মানসিকস্বাস্থ্য সমস্যা ও মাদকাসক্তি – ১

এক
শুধু মানসিকস্বাস্থ্য সমসার কারনে কেউ মাদকাসক্ত হয় না ঠিকই কিন্তু কিছু কিছু মানসিকস্বাস্থ্য সমস্যা আছে যেগুলিতে আক্রান্তগনের মধ্যে মাদকাসক্ত হবার প্রবণতা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।
এটা আরো বেশি ঘটে তখনই যখন এঁরা কোনো না কোনোভাবে এমন কোনো মাদকের সংস্পর্শে আসে যা তাঁদের মানসিক সমস্যার কিছু উপসর্গের সাময়িক রিলিফ এনে দেয়।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য হলো, সাময়িক রিলিফ পেতে এসকল মানসিক সমস্যা সম্পন্নদের মাদকে ঝুকে পড়া থেকে নিরুতসাহিত করা।
আবার যাদের এইসব সমস্যা আছে তাদেরকে মাদকাসক্তি সম্পর্কিত বাড়তি ঝুঁকির ব্যাপারে অবগত করা।
দেখা গেছে:
– বিষন্নতা বা অবষাদগ্রস্ততায় আক্রান্তগন গাজা-চরস জাতীয় মাদক গ্রহন করে তাঁদের বিষন্নতাজনিত যন্ত্রণা ভুলে থাকতে দেখা যায়।
– প্যানিক এটাকে আক্রান্তগনকে সিডেটিভ বা ব্যাথানাশক বা ফেন্সিডিল জাতীয় ঔষধ সেবন করে উপসর্গ দূর করতে দেখা যায়।
– সোশাল এংজাইটি ডিজ-অর্ডার ও এন্টিসোশাল পার্সোনালিটি ডিজ-অর্ডার আক্রান্তগনকে আকন্ঠ মদ্যপান করে সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা অর্জনে প্রবৃত্ত হতে দেখা যায়।
– হতাশা, লোএনার্জি-লোএস্টিম-লোমটিভেশন আক্রান্তগনকে কোকেন বা ইয়াবা জাতীয় মাদক গ্রহন করে এনার্জাইজড হতে দেখা যায়।
কথা হলো, এগুলো সাময়িকভাবে ঐসব সমস্যার কিছু কিছু উপসর্গ দূর করলেও দ্রুতই তাঁদের জন্য নির্ভরশীলতা তৈরী করে ফেলে। আর মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিগন একবার এসবের চক্রে ঢুকলে তাঁদের জন্য এ থেকে পরিত্রাণের আর কোনো উপায় থাকে না।

উপরের প্রায় সকল মানসিক সমস্যা নিয়েই অনেকের ধারনা আছে। তাই সবগুলো নিয়ে আলাপ করবো না। এগুলোর মধ্যে কম জানা কিন্তু বেশি দৃশ্যমান দুটি সমস্যার বিষাদ ব্যাখ্যা দেবো, আর তা এজন্য যে – আপনার পরিচিত সার্কেলে কাউকে এরকম মনে হলে যেন আপনি নিজে তাঁর ব্যাপারে সতর্ক হতে ও তাঁকে সতর্ক করতে পারেন।

