ওবেসিটির প্রতিকার – প্রথম পর্ব

এক
যারা যারা জীবনে কখনো ওজন কমানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁরা খুব ভাল করেই জানেন যে, কাজটা মোটামুটিভাবে পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলার একটা।
কঠিন কেন? কারন:
১) মাসে দেহের ওজনের ১%-এর বেশী কমানোর চেষ্টা করলে সেটা স্ট্যাবল হয় না। অর্থাৎ দেখা যায়, ওজন কমেছে কিন্তু স্বাভাবিক খাদ্যে ফিরে গেলে দ্রুত আবার তার একটা বড় অংশই ফিরে আসছে।
২) শুরুর পর তিন থেকে চার সপ্তাহ ওজন কমেতো না ই, বরং দেখা যায় তা বাড়ছে। এটা খুবই ডিমোরালাইজিং।
৩) শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রনে ওজন কমে না। সাথে চাই কিছু নিয়মিত ওয়ার্ক আউট। একসাথে এই দুইটা নিয়ম করে চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। তাছাড়া, শরীর যদি কোনো ভাবে টের পায় যে, আপনি ওজন কমাতে চাচ্ছেন, সে ভিতরে ভিতরে এমন কিছু যড়যন্ত্র করে বসে যে, আপনি যেন আর ওজন কমাতে না পারেন।
এসব সামাল দিতে তাই সপ্তাহে ১ পাউন্ডের বেশী ওজন কমানোর টার্গেট সেট করা উচিৎ না।
আর ওয়ার্ক আউট টার্গেট ধরা উচিৎ ৩০-৬০ মিনিট সপ্তাহে ৪-৫ দিন।
এবার আসি ক্যালরি ইনটেকের ব্যাপারে।
একটা লিংক দিচ্ছি, এখান থেকে আপনার ক্যালরী রিকয়ারমেন্ট জেনে নিন।
এরপর তা থেকে ৫০০ কিলো ক্যালরি কমিয়ে সেই পরিমান এনার্জি পাওয়া যাবে, এমন একটা খাদ্যতালিকা তৈরী করুন।
নিজে এটা না পারলে একজন ডায়েটেশিয়ানের (বা নিউট্রিশনিস্টের) সহায়তা নিন।
৫০০ কিলো ক্যালরি কেন?
কারন দিনে এই পরিমান কম খেলে শরীর খুব একটা টের পাবে না। কিন্তু আপনি সপ্তাহে ৩৫০০ কিলোক্যালরি কম খাবেন। আর সেটা পুরন করতে শরীরে জমা থাকা ফ্যাট মবিলাইজ করে তা বার্ন করবে। শরীরের ১ পাউন্ড ফ্যাট থেকে ৩৫০০ কিলোক্যালরী তাপ পাওয়া যায়।
তারমানে আপনার ওজন সপ্তাহে ১ পাউন্ড করে কমে যাবে।
তবে মনে রাখবেন:
১) এত কিছুর পরেও, প্রথম ৩-৪ সপ্তাহ ওজন না কমে বরং বাড়তেও পারে। আর তা যদি হয়, বুঝতে হবে, ফ্যাট মবিলাইজেশন শুরু হয়েছে। চিন্তার কিছু নাই, সামনে শুভদিন আছে প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যান।
২) ওয়ার্ক-আউট হিসাবে মূলতঃ হাঁটার ব্যবহার করবেন। অন্য কিছুও করা যায় কিন্তু ৫.৫ – ৬ কিমি বেগে হাঁটার চেয়ে ভাল কোনো ওয়ার্ক আউট ওজন কমানোর জন্য নাই। এবং অবশ্যই ৩০-৬০ মিনিট। তাঁর বেশী বা কম না।
৩) শুরুতে আপনার বিএমআই (বডিমাস ইনডেক্স) জেনে নিন। এটা ২৩ এর কম হলে ওজন কমাতে চেষ্টা করা ঠিক না। বিএমআই বের করার ফর্মুলা:
BMI = (Weight in KG) / (Height in Metre-Squared)
৪) এনার্জি রিকয়ারমেন্ট ক্যালকুলেটরে “মডারেট এক্টিভিটি” সিলেক্ট করুন। কারন আপনি ওয়ার্ক আউট সহ ওজন কমাতে চাচ্ছেন।

