জিনান্তরে

মৃগীরোগীর মত কেঁপে কেঁপে ফ্যানটা ঘুরছে যক্ষ্মারোগীর ঘড়ঘড় আওয়াজে। সেই রুগ্ন ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হটাৎ আমার মনে হল এটা এক্ষণি ছিটকে পড়বে! বনবন ঘুর্ণি তোলা তিনটা পাখা জানালার কাঁচে, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আছড়ে পড়বে! কিংবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই তিনটা ধারালো ব্লেড গেঁথে যাবে আমার নরম শরীরে! আমি তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে দিলাম। এই অদ্ভূত অযৌক্তিক আতঙ্কগ্রস্ত মুহূর্তে আমার দাদীকে মনে পড়লো। ফ্যানের উসিলায় দাদী প্রায়ই হানা দেয়। তার ভয় পাওয়া গলার আওয়াজ পাই–‘ফ্যানটা কমায় দেও! মাথায় ভাইঙ্গা পড়ব তো!’
ক্লাস ফাইভে ওঠার পর থেকেই আমার ফাইভ পাশ গ্রাম্য দাদীকে কোথাকার কোন অশিক্ষিত মহিলা ভাবতে শুরু করেছিলাম। সেই ‘কোথাকার কোন মহিলা’র এই অদ্ভূত ফোবিয়া দিব্যি সেলাই হয়ে আছে আমার রোমকূপে, বংশানুক্রমে পাওয়া সম্পত্তির চেয়ে অনেক জোরালো মালিকানায়। দাদী কখনো খোলাসা করে বলেনি প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকা ফ্যান তার মনে কিসের ঘূর্ণি তোলে। নিজের ছিন্নভিন্ন শরীর হাজির হয় কিনা! দাদীর কথা ভাবলে অবধারিতভাবে শফী পাগলার কথা মনে পড়ে যায়। হঠাৎ পাগল না হলে তিনি হতেন আমার সম্মানিত চাচা, এতদিনে হয়ত ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। দাদাবাড়িতে দেখতাম একটা ভাঙাঘরে খাটের পায়ার সাথে শেকলে বাঁধা একটা কঙ্কালসার লোক, আমার বাবার সাথে চেহারায় আশ্চর্য মিল। তার নোংরা বিছানার ওপর একটা ভাঙ্গাচোরা টিনের প্লেটে ভাত-ডাল-শাক। সেদিকে তার নজর নেই। নিজে নিজে হাসে আর বিড়বিড় করে কি যেন আওড়ে। দাদী দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘বাবা শফী, খাও বাবা!’ শফী পাগলা–আমার বাবার যমজ ভাই দাদীর দিয়ে তাকিয়ে একটু হাসে, তারপর অদৃশ্য কারও সাথে আলাপ চালায়।
‘পাগলের গুষ্টি! শফী পাগলার ভাস্তি না! পাগল পয়দা হইছে আরেকটা!’ রান্নাঘরে দাঁত-মুখ খিঁচানো ১৫-২০ বছর আগের মাকে দেখতে পাই। ছোটবেলায় মা ঘুরেফিরে এই গালই দিত। মায়ের ওপর রাগ জমতে থাকে আমার। ছ’সাত বছরের আমির জন্য মায়া লাগে! তখন মাঝেমধ্যেই বুকটা ধুঁকপুক করত–ওই শফী পাগলার মত যদি পাগল হয়ে যাই!
মধ্যরাত পেরোলে আতঙ্কের কব্জা ছেড়ে আমি কুড়ি বছর পিছিয়ে এক শীতের রাতে দাদীর আশ্রয়ে যাই। দশটাও বাজেনি তখনো। সারা গ্রাম নিশ্চুপ। কাঁথার নিচে দাদীর ওমে গুটিসুটি পাকিয়ে পাঁচ-ছয় বছরের আমি। দাদী তার জীয়ল মাছের মত জিইয়ে রাখা গল্পদের তুলে আনবেন এখন। দাদীর নিঃশ্বাসের তাপে আরাম লাগছে খুব। অরুণ-বরুণ-কিরণমালা জ্যান্ত হচ্ছে। গল্প বলতে বলতে দাদী নিজেই কখন গল্পের চরিত্র বনে যায়! আমি তখন যাকেই নাগালে পাই, গল্পের বায়না ধরি। মা গল্প শোনায়, বাবা শোনায়, পাশের বাড়ির নীতুর নানুও। কিন্তু ওরা কেউ গল্পের ভেতর ঢুকতে পারে না। বংশানুক্রমে ভয়ের বীজ আমার শরীরে ঢুকলো, গল্প ঢুকলো না কেন!


