নির্দোষ পরজীবী

এইখানে ঢাকা শহরের অ্যাপার্টমেন্ট কালচার ঢুকে পড়েনি এখনো। স্ত্রীরা মূলত গৃহবধূ। স্বামীরা ছোট চাকুরে। স্ত্রীদের জীবন মানে জী-বাংলা কিংবা হিন্দি সাঁস-বহু সিরিয়ালে আসক্তি কমই। বরং পাশের বাসার ভাবির রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে তার ডাল ঘুঁটনি নাড়তে নাড়তে কাঁচাবাজারের হালচাল (পেঁয়াজ দশটাকা বাড়ল, অথচ ঝাঁজ নাই দেখেন), বাচ্চাদের পড়াশোনা (প্রাইভেট পড়ায় যে ছেলেটা, মহা ফাঁকিবাজ), স্বামীর খানাখাদ্যে রুচি-অরুচি (আপনার ভাই পাঁচফোড়ন দেওয়া মাছ খাইতেই পারেনা) এবং বিবিধ মেয়েলি সুখ-অসুখের দৈনিক ফিরিস্তি দেওয়ার রেওয়াজ।
এইখানে ঘরগুলো গা-ঘেঁষাঘেঁষি। মেঝেতে মোজাইক-টাইলস নেই। কবুতরের খোপের মত অপরিসর বাথরুম-রান্নাঘর। সিঁড়িগুলো খাড়াখাড়া, ঢালাইয়ের পর প্লাস্টারের আস্তর না পড়ায় উদাম-উদাম। এই মহল্লায় দারোয়ান বা কেয়ারটেকার বলে কেউ থাকে না। সিলিং চুইয়ে পানি পড়লে কিংবা বেসিন নড়বড়ে হলে বাড়িওয়ালা নিজেই মিস্ত্রিসমেত হাজির হয়। কখনো নিজ হাতে সিমেন্ট গুলিয়ে মেরামতির কাজ সেরে টাকা বাঁচায়। এখানে ভাড়াটের তুলনায় বাড়িওয়ালা দু’আঙুল মাত্র সচ্ছল। কলেজপড়ুয়া মেয়ে আর স্কুলপড়ুয়া ছেলে নিয়ে দুই কামরার ইউনিটে গাদাগাদি থাকে স্বয়ং বাড়িওয়ালা।
এইরকম এক গরিব চালচুলোহীন এলাকার ঘিঞ্জি গলির শেষ মাথায় পুরানো ধ্যাড়ধেড়ে এক বিল্ডিংয়ের চারতলায় একটা একরুমের ইউনিটে উঠে পড়ে সামিয়া, বছরের শেষদিন। বাড়িওয়ালি যখন এই বিল্ডিংয়ের বাসিন্দাদের ঘনিষ্ঠতা এবং সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা যখনতখন যার তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে দু’টো সুখ-দুঃখের আলাপ করতে পারার আন্তরিকতার বয়ান দিতে থাকে, তখন তার প্রাইভেসির বাছবিচারের অভাব লক্ষ করে উটকো ঝামেলার আশঙ্কায় সে খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সেদিনই বিকালে বাড়িওয়ালি গ্রাম থেকে আনা দেশী গরুর দুধ দিয়ে বানানো দুধচিতই দিয়ে গেলে সামিয়ার থানা শহরের শৈশব ঝাপটা দিয়ে যায় এবং পাশের বাড়ির রোজির মায়ের বানানো পিঠার স্বাদ জিভে নড়ে ওঠে বহু বছর পর। আগের ফ্ল্যাটের বাড়িওয়ালির চেহারাও উঁকি দেয়, যাকে সে দুই-তিনবার দেখেছে মাত্র গাড়ি থেকে উঠতে কি নামতে। সেই ফ্ল্যাটে সে যদি মরে পড়ে থাকত, পচেগলে দুর্গন্ধ না ছড়ানো পর্যন্ত তার হদিস কেউ পেতই না! যেমন সে নিজেও সামনের ফ্ল্যাটের মানুষগুলোর চেহারা দেখেনি কখনো।


জানুয়ারির প্রথম সকালটা পুরু লেপের ওমে কাটিয়ে দেয় সামিয়া। মনে পড়ে গত বছর ১৪২জনকে নিউ ইয়ারের মেসেজ পাঠিয়েছিল সে। এবার কাউকেই না। সেই ১৪২ জনের বেশিরভাগকেই আদৌ পছন্দ করত না। আর বাকিদের ব্যাপারে উদাসীন। চেনাজানা এত অল্প যে পছন্দ-অপছন্দের ভাগে ফেলা দেওয়াটা অবান্তর। তবু প্রফেশনাল সার্কেলকে এ ধরণের মেসেজ দিতে হয়। মেসেজের নিচে নিজের নাম এবং অবশ্যই ডেজিগনেশন উল্লেখ করতে হয়। এভাবে গুরুত্বপূর্ণদের তোয়াজ করা ও নজরে থাকা অবশ্যকরণীয়।
এইবার এইসব প্রফেশনাল এটিকেটের বাইরে সামিয়া একটা সম্পূর্ণ বেকার বছরের সূচনা করে আড়মোড়া ভেঙে। না ধরাবাঁধা পড়াশোনা, না চাকরি। লোকে তাকে বোকা ও বেকার বলবে, সামিয়া তবু বেগার খাটবে না। এ বছরটা যা-ইচ্ছা-তাই…দেখার,চাখার, আঁকার, বকার, শোনার এবং সময় না গোনার।
