হাইটেক ফ্লার্টিং-এর হালচাল

এক
কর্পোরেট নামের এই শর্টফিল্মটা দেখতে দেখতে হাইটেক ফ্লার্টিং নিয়ে ভাবছিলাম।
এটা কারা করে?
কেন করে??
কিভাবে করে???

শুরুটা হয়েছিল মোবাইল টেকনোলজির সহজপ্রাপ্যতার সময় থেকে।
পদ্ধতি ছিল, র‍্যানডম কল করে বিপরীত লিঙ্গিয় একজনকে পাওয়া।
২৫টা কল করে এরকম ৮-১০ জনকে পাওয়া যেত।
এরপর তাঁদের কে আড্ডা দেবার অনুরোধ। প্রথম প্রথম যা খুবই নির্দোষ আড্ডায় সীমাবদ্ধ থাকতো ৎ।
দেখা যেতো ঐ ৮-১০ জনের মধ্যে দুই-একজন পাওয়া যেতই, যারা আড্ডায় রাজী হয়ে যেত।
আর একবার তা শুরু হলে তা ডালপালা মেলতো নানা পথে…

সোশাল মিডিয়া আসার পর ব্যাপারটা হয়ে গেল আরও অনেক সহজ।
সিঙ্গেল যে কাউকে নিরিবিলি সময়টাতে অনলাইন দেখলে নক করে দেখা আলাপে উৎসাহ আছে কিনা। তাছাড়া প্রোফাইল দেখে ইন্টারেস্ট বুঝে শর্ট লিস্ট করার একটা সুযোগও থাকে।
সাকসেস রেট অনেক হাই, আবার ঝামেলা ও টাইম ইনভেস্টমেন্ট অনেক কম…

ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে অনেক আলাপ হলো। মূল প্রশ্নের উত্তরে যাই।
১) কারা করে?
এদের বেশিরভাগই হলো নিসঙ্গতায় আক্রান্ত নারী-পুরুষ। অবশ্য কিছু কিছু অবশ্য অসদোদ্দেশ্যেও করে। তবে যারা এগুলো করে, তাঁদের একটা ব্যাপার খুবই কমন। আর তা হলো, পূর্ব অভিজ্ঞতা…
কারন খুব ভাল পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এতটা বিশ্বাসযোগ্য ও কনভিন্সিং ভাবে শুধু লেখা দিয়ে একজন সম্পুর্ন বা প্রায় অপরিচিতের দৃষ্টি আকর্ষন করা মোটামুটি অসম্ভব।
২) কেন করে?
মূলত নিসঙ্গতা কাটাতে। তবে অন্য উদ্দেশ্যও থাকে। সিরিয়াস কোনো রিলেশনে ঢোকার কোনো ইচ্ছা এদের থাকে না। অন্যান্য শর্টরান উদ্দেশ্যের মধ্যে এডভেঞ্চার, হ্যাপি টাইম, টাইম পাস, এমনকি শুধুই সেক্স হতে পারে উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্যগুলি যে শর্টরান, তাঁর প্রমান: যেরকম অবলিলায় গভীর রিলেশনে এঁরা জড়ায়, একই রকমের সাচ্ছন্দের সাথেই তা থেকে এঁরা বেরিয়ে যায়। যেন কিছুই ঘটে নাই মাঝের দিন গুলায়!!! তাজ্জব না? এই ছবিটিতেও দেখানো হয়েছে, কতটা তুচ্ছ কারনে এক কথায় সম্পর্কটা টার্মিনেট করে দিলো ছেলেটা। ঠিক যেভাবে শুরুটা হয়েছিল ছোট্ট একটা কথা দিয়ে…
৩) কিভাবে করে?
পুরুষরা বেশিরভাগই বেছে নেয় মধ্যবয়সি সিঙ্গেলদের এবং তাঁদের কাছে নিজেকে খুব কেউকেটা কিন্তু একাকিত্বে ভোগা একজন হিসাবে উপস্থাপন করে। আর নক করার পর এটাই বুঝাতে চায়, তাঁর জীবনের আর সব কিছুই কানায় কানায় পরিপুর্ণ শুধু আপনার মত কেউ একজনের অপেক্ষায় বাকিটা আটকে আছে। আপনাকে কিছুই করতে হবে না, মাঝে মধ্যে খালি একটু আধটু কথা বললেই হবে।
নারীরা শুরুটা করে নিজেকে একজন স্বাধীনচেতা কিন্তু সামাজিক-পারিবারিক ভাবে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, শৃখলাবদ্ধ এমন কেউ হিসাবে উপস্থাপন করে যার জন্য আপনার মত একজন “নাইট ইন শাইনিং আর্মার” দরকার এ থেকে মুক্তির জন্য।
শুরুটা এরকম নির্দোষ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে হলেও খুব শিঘ্রই এঁরা মূল প্রসঙ্গে অর্থাৎ হাইটেক ফ্ল্যাটারিং-এ ঢুকে পড়ে……
পরের অধ্যায়ে সেই জানাচ্ছি এতে ঢোকার পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে।

