সত্যজিতের অনির্মীত চলচ্চিত্র: দি এলিয়েন

সেই ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোরের হাতে “সন্দেশ” পত্রিকার পত্তন। জন্মের দু’বছরের মাথায় জনককে হারিয়ে সুকুমারের হাতে পড়ে সে। ১৯২৩-এ সুকুমারের অকাল মৃত্যুর পরও তার ছোটভাই সুবিনয়ের চেষ্টায় কোনমতে চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৩৪-এর পর আর পারলো না, বন্ধ হয়ে গেল সন্দেশের প্রকাশনা। ১৯৬১ সালে শুরু হওয়া অভিনব যাত্রায় সন্দেশ বিশেষ পুলকিত, কারণ এবার সে সত্যজিতের হাতে পড়েছে যে কি-না রায় পরিবারের উজ্জ্বলতম বাতি। তখনকার সময়ের সেরা শিশু বিনোদন পত্রিকা সন্দেশ, নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। সত্যজিতের অনেক গল্পই এই পত্রিকায় প্রথমবারের মত প্রকাশিত হয়। এমনই একটি গল্প “বঙ্কুবাবুর বন্ধু”, ছোট থাকতে যে বুঝতেই পারেনি, পরবর্তীতে তাকে নিয়ে এতো তোলপাড় হতে পারে। এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনীটি বিশ্বসাহিত্যের দরবারেও অনন্য। কারণ এর আগে ভিনগ্রহ থেকে আসা এলিয়েনদের ভয়ংকর, বিধ্বংসী আর শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে দেখানো হতো। সত্যজিতই প্রথম এমন এক এলিয়েনকে পৃথিবীতে নিয়ে আসলো যে কি-না সদয় ও বন্ধুভাবাপন্ন। শিশু-কিশোরদের কাছেই তার মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশী, শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এর মাধ্যমে নিজের জীবনে নতুন গল্পকথার সূচনা ঘটালো সত্যজিৎ।

the alien satyajit
গল্প থেকে করা চিত্রনাট্যের কাহিনীটা এরকম: “গ্রামের পুকুরে অদ্ভুত এক চাকি অবতরণ করে। নড়াচড়া নেই, বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি। গ্রামের মানুষ অবতার ভেবে এই চাকিকে পূজো করা শুরু করে। চাকির ভেতরের এলিয়েন কিন্তু এই পূজো নেয়নি, নিয়েছে সরল মানুষের নির্মল চাহনির অর্ঘ্য। বন্ধুত্ব করে ফেলে একজনের সাথে। এই এলিয়েনের আবার বিভিন্ন পাওয়ার আছে, সবই উপকারী। কারও ক্ষতি করার ইচ্ছা তার মধ্যে নেই। এখান থেকে যে রহস্যের শুরু তার সমাধান করতে তিনজনের আবির্ভাব ঘটে, এক বাঙালি সাংবাদিক, এক ভারতীয় ব্যবসায়ী আর এক মার্কিন প্রকৌশলী।” চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতাপশালী পরিচালক সত্যজিতের মনে যদি এই কাহিনী নিয়ে সিনেমা করার ইচ্ছা জাগে, তবে তাকে খুব একটা উচ্চাভিলাষী বলা যাবে কি? সিরিয়াসলি চিন্তা শুরু করলো সে। সাংবাদিক, ব্যবসায়ী আর প্রকৌশলী চরিত্রে তিনজন ভাল অভিনেতা এবং অর্থায়ন, এ দুটিই সমস্যা। মনে মনে ভারতীয় ব্যবসায়ী চরিত্রের জন্য অভিনেতা ঠিক করে ফেললো, প্রখ্যাত ব্রিটিশ কমেডি অভিনেতা “পিটার সেলার্স”। কারণ সেলার্স এর আগে হলিউডের “দ্য মিলিয়নেয়ারেস” ছবিতে ভারতীয় ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেছিল। আরেকটি কারণও রয়েছে, সত্যজিতের এই ছবির ইফেক্টগুলো দেয়ার জন্য যে অর্থ ও কৌশলের প্রয়োজন তা হলিউড ছাড়া পাওয়া যাবে না। সেলার্সের অনেক চেনাজানা, সেই থ্রুতে হলিউডে কোন প্রযোজককে রাজী করাতে পারলেই হলো। কিভাবে কি হবে তা ভবে অস্থির সত্যজিৎ।