চারতলায় সামিয়ার বাসা আর গায়ে গায়ে লেগে থাকা ঘরগুলোর মাথায় খোলামেলা ছাদ। শীত উদযাপনে এক কাপ লেবু চা হাতে সে ছাদে উঠে যায়। বৃষ্টি নেই, তবু ছাদে পানি জমা। বাড়িওয়ালি বোধহয় পানির পাম্প বন্ধ করতে ভুলে গেছিল। পাশের বাড়ির মহিলা ছাদে রোদ পোহাচ্ছে। তবে দুই বাড়ির দূরত্ব মাত্র হাত খানেক হওয়ায় ও বাড়ির ছাদকে এ বাড়ির অংশই মনে হয়। অনায়াসেই মহিলাটি তার সামনে নেড়ে দেওয়া চালকুমড়া-মাষকলাইয়ের বড়ি এই ছাদে পাচার করতে পারবে। সামনের একটা বাড়ির ছাদে সামিয়ার চোখ থিতু হয়, যেখানে একটা ছোট্ট খোপ থেকে সাদা, খয়েরী, ধূসর কবুতর একের পর বেরিয়ে এসে মরা ছাদটাকে মুখর করছে। রেলিঙয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকালে বেশ কয়েকটা শ্যাওলাপড়া, রঙচটা, জংধরা চেহারার ঘরবাড়ি ওর চোখে পড়ে। বেশিরভাগেরই প্লাস্টারহীন ইটের দেয়াল, টিনের ছাউনি। দু’টো মুখোমুখি ময়লা চেহারার বাড়ির মাঝখানের হাত দেড়েক প্রস্থের উঠানে হঠাৎ একটা দুধসাদা খরগোসকে লাফিয়ে উঠতে দেখে সামিয়া চমকে যায়! ওটার পেছনে আরেকটা। দু’টিতে হামলে পড়ে একটা বাটিতে। ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত চেহারার বাড়িতে ঐরকম ধবধবে খরগোসজোড়াকে কেমন অপার্থিব লাগে! আহা, শৌখিনতা তো এই! দাঁত বের হওয়া ঘরের দাওয়ায় সাদা খরগোস পোষা! সামিয়ার চোখ ঘুরতে থাকে। তিনটা বাসা পরে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। ধুলা-বালি-ইটের গুঁড়া উড়ে উড়ে ছিটাফোঁটা লাগাচ্ছে পাশের বাড়ির ছাদে মেলা সাদা ইউনিফর্মে। আর নিচে আবর্জনার স্তূপের পাশে নোংরা রাস্তা ধরে মাথায় সব্জির ঝুড়ি সমেত হাঁটছে আর হাঁকছে একটা লোক। পচাগলা ময়লার পাশে লোকটার ঝুড়ির টমেটো, শিম, গাজর, ফুলকপি দারুণ তাজা আর সজীব। এইসব দেখতে দেখতেও নেশাবশত ফেসবুকের ভার্চুয়াল দুনিয়াদারীর জন্য সে উসখুস করে। খুলব না খুলব না এই প্রতিরোধী ভাবনা সত্ত্বেও তার আঙুলের স্বয়ংক্রিয়তায় ফেসবুক খুলে যায়, আর তার নজরে আসে কলিগ মোহনার শেয়ার করা গত বছরের এ দিনের মেমোরি। তারা কলিগরা কয়েকজন মিলে ক্যাফে ফ্লোরেন্টাইনে গিয়েছিল অফিস শেষে, নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে। ছবিতে সামিয়ার সামনে স্টেক, হট চকলেট আর ব্লুবেরি চিজ কেক। স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে সে আকাশ দেখে। গায়ে রোদের তাপ মেখে নিজেকে আশ্বস্ত করতে চায় এই ছাদসুখের পাশে ক্যাফে ফ্লোরেন্টাইন ছদ্মসুখ। নাকি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তের পাশে খাঁটি ও গভীর সুখের লেবেল লাগিয়ে হট চকলেটের আফসোস সাদামাটা গরম চায়ে মিটিয়ে ফেলা?
ছাদের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পেয়ে সামিয়া পেছন ফেরে। সামনের ইউনিটের মহিলা–যাকে বাড়িওয়ালি ‘নওশীনের মা’ বলে ডাকছিল, এক বালতি কাপড় এনেছে ছাদের তারে মেলতে। সামিয়া সম্বোধন হাতড়াতে থাকে–আপা, ভাবি না আন্টি?
মহিলা দিব্যি শুরু করে দেয়, ‘তুমি তো আমাদের সামনের এক রুমের ইউনিটটায় উঠলা দেখলাম। গোছাগাছি শেষ?’
‘না, এখনো কয়েকটা ব্যাগ খুলিইনি।’
‘কি করো তুমি?’
‘আপাতত কিছু করছি না। চাকরি করতাম। ছেড়ে দিছি।’
‘অ! তাইলে তোমার খরচাপাতি?’
‘জমানো টাকা আছে কিছু।’
‘এখন কি করবা? নতুন চাকরি খুঁজবা?’