সকালে ঘুম ভাঙার পর টের পেলাম মায়ের ওপর রাগটা আরও গাঢ় হয়েছে। চেইন রিয়্যাকশনের মত একের পর এক স্মৃতি হামলে পড়তে থাকে–কবে মা বেত ভেঙেছে পিঠে, কবে মারতে মারতে শুইয়ে ফেলে গলায় পা তুলে দিতে চেয়েছে, কবে পাশের বাড়ির শেলীর মা এসে আমার কান্না মুছে দিতে দিতে সেই মুখস্থ বুলি শুনিয়েছে ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’। দগদগে মন নিয়ে অফিসের জন্য তৈরি হতে হতে আমি ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট করি–‘রক্তকে মেনে নিইনি বিনা শর্তে। ডিএনএর মিল ভুলে গেছি সেই কবে। আপন খুঁজি আত্মার ব্লুপ্রিন্টে’। মনে পড়ে না শেষ কবে মার কাছে মন খুলেছি। মার সামনে জামাকাপড় খোলা বন্ধ যে বয়সে, মন বন্ধও সে বয়সে। মা তার মফস্বলী শহর থেকে একলা একলাই আলাপ পাড়ে–পাশের বাড়ির সীমাদের জানালা দিয়ে চোর মোবাইল হাতিয়েছে, সৌদিপ্রবাসী বজলু আংকেল মাইক্রোওভেন আর কফি মেকার এনেছে, মায়ের চাচাতো বোন ঝুমা খালার শ্বশুর প্রোস্টেট সার্জারির জন্য ক্লিনিকে ভর্তি। তাকে দেখতে গিয়ে মায়ের খুব আফসোস হয়েছে–মেয়েটা ডাক্তারি পড়লো না! আমি মার কথা শুনতে শুনতে হাই তুলি। অফিসে কি ঝামেলা হচ্ছে, অলিয়ঁস ফ্রসেজে আমাদের ফ্রেঞ্চ ট্রেইনার অন্দ্রে কি কি মজা করলো, সিনেপ্লেক্সে ডানকার্ক দেখে কেমন লাগল তার কিছুই বলার উদ্যম পাইনা। আমার অন্তর্জগতে মা কোথাও নেই। ‘দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন’– এই গ্রামীনফোনীয় নীতি মেনে আমরা দুই প্রজাতির দুই প্রজন্ম অনতিক্রম্য দূরত্ব সত্ত্বেও ফোনালাপ-রীতি চালিয়ে যাই। শুধু কখনো কখনো কোন মা-অন্তঃপ্রাণ সন্তানকে দেখে অস্বস্তিতে নয়ত অপরাধবোধে ভুগি।
এক হাতে মুখে পাউরুটি-জেলী-ওমলেট গুঁজতে গুঁজতে মোবাইলের স্ক্রীনে কাহলীল জিবরান খুঁজি–
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।
এই দার্শনিক সময়ে মোবাইল স্ক্রীন থেকে কাহলীল জিবরানকে বিতাড়িত করে ক্লায়েন্টের কল। পৌনে ন’টা বেজে গেছে! আমি তড়িঘড়ি ফ্ল্যাট লক করে বেরিয়ে যাই। চারতলা থেকে তিনতলা নেমেছি, হঠাৎ মনে হয় ইস্ত্রির সুইচটা বন্ধ করেছি তো? ওমলেট করার পর গ্যাসের চুলা নেভাতে ভুলে গেছি নাকি? ল্যাপটপের চার্জার খুলে এসেছি? আমি দৌড়ে ওপরে উঠি আবার। রান্নাঘরে উঁকি দেই। সুইচ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ইস্ত্রির প্লাগটা সকেট থেকে খুলে রাখি। দরজা লাগাতে লাগাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার উপসর্গের সাথে মেলাতে থাকি–অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার,ফোবিয়া, প্যানিক অ্যাটাক…। শফী পাগলা বিদ্যুৎঝলকের মত জ্বলে উঠে। মায়ের চোখরাঙানি তেড়ে আসে–‘পাগলের বংশ যত্তসব!’