১৯৬৬ সালের কোন এক সময় সত্যজিতের সাথে লন্ডনে বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার সি ক্লার্কের দেখা হয়। সে ক্লার্ককে তার চিন্তার কথা জানায় এবং ক্লার্ক তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করে। শ্রীলঙ্কায় ফিরে এসে পরের বছর ক্লার্ক সত্যজিতের এই পরিকল্পনার কথা জানায় সেখানকার প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তার বন্ধু মাইক উইলসনকে। শোনার সাথে সাথে এর গুরুত্বের বিষয়টি বুঝে নেয় উইলসন আর তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করে সত্যজিতের সাথে। সত্যজিৎকে কলম্বোতে আসার আমন্ত্রণ জানালেও ব্যস্ততার কারণে সত্যজিতের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অগত্যা উইলসনই কলকাতায় সত্যজিতের বাসায় গিয়ে হাজির হয় আর তাকে অবিলম্বে চিত্রনাট্য শুরু করতে বলে। এমন এক প্রভাবশালী ব্যক্তি যদি পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয় তবে আর চিন্তা কি। সত্যজিৎ নির্জনে লিখতে বসার জন্য মনস্থির করলো। কিন্তু উইলসন চিত্রনাট্য লেখার সময় পাশে থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করলো। সত্যজিৎ প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিল, “লেখালেখি আমি একেবারে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মানি। কেউ পাশে থাকলে ঠিক হয়ে উঠেনা।” কেন জানি গোয়ার্তুমি করে বসল উইলসন, “মহাশয়, আপনি আপনার মতো লিখবেন, পাশে থেকে সময় সময় একটু কফি বানিয়ে দেবার অনুমতিও কি পাবনা?” অগত্যা, সত্যজিৎ লিখতে বসল; পাশে বসে থেকে উইলসন কফি বানিয়ে দেয়নি ঠিক, তবে ক্লার্কের বন্ধু হওয়ায় ভাল ভাল কিছু আইডিয়া দিতে পেরেছিল। পনের দিনে চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ হল।

এর মধ্যেই সেলার্সের এজেন্টরা যোগাযোগ করল, সেলার্স নাকি আগ্রহ দেখিয়েছে। উইলসন আর সত্যজিৎ মিলে ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে প্যারিসে পৌঁছুলো। সেলার্সের হোটেলেই দেখা হয় তাদের। সত্যজিৎ সেলার্সের প্রশংসা করে জানতে চেয়েছিল, তার কাজের সাথে সেলার্সের কোন পরিচয় আছে কি-না। সেলার্সের সাধাসিধে উত্তর, “না”। অগত্যা লন্ডনের ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে “চারুলতা” (সত্যজিতের নিজের করা সবচেয়ে প্রিয় ছবি) আনিয়ে দেখানো হল সেলার্সকে। সেলার্স দেখে তো একবাক্যেই বলে ফেলল, “আমাকে আর কেন ভায়া? আপনার অভিনেতারা তো কোন অংশে কম নয়।” একটু জোক্‌স আর কি, সেলার্সও জানে তাকে কেন “দি এলিয়েন” (মুভির নাম দি এলিয়েন হিসেবে প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছিল) মুভির প্রকল্পে দরকার। পাকা কথা হয়ে গেল। আলাপ শেষে সবাই নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গেল।

