আমার মায়েরা…

আজ কেন যেন খুব মায়ের গল্প করতে ইচ্ছা করছে।সচরাচর যা আমি করিনা…মা দিবসে সবাই মাকে নিয়ে পোস্ট দিয়ে ফেবুতে ঝড় তুলে দেয়।আমি চুপ থাকি।আমার যা বলার আছে ফেসবুকের একটা স্ট্যাটাস এর সাধ্য নাই তা বলার।আজকে বলতে ইচ্ছা করছে খুব।

আমার মায়ের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য মাত্র সতের…গ্রামে হয়তো ব্যাপারটা
খুবি স্বাভাবিক…কিন্তু একটি অবস্থাপন্ন বাড়ির সবচে ছোট মেয়ের জন্যে জীবনের অর্থ কখনোই সংসার,সন্তান কিংবা চারদেয়ালের মাঝে দিন কাটানো,সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় অফিসফেরত স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করার মাঝেই আটকে ছিল না…..হবে কেমন করে…মফস্বলে বেড়ে ওঠা আমার মা শুনতেন এলভিস প্রিসলি…পরতেন গোর্কি…মা চেয়েছিলেন অনেক বড় হতে…আব্বু মাকে দেখতে চেয়েছিলেন আর দশটা বাঙালি বউ এর চেয়ে অনেক আলাদা…অনেক স্বাধীন…বাড়ির ছোট বউ আমার মা তাই শাশুড়ি জা এর সব আদেশ মেনে,সব কাজ সামলে সারারাত ধরে পরতেন এস এস সি এর জন্যে…আমাকে নিজের ভিতর বয়ে নিয়ে মা মাইল মাইল হেঁটে গিয়েছেন পরীক্ষা দিতে…ম্যাট্রিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত প্রতিটা পরীক্ষায় আমার মায়ের রেজাল্ট নিয়ে আমার আব্বু এবং আমরা এখনো গর্ব করি…

এইচ এস সি এর পরপরই আম্মুর চাকরী হয়ে যায়…শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম হয়ে আমার মা শুরু করেন তার কর্মজীবন।আমার এত্ত সফল মায়ের একটা বড় আফসোস,তিনি আমাকে সময় দিতে পারেননি।আমি অন্যের কোলে কোলে বড় হয়ে গেছি…
আমার কিন্তু খারাপ লাগেনা।আম্মুর জন্যে কিছু ত্যাগ হয়তো বড় সন্তান হবার কারনে আমাকে করতে হয়েছে,কিন্তু আমি যা পেয়েছি…হলফ করে বলতে পারি আর কারো তা নাই…অসাধারন কিছু মহিলার স্নেহ পেয়েছি জীবনে. ..সবাইকেই কেন যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মা ডেকেছি…
আমার দাদার কোন বোন ছিল না…আমার কোন ফুফুও নাই…দাদীর অতিরিক্ত ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর কল্যানে আব্বুরা মাত্র দুই ভাই…আমার বড়চাচীর দুই ছেলে…দাদীর খুব শখ ছিল একটা নাতনীর…বংশের প্রথম মেয়ে…চাচির পরপর দুইটা মেয়ে হয়ে মারা যায়…তার অবস্থা হয়ে যায় পাগলের মত…সন্তানসম্ভবা আমার মায়ের উপর অনেক চাপ ছিল তাই,একটা মেয়ের জন্যে…আমি হলাম…আমাকে প্রথম দেয়া হল পাগলপ্রায় আমার চাচীর কোলে…আমাকে দেখেই তিনি বললেন ‘আমার মেয়ে’…তারপর থেকেই উনি আমার বড়মা।আমি ডাকতাম বম্মা।এখনো ডাকি।নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি আদর করা যায় কিনা…আমার বম্মা দেখিয়েছেন…

আম্মু সকালে রেখে যেতেন দাদীর কাছে।গলির মাথায় দাঁড়িয়ে দাদীর কোলে আমি ছলছল চোখে বলতাম ‘আমাকে নিয়ে যাও’…আম্মু চোখ মুছতে মুছতে হাত নাড়তেন।তারপর আমি পাড়া বেড়াতাম দাদীর কোলে চড়ে।প্রায়ই দেখা যেত আমার বাসায় অন্য বাসা থেকে টমেটো,ইলিশ মাছের ডিম কিংবা চিংড়ি পাঠানো হয়েছে…কেন?আমি নাকি কোনদিন বেড়াতে গিয়ে খুব পছন্দ করে খেয়েছিলাম,তাই…সব বাড়িতেই নাকি আমার একটা করে মা ছিল…মনিমা…খুশিমা…আরো অনেক…আমি স্বার্থপর…সবার কথা মনেও নাই…