‘দাঁড়াও, সব চেক করে আসি আবার! টিভির সুইচটা বন্ধ করা হইছে কিনা! যদি আগুন লাগে!’ চোখরাঙানির বদলে মায়ের চেহারায় এখন উদ্বেগ। নানাবাড়ি যাচ্ছি। গেটের সামনে রিকসা খুঁজতে দাঁড়িয়েছি আমি আর বাবা। মা আমার ছোট ভাই রাতুলকে কোলে নিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। রিকসাও একটা মিলে গেল। রিকসায় এক পা রাখা মাত্র মার কি মনে হল, রাতুলকে বাবার কোলে দিয়ে আবার বাসার ভেতরে ছুটল। বরাবর বাইরে বেরোনোর আগে মার এরকম অতিসতর্কতা-বাতিক মাথাচাড়া দিত। যদিও আদৌ বেখেয়াল স্বভাবের ছিল না। প্রতিবারই দেখা যেত সব সুইচ ঠিকটাক বন্ধ, সব ক’টা জানালার ছিটকিনি আটকানো, সব ঘরেই তালা লাগানো, কোন পানির ট্যাপ থেকে টিপটিপ পানি পড়ছে না। তবু মা একবারে আশ্বস্ত হত না।
প্রাপ্তবয়স্ক আমার ত্রিসীমানায় মায়ের ছাপ পড়তে না দেওয়া আমি খেয়াল করি মা রয়ে গেছে অবচেতনে। তার জরায়ু থেকে বেরিয়ে গেছি বলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাইনি।


অফিসে একদল জাপানী ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আমাদের। কেজো কথা সারার পর হাসিখুশি জাপানী তরুণী মাই সাকাইয়া হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে চোখ-বোঁজা হাসি দিয়ে বলে উঠল–‘ইউ লুক আ লট লাইক আস!’ পাশে বসা আবরার ভাই হেসে উঠে বললেন, ‘আমার কিন্তু প্রথম থেকেই তোমাকে চাকমাদের মত লাগে! অফেন্ডেড হও কিনা, সেই ভয়ে বলি নাই! মিস সাকাইয়া, টেক হার টু ইয়োর কান্ট্রি। শি মাইট বি ইয়োর ডিসট্যান্ট কাজিন! লেট হার সি ফোরফাদারস ল্যান্ড!’
জাপানীদের লিফটে উঠিয়ে দিয়ে আসার পর সুনীতা বলল, ‘উহু, না চাকমা না, ওর ফিচারস মারমাদের মত!’ আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘কেউ কেউ আবার আমাকে গারো ভাবে!’ ঝুমুর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, ‘এই তুমি অ্যানসেস্ট্রি কম্পোজিশন টেস্ট করাও!’
‘মানে? ডিএনএ টেস্ট করাবো?’
‘হুম, খুবই ইন্টারেস্টিং! একটা ওয়েবসাইটে দেখছিলাম। তোমার স্যালাইভা টেস্ট করে ওরা জানাবে তুমি কতটুকু চাইনিজ, কতটুকু ইন্ডিয়ান, কত পার্সেন্ট আফ্রিকান-এইসব! অবশ্য কতটা অ্যাকুরেট হবে জানিনা!’
সুনীতা উত্তেজিত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ! আমিও একটা প্রোমোশনাল ভিডিও দেখছি। ডিএনএ ট্রাভেলিং। তোমার পূর্বপুরুষেরা যেই যেই অঞ্চলের, সেইখানে ঘুরতে যাওয়া! পূর্বপুরুষের মাটি ছুঁয়ে আসা! ফ্যাসিনেটিং!’
আবরার ভাই হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলে, ‘ধুর! এগুলা ভাঁওতাবাজি! ওরা ক্লেইম করে তোমার ডিএনএ থেকে পার্সোনালিটি ট্রেইট, ডিজিজের টেন্ডেন্সি সব বের করে দেবে! পুরাই জন্মের সময়ের কোষ্ঠি বিচারের মত বোগাস!’
আমার চেহারার মাপজোখ থেকে জ্ঞাতিগোষ্টীর পরিচয় উদ্ধারে সবার উৎসাহে নিজেকে বেশ এক্সোটিক লাগে! প্রতিদিন আয়নায় কয়েকশবার দেখা নিজের পুরান চেহারা নিয়ে নতুন কৌতূহল জ্বলজ্বল করে। যেন অত ভাল করে দেখা হয়নি আগে! কাজ ফেলে অফিসের ওয়াশরুমের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