একমাস পর উইলসন সেই অবিশ্বাস্য আনন্দময় খবরটা দিল সত্যজিৎকে: হলিউডের প্রথম শ্রেণীর স্টুডিও কলাম্বিয়া পিকচার্‌স দি এলিয়েনর প্রযোজনার দায়িত্ব নিচ্ছে, সেলার্স অভিনয় করবে এবং এ নিয়ে সত্যজিতের সাথে বসার কথা বলেছে আর মুভির স্পেশাল ইফেক্ট তৈরী করতে সম্মত হয়েছে জগদ্বিখ্যাত গ্রাফিক ডিজাইনার “সল ব্যাস”। সবচেয়ে মজার কথা মার্কিন প্রকৌশলীর চরিত্রে অভিনয় করতে “মার্লন ব্র্যান্ডো” (”গডফাদার” চরিত্রের জন্য সবচেয়ে পরিচিত) আর “স্টিভ ম্যাকুইন” (“দ্য কিং অফ দ্য কুল” খ্যাত মার্কিন অভিনেতা) দুজনেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পয়লা জুন হলিউডে পৌঁছুলো সত্যজিৎ। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে উইলসন বললো, “কলাম্বিয়া তো টাকা দিয়ে বাজিমাত করেছে। আর অপু ট্রাইলজি’র নির্মাতা এখন যা বানাবেন তা তো সেরা হবেই।” প্রথম কাজ সেলার্সের সাথে দেখা করা। দেখা হল ক্যালিফোর্নিয়ায় রবি শংকরের বাড়িতে। সেলার্স “দ্য পার্টি” ছবিতে এক ভারতীয় চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছিল। এজন্য তাকে সিতার বাজাতে হবে। সিতার বাজানোর স্টাইল শেখার জন্যই সে রবি শংকরের বাড়িতে গিয়েছিল। সত্যজিৎ প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিল, দি এলিয়েনে সেলার্স মুখ্য চরিত্র নয়; বাঙালি সাংবাদিক ও মার্কিন প্রকৌশলীর চরিত্র দুটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেলার্স জানায়, এতে সে মোটেই অসন্তুষ্ট হয়নি। কারণ এক ভারতীয় জ্যোতিষী নাকি তাকে বলেছে, “আপনি শীঘ্রই এক ভারতীয় পরিচালকের সাথে কাজ করতে যাচ্ছেন।”

সবই প্রায় প্রস্তুত। সত্যজিতের চিত্রনাট্যের মাইমোগ্রাফ কপি হলিউডে ছড়িয়ে পড়লো। একদিন কলাম্বিয়া পিকচার্‌সের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললো সত্যজিৎ। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “চিত্রনাট্যের জন্য আমরা যে ১০,০০০ ডলার অ্যাডভান্স করেছি তা কি পেয়েছেন? উইলসন আপনার পক্ষে সেটি গ্রহণ করেছিলেন।” সত্যজিৎ তো তাজ্জব বনে গেল, টাকা তো দূরের কথা চিত্রনাট্যের জন্য যে এতোটা অ্যাডভান্স করা হবে তাও সে জানে না। পুরো টাকাটা হাতিয়ে নিয়েছে উইলসন। কিন্তু, বিস্ময়ের সবে তো শুরু। চিত্রনাট্যের কপিরাইট দেখে কি ভাবা যায় তাও বুঝে উঠতে পারেনি সত্যজিৎ। কপিরাইট: মাইক উইলসন ও সত্যজিৎ রায়, যে উইলসনের কোন অবদানই নেই চিত্রনাট্য রচনায়। সন্দেহ আর অবিশ্বাস ঘনীভূত হল উইলসনের ব্যাপারে। হলিউডের এক পার্টিতে উইলসনকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, “একজনের চেয়ে দুজন কর্তা থাকা কি ভাল নয়?” বলে কি শালা। হতাশ হল সত্যজিৎ। এরই মধ্যে মার্লন ব্র্যান্ডো প্রকল্প ত্যাগ করলেন। জেম্‌স কোবার্নকে দিয়ে সে স্থান পূরণের চেষ্টা করা হলো। কিন্তু, বীতশ্রদ্ধ সত্যজিৎ তখনই কলকাতায় ফিরে এলো।

এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের কলাম্বিয়া অফিসের উপর দি এলিয়েন প্রকল্পের দায়িত্ব পড়লো। লন্ডন পৌঁছুলো সত্যজিৎ। উইলসনের হোটেলে গিয়ে তো অবাক, মদ আর নারী নিয়ে সেইরকম পার্টি চলছে। দি এলিয়েনের হর্তাকর্তা হওয়ার স্বপ্নে উইলসনের খুশী যেন আর ধরেনা। হতোদ্যম হয়ে লন্ডন থেকেও কলকাতায় ফিরে আসতে হলো তাকে। আসার আগে বিশ্বাসঘাতক উইলসন যা বলল তা আরও ভয়ংকর, “এখানে একটা সই করেন। তাহলে আমি আর আপনি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মুভির কাজ শুরু করতে পারবো।” রাজি হলো না সত্যজিৎ, কলকাতায় কাগজগুলো পাঠিয়ে দিলে ভেবে দেখবে বলে ফিরে এলো। কলকাতায় আর কাগজ আসেনি। কয়েক মাস পর কলাম্বিয়ার যুক্তরাজ্য অফিসের এক কর্মকর্তা কলকাতায় এসে সত্যজিৎকে বললো, “আপনি একাই তো দি এলিয়েন নির্মাণ করতে পারেন, উইলসনের কি দরকার। উইলসনকে রাজি করাতে পারলে আমরা শুধু আপনার নেতৃত্বেই প্রকল্প চালিয়ে যেতে রাজি আছি।” অগত্যা সত্যজিৎ উইলসনকে চিঠি লিখলো যেন সে চিত্রনাট্যের স্বত্ব ত্যাগ করে। উইলসন স্বত্ব ত্যাগ করলেই সত্যজিৎ একা কাজ চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে উইলসন সত্যজিৎকে চোর হিসেবে আখ্যায়িত করলো। একসাথে যেমন অনেক শুভ সংবাদ পেয়েছিল সত্যজিৎ, তেমনই একসাথে অনেক দুঃসংবাদ পেতে হলো। পরের দুঃসংবাদ বয়ে আনলো পিটার সেলার্সের চিঠি। সেলার্স নাকি এতো ছোট চরিত্রে অভিনয় করতে বলায় অপমানিত বোধ করছে। দি এলিয়েনে সে ভুলেও অভিনয় করবে না। কি কারণে তার মতিভ্রম, তা কেউ জানে না, উইলসন না তো? সত্যজিতের উপর এতোটাই ক্রুদ্ধ সে যে, “দ্য পার্টি” মুভিতে নিজের পোষা বানরের নাম রাখল অপু।

সত্যজিতের অনেক সাধের প্রকল্প নস্যাৎ করে দিয়ে প্রথম জীবনে মাস্তিতে থাকলেও শেষ জীবনে আবার মতিভ্রম হয় উইলসনের। এবার সে বিষ্ণুর অনুসারী হয়ে “স্বামী শিব কল্কী” নাম ধারণ করে। আর্থার ক্লার্কের চিঠিতে এ সম্বন্ধে সত্যজিৎ জানতে পারে। এরপর স্বয়ং স্বামিজীর চিঠি আসে তার কাছে, স্বামিজী এতোদিন পরে সেই চিত্রনাট্যের স্বত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন, সব ভেস্তে যাবার পর, জীবনের সব আনন্দ লুটে নেয়ার পর। ধর্ম ভাল শেখাতে না পারলেও, তৈলমর্দণ করে করে শেষে গিয়ে কিভাবে জালিয়াতি করতে হয় স্বামিজী তা ভালই শেখাতে পারবেন বলে মনে হল সত্যজিতের।

শেষ কথা

দি এলিয়েন এর এই ব্যর্থতা বাংলা সিনেমার জগতে একটা কালো দাগ হয়ে থাকবে। আপনারা অনেকেই ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “ই.টি. দি এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল” সিনেমার কথা জানেন। স্টিভেন স্পিলবার্গের এই সিনেমাকে বলা হয় “ফার্স্ট অফ আ কাইন্ড”। কারণ, এর আগের সব এলিয়েন ছবিতে এলিয়েনদেরকে শত্রু হিসেবে দেখানো হতো। কিন্তু ইটি’র মাধ্যমে স্পিলবার্গ নতুন যুগের সূচনা ঘটান। এজন্যই, আমেরিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন মুভি হিসেবে ইটি স্বীকৃতি পায়। এবার ভেবে দেখুন ১৯৬০-এর দশকে সত্যজিতের এলিয়েন মুক্তি পেলে কি হতো।
কয়েক মাস আগে “কাইল এক্সওয়াই” সিরিয়ালটা কিছুদূর দেখেছিলাম। কাইলকে এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল মনে করে জশ বলে, “We should call Spielberg”। তখন আমার আর মহিবের (পরিবর্তনশীল) কেবলই মনে হচ্ছিল, জশ তো বলতে পারতো, “We should call Satyajit”।

