ডিভোর্স এণ্ড সোশ্যাল মিডিয়া

কিছু বিষয়ের অহেতুক সমালোচনা আমি একেবারেই মেনে নিতে পারি না। বিশাল এই সমাজের নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে আমার ধারণা, কিছু-কিছু সমালোচনা, হাসি-তামাসা বা তিরস্কার, ব্যাক্তি এবং সমাজ উভয়ের দৃষ্টিতেই অগ্রহনযোগ্য। হাসি-তামাসা টাইপের সমালোচনা বা কটাক্ষ, যা ইদানিং “ট্রল” নামে ব্যপকভাবে পরিচিত, এসবের মধ্য দিয়ে আমরা কিন্তু প্রকৃতার্থে নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং রুচিজ্ঞানকেই জনসম্মুখে নিয়ে আসি। অনেকেই হয়ত মুখে কিছু বলে আমাদের এই অসুস্থ মানসিকতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তামাসা যিনি করছেন বা অহেতুক মন্তব্য ছুড়ছেন বা অপ্রসঙ্গে নাক গলাচ্ছেন, তিনি নিজেই অন্যের দ্বারা সোশ্যালি জাজড হচ্ছেন না।

যেই হোক না কেন, বা যার জীবনেই ঘটুক না কেন, একটা দাম্পত্য বিচ্ছেদ কোন ভাবেই সুখের বিষয় নয়। যারা এই সিদ্ধান্তে আসেন, তারা সুখের চেয়ে বরং স্বস্তির আশায় এই সিদ্ধান্ত নেন বলেই আমার কাছে মনে হয়। সামান্য মানবিক বোধ শক্তি থাকলেই বোধগম্য হবার কথা যে, এটা কোনভাবেই হাসি-তামাসার বা পাব্লিক ক্রিটিসিজমের বিষয় হতে পারে না। এটা দুজন মানুষের জীবনের ক্রিটিকাল মুহূর্তের এক্সট্রিম সিদ্ধান্ত। একান্তই তাদের নিজস্ব বিষয়। তারা এই সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই হুটহাট চলে আসেন না। এটাতে তারা উল্লাস করেন বলেও আমার কাছে কখনোই মনে হয় না। নেহায়েতই একটু ভাল থাকার আশাতেই মানুষ জীবনে এত কঠিন একটা ভাঙ্গণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর কেউ যদি নিজের জীবনের ভালটা নিজেই বুঝে নেয়, এবং তা যদি আমাদের কোন ক্ষতি না করে, তাহলে তাদেরকে সম্মানের সাথে আমরা ভাল থাকতে দেই না কেন?

অন্য ডিপার্টমেণ্টের আমার এক কলিগের কাছে একটা ইংরেজি সাইটেশন/কোটেশন শুনেছিলাম। বাংলা করলে অনেকটা এমন হয়ঃ “নিচু শ্রেণীর মানুষ অন্যের জীবন নিয়ে নাক গলায়; সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ঘটনাবলিতে আগ্রহী হয়; আর বিচক্ষণ বা জ্ঞানী মানুষ ধ্যাণ-ধারণা (আইডিয়া বা কন্সেপ্ট) নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়”। কথাটার সত্যি-মিথ্যা আপেক্ষিক, তবে এর গুরুত্ব যে নিশ্চয়ই আছে তা সহজেই বোধগম্য।

নিজে আমি খুব বেশি মাত্রায় ধর্মীয় জ্ঞান না রাখলেও যতটুকু জানি, তা যৌক্তিকভাবে মনে-প্রাণে মেনে চলি। অন্যকে ছবক দিয়ে বেড়াই না, বরং যেটা মঙ্গলজনক মনে হয়, নিজেই মেনে চলি, আমাকে দেখে কেউ যদি তা ধর্মীয় বা নৈতিকতা যে কোন দিক থেকে মানতে চায় তো মানুক। না মানতে চাইলে তার নিজের বিষয়। ইহজাগতিক বিচারের জন্য জাগতিক আইন-কানুন আছে; পরলৌকিক জগতের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জন্য রয়েছে বিধাতার বিধান। আর, ধর্ম বা পরলৌকিকতায় আস্থাহীনদেরও একটা আস্থার জায়গা আছে বলেই আমি জানি, তা হলো ন্যাচারাল জাস্টিস বা প্রকৃতির নিয়ম। … ধর্মীয় দৃষ্টিতে, সম্ভবত হিন্দুশ্বাস্ত্র মতে বিবাহিত জীবনের পরিনতি হতে হবে ইহজীবনের আবসানের মধ্য দিয়ে; খ্রীষ্টধর্ম মতে বিয়েতে ধর্ম জাজকের সামনে জীবনাবসানের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একে অন্যের সাথী হয়ে থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হয়; আর ইসলামের বিধানে বিবাহ বিচ্ছেদ অনুমোদিত, তবে সেটা সবচেয়ে অপন্দনীয় অনুমোদন। (আমি কোন বিশারদ নই। এই কথাগুলো নিজের সামান্য জ্ঞান থেকেই লিখলাম। সকলকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েই কথাগুলো লিখছি। আমার অজান্তেই কোন ভুল হলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।)… … … তাহলে ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু বুঝছি, বিবাহ-বিচ্ছেদ কোন সুখের বিষয় নয়, এটা জীবনের চলার পথের ক্রিটিকাল মুহূর্তের একটা অপ্রিয় প্রয়োজন। গ্যাংরিন হলে শরীর থেকে একটা অঙ্গচ্ছেদ ঘটানো যেমন জরুরী, ঠিক তেমন।