আয়নায় যে মেয়েটি–অনেক বাঙালির চেহারা যদিও এমনই, তবু গড়পড়তা বাঙালির চেহারা না। অগভীর প্রায়-কোটরহীন ছোট দুই চোখ, নিভাঁজ সোজাসরল চুল। বাঁকহীন সমতল চ্যাপ্টা মুখ। সোজাসাপ্টা নির্মেদ শরীরী গঠন। টিপিক্যাল মঙ্গলয়েড ফিচারস। বাবা-মার চেহারার ধাঁচে-ছাঁচে মেলে না। তারা কেউ অবাঙালি না, ফ্যামিলি-ট্রির অন্তত দুইতিন পুরুষে কেউ অবাঙালি ছিল না। কারও শরীরে নিশ্চয়ই প্রচ্ছন্ন ছিল খানিকটা অবিশুদ্ধ মঙ্গলয়েড জিন, তা-ই মুখ তুলেছে আমার ভ্রূণে। এই আপাত-মঙ্গলয়েড শরীরে কত জাতের রক্তের সংকর। কত বিচিত্র আদিপুরুষের ডিএনএর যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের জটিল অংক শেষে একেকটা মানুষ অনন্য অস্তিত্ব নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়! নিজের শরীরেই কত রহস্য, কত ধাঁধা! কয়েকশ বছর পিছিয়ে জিনান্তরে লুকানো পূর্বপুরুষদের আবিষ্কারের অবাস্তব ইচ্ছাটা খচখচ করে ওঠে। দাদী যতদিন বেঁচে ছিলেন কখনো বলিনি, ‘পুরান দিনের কথা কও–তোমার বাপ-মার কথা! এই ঘির মত গায়ের রঙ কার থেকে পাইছো? তোমার এই টিয়া পাখির মত নাকটা কি বাপের?’ বুড়ি দাদী যেন চরকাকাটা চাঁদের বুড়ির মত জন্ম থেকেই বৃদ্ধ। কখনো কৌতূহল হয়নি,‘ ও দাদী! তোমার নানা-নানী, দাদা-দাদীর কথা মনে আছে? তোমার স্মৃতি তো খুব টনটনা! তোমাদের ঘরদুয়ার কেমন ছিল? আর পাঠশালা? ছোটকালে রাউঠার বিলে খুব দাপাদাপি করতা?’ এইসব সাধারণ মানুষের সাদামাটা গেরস্থালি গল্পে আমার আগ্রহ ছিলনা।
আমি আয়নায় দেখি–ঘোড়ায়-চড়া দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস বাহিনীর যোদ্ধা, মাথায় রুমালের মত ঘুতরা-বাঁধা আরব বণিক, লাঙ্গলে চষে বেড়ানো দ্রাবিড় চাষা, বাঙালি স্বামীর হাত ধরে আরাকান থেকে বাঙালমুলুকে পাড়ি জমানো বর্মী তরুণী। তাদের চেহারা পেইন্টিং-ডকুমেন্টারি আর বইয়ের পাতা থেকে জোগাড় করা। সুদূর অতীতের খাঁজে খাঁজে ফসিল হয়ে যাওয়া এরা সবাই হয়ত আমার জিনে ঘাপটি মেরে আছে। এদের জীবনে দাঁত বসানো কত ঘটনা আদিম শঙ্কা, অবান্তর ভয় আর অমূলক ঈর্ষার সংকেত এখনো রয়ে গেছে আমার জিনে! হয়ত সময়ে আঁচড় হালকা হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়নি। পূর্বপুরুষের জীবন পূর্বজন্মের নস্টালজিয়ার পুরনো গন্ধের মত দোলা দেয়। যেন মাত্র ছাব্বিশ না, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।
ফোনের ভাইব্রেশনে কল্পনার বিলাসিতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এতক্ষণ যে কোন ক্লায়েন্টের কল আসেনি সেটাই তো আশ্চর্যজনক! আমি আবার অফিসের হিসাবনিকাশে ঢুকে পড়ি। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দ্রুত কাজ করতে থাকি। হাতের জরুরি কাজ ক’টা শেষ হওয়া মাত্রই আবার আদিপুরুষদের তালাশে নামব। কি-বোর্ড আর মাউস আমার মস্তিষ্কের স্পন্দনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায়। এই মুহূর্তে ওই কী-বোর্ড-মাউসের সাথে আমার কোন পার্থক্য নেই।
ঘন্টাখানেক যন্ত্রের মত কাজ করে বিরতি নেই। কফির ধোঁয়ায় পেছাতে থাকি–একশ বছর, দুশো বছর, তিনশ বছর…। চেনা জনপদের চেহারা বদলাচ্ছে। দাদাবাড়ির গ্রামে মাটির নিচে চাপা পড়া দালান বেরিয়ে আসছে, পরিত্যক্ত মন্দিরের গায়ে চুন-সুড়কি লাগছে। জীর্ণ রাউঠার বিল জলে-যৌবনে টইটুম্বুর। আস্ত দাদাবাড়িটাই উধাও! সে জায়গায় জংলীঝোঁপ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে একটা বাঘডাসা…
‘আপনার কি মন খারাপ? এনিথিং রং?’ আমি হকচকিয়ে যাই। মাসখানেক আগে জয়েন করা কলিগ মাজহার ভাই সামনে দাঁড়িয়ে।
হাসতে হাসতে বলি ‘না তো! ইনফ্যাক্ট আয়্যাম ইন ভেরি গুড মুড!’
‘তাই? ইউ নো হোয়াট, মোস্ট অফ দা টাইম ইউ লুক গ্লুমি।’
‘আই ইনহেরিটেড আ গ্লুমি ফেস।’
মাজহার ভাই চলে গেলে স্মৃতি বাবাকে তুলে আনে একটা সাধারণ ঘরোয়া দিনের সুতা টেনে।
পাশের বাড়ির জলিল আংকেল বলছেন, ‘ভাই আপনি সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন কেন?