দুই
স্থুলতা পরিহার করা কতটা জরুরী?
অত্যন্ত জরুরী।
কারন, স্থুলতা পরিহার করতে পারলে আপনি যে শুধু শারীরিক ও মানসিক ভাবেই সুস্থ্য বোধ করবেন, তা না, আপনার অনেক ধরনের অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হবার ঝুকিও কমে যাবে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
– ডায়াবেটিস
– হাইপারটেনশন
– হার্ট ডিজিজ ও স্ট্রোক
– অস্টিও-আরথারাইটিস
– গাউট
– পিত্তথলির পাথর সহ পিত্তথলির অন্যান্য জটিলতা
– বেশ কয়েকধরনের ক্যান্সার
– শ্বাসকষ্ট, স্লীপ এপনিয়া, এজমা
তাছাড়া স্থুলতা অনেকের সেলফ-এস্টিম কমিয়ে তাঁকে বিষন্নতার দিকেও নিয়ে যেতে পারে।
এর সবগুলো যদিও কেবলই স্থুলতা থেকে হয় না, কিন্তু স্থুলতা যেসব বিষয়ে সরাসরি কন্ট্রিবিউট করে, তা থেকে এগুলোতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। সেসব বিষয় হলো: গ্লুকোজ ইনটলারেন্স, হাইপার লিপিডেমিয়া, হাইপার এসট্রোজেনেমিয়া, হাইপার টেনশন, বাম ভেন্টিকুলারের হাইপারট্রপি, ইত্যাদি। এছাড়াও অতিরিক্ত ওজনের ভার বহন করতে গিয়ে হাড়ের ক্ষয় বেশী হয়, জয়েন্টগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু ভিটামিন ডি ফ্যাটের ভিতর ট্র্যাপড থাকায় হাড়ের ক্ষয়পুরন বাধাগ্রস্ত হয় অথবা আনইভেন ভাবে হয়। এসবের কারনে জীবন হয়ে উঠতে পারে ব্যাথ্যাময়।
আরেকটা কারনে স্থুলতা জীবনকে ব্যাথাময় করে তুলতে পারে।
স্থুলতার কারনে দেহে ফ্যাটের আধিক্য ঘটে। শরীরে ফ্যাট বেশী থাকলে ইনসুলিনের উপস্থিতিও বাড়ে। এই বাড়তি ইনসুলিন ইউরিক এসিডের নিষ্কাসন বাঁধাগ্রস্ত করে দেয়। এই কারনে যে ইউরিক এসিড শরীরে জমা হয়ে গাউট বা বাতের সৃষ্টি করতে পারে। আবার একবার গাউটে আক্রান্ত হলে এবং ওজন না কমাতে পারলে ব্যাথার আক্রমণ গুলো তুলনামূলক ভাবে ঘন ঘন হতে থাকে। জীবন হয়ে পড়ে যন্ত্রণাময়…

দেখা যাচ্ছে, উপরে লেখা রোগগুলির শুধু ঝুঁকি কমাতেই না, সেগুলোতে আক্রান্ত হবার পর সাফারিং কমাতেও স্থুলতার রাশ টেনে ধরাটা খুবই জরুরী……

তিন
দুইটা ব্যাপার ক্ল্যারিফাই করে দেই আজ।
১) কেন ওজন কমানোর ব্যাপারে “ধীরে চলো” নীতিটা অধিকাংশ মানুষের জন্যই শ্রেয়তর।
২) শুধু ডায়েটিং বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণই নয়, কেন কিছু শারীরিক এক্টিভিটি যোগ করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