মায়ের ট্রেনিং এর সুবাদে চার বছর বয়সে চলে যাই জয়দেবপুর।দুই বছর কেটেছে সেখানে।প্রতিসকালে মা ঘুম থেকে তুলে কপালে চুমু দিয়ে চলে যেত।আমি আবার গিয়ে শুয়ে পরতাম পাশের ফ্ল্যাটে।নিঃসন্তান এক মহিলা থাকতেন সেখানে।তাকে ডাকতাম আম্মি।দুই বছর আমাকে মাতৃস্নেহে মানুষ করেছেন তিনি।সারা বাড়ি আমার পেছনে দৌড়িয়েছেন ভাতের প্লেট হাতে।সকল জ্বালাতন সহ্য করেছেন আমার।আমার একবার দশদিন ধরে নাকি জ্বর ছিল।আর সে সময় আম্মি সারারাত আমার মাথার পাশে বসে থাকতেন।সবই মায়ের কাছে শোনা।চলে আসার পর কখনো কথা হয়নি আমার তার সাথে।মা আব্বু যোগাযোগ রেখেছে অনেকদিন।আমি বড় হয়ে কখনোই খোজ নিইনি।

ক্যাডেট কলেজে পেয়েছি আরেকজন কে।এস এস সি পরীক্ষার মাঝে ভীষন জ্বরে হসপিটালে আমি।পুরো হসপিটালে একলা আমি।কি যে খারাপ লাগত।এক রাতে জ্বরে আমি আধো ঘুম আধো জেগে আছি।খারাপ লাগছে খুব।হঠাত দেখি,কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।চোখে পানি এসে গেল।এই এক ব্যাপার আমার আছে।মাথায় কেউ হাত রাখলে এত্ত ভালো লাগে।আমার অনেক রুমমেট,ডর্মমেট আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত।স্কুলে একবার জ্বরে হেড ডাউন করে আছি।ক্লাসে আমার একমাত্র শত্রু মিথিলা এসে মাথায় হাত রেখেছিল।তখন থেকেই ভাললাগাটা শুরু।কলেজে সারওয়ার স্যারকে একদিন বলেছিলাম,স্যার আমার মাথায় হাত রেখে একটু দোয়া করে দেন তো!এরপর থেকে আমাকে দেখলেই স্যার দোয়া করে দিতেন…
যাহোক হসপিটালের সেই মধ্যরাতের হাতটা ছিল আমেনা বুয়ার…এরপর ইলেভেন টুয়েল্ভ প্রায়ই যেতাম হসপিটালে,শুধু উনার জন্যে।আম্মা ডাকতাম তাকে।বৃদ্ধ সেই মহিলা এক শবে বরাতে বাড়ি থেকে আমার জন্যে নানা রকম হালুয়া,রুটি সেমাই এনে এক কোনায় ডেকে নিয়ে বলেছিলেন,খেয়ে নিয়েন…সবাইকে নিয়ে…রুমমেটরা সব হামলে পরেছিল বাটির উপর…আমি কেন যেন খেতে পারিনি…আম্মাকে এক ঈদ ছাড়া আর কখনোই মনে করা হয়না…এমনই স্বার্থপর আমি…

এত্ত লিখতাম না আজকে।গাজিপুর যাচ্ছিলাম আজ।হঠাত কি মনে করে জয়দেবপুর,যে বাড়িতে আমরা থাকতাম তার সামনে গিয়ে মা বলল গাড়ি থামাতে।সবাই গেলাম।একজন অসুস্থ মহিলাকে দেখিয়ে মা বললেন চিনতে পারছ?তোমার আম্মি…আমি মাথার দুপাশে ঘাড় নেড়েছি।আম্মি কিন্তু একটুও রাগ করেননি…আমাকে পাশে বসিয়ে কি যে আদর করলেন…আসার সময় মাকে একটা ছোট্ট ভেলভেটের ব্যাগ দিয়ে বললেন,পিউএর জন্যে অনেকদিন ধরে রেখেছি।খুলে বের হল,দুটা সোনার চুড়ি,দুটা ঝুমকা…আর একটা হার।আমাকে বললেন,বিয়েতে পরিস।নেবনা বলেছি,কেঁদেই ফেললেন।আমার আর সাহস হয়নি মানা করার।কিন্তু স্বার্থপরের মত ব্যাগটা বওয়ার শক্তিও ছিল না…সারাটা পথ কেমন যে লেগেছে…

এইটুকু জীবনে অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল না…পাওয়ার কথা ছিল না…পেয়েছি,হয়তো আমার মায়েদের আশীর্বাদ সাথে ছিল বলেই…মায়েরা বোধহয় এমনই হয়…জগতের সকল মা সুখে থাকুক…

৪,৩৯১ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “আমার মায়েরা…”

  1. নাফিজ (০৩-০৯)

    লেখার আবেগটুকু খুব স্পর্শ করে গেলো।

    কিছু লেখাকে শুধু "অসাধারণ লেখা " টাইপের কমেন্ট দিয়ে প্রশংসা করলে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। more than a writing.