হুম, সত্যজিৎ সিনেমাটা করতে পারলে পরিস্থিতি এমনই হতো। সবাই আধুনিক ইটি-র জন্মদাতা হিসেবে সত্যজিতকেই জানতো। এমনকি ইটি বের হওয়ার পর কথা উঠেছিল যে, স্পিলবার্গ হলিউডে ছড়িয়ে পড়া দি এলিয়েন চিত্রনাট্যের মাইমোগ্রাফ কপি থেকে কিছুটা নকল করেছেন। স্পিলবার্গ অবশ্য বলেছেন,

সে সময় আমার বয়স ছিল ১০-১৫। দি এলিয়েনের কথা আমি জানতামই না।

উল্লেখ্য, সত্যজিতের দি এলিয়েন মুক্তি পেলে ১৯৭৯ সালে রিডলি স্কটও তার সিনেমার নাম “এলিয়েন” রাখতে পারতেন না। একটা বিষয় ভেবে বিস্মিত হই, হলিউডে যে ধারা এসেছে ৮০’র দশকে, সত্যজিৎ ষাটের দশকেই তার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাধে কি আর তাকে গুরু মানতে হয়?!

আরও কত কিছু হতে পারতো। সত্যজিৎ এমনিতেই সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্র পরিচালকের তালিকায় (দে শুট পিকচার্‌সের তালিকা) ৩৩ নম্বরে আছেন। দি এলিয়েন করতে পারলে হয়তো পরিচিতি আরও বাড়তো। শুধু সত্যজিতের না, এর সাথে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রসারও বাড়তো। হিন্দি ছবির সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা ছবিকেও ব্যবসায়িক সাফল্যের পথে নিয়ে যাওয়া যেতো। সত্যজিৎ সারা জীবন আক্ষেপ করেছেন, “হিন্দি সিনেমা দর্শকদের রুচি নষ্ট করে দেয়। এজন্যই এদেশে ভালো সিনেমা অতো বাজার পায় না।” সেই পাল্লা দেওয়া আর হলো না। কি আর করার। তবে আমাদের চিন্তা নেই। সত্যজিৎ যা করেছেন তাতেই বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার নাম টিকে থাকবে। ভারতবর্ষে তার সমমানের কোন পরিচালক অতীতে ছিল না, বর্তমানেও নেই। ভবিষ্যতে আসবে কি-না তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

উপরি কথা

এই লেখাটা অতিথি লেখক হিসেবে সচলায়তনে দিয়েছিলাম, অনেকদিন আগে। শেষ কথা আর উপরি কথাগুলো তখন ছিল না। এবার এই দুটা অনুচ্ছেদ যোগ করে ক্যাডেট কলেজ ব্লগে দিয়ে দিলাম।
উপরে দেয়া ছবি সম্বন্ধে একটা বলেই শেষ করছি। ছবিটা সত্যজিতের নিজের আঁকা। দি এলিয়েন সিনেমায় বহির্জাগতিক প্রাণীর অনেকগুলো ছবিই তিনি এঁকে ফেলেছিলেন। আপনারা অনেকেই জানেন, সত্যজিৎ সিনেমা শুরু করার আগে ছবি এঁকে নিতেন। তারপর সে ছবির মত করে দৃশ্য সাজাতেন। এমনকি পথের পাঁচালির অনেকগুলো দৃশ্যও তিনি ছবি এঁকে তৈরী করেছিলেন।

১৬ টি মন্তব্য : “সত্যজিতের অনির্মীত চলচ্চিত্র: দি এলিয়েন”

  1. তারেক (৯৪ - ০০)