সামিয়া ইতস্তত করে। যদি বলে প্রতিদিন বিকালে ছাদে শ্বাস নেবে, উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তার পর রাস্তা হাঁটবে, মানুষ দেখবে–বেশি আঁতলামি হয়ে যাবে। মহিলা নির্ঘাত তাকে পাগল ঠাওরাবে! সাদামাটা উত্তরই সই।
‘দেখি, কতদিন জমানো টাকায় চলা যায়…শেষ হওয়ার আগে আগে একটা চাকরি জুটায় নেবো।’
‘জমানো টাকা শেষ কইরো না! আমি এই যে হাউজ ওয়াইফ, তাও টেইলারিং এর কাজ করি। এসএসসির পর পর শিখছিলাম। আমার বইসা থাকা ভাল্লাগেনা। টুকটাক ইনকামও হয়। তোমার সালোয়ার-কামিজ-ব্লাউজ কিছু বানাইতে হইলে আমারে দিও। যত্ন কইরা বানায় দিবো। বাড়িউলির সব আমিই বানাই।’
ছাদ থেকে নেমে আসার পর সামিয়ার দুপুরটা যায় চপিং বোর্ডে গাজর-ফুলকপি-টমেটো কেটে চালে-ডালে চড়িয়ে খিচুড়ি পাকাতে পাকাতে। ল্যাপটপে তখন ঝিমধরা দুপুরের ইন্সট্রুমেন্টাল। বিছানায় গা এলিয়ে রিডার্স ডাইজেস্টের পাতা ওল্টাতে না ওল্টাতে বিকাল হাজির। আলসেমি সত্ত্বেও সে লেপের তলা থেকে বেরিয়ে আসে। বিছানায় শিকড় গজানোর জন্য তো আর চাকরি ছাড়েনি! মোবাইল সেটের সাথে ফ্রীতে পাওয়া স্মার্ট ব্যান্ডটা কব্জিতে পরে নেয়। দিনে কয় কদম হাঁটতে পারে সে তার হিসাব থাক। কবীর সুমনের মুখটা হাজির হয়–কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়।


সামিয়া ধানমন্ডি লেকের পাড় ধরে হাঁটে। ঋজু দেহ বাঁকিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে কত গাছ। শিকড়ে-বাকড়ে-ঝুড়িতে জটাধারী, ভারস্থ একটা গাছের সামনে সে দাঁড়ায়–বট, পাকুর না অশ্বত্থ? ওর স্বপন ভাইকে মনে পড়ে। একবার বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাছ চিনিয়েছিল সে। তবে ওই একদিনে চিনে ফেলা শত গাছ সব ওলটপালট হয়ে গেছে। একদিন তাকে ডাকতে হবে আবার। গাছের পাতা নেড়েচেড়ে, বাকলে আঁচড় কেটে, শিকড়ের বিস্তার দেখে গাছ চিনতে হবে। সামিয়া ভাবে, থানা শহরে শৈশব কাটানোর সুবাদে অল্প কিছু গাছ সে চেনে। ঢাকা শহরের গাছহীন অ্যাপার্টমেন্টে বড় হওয়া শিশুরা কিছু ফুলগাছ, কিছু পাতাবাহার, কিছু অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট ছাড়া আর কিছু চিনবে?
লেকের ধারে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। টু-লেট ঝুলছে। ২৯০০ স্কয়ার ফিট! সর্বসাকুল্যে ২০০ স্কয়ার ফিটের বাসায় আস্তানা গাড়া সামিয়ার কাছে এখন এদের প্রাসাদ-প্রাসাদ লাগে! তবে সুখের বিষয়, তার আফসোস হয় না। হাঁটা পথে যত্রতত্র প্রস্রাবের গন্ধের ফাঁকে ফাঁকে ঝালমুড়িওয়ালার পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ-চানাচুরের গন্ধ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে আসে। প্রস্রাবের গন্ধ দিব্যি হজম করে ঝালমুড়ি চিবাতে চিবাতে লেকের পানিতে গোল হয়ে থাকা পদ্মফুল দেখতে পেয়ে সে মনেমনে আওড়ায়, হোয়াট আ কম্বিনেশন! তক্ষনি একটা লোকের লেকের পানিতে হাত-মুখ ধোয়ার দৃশ্য পরিবেশটাকে খানিক করুণ করে দেয়। এই জঘন্য নোংরা পানি দিয়েও মানুষকে হাত-মুখ ধুতে হয়!
এতক্ষণে প্রয়োজনীয় অন্ধকার ঘনিয়ে আসলে গাছের গুড়িতে বসা জোড়ারা আষ্টেপৃষ্টে জড়ায়। লেকের জল কত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি জমা করে প্রতি সন্ধ্যায়! স্মার্ট ব্যান্ড ১১,৮০২ কদমের হিসাব দিচ্ছে। একদিনের জন্য যথেষ্ট। আগুন পোহানো মানুষ, চাঁদাবাজিরত হিজড়া, বেপরোয়া জোড়াদের অন্তরঙ্গতা দেখতে দেখতে সামিয়া এবার নিজের বাসার রাস্তা ধরে। হাঁটতে হাঁটতে এক কলিগকে রিকসায় দেখতে পেয়ে হাত নাড়ে। অফিস থেকে ফিরছে নিশ্চয়ই। মোবাইল সময় দেখাচ্ছে সাড়ে সাতটা। যাক, সকাল-সন্ধ্যা অফিসে বেচে আসতে হচ্ছে না! খুব নির্ভার লাগে ওর। শিমুল তুলার মত উড়ুউড়ু আর হালকা।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নিচতলার হাট করে খোলা দরজার ঘর থেকে একটা মেয়ে সামিয়াকে দেখে হাসে। গতকাল সাত সকালে মালপত্রসমেত চারতলায় ওঠার সময়ও এ ঘরের দরজা এরকম হাঁ হয়ে ছিল আর খাটে আধশোয়া মেয়েটা তাকে দেখে হাসছিল। এরকম গায়েপড়া হাসিতে খানিক বিরক্তই হয়েছিল তখন । কালকের শীতল চাহনির পরও মেয়েটা দমে যায়নি তাহলে! সামিয়া তাই একটু হাসে এবার। মেয়েটা প্রশ্রয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আপু, কি কিনলেন? আসেন, একটু বইসা যান!’
‘মটরশুঁটি আর টমেটো।’ হাতের পলিথিনের ব্যাগ দেখিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সামিয়া বলে, ‘আপনি সবসময় বিছানায় পড়ে থাকেন নাকি?’
‘সাধ কইরা পইড়া থাকিনা আপা! আমার পাও ভাঙছে আইজ ১৩ মাস! তিনবার অপারেশন হইছে।’ বলতে বলতে সালোয়ার তুলে নিজের ভাঙা পায়ের সেলাইয়ের দাগ দেখায়। ‘কোথাও যাইতে পারি না, কথা কওয়ার মানুষ পাই না! এইজন্যই যারে দেখি চায়া থাকি। যদি কথা কওয়ার কাউরে পাই!’
সামিয়ার মনটা খচখচ করে ওঠে। তার কথায় মেয়েটা রাগ করলো না তো?