‘আর বলবেন না ভাই, আমি চুপ থাকলেই লোকে ভাবে মুড খারাপ! চেহারাটাই এমন!’
‘দেখেন, আপনার দেখাদেখি আপনার মেয়েটাও গোমড়া হয়ে থাকে!’
‘আমাকে দেখবে কখন? আমি তো মাসে দুইবারের বেশি বাড়িতে আসার সময়ই পাই না! মাকেই না সবসময় দেখে!’
‘তা ঠিক! কিন্তু ভাবী এত হাসিখুশি-মিশুক স্বভাবের, আপনার এই বাচ্চা মেয়েটা এই বয়সেই এত গম্ভীর কেন?’
আমার খুব রাগ হচ্ছিল তখন জলিল আংকেলের ওপর! বাবা হেসে বলল, ‘জলিল সাহেব, আমার মেয়েটা এতক্ষণ ভালই ছিলো। আপনিই ওর মেজাজ খারাপ করে দিলেন!’
জলিল আংকেল আমার হাত ধরে তার কাছে টেনে বললেন, ‘রাগ করছো মা? একদম বাপ কা বেটি!’
কড়া ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দেই, কিন্তু ক্যাফেইন নিষ্ক্রিয় থেকে আমার মনটাকে ভারী হতে দেয়। বাবা মাটিতে মিশে গেছে সেই কত বছর আগে। মেয়ের বিষণ্ন মুখে রয়ে গেছে কি?


‘কি বলো! পঁয়ত্রিশে কিভাবে হার্ট অ্যাটাক?’
মার মুখে চাচাতো ভাই জামির হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে আমি অস্থির হয়ে যাই। জামি ভাই আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে। ঘন্টা তিনেক আগেও ফেসবুকে তার চেকইন দেখলাম– ডিজনিল্যান্ড। শামা ভাবী, তিন বছর বয়সী ছেলে উৎস আর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে গ্রুপ ফটোও।
মা বললো, ‘ওইখানে কোন কোন রাইডে নাকি হার্ট পেশেন্টপদের চড়া নিষেধ। বন্ধুবান্ধব ছিল সাথে, বাহাদুরি দেখায় উঠতে গেছে…একটা রাইড থেকে নামার পর নাকি হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হইছে। মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক।’
আমি খানিকটা ধাতস্থ হই। বিস্মিত হওয়ার কী আছে? বংশানুক্রমে জামি ভাইয়ের হৃৎপিণ্ডে ট্রাজেডির সীল-ছাপ্পড় মারাই ছিল। এই ধরণের চোখ কপালে তোলা বিস্ময়পর্ব তখন শেষ হয়ে গেছে, যখন মা কাঁদতে কাঁদতে নানাভাইকে জানাচ্ছিল আমার বাবার দু’টো আর্টারি চর্বিতে বুঁজে গেছে, হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ঠিকমত শরীরে পৌঁছাচ্ছে না।
চর্বি! বাবার শরীরে মেদ দেখিনি কখনো। খাবারদাবারের ব্যাপারে তার খুব কড়াকড়ি। কোরবাণী ঈদেও পাতে দুই টুকরার বেশি গরু-খাসি নেবে না। ক’মাস আগেই বই কিনেছে ‘যোগব্যায়ামে রোগারোগ্য’। মাঝেমাঝেই মাদুর পেতে চর্চা করে। অফিসফেরতা পথে তেঁতুল,আমলকী,জাম্বুরা এরকম টক ফল পেলেই কিনে আনে আর পাশের ফ্ল্যাটের জলিল আংকেলকে উপদেশ বিতরণ করে, ‘ভাই, টক ফলটা খান। শরীরে কোলেস্টেরল জমবে না।’ আমার নানাভাইয়ের খাওয়াদাওয়ায় বাছবিচার নেই। এই বয়সেও অনায়াসে তিনটা ডিম একবারে খেয়ে ফেলেন। কোরবাণী ঈদে বাটিভর্তি মাংস না দিলে মন খারাপ করেন। বাবা মাকে সাবধান করে, ‘তোমার বাবাকে সামলাও। এই বয়সে এত ডিমের কুসুম, রেডমিট খেলে বাঁচতে হবে না বেশিদিন!’ মা বলত, ‘আরে কিচ্ছু হবে না! বাবার তো প্রায়ই প্রেশার লো হয়ে যায়। ভালমত খাওয়াদাওয়া না করলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে!’ বাবা নির্ঝঞ্ঝাট একটা সরকারি চাকরি করত, সংসারে ঝুটঝামেলা ছিল না। অথচ হাইপারটেনশনের রোগী। আর নানাভাই সংসারের এত কলহ-দ্বন্দ্বের মাঝেও, খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণের তোয়াক্কা না করে এই বয়সেও দিব্যি সুস্থ আছেন।