    মুহাম্মদ,
    চমৎকার লিখছো। এই ঘটনাটা জানা ছিলো আগে। একটা বই আছে আমার কাছে, নাম সম্ভবত গ্লিম্পস অব রে (ray)। সম্ভবত বলার কারণ, এই মন্তব্যটা লেখার সময় বইটা খুঁজে পাচ্ছি না, যেখানে থাকার কথা ছিলো ওখানে নেই। যাকগে, বইটার সত্যজিতের দুর্লভ কিছু ছবির সাথে এই ঘটনাটারও উল্লেখ ছিলো। প্রথমবার পড়ার পরে রাগে গা জ্বলে গেছিলো। এখন তোমার এখানে পড়েও একই অনুভূতি হলো।
    তবে আমার মনে হচ্ছে বারবার, সত্যজিত মোটের ওপর কিছু না বলেই ওদের ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা ঠিক হয়নি, টাইট করে ধরা দরকার ছিলো।
    *
    তোমার অনুবাদগুলা পড়তে আমার দুর্দান্ত লাগে। তোমার অনুবাদকালীন অভিজ্ঞতা নিয়া একটা লেখা পাইলে খুব খুশি হইতাম। অবশ্য এটা ইগ্নোরও করতে পারো, একেবারেই আমার পার্সোনাল ইন্টারেস্ট থেকে বললাম। সম্প্রতি আমি একটা অনুবাদ শেষ করলাম, সে জন্যেই তোমার অভিজ্ঞতা জানতে আগ্রহ হচ্ছে!


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  2. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    @ফয়েজ ভাই :(( শঙ্কু নিয়ে সিনেমা নেই। শঙ্কু সত্যজিতের ফেলুদার মতই প্রিয় ছিল। এবং শঙ্কুর কিছু গল্প আছে যা তৈরী করতে গুপী বাঘা লেভেলের খরচ এবং প্রজুক্তিতেও হত। কিন্তু এলিয়েনের কাহিনী তাকে বোধহয় অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছিল। এজন্যই আমরা শঙ্কু থেকে বঞ্চিত হলাম।

    @ মুহাম্মদ
    জবর লিখেছ। বেশ সুখপঠ্য। পৃথিবীটাই বোধহয় এমন। জ্যঁ রেনোয়ার মত বন্ধু মেলে, আবার উইলসনের মত বিশ্বাসঘাতকও


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  3. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    @তারেক ভাই:
    ধন্যবাদ তারেক ভাই। ঠিক বলছেন, তাদেরকে আরও শক্ত করে ধরা উচিত ছিল। আসলে সত্যজিৎ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
    আপনের "আশ্চর্য তীর্থযাত্রীরা" এখনও পড়া হয়নি। তবে শীঘ্রই পড়ে ফেলবো। সেক্ষেত্রে অনেক কিছু শেয়ারও করা যাবে। অবশ্য আমি তো শুধু নন-ফিকশন অনুবাদ করি। নন-ফিকশন অনুবাদ তো খুব সহজ। সেদিক দিয়ে সাহিত্য অনুবাদ করা কঠিন কাজ। এজন্যই জীবনে কখনও সাহিত্য গ্রন্থ অনুবাদের চেষ্টা করি নাই।

    @ফয়েজ ভাই:
    শঙ্কু নিয়া কোন সিনেমা করলে আসলেই চরম হইত। বাজেটের জন্যই বোধহয় করতে পারেন নাই। দি এলিয়েন করতে পারলে এর পর অনেক কিছুই ঘটতে পারতো।

    @টিটো ভাই:
    আসলেই পৃথিবীটা এমন। রনোয়ারের সহকারী হয়ে কাজ করলেন, ঐদিকে আবার উইলসনের মতো লোকের কাছে প্রতারিতও হলেন। কি আর করা।

    জবাব দিন
  4. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    তারেক ভাই, অনুবাদ নিয়ে আমি একটা লেখা দেব বলে ঠিক করছি। আপনার তীর্থযাত্রীরা পড়ার পর। অনুবাদ করার সময় আপনার কি কি অসুবিধা হচ্ছিলো সেগুলোর সাথে আমারটা মেলানোর একটু চেষ্টা করবো।

