অ্যানাপোলিসের ডায়েরী

#কলেজে প্রায় ই কঠিন কোনো পরীক্ষার দিন সকালে ক্লাসরুমে এসে একটা মৃদু অসন্তোষের গুঞ্জন শোনা যেত।আস্তে আস্তে সেই গুঞ্জন টা একটা তীব্র আন্দোলনে রূপ নিত। আমার মতো  সেই সমস্ত ক্যাডেট যারা “ওস্তাদের মাইর শেষ রাতে” এই মতবাদে বিশ্বাস করে তারা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে চিল্লা চিল্লি শুরু করতো । এরপর নানা দিকে কাহিনীর জল গড়াতো। একশন কমিটি গঠন করা হতো। এই পার্টি থেকে যথাযথ দিক নির্দেশনা দেওয়া হতো।  যাদের ইমপ্রেসন ভালো তাদের পাঠানো হতো ভিপি স্যারকে কনভিন্স করানোর জন্য। বেশির ভাগ সময়ে মিশন সাকসেসফুল । পরীক্ষা পিছিয়ে একধরণের পৈশাচিক আনন্দ পেতাম আমরা ।

আজ  ক্যালকুলাস পরীক্ষার আগ মুহুর্তে এই সব কাহিনীর কথা চিন্তা করছিলাম। প্রিপারেশন খুব বাজে ছিলো। কিন্তু আর যাই হোক একটা ডিফেন্স একাডেমিতে তো আর পরীক্ষা পেছানোর মতো কাহিনী ঘটানো  সম্ভব না। যাই হোক , কিছুক্ষণ পর  হুট করে কিছু গুঞ্জন শুনলাম। আস্তে আস্তে শব্দের তীব্রতা বাড়তে থাকে। অবাক হয়ে দেখি বেশির ভাগ স্টুডেন্ট পরীক্ষা পিছানোর জন্য কাকুতি মিনতি করছে। সেকি ইমোশোনাল ব্ল্যাক মেইল ! ক্লাস টিচার এক পোড় খাওয়া জাদরেল লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার। তিনি পর্যন্ত এই ইমোশোনাল ব্ল্যাক মেইল এ ধরাশয়ী।  নিজের অজান্তেই হেসে দিলাম। বিশ্বের সব জায়গায় দেখি এক ই কাহিনীরে ভাই ! কাল যে পরীক্ষা ভালো হবে না, তা আমি জানি। কলেজেও পরীক্ষা পিছিয়ে ভালো কোনো এক্সাম দেই নাই কখনো ।তবু ও বিশাল মজা পেলাম।  মনে হলে এম সি সি র 42nd ব্যাচের বি ফর্মে বসে আছি। ডেজা ভু !

 

#বাংলাদেশে নেভাল একাডেমিতে যখন একটা ব্যাচ পাস আউট করে বের হয়, তখন পাসিং আউট প্যারেড এর শেষ দিকে তারা সবাই একসাথে মার্চ করতে করতে গ্রাউন্ডের একটা নির্দিষ্ট দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। গ্রাউন্ড ক্রস করলেই অফিসার ! ইমোশোনাল একটা মুহূর্ত। তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যান্ড পার্টি রবি ঠাকুরের “পুরানো সেই দিনের কথা” গান টার মিউজিক বাজায়। বিএমএ তেও পোডিয়াম ক্রস করার সময় এই মিউজিক টা বাজানো হয় ! ওই মুহূর্ত টুকু তে সবার মাঝেই অন্যরকম একটা থ্রিল কাজ করে। এই মিউজিকটার মাঝে কি একটা জানি আছে। একদম হার্টে গিয়ে আঘাত করে। একটা বিশেষ মিউজিক যে মুহুর্তের মাঝে মানুষের মনে কত চেঞ্জ আনতে পারে তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই “পুরানো সেই দিনের কথা” ….

