টুকিটাকি – ২


আশির দশকের একজন স্মার্ট নায়িকা ছিলেন দিতি। অনেক সংগ্রামী জীবন। অনেকটা সেলফ-মেড। এখন তিনি অসুস্থ। সহকর্মীরা তাঁর জন্য দোয়া করছেন। আবার বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে নায়িকা মানেই শুধু একজন অভিনয়শিল্পী নয় – যেন অন্যকিছু। তাকে সম্মানিত করতে নেই, তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ংকর পরিণতি। একটি রক্ষণশীল সমাজ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এই ভয়ংকর পরিণতির ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে। তাই সে সমাজে কোন সৃষ্টিশীলতা নেই, গতিময়তা নেই। কারণ অবরুদ্ধ ভাবনা আমাদেরকে কবরে জীবন্ত অবস্থায় আটকে ফেলে। এর ফলে আমরা পারিনা দারিদ্র্যের শিকল ভাঙতে।
আমার খুব পছন্দের একটা বই হচ্ছে হাফ দ্য স্কাই। মেয়েদের তথা মানুষের জীবন যে কতো করুণ হতে পারে এই বইটি পড়লে জানা যায়। অধিকাংশই দারিদ্রপীড়িত। অনেকে ফাঁদে পড়ে বা অন্য কোন বিকল্প পথের সন্ধান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পতিতালয়ে আটকে পড়ে। তারপর শুরু হয় অবর্ননীয় কষ্টের জীবন। এইসব কাহিনী পড়লে অনুধাবন করি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা কী নারী কী পুরুষ সবার জন্যই কতো প্রয়োজন। কিন্তু চাকরি পেতে হলে বাজারে চাকরি তো থাকতে হবে। একে একে প্রতিটি সেক্টর বন্ধ করে দিলে চাকরির বাজার প্রসারিত হবে কি করে? সিনেমা তেমনই একটি সেক্টর বা ইন্ডাস্ট্রি যেখানে অনেক কর্ম সংস্থান তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এই সেক্টরে আমরা দিন দিন ভোক্তা হয়ে পড়ছি, উৎপাদন থেকে পিছিয়ে পরছি। এই সমস্যাটি বেশি দেখা যাচ্ছে রক্ষণশীল সমাজে। তুলনামূলকভাবে যে সব দেশে মেয়েদের সাংস্কৃতিক উপকরণে অবরুদ্ধতা নেই সে সব দেশ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে নিজের দেশের অর্থনীতিটি রুষ্ট-পুষ্ট করে নিচ্ছে। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাপারটা বা হয় আরেকটু ব্যাখ্যা করি।

গত বছর সামারে অ্যালাবামাতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। পাত্র বরের মামাতো ভাই। পেশায় ল’ইয়ার। পাত্রী ডেন্টিস্ট, বাবা-মা পাকিস্তানী। অ্যামেরিকাতে ধার্মিক বাংলাদেশীদের সন্তানদের সাথে পাকিস্তানীদের সন্তানদের বেশ আত্মীয়তা হচ্ছে। বিয়ের আগের দিন মেহেদী অনুষ্ঠানে দেখা গেল ভূড়িভোজের পর সব পুরুষদের বাইরে যেতে বলা হচ্ছে। রাসীন বলল, এ তো মহা বৈষম্য। তারপরও উপায় নেই। যেতে বাধ্য। এরপর হলঘরের দরজা আটকে দেওয়া হল। একে একে সব হিজাবি তাদের হিজাব খুলে ফেললেন। বলা বাহুল্য অধিকাংশ মহিলাই হিজাবী ছিলেন। তারপর শুরু হল ধুমধাড়াক্কা মিউজিক সাথে নাচ। এখন অনেকেই বলবেন এতে খারাপ কী? কিন্তু ততক্ষণে আমি অন্য হিসাব করতে শুরু করেছি। মিউজিক, গান বা অনুকরণীয় নাচ যা হচ্ছে সবই বলিউডের। মানে দাঁড়াচ্ছে বলিউড এক্ষেত্রে উৎপাদক আর বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান হচ্ছে ভোক্তা। এবার আপনার ডানাটাকে আরেকটু মেলে ধরুন – আরেকটু উপর থেকে এই তিনটা দেশের দিকে তাকান। ভারতের অর্থনীতির কাছে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান এখনও শিশু। তারপর তাকান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে – যতই তর্ক করেন কিন্তু কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে আমরা ভালো আছি। কালাহাতি, ব্রাক্ষণবাড়িয়া – এই খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষগুলো বলে দেয় ভেতরে ভেতরে মানুষগুলো আসলে খুব ক্ষিপ্ত। ভারতের বর্তমান ধর্মীয় অসহিষনুতার মধ্যেও তারাই তুলনামূলক বিচারে সবচেয়ে স্থিতিশীল। স্থিতিশীলতার সুবিধা হচ্ছে আপনি একটি পরিকল্পনা করলে তা বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ তারিখগুলো নিশ্চিন্তে নির্ধারণ করতে পারেন। এরপর শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন যেটিই ধরেন না কেন – প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতার একটি ইতিবাচক দিক থাকে যা দেশকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। হ্যাঁ ভারত অনেক এগিয়ে গেছে। ওদের সিনেমা সারা পৃথিবীতে ব্যবসা করছে। হ্যাঁ মানছি ওদের মুভির মতো নারীদের অব্জেক্টিফাই করার মতো মুভি আমরা চাই না। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে গাইতে গাইতে গায়েন। একটা সময় ওদের মুভিতে মেয়েরা শুধুই পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন পরিচালনায় নারীরা আসছে। তাদের ছবিতে নারীদের প্রাধান্য থাকছে। আবার পুরুষরাও নারীদের অনেক ছবিতে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তুলে ধরছে।