সামিয়া ভাবেনি সালমার সাথে সে মাঝেমাঝেই লুডু খেলবে, বিছানায় আধশোয়া হয়ে সখী-সখী চেহারা নিয়ে গল্পে মজবে আর ওর ভাঙা পা সচলে জিমের সঙ্গী হবে সপ্তাহে দুইদিন।
সালমার স্বামী তাকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গিয়ে রেস্টোরেন্টের কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বছর পাঁচেকের মাথায় সে যখন কাজেকর্মে, চলনেবলনে বেশ লায়েক হয়ে উঠেছে তখন হঠাৎ এক্সিডেন্টে ডান পা ভেঙে গেল। স্বামী আর দেশি বোনেরা মিলে তার গু-মুত সাফ করে, খাইয়ে-পরিয়ে দেখে শুনে রাখলো কয়েক মাস। কিন্তু ওখানে চিকিৎসার খরচ বিস্তর। শেষে দেশে ফিরছে এমন একজনের জিম্মায় তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হল।
সালমার এই স্যাঁতসেঁতে জানালাবিহীন ঘরে হাঁটু মুড়ে বসে সামিয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা নানা কিসিমের মানুষের গল্প ঘাঁটে। রায়েরবাজারের পিঠাওয়ালীর সাথে নানাবাড়ির গঞ্জের গুলগুলা পিঠার তুলনা, স্প্রিংয়ের মত লাফানো টোকাইয়ের সার্কাস নাচ, ডাস্টবিনের পাশে বিশাল উদাম পেট নিয়ে শুয়ে থাকা গর্ভবতী পাগলী, যাকেতাকে অভিশাপ দিতে থাকা লাল থান পরা এক সন্ন্যাসী–এইরকম কুড়িয়ে পাওয়া ঘটনা আর কি।
আর সালমার মুখে খইয়ের মত ফুটতে থাকে কুয়ালালামপু্রের কোতারিয়া। মালয়েশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণী যেরকম দুঃখকষ্টে থাকে বলে শোনা যায়, তার কোন নমুনা মেলেনা ওর কথায়। হয়ত পা ভাঙার আগের সব স্মৃতিই এখন মধুর লাগে ওর।বেশ আহ্লাদের সাথে সে রেস্টোরেন্টের ছবি বের করে। তার কোমরজড়ানো স্বামীকে দেখিয়ে বলে, ‘আমার কুনো অভিযোগ নাই। কাজ থাইকা ফিরা কত সেবা করছে আমার! এখনো তো প্রত্যেক রাইতে ভাইবারে ভিডিও কল দিবো। দশটায়। ওইখানে তখন রাত বারটা।’ সালমা কি একটু লাল হল? পাকা আমের মত মসৃণ মুখ মেয়েটার। সামিয়া ওর তাজা তেজী শরীরের দিকে তাকিয়ে এই জানালাবিহীন ঘরের জানালায় উঁকি দিল রাত দশটায়।ভিডিও কলে স্ত্রীর শরীর দেখা নিশ্চয়ই নাজায়েজ নয়। রাতের বেলা বন্ধঘরে দুইজন দুইজনকে দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই উন্মুখ হয়। স্ক্রীনের দুইধারে দুই জাগ্রত শরীর, মাঝখানে হাজার মাইলের ব্যবধান ততটা নয়, যতটা একটা ভাঙা পায়ের। সালমা সামিয়ার তাকানো লক্ষ করে বলে, ‘আমার পাও ভাঁজ করতে যে কষ্ট! পুরা সুস্থ কি আর হব এই জীবনে, কও তো! সংসার করা কপালে আছে গো?’ সালমার আক্ষেপে সামিয়ার কল্পনা আরও সচিত্র হয়। হায়, স্বামীসঙ্গের সময় হাঁটু ভাঁজ করতে গিয়ে নিশ্চয়ই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠবে মেয়েটা!
‘কি ভাবতাছো অত সামিয়া আপু? লও, চিঁড়াভাজা খাও!’ সালমা একটা টিন এগিয়ে দেয় সামিয়ার দিকে।
‘শোনো সালমা, তোমাকে যে কাঠবাদাম এনে দিছি, খাচ্ছো ঠিকমত? ক্যালসিয়াম ঠিকঠাক না খেলে তোমার পা কিন্তু সারতেছে না!’
‘হ খাইতো! প্রত্যেকদিন সক্কালে। শোনো, আমি গোসলটা সাইরা আসি। তুমি যাইও না আগে। এক দান লুডু খেইলা যাইবা!’
সালমা একটা মোড়া নিয়ে বাথরুমে চলে গেলে মেঝেতে একদল পিঁপড়ার এক দানা লাড্ডু মাথায় চলা দেখতে দেখতে সামিয়া কলিগ নুহার কথা ভাবে। প্রথমবার সালমার মুখ থেকে মালয়েশিয়া শব্দটা পড়া মাত্র নুহার মুখটা হাজির হয়েছিল। অফিসের অ্যাসাইনমেন্টের কাজে গতবছরের কোন এক শুক্রবারে নুহাদের গুলশান-২ এর বাসায় গিয়েছিল সে। ওখানে যাওয়ার আগপর্যন্ত অত সুন্দর বাসা শুধু ফিল্মেই দেখা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নুহা মোবাইলে মালয়েশিয়ার ছবি দেখিয়েছিল । কুয়ালালামপুরের একটা ভার্সিটিতে বিবিএ করতে গিয়ে সে চারটা বছর যে মালয়েশিয়া ঘুরেছে, সে ছবি দেখলে মনে হবে মালয়েশিয়া আগাগোড়া ঝকঝকে হলিডে ডেস্টিনেশন। ওর মালয়েশিয়া মানে লংকাউই, পেনাং, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। সালমার মালয়েশিয়া বাংলা মার্কেট নামধারী কোতারিয়া। কে জানে, নুহারা হয়ত শিগগিরই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গোছাবে। আর এদিকে সালমার ভিসা বৈধ না অবৈধ, তাই তো নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছেনা! সেদিন নুহার বেডরুমে একটা টি-পার্টির বাঁধানো ছবি দেখে সামিয়া কয়েক মুহূর্ত ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল। কোন আত্মীয়ের বাড়ির মোলায়েম লনে হলুদ আর পীচ রঙা গোলাপে সাজানো সাদা গোল টেবিল। দামি পোর্সেলিনের ফুলতোলা টি-পট। কেক স্ট্যান্ডে কাপ কেক-ব্রাউনি, ট্রেতে স্যান্ডউইচ, প্লেটে কাজু। টেবিল ঘিরে বসে নুহা আর তার ঝকঝকে কাজিনেরা। সামিয়ার তখন ঐ ছবিতে ঢুকে পড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল খুব। তবে ইচ্ছাটা স্থায়ী হয়নি। নুহার তরফে খানিক তাচ্ছিল্যের আভাসে তার আত্মসচেতনতা সজাগ হয়েছিল। নুহার আলাপে ঘুরেফিরে জামাকাপড়, মেকআপ, রেস্টোরেন্ট আর টিভি সিরিজের গল্প একঘেয়ে লাগে। যত দেশেই ঘুরুক, ওদের দুনিয়া ঘোরা তো ওই রিসোর্ট আর শপিং মল পর্যন্তই। নুহার গায়ে এরকম লেবেল লাগিয়ে সম্পর্কটাকে একরকম সিলগালা করে দিয়েছিল সামিয়া।
সালমার এই সস্তা চৌকিতে বসে সামনের আলনা আর ট্রাংকটায় চোখ রেখে চিঁড়াভাজা চিবাতে চিবাতে সামিয়ার কাছে নুহার সেই আশ্চর্য নরম বিছানাটাকে অবিশ্বাস্য লাগে!