ধীরে চলার ব্যাপারে আগেও বলেছি, যে ওজন কমানোর ব্যাপারে এটা হলো স্ট্যাবল অপশন।
অর্থাৎ ধীরে ধীরে যে ওজনটা কমে, শরীরের অন্য সব ফাংশান তাঁর সাথে বেশী ভাল ভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার সুযোগ পায়। এতে করে ওজন হ্রাস সম্পর্কিত চেঞ্জ খুব একটা অনুভুত হয় না। আর এজন্য দেখা যায়, হারানো ওজনটাও আর খুব সহজে ফিরে আসে না।
তাছাড়া যারা বেশী স্থুল থাকেন, তাঁদের জন্য আরেকটা লাভ হলো, চর্বি কমার সাথে বাড়তি চামড়াটাও কমে আসার একটা সুযোগ তৈরী হয়।
দ্রুত ওজন কমালে তখন কারো কারো বাড়তি চামড়াটা অস্ত্রপ্রচার ছাড়া ঠিক অবস্থায় আনাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

ডায়েটিং এর পাশাপাশি এক্সাসাইজের গুরুত্ব বুঝতে একটু বাড়তি তথ্য জানা দরকার। শরীরে জমা হওয়া ফ্যাট অনুগুলি যেখানে গিয়ে অবস্থান করে তা হলো এডিপোস টিস্যু।
শরীরে জমা এই ফ্যাটকে অবস্থানানুযায়ি দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
শরীরের উপরভাগের বেশিরভাগ ফ্যাট-অনু যে এডিপোস টিস্যুতে গিয়ে জমা হয়, সেগুলো থাকে স্থিতিস্থাপক। এঁরা সংখ্যায় খুব না বেড়েও নিজেদের মধ্যে প্রচুর ফ্যাট-অনু ধারণ করতে পারে। কিন্তু শরীরের নিচেরভাগের বেশীরভাগ ফ্যাট অনু জমা হবার জন্য নতুন নতুন এডিপোস টিস্যু তৈরী হতে হয়। কারন এরা খুব বেশী ফ্যাট-অনু একটি সেলে ধারণ করে না।
তাই কেউ, বিশেষ করে নারীরা, যখন শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ফ্যাট মবিলাইজেশনের চেষ্টা করেন, দেখা যায়, এজন্য সরবরাহটা আসে আপার বডিফ্যাট থেকে। কারন অনুর ঘনত্ব কম বলে এখান থেকে সরবরাহ পাওয়াটা সুবিধাজনক।
আর এই জাতিয় এডিপোস টিস্যু যে যে জায়গায় বেশী থাকে, কোপটা ভারসাম্যহীন ভাবে ওখানে গিয়ে পড়ে।
অনেক নারীকেই বলতে শুনেছি, ডায়েটিং শুরুর অল্প পরেই তা ছেড়ে দিয়েছেন কারন ওজন কমানোর শুরুতেই বক্ষস্ফিতি দ্রুত কমে গিয়ে তাঁদের সৌন্দর্য্য হুমকির মুখে ফেলে দেয়। তাই তাঁরা আর এটা নিয়ে এগুতে উৎসাহ পান না।
আপার বডিফ্যাট কেবল ডায়েটিং-এ সহজে মবিলাইজ করা গেলেও লোয়ার বডি ফ্যাট মবিলাইজেশনের জন্য এর পাশাপাশি দরকার এক্সাসাইজের। তাই সারা শরীরের ফ্যাট একসাথে মবিলাইজ করার জন্য ডায়েটিং আর এক্সাসাইজ, এই দুই যুগপৎ ভাবে করাটা খুবই জরুরী।
এটা না করা হলে যে ভারসাম্যহীন ওজন কমে, তা স্বস্তি দেয়ার বদলে বরং অন্যভাবে অনেকের সেলফ-এস্টিম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে………

ওবেসিটির প্রতিকার – দ্বিতীয় পর্ব

৮,৯৩৬ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “ওবেসিটির প্রতিকার – প্রথম পর্ব”

  1. অনেক কিছু জানলাম।একটা কথা ঠিক বলেছেন যে ওজন কমানোর কাজটা মোটামুটিভাবে পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলার একটা... 🙁
    আমিও এর একজন প্রত্যক্ষ ভুক্তভুগি।চেস্টা করছি ওজন কমানোর কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না.. 🙁
    দেখি এখন আপনার লিখা ফলো করতে পারি কিনা।

    ধন্যবাদ এত সুন্দর করে সবকিছু ব্যাখ্যা করার জন্য

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : Saikat Roy Chowdhury

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।