আজ বিকালে একাডেমির ৫ জন প্রফেসরের রিটায়ারমেন্ট উপলক্ষ্যে ফরমাল প্যারেড হচ্ছিল। মার্চ পাস্ট, আরো কিছু স্বাভাবিক ড্রিলের পর আমরা প্রফেসরদের স্বশস্ত্র সালাম দেই। তখন এখান কার ব্যান্ড পার্টি একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্লে করে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম যে আরে মিউজিক টা দেখি চেনা চেনা লাগে। আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাওয়া নামে একটা বাগধারা পড়েছিলাম ছোটবেলায়। ওই সময় আমার সত্যিই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় যখন আবিষ্কার করলা যে  একাডেমি র ব্যান্ড পার্টি “পুরানো সেই দিনের কথা” র মিউজিক বাজাচ্ছে!প্যারেডের পর রুমে এসে রুমমেট কে নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালালাম কাহিনী র মানে বোঝার জন্য। ওরে “পুরানো সেই দিনের কথা” শুনাইলাম। সে ও ভেড়া বনে গেল। অবশেষে অনেক ঘাটাঘাটির পর কাহিনী বুঝলাম। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্কটল্যান্ডে “auld lang syne” নামে একটা ফেমাস গান কম্পোজ করা হয়। রবি ঠাকুর যখন বিলাতে ছিলেন তখন তিনি এই গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে “পুরানো সেই দিনের কথা” লিখেন এবং সুর করেন। আমেরিকান রাও ওই একই গান থেকে ইন্সপায়ার হয়ে ওদের নিজেদের ভার্সন বানায়। আর মাঝখান দিয়ে আমার মত পাবলিকদের হুট করে বিভিন্ন অকেশনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় ! ইন্টারেস্টিং !

 

#সিক রিপোর্ট করে কোনো এক্সকিউজ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার লাক টা বিশাল রকমের খারাপ। ঘটনার সূত্রপাত সেই আদ্যিকাল থেকে।কলেজে দেখতাম পোলাপান কোন কারন ছাড়াই সিক রিপোর্টে গিয়ে ৫/৭ দিনের রেস্ট নিয়ে আসতো। পিটি টাইমে দৌড়াতাম আর এই পার্টির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম নীরবে। বেশ কয়েকবার কিছু সিরিয়াস কিছু কারন দেখিয়ে  রেস্ট নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারনে আমার ভাগ্যে রেস্ট বা এক্সকিউজ  জুটতো না। কি সেই কারন তা আজও বের করতে পারি নাই।

গতকাল থেকেই ভালো রকমের সর্দি জ্বর। মার্কিনি বসন্তকাল গায়ে সয়নি মনে হয়। সিক রিপোর্টে গেলাম সকালে। গত সপ্তাহেই এই একই কারনে আমার রুমমেট ২ দিন সিক ইন কোয়ার্টার পেয়েছিল। এটেন্ড সি বা হাউস রেস্ট টাইপের একটা এক্সকিউজ এটা। আমি মোটামুটি আগামী ২ দিনের ঘুমের প্ল্যান পোগ্রাম করে ফেলেছি। ব্যাপক সুন্দরী এক লেফটেনেন্ট ডাক্তার এসে আমাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, খুব মিষ্টি মিষ্টি কিছু কথা বার্তা বলে এক কৌটা ট্যাবলেট আর একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। পুরা প্রেসক্রিপশন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে খুজেও কোথাও রেস্ট/সিক ইন কোয়ার্টার টাইপ কোনো শব্দ খুজে পেলাম না। কি নির্মম ট্র্যাজেডি ! ডাক্তার জাতিটার সাথে আমার শত্রুতা কোন জায়গায় তা বুঝে উঠতে পারছি না।

 

#এখানে আসার পর থেকে ফুটবল খেলি একাডেমীর ইন্ত্রামুরাল সকার লিগে। ৩০ টা কোম্পানি একাডেমীতে , সুতরাং লীগটা ও মোটামুটি কম্পিটিটিভ। বেশ কিছু মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে এখানে খেলতে গিয়ে। আমরা খেলি এমন কিছু মাঠে, যেগুলো নরমাল ফুটবল মাঠের চেয়ে ছোট, কিন্তু ফুটসাল মাঠের চেয়ে বড়। রোলিং সাবস্টিটুশন।কোনো  অফ সাইড নেই  ! এই জিনিসটা সবচেয়ে মজার।

প্রথম কয়েকদিন খেলেই যে জিনিসটা বুঝতে পারলাম যে আমেরিকান গুলোর পায়ে স্কিল থাকুক আর না থাকুক প্রত্যেকটা ভয়াবহ রকমের গাবর। খেলার সময় এরা ট্যাকল করতেই বেশি আগ্রহী থাকে। এদের এই ফিজিকাল খেলার সামনে মিডফিল্ড এ আমি ভালো রকমের নাকানি চুবানি খেয়ে গেলাম। কলেজে খেলতাম মিডফিল্ড এ। অন্য প্লেয়ারকে দিয়ে গোল করিয়ে বেশি মজা পেতাম। এখানে পাস দেওয়ার আগেই লাথি টাথি খেয়ে আমার অবস্থা খারাপ। তো শেষ মেষ উপায় না দেখে পজিশন চেঞ্জ করে হয়ে গেলাম স্ট্রাইকার। এরপরেই শুরু হলো মজা। এই কদিনে অফ সাইডে থেকে গোল দেওয়াটাকে মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। গুরু ফিলিপ্পো ইনজাগির মতো ম্যাচের সময় হাইড আউট এ থাকি, চিপা চুপা গলে অফ সাইডে থেকে কয়েকটা গোল দিয়ে চলে আসি । ব্যাপক মজা। অপোনেন্ট টিম অলটাইম এ খেপা। তাদের ভাষ্যমতে ,”ডুড , ইটস নট ফেয়ার প্লে” ! আমি বাংলায় বলি,” ডুড তোমার ফেয়ার প্লে র আমি গুষ্ঠি কিলাই।”