    এই মায়েদের জন্যই বোধহয় সব রেখে পালিয়ে যেতে পারিনা।

    :thumbup:


    আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।

    জবাব দিন
  2. মীম (২০০৬-২০১১)
    এইটুকু জীবনে অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল না…পাওয়ার কথা ছিল না…পেয়েছি,হয়তো আমার মায়েদের আশীর্বাদ সাথে ছিল বলেই…মায়েরা বোধহয় এমনই হয়…জগতের সকল মা সুখে থাকুক…

    আপু ভাষা হারিয়ে ফেললাম তো...... :boss: :boss: :hatsoff: :hatsoff:

    জবাব দিন
  3. শরিফ (০৩-০৯)

    একবার ছুটিতে বাসায় গিয়েছি । তখন শীতকাল । আমার জন্য আম্মু দুইটা কম্বল দিয়ে গেলেন । আর যাওয়ার সময় বললেন আরও কম্বল লাগবে কিনা ? আমি বললাম না । আসলে বাসায় যে পরিমাণ কম্বল আছে তাতে সবার ভাগে দুইটার বেশি কম্বল দেয়া সম্ভব না । রাতে ঘুমিয়েছি । সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার গায়ে ৩ টা কম্বল । পরে আম্মুর রুমে গিয়ে দেখি আম্মুর কাছে ১টা কম্বল । রাতে এসে চুপচাপ আর একটা কম্বল আমাকে দিয়ে গেছেন ।
    আসলে মায়ের ভালবাসা বলে শেষ করা যাবে না । কিন্তু আমরা অনেক সন্তান আছি যারা বাবা মায়ের ঠিক ঠাক মতো দেখাশুনা করিনা বড় হবার পর । বাবা মায়ের কষ্টের কথা মনে রাখি না ।
    লেখা অনেক ভাল হইছে । :clap:

    জবাব দিন
  4. রেজা শাওন (০১-০৭)

    লেখাটা সুযোগ হলে তোমার মা'কে পড়াবে। ভালবাসার এই ব্যাপারগুলো অন্য সবার চেয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছানোটা অনেক বেশি জরুরী বোধহয়।

    তোমার লেখা পড়তে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়েছি। ভাল থেকো। দোয়া থাকলো।

    জবাব দিন
    • পিয়া(০৩-০৯)
      ভালবাসার এই ব্যাপারগুলো অন্য সবার চেয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছানোটা অনেক বেশি জরুরী বোধহয়

      কথা খুবি সত্যি।কিন্তু এই জিনিসটা কখনোই কেন যেন হয়ে উঠলোনা...আমরা তথাকথিত স্মার্ট প্রজন্ম হলেও আজ পর্যন্ত কখনোই মাকে বা বাবাকে সরাসরি বলতে পারলাম না তোমাকে অনেক ভালবাসি।কেমন যেন একটা বাধোবাধো ঠেকে। এই লেখাটাও অনেকটা কনফেশান...যারা অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন,তাদের জন্যে কখনো কিছুই করতে না পারার অপরাধবোধ কাজ করেছে...তা থেকেই লেখা...পড়ার জন্যে থ্যাঙ্কস... 🙂

      জবাব দিন
  5. Tameema

    :boss: :boss: :boss:
    তোমার লেখা পড়ে কখন যে চোখে পানি এসে গেছে, টের পাইনি
    জীবন এমনই।যদি কোনদিন দেশের বাহিরে আস তখন আর ও বোঝবা মা্য়ের আদর কি জিনিস।
    বেশি বলে ফেললাম কিছু মনে করনা


    tameema

    জবাব দিন
  6. শাইখ (০৩-০৯)

    …মায়েরা বোধহয় এমনই হয়…

    অনেক দিন হল মাকে দেখি না । প্রতিদিন শুধু ফোনে কথা হয় । লেখাটা পড়ে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে ! কিন্তু সম্ভব না ।

    সুন্দর সাবলীল অভিবাক্তি :clap:

    জবাব দিন
  7. ইসলাম (১৯৯৬-২০০২)

    আসলেই মায়ের ভালবাসা দুনিয়ার সবচেয়ে আলাদা। আর সন্তান্দের এই ভালবাসার বহিপ্রকাশটা মায়ের কাছেই করা উচিৎ অনেক বেশি বেশি করে যাতে জীবনের কোন মুহূর্তে এই আফসোস না থাকে যে আমি তোমাকে বলতে পারিনি মা আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি।


    Islam, CCR (1996-2002)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আল ইমরান পরশ (০৩-০৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।