কিন্তু এর পরেও জীবন চলমান। এক বহমান প্রক্রিয়া। অনার্স লেভেলের বিজনেস ইংলিশ ক্লাসে টিম-কমিউনিকেশন পড়াতে গিয়ে আমাকে কফ্লিক্ট ম্যানেজমেণ্টের উপরে আলোকপাত করতে হয়। কনফ্লিক্ট যখন ম্যানেজেবল নয়, তা সে যে কারনেই হোক, তখন একটা সিদ্ধান্তে তো আসতে হয়, নাকি! শুধু কি সংসার, দীর্ঘদিন বাসায় যে কাজের মানুষটি থাকেন, তাকে কোন কারনে স্যাক করার সময় আপনি-আমি কি আনন্দিত হই? নাকি সেই অপ্রিয় কাজটি আমরা করি শুধুমাত্র হাঁফ ছেড়ে স্বস্তিতে থাকার উদ্দেশ্যে? আমি দুঃখিত, এমনভাবে উদাহরণ টানার জন্য; এটা জাস্ট একটা উদাহরণ হিসেবে নিলেই ভাল হয়, দয়া করে কেউ অন্যভাবে নেবেন না। আমি চারপাশে দেখে বেশ ভালভাবেই বুঝেছি, একটা ব্রোকেন ফামিলির বাচ্চার কি কষ্ট। আবার এটাও দেখেছি, সন্তান বা সমাজের কথা ভেবে অস্বস্তিকর দাম্পত্য সম্পর্ক ঠেলে নিয়ে যাবার মানষিক যন্ত্রণা কতটা মারাত্মক।

যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা কথিত ডিভোর্স ইস্যুতে ইদানিং বেশ ট্রল করছেন, তারা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন তো, আপনি কি কাজটা করলেন। ক্ষমা চাচ্ছি, আল্লাহ না করুক, এমন ঘটনা কোনভাবে আপনার-আমার জীবনে ঘটলে তখন আপনার-আমার করা এই ট্রলগুলো কেমন লাগতো আমাদের কাছে। আচ্ছা বাদ দিন, নিজেকে নিয়ে নাই বা ভাবলাম, আদরের ভাই-বোন বা সন্তান, কিংবা আমাদের মা-বাবা, কারো জীবনে এটা ঘটল, তখন আপনি-আমি কি ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়ায় মশকরা আর সমালোচনায় মত্ত হব? আচ্ছা আপনি-আমি নাহয় সেখানে পারিবারিক ইনভলভমেণ্টের কারনে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়ে গেলাম, কিন্তু আশেপাশের মানুষ যখন কটাক্ষ করে চলেছে (যে কটাক্ষের কোনই যৌক্তিকতা নেই, নিতান্তই পরনিন্দা, পরচর্চা আর অসুস্থ রুচির প্রকাশ ঘটানো ছাড়া), তখন আমাদের কেমন লাগবে?

এখন হয়ত যুক্তি দাঁড়াবে, সেলিব্রেটিদের জীবন নিয়ে তো আলোচনা হবেই। এই কথাটাও আমি মানতে নারাজ। স্বাভাবিকভাবে কম-বেশি সবাই নিজের জনপ্রিয়তা কামনা করে। সেক্ষেত্রে সেলিব্রেটিদের জীবন নিয়ে এত অতি উদসাহ আর কটাক্ষ (ট্রল) কিন্তু পরোক্ষভাবে এটাই সামনে নিয়ে আসে যে আপনি চরমভাবে জেলাস, তা সে স্বজ্ঞানে বা মনের অজান্তে, যেভাবেই হোক না কেন। একটা সুস্থ প্র‍্যাক্টিসে যে আমরা থাকতে পারছি না, সেটা আমরা কবে বুঝব? নিজের সন্তান যখন আমার দূর্দশায় হাসি-তামাসা করবে, তখন??

৭,২২২ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “ডিভোর্স এণ্ড সোশ্যাল মিডিয়া”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এটা দুজন মানুষের জীবনের ক্রিটিকাল মুহূর্তের এক্সট্রিম সিদ্ধান্ত। একান্তই তাদের নিজস্ব বিষয়। তারা এই সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই হুটহাট চলে আসেন না। ... নেহায়েতই একটু ভাল থাকার আশাতেই মানুষ জীবনে এত কঠিন একটা ভাঙ্গণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর কেউ যদি নিজের জীবনের ভালটা নিজেই বুঝে নেয়, এবং তা যদি আমাদের কোন ক্ষতি না করে, তাহলে তাদেরকে সম্মানের সাথে আমরা ভাল থাকতে দেই না কেন? -- এরকম একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে মানুষ তার হৃদয় অনলে অনেকটা দগ্ধ হয়, অনেক নিদ্রাহীন, যন্ত্রণাময় রাতদিন অতিক্রম করার পরেই মানুষ এ সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক ভুক্তভোগী divorce এর যন্ত্রণাকে death এর যন্ত্রণার চেয়ে কোন অংশে কম নয় বলে মন্তব্য করে থাকেন।
    আমি চারপাশে দেখে বেশ ভালভাবেই বুঝেছি, একটা ব্রোকেন ফামিলির বাচ্চার কি কষ্ট -- বাচ্চারাই divorce এর worst casualty।
    সুস্থ বিবেকবোধ এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে লেখা এ পোস্ট ভাল লেগেছে। সাধুবাদ জানাচ্ছি।

    জবাব দিন
    • আহমদ (৮৮-৯৪)

      ভাইয়া,
      পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
      আমি জীবনে যে কয়বার নিজের কিছু কথা লিখতে গিয়ে অন্তরে রীতিমত রক্তক্ষরণের অনুভুতি টের পেয়েছি, সেগুলোই আপনি কোট করেছেন। পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু মানুষকে আমি এর মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি। তাদের জায়গায় নিজেকে বা নিজের পরিবারকে স্বপ্নেও ভাবতে চাই না।


      চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।