    জবাব দিন
  5. অস্কার পাবার পর সত্যজিতকে নিয়ে করা 'আনন্দলোকে'র একটা সংখ্যায় ঘটনাটা প্রথম জেনেছিলাম।
    মুহাম্মদ কে ধন্যবাদ সবার সাথে শেয়ার করার জন্য।

    গুরু মানুষ। যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। 'অরন্যের দিনরাত্রি' আমার সারাজিবনে দেখা সেরা ১০টি ছবির একটি। :boss: :boss:

    জবাব দিন
  6. তারেক (৯৪ - ০০)

    মুহাম্মদ,
    থ্যাংক্স। তুমি তীর্থযাত্রী নিয়াও কিছু বইলো পারলে।
    আর, ফিকশান নন-ফিকশান অনুবাদের হ্যাপার পার্থক্যের ব্যাপারটা মাথায় আসে নাই আগে। তুমি বলার পরে মনে হইলো, তাইতো। তবে আমার খুব মনে হয়- কোন একটা অষুধ খাওয়াইয়া যদি তোমার মধ্যে সাহিত্য-প্রেম ঢুকাইয়া দেয়া যায়, তাইলে দারুন সব অনুবাদ পেয়ে যাবো। 🙂
    দেখি, শঙ্কুরে ফোন দিই, সাহিত্য-প্রেম-বর্ধক-বটীকার ফর্মূলা আছে কি না দেখি। 🙂


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  7. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    @কামরুল ভাই,
    অরন্যের দিনরাত্রির কথা মনে করায়া দিলেন। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। মাইন্ড গেমের জায়গাটা একেবারেই অন্যরকম লাগছিলো। কিন্তু সে সময় মাহাত্ম্য বুঝি নাই। পড়ে সত্যজিতের লেখা "বিষয় চলচ্চিত্র" বইটা পড়ে অনেক কিছু বুঝলাম। সত্যজিৎ বলছেন, অরন্যের দিনরাত্রির মাইন্ড গেমের মতো এত ভালো ক্যারেক্টার স্টাডি তিনি জীবনে করতে পারেন নাই। এটা নাকি তার চুড়ান্ত পরিপক্কতার ফসল। এই সিনেমাটা আমারও ফেভারিটের মধ্যে আছে। সত্যজিতের অনেক সিনেমাই দেখা হয়নাই। সব মিলায়া ১৩-১৪ টা দেখছি। সবগুলা দেখতে হবে।

    @তারেক ভাই:
    আমার মনে হয় বিজ্ঞান-প্রেমরে ছাপায়া সাহিত্য-প্রেম উঠতে পারতেছে না। এইজন্যেই নন-ফিকশনের প্রতি মোহটা বেশী। শঙ্কুর বটীকা দিয়া কাজ হয় কি-না সন্দেহ আছে। তারপরেও চেষ্টা কইরা দেখুম।
    সত্যি কথা বলতে, ফিকশন পড়তে আমার খুবই ভাল লাগে। যা পড়ছি তাতেই মুগ্ধ হইছি। কিন্তু ঐ যে নন-ফিকশন বেশী পড়ার কারণে গল্প-উপন্যাস বেশী পড়ার সুযোগ হয় না। এজন্যই মনে হয় সাহিত্যের অনুবাদটা আমারে দিয়া হবে না। একটা কারণ হইলো, যারা নিয়মিত নন-ফিকশন পড়ে তাদের লেখার স্টাইলটাও নন-ফিকশন টাইপ হয়ে যায়। এই যেমন, আমার লেখার মধ্যে একটা নন-ফিকশন ভাব আছে, যেটা গল্প বা উপন্যাসের সাথে ঠিক যায় না।

    জবাব দিন
  8. সাইফ (৯৪-০০)

    মুহাম্মদ,তোমারে বাংলাদেশে যেকোনো চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের মেম্বার বানানোর রিকমেন্ড করলাম,ঘটনা অনেকেই জানে পড়ে,কিন্তু তুমি একজন পরিপক্ক ফিল্ম ক্রিটিক্স এর মত করে লিখেছ....।..।.....।।.।।...সিনেমার কথা তুমিই চালিয়ে নিয়ে যাবা.।।.........।এই আশায় রইলাম...............।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইফ (১৯৯৪-২০০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।