দুই
ফ্লার্টিং ইনিশিয়েটর নারী হোক বা পুরুষ, এই পর্যায়ে তাঁদের আলাপচারিতার মুখ্য অংশ অধিকার করে থাকে জালে আটকা পড়া শিকারের প্রশংসা ও স্তুতি।
শিকার যদি প্রচলিত অর্থে দেখতে শুনতে ভাল হয়, তাহলে তো প্রশংসা স্তুতির টপিকের কোনো অভাবই নাই। কিন্তু তা না হলেও তখন, গলার স্বর, কথা বলার স্টাইল, তাকানোর ভঙ্গি, পার্সোনালিটি, হাসি, শিক্ষা-জ্ঞান, রুচি, চাল-চলন, সেন্স অব হিউমার, সংস্কৃতিমন, ইত্যাদি হেন কোনো ইস্যু নাই যাকে অবলম্বন করে প্রশংসা বানে জর্জরিত করে ফেলা হতে থাকে তাঁকে।
এইভাবে কথায় যখন চিড়া ভেজে ভেজে, তখন প্রস্তাব আসে দেখা সাক্ষাতের।
প্রথম সাক্ষাতের জন্য সাধারনতঃ বেছে নেয়া হয় খুবই নিউট্রাল কোনো স্থান বা পাবলিক প্লেস (যেমন রাস্তার চটপটি পার্লার, কোনো মেলা বা এগজিবিশন, ইত্যাদি)। এটা মূলতঃ একটা ইনকুলেশন বা স্বাভাবিকিকরন প্রচেষ্টা।
দ্বিতীয় সাক্ষাতে আরেকটু এক্সক্লুসিভ স্থান নির্বাচন করা হলেও এবার টার্গেটের মতামত প্রাধান্য দেয়া হয় (যেমন রেস্টুরেন্ট, থিয়েটার, সিনেমা হল, ইত্যাদি)।
এসবের মধ্য দিয়ে শিকারী তাঁর একটা গ্রহনযোগ্যতা দাড় করিয়ে ফেলে।
আর তা দিয়ে তৃতীয় সাক্ষাতের জন্য নিজেই নির্ধারন করে ফেলে নেক্সট কবে কোথায় যাবে।
নারী শিকারীরা বেছে নেয় কোনো আত্মীয়, বন্ধু বা বান্ধবির নিরিবিলি বাসা। আর পুরুষ শিকারী আরও সঙ্গিসাথি সহ কোনো রেস্টুরেন্ট অথবা লংড্রাইভ…
এই সেশনটায় আরও অনেকে থাকে। তাই সারাক্ষণ হৈ চৈ-এ কাটে এটা।
তবে শেষ দিকে কিছু একটা টুইস্ট থাকে উইথ সাম ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট।
পুরুষ শিকারীর ক্ষেত্রে ড্রপ করতে চেয়ে গাড়িতে একাকী হওয়া অথবা সবাই চলে যাওয়ার পর লাস্ট এককাপ চা-কফি খাওয়ার উসিলায় কিছুক্ষন একা থাকা, এবং সেই একা থাকা সময়টাতে অত্যন্ত নিরাপদ দুরত্ব মেন্টেন করে আস্থা অর্জন করা যে পুরুষ হলেও সে কতই না নিরাপদ…
নারী শিকারীদের ক্ষেত্রে বিদায়ের সময় যতদুর সম্ভব একাকী এগিয়ে দিয়ে অপলক তাকিয়ে থেকে মুগ্ধতা পূর্ন দৃষ্টি বিনিময়, যেন এরপর সেখান থেকে আলাপ শুরু করা যায়।