দুই
প্রথমেই সোশাল এংজাইটি ডিজ-অর্ডার (SAD) নিয়ে কিছু কথা।
সোশাল এংজাইটি হলো “পাছে লোকে কিছু বলে” টাইপের একটা অবস্থা।
এমনিতে এই অবস্থাটা ঈষৎ বিব্রতকর বা কিছুটা বিড়ম্বণার হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা খুব একটা সমস্যার কিছু না।
তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই এংজাইটির ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রনাতিত হয়ে পড়ে। আর তখনই তা এসএডি নামক একটি মানসিক সমস্যা হিসাবে আবির্ভুত হয়।
যাদের ক্ষেত্রে এসএডি এই জটিলতা নিয়ে হাজির হয়, তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই নিকট রক্তসম্পর্কিয় কারো কারো মধ্যেও এই জটিলতার ইতিহাস খুজে পাওয়া যায়।
বাকিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় জীবনের কোনো এক পর্যায়ে তাঁরা জীবনের মোড় ঘোরানো কোনো না কোনো কু-অভিজ্ঞতার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
এটা হতে পারে ক্যারিয়ার বা বৈবাহিক বা অন্য এমন কিছু সম্পর্কিত যা তাঁকে অন্যদের থেকে সমাজে ম্রিয়মান অবস্থানে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছে।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে পাওয়া উজ্জ্বল কোনো সুযোগ অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে হাতছাড়া করার পর লেজে-গোবরে হয়ে ওঠা ক্যারিয়ার নিয়ে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে চাপে পড়া অথবা সামাজিক বিচারে সকলের কাঙ্খিত একটি বৈবাহিক সম্পর্ক অনাকাঙ্খিত কোনো কারনে ভেঙ্গে যাওয়ার পর পদে পদে জবাবদিহি করে বেড়ানো জাতীয় বিড়ম্বণা হতে পারে যার উদাহরণ।
দেখা যায় এসবের মধ্য দিয়ে যারা যেতে থাকে, তাঁরা পরবর্তিতে তাঁদের যেকোনো কাজের জন্যই “আশেপাশের লোকজন কি ভাবছে”, “সমালোচনা করছে না তো?”, “জাজমেন্টাল হচ্ছে নাকি?” – এজাতীয় কথা ভেবে ভেবে নানান মানসিক চাপ তো বটেই, এমন কি শারীরিক সমস্যারও মুখোমুখি হওয়া শুরু করে।
এবং দিনে দিনে এই শারীরিক সমস্যাগুলো এইসব এসএডি আক্রান্তদের জন্য জটিলতর হয়ে উঠতে থাকে।
সোশাল এংজাইটি থেকে যেসব শারীরিক সমস্যাগুলোর উদ্রেক হলে সমস্যাটিকে এসএডি বা সোশাল এংজাইটি ডিজ-অর্ডার নামে অবিহিত করা হয়, তা হলো:
– অল্পতেই আবেগ বা উৎকন্ঠাজনিত কারনে রক্তিমাকার ধারন করা বা excessive blushing,
– একই কারনে ঘেমে নেয়ে ওঠা বা excessive sweating,
– আতঙ্ক বা অসহত্বজনিত কাপুনি শুরু হওয়া বা trembling,
– বুক ধরফর করা বা palpitations,
– বমিভাব হওয়া বা nausea
– এমনকি, সময় সময় কন্ঠরূদ্ধ হওয়া বা তোলতামি শুরু করা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি।

এসএডি-র কারনে যারা প্রতিনিয়ত উপরের শারীরিক উপসর্গগুলি মোকাবেলা করতে থাকেন, তাঁরা যদি আনডায়াগোনাইজড ও আনট্রিটেড অবস্থায় চলতে থাকেন, দেখা যায়, তাঁরা তখন এ থেকে বেরুতে সেলফ-মেডিকেশনে প্রবৃত্ত হয়ে পড়েন। এই সেলফ মেডিকেশন বা সান্ত্বনা খোজার ছলে এঁরা যদি একবার মদ্যপানের মাধ্যমে বা অন্য কোনো সাবস্ট্যান্স এবিউজের মাধ্যমে এসব উপসর্গ উপশমের পথ খুজে পান, তাঁদের জন্য সেসবে আসক্ত হয়ে পড়াটা হয়ে পড়ে কেবলই সময়ের ব্যাপার।
কারো এসএডি আছে কিনা, এটা বোঝা খুব জটিল কিছু না।
মানসিক রোগ সম্পর্কিত সোশাল-স্টিগমা অতিক্রম করে এদেরকে এসএডি-চিকিৎসার আওতায় আনা না গেলে এদের জন্য মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়াটা প্রায় অবসম্ভাবি হয়ে দাঁড়ায়।
অথচ খুবই ট্রিটেবল এই এসএডি রোগটি নিয়ন্ত্রনে আনা গেলে একদিক দিয়ে তাঁদের জন্য যেমন একটা কোয়ালিটি-লাইফ নিশ্চিত করা যেতো, অন্যদিকে তাদেরকে যেকোনো ধরনের মাদকাসক্তি থেকেও দূরে রাখা যেতো।

আপনার চেনাজানা কাউকে এসএডি আক্রান্ত বলে মনে হলে, দ্রুত কারেক্টিভ মেজার নিতে আপনার পক্ষে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নিন। মনে রাখবেন, আপনার সময়োচিত পদক্ষেপের কারনে, জানুক বা না জানুক, একজন এসএডি আক্রান্ত ও তাঁর গোটা পরিবারই ঘটতে যাওয়া এক বিরাট দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে………
(চলবে…)

৫,৬০৮ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “মানসিকস্বাস্থ্য সমস্যা ও মাদকাসক্তি – ১”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