বাবার হৎপিণ্ড যখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল, নিয়তি শব্দটার সাথে সাক্ষাৎ হল আমার। এত নিয়ম-কানুন মেনে শেষ রক্ষাটা হল কই? বাবাকে আমার ট্রাজেডির চরিত্র মনে হয়। এই অমোঘ পরিণতি পূর্বনির্ধারিত। জন্মের আগেই তার জিনে মৃত্যুপরোয়ানা লেখা হয়েছিল। ৪৫ বছরের জীবনে এত সংযম, এত সতর্কতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হৃৎপিণ্ড হাল ছেড়ে দিল। গড়আয়ুর হিসাবে আরও এক তৃতীয়াংশ জীবন তো পাওনা ছিল তার! তদ্দিনে জেনে গেছি বাবাদের বংশে রক্তে চর্বি জমার প্রবণতা বেশি। দাদা গেছেন এই হার্টের অসুখেই, চাচারা দিন গুনছেন। চাচাদের পর এবার লাইনে দাঁড়িয়েছে চাচাতো ভাইয়েরা। পাওয়া বনাম পাওনার হিসাবে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলার পালা এখন জামি ভাইয়ের।
বাবার মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন শফী পাগলার স্কিৎজোফ্রেনিয়া আর বাবার হার্ট অ্যাটাক ধাওয়া করত আমাকে! হার্ট অ্যাটাকের ভয় তফাতে গেল নারী হবার সুবাদে। যখন জেনেছিলাম এস্ট্রোজেনের রক্ষাকবচে মেনোপজের আগপর্যন্ত মেয়েদের হৃদরোগের ঝুঁকি তুলনামূলক কম, সেইপ্রথম জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনে খুশি হয়েছিলাম! দাদাবাড়ির সাথে যোগাযোগ আর মায়ের ‘পাগলের গুষ্টি’ জাতীয় গালাগাল–দুটোই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ভয়ও শক্তি হারালো। শুধু দাদীর কিছু অমূলক ভয় আমার কোষে কোষে সেঁটে থাকল ঘোর অন্ধকারের মত।


ছোটভাই রাতুলের সাথে দুর্গাপূজা দেখতে বেরিয়েছি। শাঁখারিবাজারে গোটা রাস্তায় কিছুদূর পরপর মণ্ডপ। প্রত্যেকটা মণ্ডপের নিচে বিশাল সব সাউন্ড সিস্টেম থেকে এড শিরান নয়ত বলিউডি আইটেম সং বিকট শব্দে মাটি কাঁপাছে। সেই শব্দে আমার মনে হতে থাকে উন্মত্ত কেউ হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে হৃৎপিণ্ডে! ভেঙ্গে চুরমার করবে পাঁজর! চালু হয়ে গেল আমার ভয়ের চেইন রিয়্যাকশন। সিকোয়েন্স মেনে পর্দায় দাদী হাজির। জামি ভাই ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুল ভলিউমে হেভি মেটাল শুনছে। কাঁপতে থাকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাদীর ভয়ার্ত গলা–‘সাউন্ডটা কমাও! আমার যেমনে বুক ধড়ফড় করতেছে! ইস্রাফিল শিঙায় ফুঁ দিলো নাকি! কেয়ামত আয়া পড়ছে?’ আমি রাতুলকে বলি, ‘এইখানে এত সাউন্ড পলিউশন! চল ঢাকা ভার্সিটির জগন্নাথ হলে যাই!’ আমার বুকে ভয়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। পুরান ঢাকার সংকীর্ণ রাস্তায় রিকসা চলতে শুরু করলে মনে হয়, ঢাকা একটা সম্পূর্ণ অরাজক জায়গা। মাথার ওপরের ফ্লাইওভার যেকোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। বাস ড্রাইভার আমাদের ভাঙাচোরা রিকসাটাকে যেকোন মুহূর্তে ধাক্কা দেবে, বেপরোয়াভাবে ফুটপাতের দোকানে বাস উঠিয়ে দেবে! ওই ফাটল ধরা কাত হয়ে পড়া মানুষে গিজগিজ করা পুরানো তিনতলাটা বাসিন্দাসমেত ভেঙ্গে পড়বে! আমি চারপাশে শুধু হিংস্রতা, নৃশংসতা আর ধ্বংসের আলামত দেখি। সে মুহূর্তে কেউ আমাকে খেয়াল করলে একটা কুঁকড়ে চুপসে আড়ষ্ট হয়ে থাকা মানুষকে দেখবে। যেমন দোমড়ানো আমি দাদীকে দেখতাম।
জগন্নাথ হলে ঢোকার মুখে রাতুলের নাগরদোলা চোখে পড়ে–‘চল আপু, উঠি!’ ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ঘুরতে থাকা নাগরদোলা আমার সামনে আবার ধ্বংসের পূর্বাভাস হাজির করে। যদি মাটি থেকে উপড়ে যায় খুঁটি গুলো! যদি ছিঁড়ে যায়! যদি ছিটকে পড়তে থাকে একেকটা মানুষ! আমার হৃৎপিণ্ডে চড়কির ঘূর্ণি শুরু হয়। নিজেকে খুব অসহায় লাগে। এই অস্থির পৃথিবী এত নাজুক মনের মানুষের জন্য অনুপযোগী! রাতুল বলে, ‘তোর এখনো প্যানিক অ্যাটাক হয়? তুই একদম দাদীর মত হইছিস! তা দাদী নাহয় অশিক্ষিত মহিলা ছিল। তোর মত স্মার্ট মেয়ে কেন ভয় পাবে?’