মজার ব্যাপার হলো, এই পর্বটা সফলভাবে শেষ করতে পারলে শিকার এক্কেবারে নাগালের মধ্যে এসে যায়।
শিকার তো গদ গদ হয়ে ভাবে, “আমার জন্য তাঁর এত ব্যাকুলতা! যাই এগিয়ে, কি আছে জীবনের।”
অথচ শিকারী তাঁর সঙ্গিসাথিদের নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে, “যা দিলাম না আজ সবাই মিলে? মুর্গা (বা মুর্গি) তো পুরাই রেডি স্লটারড হবার জন্য!!! চল এখন তাহলে একটা দিন-তারিখ ও ভেন্যু খুজে বের করি ফাইনাল কোপটা বসাতে………”

তিন
এই পর্যায়ে হাইটেক ফ্লার্টিং এর প্রস্তুতি শেষ হলে পর শিকার ও শিকারী উভয়েই রিয়েল ফ্লার্টের জন্য ঐক্যমতে আসে। এখন তাঁরা ফুললি রেডি টু গিভ এ ট্রাই।
এই পর্যায়ে তারা দুজনে মিলে ঠিক করে নেয়, কি কি করবে, কতটা করবে, কিভাবে করবে, কোথায় করবে – ইত্যাদি।
তবে এখানে শিকারীর একটা আপার হ্যান্ড থাকে। আর তা হলো এই যে, সে ঠিক করে, এটা কতদিন চলবে…
এটার পিছনে যে কারনগুলা কাজ করে, তা হলো:
– একজন শিকারীর কাছে এই হাইটেক ফ্লার্টিং ইজ মোর অব এ গেইম। আর নতুন নতুন শিকার ধরা তাঁর সেই গেইমের এক একটা সাফল্য। একটা শিকার ধরার পর কিছুদিন সেটার সাথে সে কাটাতেও পারে, নাও পারে। দেখা যায়, খুব শিগগিরিই তাকে আবার নতুন শিকার ধরার নেশায় পেয়ে বসে। এটা থাকতে থাকতেই সে নেক্সট একশন শুরু করে। আর তাতে সাফল্য যখন নিকটবর্তি, তখন এটাকে তাড়ানো হয়ে পড়ে বাধ্যতামূলক। একদম না তাড়ালেও অন্ততপক্ষে একটা লম্বা ব্রেক নেয়া তো খুবই জরুরী হয়ে পড়ে…
– শিকার সাধারনত বোঝেই না যে সে ধরা খেয়ে লটকে আছে। দেখা যায়, সে এটাকে ট্রু লাভ ধরে নিয় আটকে আছে। অথবা ধাওয়া খেয়েও যাচ্ছে না। তখন ব্রেক নেয়ার অপশনটা সে মেনে নিচ্ছে যখন শিকারী তাঁর নেক্সট হান্টিং সেশনে ব্যাস্ত।
– এই শিকারীদের এরকম হান্টিং-এর আরও এক্সপেরিয়েন্স থাকে। আর তাই তাঁরা জানে, একজনে তাঁরা বেশিদিন মনযোগ রাখোতে পারবে না। এটা যখনই তাঁদের জন্য বোরডম তৈরী করে, নতুন কাউকে পাক না পাক, আগেরটা তাঁরা টার্মিনেট করে…

টার্মিনেটেড হবার পর কি হয় শিকারের পরিনতি?
– কেউ কেউ খুবই হতাশ হয়ে প্রেম ভালবাসার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। হতাশার অন্যান্য ইফেক্ট যেমন ডিপ্রেশন, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়। সুইসাইডালও হয়ে উঠতে পারে কেউ কেউ।
– সব ভুলে গিয়ে কেউ কেউ নতুন করে সম্পর্কে জড়ায়, পর্যাপ্ত সতর্কতা নিয়ে।
– কেউ কেউ শিকার করার লেসনটা নিজে ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয় আর এ থেকে লেসন নিয়ে নিজেও হয়ে ওঠে এক নব্য শিকারী…