এই জন্যই মনে হয় , ইদানিং কোনো টিম বা প্লেয়ার অফ সাইডে থেকে গোল দিলে তাদের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে সহমর্মিতা অনুভব করি। কনগ্রেটস ! কিপ স্কোরিং ফ্রম অফ সাইড !

 

#ভোর সাড়ে চার টায় ঘুমুতে  গেছি। কোনো মিলিটারী অবলিগেশন নেই । তাই ব্যাপক খুশি হয়ে আনলিমিটেড একটা ঘুমের আশায় কোনো এলার্ম ও সেট করিনি । হুট করে বিশাল সাউন্ডে ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘড়িতে দেখি সকাল আটটা বাজে। শব্দের তীব্রতা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। আরে এতো ফায়ার এলার্ম ! আগুন ! এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। আমাদের কোম্পানি ফোর্থ ফ্লোরে থাকে। তাই সবাই সিড়ি র দিকে দৌড়াচ্ছিল । নিচে নেমে কোম্পানির ফল ইনে যোগ দিলাম। কাউন্ট করা হলো। অনেক ফর্মালিটিস করা হলো। এক ঘন্টা ওখানে দাড়িয়ে ছিলাম। এরপর কোম্পানি কমান্ডার এসে যা বললেন তার সারমর্ম হলো যে এটা একটা ফায়ার ড্রিল ছিল।কোনো আগুন লাগেনি।চেক করা হলো যে আগুন লাগলে আমরা কেমন সুইফটলি রিয়েক্ট করি। আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ আছে অনেক। সুতরাং বিনা মেঘে বজ্রপাতের কোনো সম্ভবনা নেই। খালি মনে মনে বললাম , মাননীয় স্পীকার আমি তো ___ হয়ে গেলাম।

 

#আহ! শান্তি !উইকেন্ড !ভালো একটা দিবানিদ্রা হচ্ছিলো ! হুট করে একটা গান শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। একটু অবাক হলাম! এই গান তো আমার এখানে শোনার কোনো সম্ভাবনা নাই। চোখ বন্ধ করলাম। ভাবলাম যে মনে হয় এখনো স্বপ্ন দেখছি! কিন্তু না, এবার গানের ভলিউম আরো বেড়ে গেলো ! বেড থেকে লাফ দিয়ে নেমে কোনমতে স্নিকার টা পরে বাইরের করিডোরে চলে গেলাম ! গিয়ে দেখি আমার মার্কিনি ক্লাসমেট রা দিল সে মুভির ” চলো ছাইয়া ছাইয়া ” গান ছেড়ে উদ্দাম নাচানাচি করছে ! আমার অবস্থা যাকে বলে কিনা টিনের চালে কাক, আমিতো অবাক। ওদের অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলাম যে এই গানের সন্ধান কোথায় পাইলো ওরা? ওদের জবাব ছিলো,”ডুড ফরগেট এবাউট দ্যাট, লেটস ড্যান্স।” আপাতত নাচা নাচি করার চেয়ে অসমাপ্ত দিবানিদ্রা শেষ করাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হওয়াতে  ওদের প্রস্তাব বিনয়ের সহিত প্রত্যাখান করে ঝাপিয়ে পরলাম বিছানায় !  সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এদের ছাইয়া ছাইয়া নাচের তীব্রতা সমানুপাতিক হারে বাড়া শুরু করলো। মতি গতি সুবিধার ঠেকছে না ! কানে ইয়ারপ্লাগ টা আরো ভালো মতো গুজে পাশ ফিরলাম।

৩,০৫৯ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “অ্যানাপোলিসের ডায়েরী”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো, এ ধরনের দিনলিপি আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্লগ টাইপ। নিয়মিত এই ব্লগর ব্লগর চাই।

    ছাইয়া ছাইয়া শুনে অবাক হইছিলাম INSIDE MAN মুভি দেখতে গিয়ে, মুভির শুরুতেই দেখি ইন্ট্রো মিউজিকে এইটা বাজছে তখন ভাবছিলাম যে আপলোড করছে যে একটা ফাইজলামি করছে। পরে এন্ড ক্রেডিটে দেখি ঐটা আসলেই মুভির ইন্ট্রো ট্রাক।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নাফিস (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।