সালমা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে সামিয়ার মনে হয়, নুহা কি সালমার রেস্টোরেন্টে খেতে গিয়েছিল কখনো? টিপস দিয়েছিল ওয়েট্রেস সালমাকে?


‘অই, তোর কখনো মাছ ধরতে ইচ্ছা করেনা? কিরকম ইকুইপমেন্ট লাগে সমুদ্রে মাছ ধরতে?’
‘না বাবা, অত শখ নাই, সময়ও নাই। ফ্রিজে আস্ত মাছ-মাংস থাকে, টান পড়লে ক্যানড টুনা-স্যামন খাই, ড্রাই বিফ থাকে, ফ্রুটস থাকে, চলে যায়। ওইরকম মাছধরনেওয়ালা শৌখিন মেরিনার কোন ভয়েজে পাই নাই! এইটাতো আমাদের পেটের ধান্দা রে। এত ডিউটির চাপে এইসব মাথায় ঘোরেনা।’
‘ওহ্! ডাঙায় বসে বসে আমি বেশি রোম্যান্টিসাইজ করে ফেলছি!’
স্কুলবন্ধু জাহিদের সাথে সামিয়ার দেখা হওয়াটা নেহায়েত কাকতালীয়। টিএসসির পাশের রাস্তায় সে একা একা হাঁটছিল ভবঘুরের তরিকায়। আর জাহিদ কোন আড্ডা শেষে টিএসসি থেকে বেরোচ্ছিল। ফেসবুক মারফত জাহিদের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এ যাওয়ার খবর আগেই নজরে এসেছে সামিয়ার। জাহিদও ওই ফেসবুকের বরাতেই সামিয়ার চকচকে চাকরির খবরটা পেয়েছিল। আজকের আচমকা দেখায় সামিয়ার চাকরি ছাড়ার নজিরে তার মুখভঙ্গি হয় দুর্বোধ্য বিমূর্ত ছবির সামনে বিহ্বল দর্শকের মত। সামিয়াও বেমালুম ভুলে যায় মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা শৌখিন সমুদ্রচারী না। তার কৌতূহল ঝাঁকবাঁধা ডলফিনের মত জাহাজের পাশে লাফঝাঁপ দিতে থাকে। ওই নীল দরিয়ায় ভাসা, গাঙচিল দেখা, বন্দরে বন্দরে ভেড়া নোনা জীবন কয়জনের হয়!
‘রাতে ঘুমানোর আগে তারা দেখিস? ইশ, মাঝসমুদ্রে একাএকা তারা দেখাটা কি ইন্টারেস্টিং! তারা চিনিস নিশ্চয়ই? তোদের একাডেমিতে তারা চেনাতো না?’
‘তারা চিনাইছিল। এখন অবশ্য তুই জিজ্ঞাস করলে বলতে পারব না। তারা দেখতে দেখতে একঘেয়ে হয়ে গেছে। ঘুমানোর আগে ল্যাপটপে ম্যুভি দেখি।’
‘আচ্ছা, ওইরকম খোলা আকাশ আর তারা দেখতে দেখতে মেরিনারদের মাথায় ফিলসফিক্যাল চিন্তা আসেনা?’
জাহিদ এবার বোধহয় কিছুটা বিব্রত হয়। সামিয়া সেটা খেয়াল করে বলে,
‘আমার আউলা-ঝাউলা কোশ্চেনে বিরক্ত হোস না! আমার প্রশ্নগুলা নাইভ, আমি জানি। সমুদ্র, গাঙচিল,আকাশ, তারা নিয়ে এত বলতেছি ঠিকই, কিন্তু তোদের জীবনে আমি ছয়মাসের বেশি সারভাইভ করতেই পারতাম না! কেমন লাগে তোর?’
‘ভালই। কেটে যায়। অত ভাবি না। চাকরি আছে মানে টাকাপয়সা জমতেছে।’
‘কতগুলা সাগরে সাঁতরাইছিস তুই?’
‘মেলা।’
‘বল, কোন সাগরে সাঁতরাইতে কেমন লাগছে? কোন সাগরের পানি কেমন?’
‘নারে বাবা, দলেবলে সাগরে লাফ দিয়া সাঁতরাইছি। ওই হু-হুল্লোড়ের সময় খেয়াল থাকে অত?’
‘আহা, মাস ছয়েক তোদের মত সাগরে থাকতে পারলে ভাল হত। নেটওয়ার্ক নাই, ফেসবুকে ঢুকতাম না, এর ওর সাথে ফোনে আজাইরা প্যাঁচাল পারতাম না। ডিউটি শেষে তারা দেখতাম আর আকাশপাতাল ভাবতাম!’