আমি চুপ করে থাকি যেহেতু এই অহেতুক হাস্যকর ভয়কে কথায় বোঝানো যাবে না যতক্ষণ না তুমি এর কবলে পড়েছো, রাতুল! কোন পত্রপত্রিকায় কখনো খবর আসে না নাগরদোলা ছিটকে কারও মৃত্যু হয়েছে, ফ্যান ছিড়ে পড়ে কেউ মারা গেছে কিংবা হেভি মেটাল শুনে হার্ট অ্যাটাক করেছে! বরং পত্রিকা খুললেই সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। আমি নির্ভয়ে বাসে চড়ে রোড অ্যাকসিডেন্টের খবর পড়ি আর ব্যাখাতীত এইসব ভয়ের স্বাভাবিক উৎস থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি। রাতুল বলে, ‘আপু, তুই একটা সাইকায়াট্রিস্ট দেখা! হেরেডিটারি প্রবলেমের কি ট্রিটমেন্ট হয়না?’
আমি হেসে বলি, ‘জিন নে মেরি জিনা হারাম কার দিয়া! আর তুই এত চিজ দেওয়া পাস্তা-পিৎজা খাবি না। জিনের মধ্যে যে হার্ট ডিজিজ নিয়ে ঘুরতেছিস, সে খেয়াল থাকেনা?’


আগাছায় ছাওয়া পরিত্যাক্ত ভাঙ্গা মন্দিরে আমরা সাবধানে হাঁটি। সাপখোপ কখন না বেরিয়ে আসে! এরই মধ্যে পোকার কামড়ে আমার ডান হাত লাল। পা-ও চুলকাচ্ছে। পারফিউমের গন্ধে কিনা কে জানে, মাথার ওপর নাছোড়বান্দা এক দল মশা ঘোঁট পাকিয়ে ঘুরছে। চাচাতোভাই স্বপন মুখচোরা স্বভাবের হওয়ায় ওকেই সাথে এনেছি। এসময় কেউ বকবক করলে নির্ঘাত বিরক্ত হতাম। আমি মন্দিরের শ্যাওলা জমা দেওয়ালে হাত রাখি। প্রায় মাটির মত নরম হয়ে যাওয়া কমলা রঙের ইট আমার পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে যায়। বর্ষাকাল হওয়ায় পরিত্যাক্ত কুয়াটায় পানি জমা। আমি স্বপনকে বলি, ‘আচ্ছা দাদাবাড়ি আগে কোথায় ছিল বল তো?’
