে লেখার মৌলিকত্ব নষ্ট হয়েছে। তাই মূল শব্দটি ফেরত আনলাম। খায়রুল ভাই এবং যারা বিদঘুটে জাপানী শব্দ দেখে আহত হয়েছেন তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।]

Sadako sanPage.jpg

৫,৭০০ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “নিহোন এর দিনলিপিঃ শেষ পাতা”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    একটানে পড়ে গেলাম।
    মনবিক ও সুখপাঠ্য।
    একটা চমৎকার গল্পের বা উপন্যাসের সুচনা হতে পারে এইভাবে.........

    ভেবে দেখো।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

    ১। হুমম! আসলেই, জাপানী ভাষা অদ্ভুদ! (কপিরাইটঃ মতিকন্ঠ) 😛

    ২। লেখা বদলেছেন? প্রথম সংস্করণে অন্যকিছু পড়েছিলাম কি! 😉



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
  3. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    মোস্তাফিজ ভাই, ভাষাগত সমস্যাদি মানুষকে কতটুকুন ভোগাতে পারে সেটা বোঝার জন্য জাপান ও চীনগেলেই হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যায়.... :no:
    তবে কিছু না বোঝাতে পারার শেষে মেজাজ মর্জি খারাপ হলে আমার মনে হয় মায়ের ভাষায় কিছু উপাদেয় গালি নাদিলে কারো মেজাজ ভালো হয় না.... :))


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।