সেদিন একটি পত্রিকায় দেখলাম একজন বলছে উন্নয়ন হয় শুধু কারিগরী শিক্ষায়, রবীন্দ্র সঙ্গীত কি কোন কাজে দেয়? এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান থেকেই দেওয়া সম্ভব। আমরা ইকোসিস্টেম থেকে জানি এই দুনিয়ায় কোন প্রাণই অপ্রয়োজনীয় নয়। ইকো সিস্টেমের চক্রটি হল তৃণভোজী-মাংসাশী প্রাণী-উভভোজী-পোকামাকড়/ব্যাকটেরিয়া। এখন আমরা জানি এই চক্রের একটি অদৃশ্য হয়ে গেলে ইকোসিস্টেম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। ঠিক তেমন আপনি কম্পিউটার বানাতে শিখলেন ভালো কথা, এখন সে কম্পিউটারের জন্য তো কন্টেন্ট লাগবে। তাই না? কম্পিউটার তো আর লোহার সিন্দুক না যে ঘরের এক কোণে রেখে দিলেন। এর মনিটরের দিকে তাকিয়ে আপনি কখনও দর্শক, কখনো শ্রোতা, কিম্বা নিজেই বানাচ্ছেন কোন কনটেন্ট। তেমনি রবীন্দ্রসংগীতও হতে পারে একটি কনটেন্ট। এখন আপনি যদি আপনার নিজের সংস্কৃতির কোন কনটেন্ট না বানিয়ে ভিনদেশী কনটেন্টের ভোক্তা হয়ে পড়েন তাহলে আপনি নিজেই অন্য দেশের সাংস্কৃতিক আগ্রসনকে আহবান করছেন। এক্ষেত্রে শুধু শুধু মীরজাফরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। একজন অভিনেত্রী যখন ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন তখন সে ক্যামেরার পিছনে থাকে কমপক্ষে আরও পাঁচজন। তার মানে পাঁচজনের কর্মসংস্থান।
প্লেটোর একটি উক্তি আছে, “যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না।”
আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবদান অনুধাবন করতে চেষ্টা করি। একটা সময় সেই আশির দশকে অভিনেত্রী দিতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কতজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন আজ না হয় তাই হিসেব করি।

৭,৩১৭ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “টুকিটাকি – ২”

  1. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)
    একটা সময় সেই আশির দশকে অভিনেত্রী দিতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কতজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন আজ না হয় তাই হিসেব করি।

    :thumbup: এভাবে কখনও ভাবিইনি!



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    যে জায়গাটা সবচেয়ে পছন্দ হয়েছিল সেটা দেখলাম ইশহাদ দখল করে ফেলেছে...