ও দূরের ধানী জমিটা দেখায়– ‘ওইটার আশেপাশে কোথায় নাকি ছিল।’ আমার উৎসাহ টের পেয়ে স্বপন বলে, ‘মেলা পুরানা বাড়ি। দুইতিন পুরুষের। দাদারা যখন ছোট তখন নাকি ওই বাড়ি ভাইঙ্গা এখনকার জায়গায় চলে আসছে।’
আমি ওই দিকে তাকিয়ে ফিউ থিরি নামের এক বর্মী নারীর গন্ধ পাই–যাকে আরাকান থেকে বিয়ে করে এইখানে এনেছিল হিন্দু যুবক সুবল। ব্রহ্মার পা থেকে সৃষ্ট শূদ্র পুরুষটি আর পদতলে না থেকে ধর্মান্তরিত হতে চাইলে বুদ্ধকে ছেড়ে নবীজীকে গ্রহণ করে ফিউ থিরি। মুসলমান নারী-পুরুষে মিশে যায় তারা। আমি তাদের চিহ্ন খুঁজি। এদের অস্তিত্ব তথ্যপ্রমাণসাপেক্ষ না। নিতান্ত স্বপ্নে পাওয়া। তবে স্বপ্নে এসে স্বপ্নে মিলিয়ে যায়নি তারা। বিশেষত সেই বর্মী নারী মাঝেমাঝেই আসে, আলাপ চালায়। রিনরিনে গলায় আমার রক্তে তার প্রবাহমানতা দাবি করে। আমার অসম্পূর্ণ অবিশুদ্ধ মঙ্গলয়েড ছিরিছাঁদের শুদ্ধ রূপ দেখি ফিউ থিরির নাকে-ঠোঁটে-চোখে। আমি তাকে কি বলে সম্বোধন করবো ভেবে পাই না। অত পেছনের পূর্বপুরুষদের সম্বোধন তো কাউকে শেখানো হয় না। এই নারীর আসা-যাওয়া শফী পাগলার মত হ্যালুসিনেশন কিনা আমি সেই ধন্দে পড়ি। যদি হয়ও, আমি চাই এই হ্যালুসিনেশন চলতে থাকুক। আমি ওদের গল্পটা শুনবো। তারপর দাদী যেমন করে গল্প বলতে বলতে তার গল্পের চরিত্র হয়ে যেত, তেমন করে নেমে পড়ব গল্পের জমিনে।
দাদাবাড়িতে ছোটবেলায় কয়েকবার এসেছিলাম। তারপর ১৪ বছর আসিনি। আদিবাড়ি, আদিভিটা সংক্রান্ত ভাবালুতা ছিল না কখনো। এইবার খুব আপন লাগে এই মাটি-জল-আকাশ-বাতাস! যেন ওই মাঠের শেষের অশ্বত্থ গাছটাকে আমি চিনি। আমি ওদিকে এগোতে থাকলে স্বপন বলে, ‘আপু যাইয়েন না ওইদিকে। সন্ধ্যা নামতেছে। ওই গাছটার দোষ আছে!’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে এগোতে থাকি। আমার ভয় লাগে না একদম। প্রাচীনকে ভয় কিসের? অশরীরীকে ভয় কিসের? হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি!
দাদাবাড়িতে যখন ফিরি তখন ঘোর সন্ধ্যা। শফী পাগলার ঘর অন্ধকার। লাইট নেই। পাগলের ঘরে ইলেক্ট্রিক বাল্ব লাগানোর প্রয়োজনীয়তা দেখেনি কেউ। আমি মোবাইলের টর্চ জ্বেলে তাকে একবার দেখি। আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। ওই তো আমার বাবা! চাচাতো বোন চৈতীকে বলি, ‘আমার আনা মিষ্টি আর দই থেকে এক বাটি আনো তো আপু। শফী চাচাকে খাওয়াই!’ চৈতী তড়িঘড়ি মিষ্টি আর দইয়ের বাটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর কোন এক টিভি প্রোগ্রামের নেশায় ঢুকে যায়। আমি সাহস করে শফী পাগলার ঘরে ঢুকি। বোঁটকা গন্ধ জমে আছে। শফী পাগলা মিষ্টির গন্ধ পেয়ে বাটির ওপর হামলে পড়ে। অন্ধকার স্বস্তির, বিশেষ করে চোখ যখন ভেজা থাকে।
চৈতীদের ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। অনেক মানুষের সমাগম। বাড়ির মানুষ তো আছেই, পাশের বাড়িরও কেউ কেউ। কি চলে টিভিতে? বাংলা সিনেমা? নাকি হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’? ঢুঁ মেরে দেখি যুদ্ধশিশুদের ওপর ডকুমেন্টারি চলছে একাত্তর টিভিতে। এত মানুষের হুমড়ি খাওয়ার কারণ জানা গেল একটু পরে। এই ডকুমেন্টারির একটা অংশের শ্যুটিং পাশের গ্রামে হয়েছে। তাই এদিককার মানুষের এত আগ্রহ! একাত্তরে পাঞ্জাবি সেনার ধর্ষণে জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু, এখন যিনি মাঝবয়সী পুরুষ– মাছ খান না, কারণ মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। যেমনটা পারত না পাঞ্জাবি সেনারা। আমি দেখতে দেখতে ভাবি, এই লোকটা তার বাপকে যতই ঘৃণা করুক, নিজের জিন থেকে মুছত পারেনি তাকে। মাছ খাওয়া না খাওয়ার মত তুচ্ছ বিষয়েও নিস্তার নেই! আমি ঘরভর্তি মানুষজন দেখি। বেশিরভাগই আমার আত্মীয়। শহর-গ্রামের ফারাকে, রুচি-অরুচির তফাতে, স্বচ্ছলতার ব্যবধানে এদের অপ্রয়োজনীয় আগাছা মনে করেছিলাম অ্যাদ্দিন। অমিলগুলোই আমার কাছে স্পষ্ট। এবার মিলগুলো খুঁজে পাবো ?

৬,৫৭৩ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “জিনান্তরে”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।