‘অত কষ্টের দরকার নাই! আমাদের শিপের ক্যাপ্টেনের বউ মারা গেছে কিছুদিন আগে। বিয়া করবি? ক্যাপ্টেনের বউ হয়া আরামসে ঘুরবি। ডিউটি-ফিউটি নাই, খালি গাংচিল দেখবি আর তারা গুনবি!’
সামিয়া হাসতে হাসতে বলে, ‘ছয় মাসের কন্ট্র্যাক্ট ম্যারেজে উনি রাজি থাকলে আমি রাজি!’
সামিয়া যেন আর উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করতে না পারে সেজন্যই বোধহয় জাহিদ ঝটপট প্রশ্নকারীর ভূমিকা নেয়।
‘চাকরিটা ছাড়লি কেন বল।’
সামিয়া আবৃত্তির ঢঙে বলে,
‘ইটচাপা পড়া ঘাসের জীবন চাই না! আলো চাই, হাওয়া চাই!’
‘শোন, জীবন একটা প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার, কোন আইডিয়া না। আলো-হাওয়ায় ভাসিস না বেশিদিন।’
‘মানুষ কি নির্বিকারভাবে চাকরিতে জীবনের টু-থার্ড পার করে আসে! এইসব ভাবলে জীবনকে একটা বোঝা ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না!’
‘কত মানুষ চাকরিতেই পারপাস পায় লাইফের। একেকটা ভয়েজের পর মাস দেড়েক বেকার থাকলে ঠিক আছে। কিন্তু বেশি চাইনা ভাই। মেরিনারদের মার্কেট খুব খারাপ এখন!’
‘কেন? কি হইছে?’
‘ডিম্যান্ডের চেয়ে সাপ্লাই বেশি হয়ে গেছে। নামমাত্র টাকায় ভয়েজে যাই এখন। সেই চাকরি জোটাইতেও কত কষ্ট! কিছুদিন আগে মেয়েদের ফার্স্ট ব্যাচ বের হল মেরিন একাডেমি থেকে। জানিস, ওরা একজনও শিপে চাকরি জোটাইতে পারে নাই! মাঝে মাঝে ভাবি, ঢাকায় একটা ভাল চাকরি ম্যানেজ করলে পারলে জাহাজে আর যাবো না। এত অনিশ্চয়তা খুব অশান্তির। আচ্ছা, বাদ দে এইসব। আর কি খবর বল।’
এরপর আলাপটা কেমন কৃত্রিম হয়। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নাযিল হলে জাহিদ চলে যায়। সামিয়া হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, প্রথমবার সমুদ্রযাত্রার উত্তেজনা আর আনন্দ থিতিয়ে পড়ার পর ইদানীং হয়ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে তলানিতে ঠেকা ব্যাংক ব্যালান্সের হিসাব করে জাহিদ। গাঙচিলজন্ম কত নির্ভার , ওদের সমুদ্রভরা আহার, পেটের ধান্দা করতে হয় না–এইসব কি ভাবে জাহিদ? নাকি সেই ভাবাভাবির ভারে আর ভারাক্রান্ত করতে চায়না নিজেকে? গাঙচিল, আকাশ আর ডলফিন দেখতে দেখতে পচে যাওয়া চোখ রাতের বেলা ল্যাপটপের স্ক্রীনে সেঁটে থেকে এক পিস বলিউডি নেশায় বাস্তব ভোলে?


বিকাল বেলা রিডার্স ডাইজেস্ট হাতে ছাদে উঠে সামিয়া দেখে নওশীনের মা পাটি বিছিয়ে সুতার গুঁটি আর কুরুশের কাঁটা নিয়ে বসে গেছে। বা-হাতের আঙুলে সুতা প্যাঁচানো আর ডান হাতের কাঁটা সুতায় প্যাঁচ লাগিয়ে লাগিয়ে এগোচ্ছে ।
সামিয়া পাটিতে ছড়িয়ে বসে।
‘কি বোনেন?’
‘কুরুশের লেস বানাই। কামিজের গলায় আর হাতায় লাগাবো।’
‘আমাকে শিখাবেন?’
‘তোমরা আর এইসব শিইখ্যা কি করবা? পড়াশুনা জানা মানুষ! আমরা পড়াশুনা বেশি শিখি নাই, এইসব কইরা টেকাটুকা বাঁচাই।’
নওশীনের মায়ের থেকে এক হাত দূরত্বে বসা সামিয়া সেই বিকালের আলোয় স্পষ্ট দেখে তার পড়াশোনা, হাতের ইংরেজী ম্যাগাজিন আর নওশীনের মায়ের কুরুশকাঁটা, সেলাইফোঁড়াই তাদের দু’জনকে আসলে দু’টা ভিন্ন বাড়ির ছাদে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর এরকম নানা ভিন্নতায় পৃথিবীর তাবৎ মানুষ থেকে সরতে সরতে সে একটা বিচ্ছিন্ন ছাদের মাথায় চলে গেছে। পিরামিডের চূড়ার মত সরু সে ছাদ কবে জানি শূলের মত তীক্ষ্ণ হয়! নিজের জীবনের মনোক্রোম আর সীমিতিতে ক্লান্ত সামিয়ার তাৎক্ষণিকভাবে নওশীনের মায়ের ক্লোন হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। বক্তিস্বাতন্ত্র, নিজস্ব রুচি ইত্যাদি ভুলে একটা স্বচ্ছ জলের আয়না হওয়ার বাসনা তাকে কেমন রূপান্তর করে। নওশীনের মায়ের আঙুলের চলাচল আর সুতার প্যাঁচ খাওয়া দেখতে দেখতে সে এই প্রথম তাকে সম্বোধন করে।
‘ভাবি, দেন দেখি আমাকে।’
সুতা-কাঁটা হাতে দিব্যি কুরুশ বুনে যায় সামিয়া! নওশীনের মায়ের মুখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
‘ভালই তো পারো! তুমি তাইলে পড়াশুনা জানা অকর্মা মেয়েগুলার মত না!’