    আন্ডারগ্র্যাড করার সময় ইলেক্টিভ বিষয় হিসেবে বেশ কয়েকটি সাইকোলজি ক্লাস নেবার সুযোগ ঘটেছিল। সাইকোলজি ক্লাসগুলো আমার ভাবনার নতুন অনেক দুয়ার খুলে দিয়েছিল। বেশ উপভোগ করেছিলাম কেস স্টাডিগুলো। মানুষের বিচিত্রবর্ণ ভাবনা আজো আমাকে আকর্ষণ করে। আগেও বলেছি, তোমার লেখালেখির বৈচিত্র্য নিয়ে; আজ আবারও বলি, সিসিবিকে সম্পদশালী করছে তোমার এইসব লেখাগুলো!

    অনেকদিন পর এদিকে এলে, ভাইয়া! আশাকরি ভাল আছো।

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      তোমার প্রশংসা (মতান্বরে প্রশ্রয়) পেয়ে পেয়ে সাহস খুব বেশি বেড়ে গেছে।
      এই যে যা খুশি তাই নিয়েই লিখে যাই, না জানি এতে কতজন আবার এই ভেবে বিরক্ত হচ্ছে "মেরে আঙ্গিনা মে তুমারা কিয়া কাম হ্যায়..."।
      যা হোক এইভাবে প্রশ্রয় পেতে থাকলে লেখা চলবে...
      😀 😀 😀 😀 😀
      অনেক ধন্যবাদ পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য!!!


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    কোথায় সাহায্য পাওয়া যাবে সেটার উল্লেখ থাকলে হয়তো আরো ভালো হবে। আপনার পোস্ট দেখার পর আমি ঢাকায় কারা এই ধরণের সাহায্য দেয় গুগল করলাম। খুবই কম ফলাফল আসলো। ডিপ্রেসিং 😛


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      দেশে যেকোনো মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে সাহায্য পাবার শ্রেষ্ঠতম উপায় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগে যোগাযোগ করা।
      ওখানে একটা ফর্ম ফিল-আপ করে সমস্যার কথা সংক্ষেপে লিখে এলে তাঁরা সমস্যাটির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করে তাঁর কাছে কেইসটি রেফার করেন।
      বিশেষজ্ঞের সাথে দু'চারটা সিটিং দিলেই সমস্যার গভীরতা বোঝা ও সমাধানের লাইন খুজে পাওয়া সম্ভব বলে তাঁদের সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে।
      এরপর বাকি ট্রিটমেন্টের জন্য নির্দিষ্ট ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াটিস্টে সরণাপন্ন হলেই হলো।
      ক্লিনিকাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টি বা কলা ভবনের পাঁচ তালায়।

      এছাড়াও Mind Matters নামে একটা সংগঠনের কথা জানি যারা নানান মানসিক সমস্যা চিহ্নিত করার ও সেটার লাইন অব ট্রিটমেন্ট নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন।
      ফেসবুকে তাঁদের পাওয়া যাবে "mindmattersbd" এই কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে.........


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      অনেক ধন্যবাদ খায়রুল আহসান ভাই।
      আপনাদের মত কেউ কেউ সাহস দেন বলেই এতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠি।
      এ থেকে কেউ যদি কিছু তথ্য নেন, সেটাই সাফল্য বলে গন্য করবো।
      আর সেই সাফল্যের কৃতিত্ব আসলে সবারই।
      আমিতো মনে করি প্রথমতঃ সেই কৃতিত্ব হলো পাঠকের কারন তাঁরা যখন পড়তে আসেন, কোনো মটিভ ছাড়াই আসেন।
      এরপর একটা তথ্যময় লিখা দেখার পরেও বিরক্ত না হয়েও সেটা পড়েন।
      আবার কিছু কথা "টেইক হোম" হিসাবে সাথে নিয়ে নেন।
      অশেষ কৃতজ্ঞতা এই সকল পাঠকদের।
      এরপরেই কৃতিত্বের দাবীদার এই ব্লগ নির্মাতা ও এটা চালিয়ে নেয়া সকললের জন্য।
      তথ্যের ভুতে পাওয়া একদল তরুণ বছরের পর বছর স্বেচ্ছাশ্রমের মধ্য দিয়ে এরকম একটা ব্লগোদ্যগ চালিয়ে না গেলে কতজনেরই কিন্তু জীবনেও কিছু লেখা হতো না।
      সম্ভবতঃ লেখকের কৃতিত্ব অ্যান অব দ্যা লোয়েস্ট......
      😛 😛 😛 😛 😛


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।