    মুস্তাফিজের মতই বলি, এ ধরনের লিখা আসলেই মিস করি.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আমাদের সামনের দিকে যদি এক পা তো পেছনের দিকে দুই বা ততোধিক।
    সমাজে প্রজন্মান্তরে ভাবনা ও বিশ্বাসের যে পরিবর্তন আসবার তা আসছে বটে। তবে সেই সাথে ভূতুড়ে চিন্তার ডালপালা ছড়াচ্ছে জোর ধর্মব্যবসায়ী আর ফায়দাবাদীরা। ওটাকে মোকাবেলা করবার কমব্যাট টেকনিক নিয়ে কিছু কি আমরা সেভাবে আদৌ করতে পারছি!

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      একদম ঠিক কথা লুৎফুর ভাই। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে দেখে যে এই যুগের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষিত মেয়েরা এম্পাওয়ারমেন্ট হিসেবে ধর্ম যাজক সাজছে - যে যত ধর্মের বিধিনিষেধ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে সে তত জ্ঞানী।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শান্তা,
    তোমার লেখা বরাবরের মত মুখরোচক --- ভাবনাকে উস্কে দ্যায়। দিতির খবরটা শুনে বেশ বিষণ্ণ বোধ করেছিলাম। তাঁর মতন সুশ্রী এবং মেধাবী শিল্পীর এমন মুহূর্তের ছবি দেখতে কষ্ট হয়।

    রবীন্দ্রসংগীত (বা সংগীত বা কবিতা বা এমন যে কোনকিছুই) কি আসলেই কাজে লাগে? লাগে মনে হয়। মননশীলতা তৈরি না হলে, সুকোমল মন না থাকলে মানুষের কথা পৃথিবীর কথা কি করে ভাবা যেতে পারে বুঝিনা। সবকিছুকে একসূত্রে গেঁথে নিয়ে এগুতে পারলে কতই না ভালো হত। লোভ ইত্যাদি একটু বশ হতো যদি মানুষের মত করে মানুষের কথা ভাবা যেতো। আমার মনে হয় বড় বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং ব্যবসায়ী সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কবিতা, গান বা ছবি আঁকেন বলেই সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারেন। কথা হচ্ছে, কেউ এটা বলে দ্যায়নি যে, শিল্পবোধ গুরুত্বপূর্ণ কিছু। বলে দ্যায় ওর মত হতে হবে যে করেই হোক। শিল্পের পথে না গিয়ে তঞ্চকতা বা চোরাগলি ধরতে প্ররোচিত করে।

    জবাব দিন
    • ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

      সুন্দর বলেছেন। মানুষ এখন শুধু টাকাপয়সা বুঝে তো তাই লেখাটাকে বোধগম্য করার অন্য এই দিকটাই টানলাম। সাহিত্য আছে বলেই তো বিজ্ঞান প্রকাশিত হতে পারছে। যখন প্রোগ্রামিং করি তখন মনে হয় কবিতা লিখছি আবার যখন উপন্যাস লিখি তখন মনে হয় অঙ্ক কষছি। কিম্বা অন্য ভাবে বল্যতে গেলে মনের ভাব যখন শব্দে লিখি তখন তা হয়ে যায় গল্প আর যখন একই ভাব প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে লিখি তখন তা হয়ে যায় অ্যাপস।


      “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
      ― Mahatma Gandhi

      জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    শান্তাপা,
    ১। ব্যক্তিগতভাবে দিতিকে আমার কখনও মেধাবী মনে হয় নি। তবে, তাঁর কারণে যে অজস্র ছবি বানিজ্যিক সফলতা পেয়েছে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। আপনার মতন আমিও শুধু এটাই মনে রাখতে চাই যে- অভিনেত্রী দিতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কতজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

    ২। বেশিরভাগ বাংলাদেশী প্রবাসীকে (প্রথম প্রজন্ম) দেখলেই আমার খুব মায়া লাগে। শুরুতে এরা অতিমাত্রায় বিদেশি হতে চান। সন্তান বড় হবার সময়ে তাদের কোন রীতিতে (সংস্কৃতি) বড় করবেন- এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন। সন্তান পূর্ণ বয়স্ক হলে তারা ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে বেশি মাত্রায় ঝুঁকে আগের সবকিছু ব্যালান্স করার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত কোন কিছুই ঠিক মত করতে না পেরে শেষ জীবনে নিঃসঙ্গ ও অপূর্ণতাময় জীবন যাপন করেন। না ঘারকা, না ঘাটকা... সবাই এরকম না হলেও অনেকেই যে এরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান- তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।

    ৩। আপনার লেখাটি বরাবরের মতনই চিন্তার খোরাক জোগালো।


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।