সেই বিকালে সামিয়া আর রিডার্স ডাইজেস্ট খোলে না। যদি ইংরেজী ম্যাগাজিনের পাহারায় নওশীনের মা আড়ষ্ট হয়! সামিয়া টের পায়, সে নওশীনের মায়ের স্বর আয়ত্ত করে ফেলেছে। আগে যে মেয়েলি ও গেরস্থালি গল্পগুলো তাকে ক্লান্ত ও বিরক্ত করত সেগুলো সে মন দিয়ে শুনছে। তার নিজের কাছেই অজানা চাপাপড়া মেয়েলি গল্পগুলোও গলগল বেরিয়ে আসে। সে অবাক হয় যখন নিজেকে বলতে শোনে, ‘শুনেন ভাবি, নিচতলায় সালমার ঘরটার পাশের ঘরটায় যে মেয়েটা নতুন উঠছে সে নাকি পার্লারের কাজ করে? চলেন একটা ফেসিয়াল কইরা আসি।’
পার্লারের মেয়েটার ঘরে সামিয়া আর নওশীনের মা যখন পাশাপাশি মুখে স্ক্রাব-মাস্ক লাগিয়ে শুয়ে থাকে, তখন সামিয়ার মনে হয় একটু একটু করে সে তার কুঁচকে থাকা নাক সোজা করে নওশীনের মায়ের জীবনের ঘ্রাণ নিচ্ছে। পার্লারের মেয়েটা, জানা গেল তার নাম যুথী,হাতে বিলি কেটে যায় সারা মুখে। আরামে সামিয়ার চোখ বুঁজে আসে। কানের কাছে মুখ এনে নিচু গলায় যূথী বলে, ‘আপনার স্ক্যাল্প খুব ড্রাই। অয়েল ম্যাসাজ করবো?’ সামিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে কি এক সুগন্ধী তেলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গরম পানিতে চোবানো মোটা তোয়ালে দিয়ে সামিয়ার মাথায় পাগড়ি বেঁধে দেয় সে। কপাল থেকে সারা মুখে গরম ভাপ ছড়িয়ে পড়ে। ঘুমঘুম ঘোরে ওর হাত পা শিথিল হয়ে আসে।


মোটরপার্টসের দোকান, মেকানিকদের আস্তানা, ভাঙ্গারী জিনিসের বহর, আবর্জনার পাহাড়– রাস্তার দুই ধারে এইসব রেখে চলতে চলতে একটা গলির সামনে এসে সিএনজিঅলা চূড়ান্ত জানিয়ে দেয় সে আর যেতে পারবে না। সালমা ডান হাতে স্টিকে ভর দেয় আর বা হাতে সামিয়াকে ধরে মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা পচা ডোবার পাশে কয়েকটা ঝুপড়ি মতন টিনের ঘরের কাছাকাছি এসে ‘হেনা ফুপু, অ হেনা ফুপু’ বলে ডাক দেয়। হেনা ফুপু তার ঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে সালমার ডান হাত নিজের কাঁধে পেঁচিয়ে নিয়ে বলে, ‘হেই কবে তরে দেইখা আসছি। কাম থুয়া যাবার পারি না! এইহানে থাইকা যা ত!’
রাতের বেলা টিমটিমে বাল্বের তলায় হেনা ফুপুর রান্না শোলকা-প্যালকা, শুঁটকি ভর্তা আর ট্যাঙরা মাছে ভাত খেতে খেতে সামিয়ার মনে হয়, বহুদিন পর এমন তৃপ্তি করে খেল! তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রেখে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতেও শরীর থেকে সুখসুখ ভাপ উঠতে থাকে আর ওর মনে হয় এটা নিজের ফুপুর বাড়ি!
হাতের চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে , কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। এইটুকু চায়ে এত ধোঁয়া। হেনাফুপুর ছাপড়া ঘরের কাছে মতি মামার চায়ের দোকানে পাশাপাশি বসে জাহিদ আর সামিয়া। সামিয়া বলে, ‘এত ধোঁয়া কেন! আলাদীনের দৈত্য বের হবে নাকি? দৈত্য বের হলে তিনটা ইচ্ছাপূরণ লাগবে না গো! একটা চাকরিতেই চলবে!’ ব্যাংকের সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে সেই চিন্তায় তার মুখ শুকনা। চাকরি মন্দ, চাকরি মন্দ বোল উধাও। জাহিদ আলগোছে তার নাবিক-জীবনের ঝুলি খুলে ঝড়ে উত্তাল সাগরে জাহাজের গায়ে চাবুক পেটানো ঢেউয়ের কথা বলে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বলে তার রিটায়ার্ড বাবা আর ডায়াবেটিক মায়ের কথা। বিয়েটা আটকে আছে অনুষ্ঠান করার মত টাকার অভাবে। এই সময়টা বেকার বসে না থেকে একটা ওষুধ কোম্পানীর সেলস টিমে পার্ট টাইম চাকরি নিয়েছে। নিয়মিত ধর্না দিচ্ছে শিপিং কোম্পানীর অফিসগুলোতে। এইবার একটা বিদেশী জাহাজে সওয়ার হতে হবে! সামিয়া আবদার করে, ‘তোর কোম্পানীর সেলস টিমে একটা চাকরি হবে রে?’