কি হয় এসব শিকারীদের পরিনতি?
যাদের একবার এই হান্টিং স্প্রিতে পেয়ে বসে, তাঁদের লাভ লাইফ পুরাই ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যায়।
ভবিষ্যতে কাউকে এঁরা আর বিশ্বাস করতে পারে না।
প্রত্যেকটা শিকারকে “তুমিই আমার শ্রেষ্ঠ প্রেম” বলতে বলতে এঁরা নিজের প্রেমটাই খুইয়ে বসে। দিনের শেষে ভাল থাকাটা না, শুধু নাম্বার গোনাটাই হয়ে ওঠে এদের লাভ লাইফের গন্তব্য।
এদের মধ্যে পুরুষ হান্টার যারা থাকে, তাঁদের প্রচুর পয়সা ও সময় ব্যয় করা লাগে এসবের পিছনে। এতে করে ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চাকুরিও হারাতে হয় কখনো সখনো। আর যাদের সংসার থাকে, সেটার অবস্থা হয়ে পরে একেবারেই না ঘাটকা না ঘরকা। শুধু স্ত্রীই না, সন্তানরাও অনেক সময় এর পরিনতি ভোগ করে।
শিকারী নারীদের অর্থ ব্যয় হয়তো খুব একটা হয় না, কিন্তু রেপুটেশন খুব খারাপ হয়ে যায় ২-৪টা কেস ডাম্প করার পরেই।
কারন এইদেশে নারীর কলঙ্কের চেয়ে মুখরোচক আলাপ বোধহয় আর কিছুতেই নাই।
আর এ জাতীয় কলঙ্ক একবার ছুতে পারলে সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো হয়ে পড়ে নেয়ারলি ইম্পসিবল…

দেখা যাচ্ছে, এরকম হাইটেক ফ্লার্টিং গুলায় তাৎক্ষণিক কিছু প্লেজার থাকলেও লংরানে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব পক্ষই।
সেটা জেনে বুঝে ক্ষনিকের মোহাক্রান্ত হয়ে তারপরেও কি এসব আমরা চালিয়ে যাবো?

৬,০৩৫ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “হাইটেক ফ্লার্টিং-এর হালচাল”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    ভার্সিটি লাইফে কাছের বন্ধুকে দেখেছি শিকার হয়ে কীরকম ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছিলো। তবে সুখবর হচ্ছে এখন সে সেসব ভুলে গিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করছে।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      প্রথম তথ্যটা দুঃখজনক হলেও পরেরটা আশার।
      আমার এসব লেখালেখি করার পিছনে একটা উদেশ্য হলো মানুষকে উৎসাহিত করার তাঁদের অভিজ্ঞতা বা জানা ঘটনাগুলো এরকম নাক উল্লেখ না করেই শেয়ার করুক।
      এতে করে ঘটনার শিকার হওয়া মানুষগুলো আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পাবে।
      তাঁদের মুষড়ে পড়ার পিছনে একটা বড় কারন হলো এগুলো নিয়ে লুকোচুরি করার কারনে এটা ভাবা যে "আমি একাই বুঝি এই ধরনের ঘটনার শিকার। তাই কেউ আমার কোনো কাজে তো আসবেই না বরং অন্য কেউ জানলে আমার অবস্থা আরও খারাপ করে ছেড়ে দেবে।"
      অবশ্য নারীদের এ জাতিয় ঘটার স্লাট-শেইমিং-এর মুখোমুখি হতে হয়, সেটা ঠিক, কিন্তু ঘুরে না দাড়ালে যে সেটাও বন্ধ করা যাবে না - তাও বুঝতে হবে...
      মন্তব্যটার জন্য ধন্যবাদ। কারন এই কঠার পিঠে আরও অনেক কিছু বলতে পারলাম... 🙂 🙂 🙂


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।