ধানমণ্ডি লেকে প্যাডেল বোটে চেপে বিদেশী জাহাজ ধরতে গেল জাহিদ। ঐ যে দূরে ওর জন্য অপেক্ষারত জাহাজীরা সাইরেন বাজিয়ে তাড়া দিচ্ছে। ওকে বিদায় জানিয়ে লেকের ধারেই শুকনা পাতা জড়ো করে জ্বালানো আগুনের সামনে ধোঁয়াটে হয়ে থাকে গেরুয়া শাড়ির সামিয়া। সজল ভাই আর তার মেলে দেওয়া হাত আগুন পোহায়। বহু আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার একটা আবৃত্তি সংগঠনে ‘বাচিক উৎকর্ষ সাধনে’ সপ্তাহ দুয়েক ঢুঁ মেরে বেরিয়ে এসেছিল সামিয়া। সেখানেই মেলাজনের ভিড়ে সজল ভাইয়ের সাথে পরিচয় এবং এরপর আরও মেলাজনের ভিড়ে তাকে স্বভাবতই মনে না রাখা। আজকাল লোকটা কবিতা পড়েই ক্ষান্ত দেয়না, লেখেও। এই সন্ধ্যায় তার শতভাগ প্রমিত শুদ্ধ উচ্চারণের সামনে সামিয়াও সংবাদ পাঠিকার মত শুদ্ধতা চালিয়ে যায়। সজল ভাই নিজের লেখা কবিতার বই উপহার দিলে সে অনুরোধ করে, ‘আপনার সবচেয়ে প্রিয় কবিতাটা পড়ে শোনাবেন?’ অন্ধকার লেকের ধারে আগুনের ঝলসানো আলোতে সজল ভাই পড়তে শুরু করে, ‘যে জলে আগুন জ্বলে…’
‘আপা, ও আপা, ঘুমায় পড়লেন নাকি?’ যূথীর ডাকে সামিয়ার চোখ খুলে যায়। নওশীনের মা তড়িঘড়ি, ‘নওশীনের আব্বুর আসার সময় হইছে। আমি গেলাম গা!’ বলে উঠে চলে যায়। এতক্ষণের তন্দ্রাচ্ছন্নতা সামিয়াকে বেশ আউলে দেয়। কি চলল এতক্ষণ? সামিয়া বিড়বিড় করে। কি আজগুবি কাণ্ডকারখানা! সালমার হেনাফুপুর ঘরে থাকতে তার ঘেন্না করল না? ঢকঢক পানি খাওয়ার সময় পানিটা ফোটানো কি না, জন্ডিস-টাইফয়েড হবে কি বা সেই চিন্তা খচখচ করল না! তেল চিটচিটে বালিশটা দেখেও ব্রণ বা উকুনের আশঙ্কায় উসখুস করল না একটুও! ওইরকম জাহিদীয় কাঙালপনায় তার চাকরির জন্য হাহাকারই বা কেন? আর সজল ভাইকে নিজের কবিতা পড়তে বলল কিভাবে? আদৌ কখনো কবিতার ভক্ত তো সে ছিল না। বিশেষ করে সজল ভাইয়ের কাঁচাকাঁচা অতি আবেগী কবিতাগুলোর তো নয়ই! আর ওই লোকটার মুখে নিজের কবিতার নামে হেলাল হাফিজের কবিতার বইয়ের নাম কেন? কি ঘটল এতক্ষণ? না, নির্ভেজাল স্বপ্ন না। স্বপ্ন আবছা জিনিস, এত স্পষ্টতায় তাকে মনে করা যায় না। স্বপ্ন আর আর কল্পনার সংকর? ওই মানুষগুলোর আয়না হয়ে গিয়েছিল নাকি সে? কোথায় তার রুচির কড়াকড়ি, খুঁতখুঁতানি, নাক সিঁটকানি?
সামিয়া যূথীর পাশের ঘরটায় সালমার কাছে যায়। সে তখন মোবাইলে মোশাররফ করিমের কোন নাটক দেখতে দেখতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। সালমার হাসতে হাসতে লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে সামিয়ার সামিয়াত্ব ভুলে সালমা হতে ইচ্ছা করে। অন্য সময় ভুলেও মোশাররফ করিমের এই নাটক সে দেখত না, বোকা বোকা কৌতুকে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু এখন আধশোয়া হয়ে সালমার ছোঁয়াচে হাসির গুণে সে হাসতে থাকে। এমনকি নাটকের মাঝে ফোঁড়ন কাটতে ভোলেনা। হাসির দমকে দমকে সামিয়ার নিজেকে হালকা হাওয়াই মেঠাই লাগে । সেইরকম গোলাপী ফুরফুরে মেজাজে সে বলে, ‘সালমা, হেনা ফুপুর বাড়িতে যাইতে চাইছিলা না? চলো, আমরা ঘুইরা আসি কালকে। রাইতে ওইখানে থাকবো।’
‘তুমি যাবা? না, তুমি অইখানে থাকতে পারবা না! খুব নোংরা জায়গা। পাশে আবার পচা ডোবা। ল্যাট্রিন দূরে।’
‘একরাতে মইরা যাবো? চলো কাইলকাই যাই। ফুপুরে কল দেও। শিদল না হিঁদল কি জানি উনি রান্ধে মজা কইরা? ঐটা থাকলে রানতে কইয়ো।’
সামিয়ার সেই শাঁকচুন্নির গল্প মনে পড়ে, ব্রাহ্মণের বউকে হাপিশ করে তার রূপ ধারণ করে যে ঢুকে পড়েছিল সংসারে। না বাবা, কাউকে হাপিশ করে নয়, নির্দোষ পরজীবীর মত অন্যের মজ্জায় তার শাঁস খোঁজা। অন্যকে মুগ্ধ করা নয়, নিজের স্বর জানান দেওয়া নয়, বেছেবেছে নিজের ঝাঁকে ভিড়ে যাওয়া নয়। অনেকগুলো মানুষের আছরে পড়া। তারপর তাদের স্বর নকল করে নিজের মনোক্রোম থেকে বিরতি নেওয়া। কিংবা একটা দীঘির জল হওয়া। দীঘির জলে কাদের ছায়াগো?
সে রাতে এভাবেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারত সামিয়া, কিন্তু হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস জেগে ওঠে। যদ্দিন কাছাকাছি ছিল, মধ্যবিত্ত শুচিবাইয়ে নুহার ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছে সে, পাছে না বড়লোকি ঘোড়ারোগে ধরে কিংবা তার মধ্যবিত্ত অতি সংবেদনশীল আত্মসম্মান আহত হয়! সিলগালা নুহা আর তার নাগালে আসবে না, এই দীঘির জলে সে ভূতের মত ছায়াহীন।

৬,১০৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “নির্দোষ পরজীবী”

মওন্তব্য করুন : সাইফ সহিদ

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।