রং কাস্টিং

সেই বিপ্লবী কিংবা বলা ভাল প্রাক্তন-বিপ্লবীর সাথে আমাদের একতরফা ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। একতরফা কারণ তিনি আমাদের বিন্দুবিসর্গও জানেন না। আমরাও তাকে রক্তে-মাংসে দূরের কথা, ছবিতেও সনাক্ত করিনি। তার এই অশরীরী উপস্থিতিতে আমাদের কৌতূহল ও অনুমান পাক খায়। লোকটা বকিয়ে না, করিয়ে। কলমবিপ্লবী বা কাগুজে যোদ্ধা না। রীতিমত চাষীর পাতের এঁটোকাঁটা খেয়ে বিপ্লব করা মানুষ। শ্রেণীশত্রু খতম মিশনে আপন ভাইকে রেহাই না দেওয়া ভ্রার্তৃঘাতী। আমাদের রায়ে আত্মঘাতীও। পতঙ্গের আগুনে ঝাঁপ। প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে জমিদার-জোতদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামা, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাক সেনাদের মোকাবেলা করা, যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক মামলায় ফেঁসে দশ বছর জেল খাটা মঈন আলী ঘরদোর,আত্মীয়-বন্ধু, পড়াশোনা আর শখ-শৌখিনতা যখন ছাড়ে, বয়স তখন মেরেকেটে বিশ। জেলের ভাত ছাড়তে ছাড়তে বত্রিশ যায় যায়। কিন্তু এও তো ঠিক, জীবনের ‘এক যুগ’ বরবাদ করতে পারার মত আত্মঘাতী না হলে আমরা এই রেস্টোরেন্টে বসে তাকে নিয়ে আচ্ছন্ন হবই বা কেন!
অর্পা সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ টেনে আনে, ‘অনিমেষের তাও মাধবীলতা ছিল, মঈন আলীর কেউ ছিল না।’ আমি সবজান্তাসুলভ জ্ঞান ফলাই, ‘আরে, বিপ্লবীদের এরকম শপথ থাকে—বিপ্লব শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রেম-বিয়ে নিষিদ্ধ! প্রেমভালবাসা না থাকলে পাঠক বেজার হবে, এইজন্যই কালবেলায় মাধবীলতার মত চরিত্র রাখতে হয়!’
অর্পা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘আর আমরা খালি প্রেম করে করেই জীবন পার করতেছি। ওয়ার্থলেস!’ আমি ওর আয়েশক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বিপ্লবী চেতনা বনাম যৌনাকাঙ্ক্ষার রশি টানাটানির হিসাব করি। ইদানীং মঈন আলী চর্চার সূত্রে আমরা এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে যাই। মঈন আলীর ব্যাপারটা খোলাসা করি—তার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ-পরিচয় তার আত্মজৈবনিক বইয়ের পাতায় (যদিও ফ্ল্যাপে তার ছবি পর্যন্ত নেই)। আপাতদৃষ্টিতে খুব সরল সাদামাটা এই সংযোগ। ঠিক সম্পর্কের গোত্রে ফেলা যায় না। কিন্তু বইটাকে আর দশটা নীরস কাগুজে খসখসে বস্তু হিসাবে অবহেলা করার উপায় নেই। বহু শ্বাস নেওয়া মানুষের চেয়ে জ্যান্ত! পড়তে পড়তে কখন যেন মঈন আলীর আছর পড়ে যায়! তার ছাল-চামড়া ছাড়ানো অনুভূতির সামনে নির্বিকার থাকা যায় না। বইটাকে হজম করে ফেলতে না পেরে আমরা ডেটে ও চ্যাটে বিভিন্ন দৃশ্যের চিত্রায়নে নামি। ঠাণ্ডা লেমোনেডের বরফ কুচি কুড়মুড় করে ভাঙতে ভাঙতে হয়ত অর্পার মঈন আলীকে মনে পড়ে। চুমুক থামিয়ে বলে, ‘ইশ! সারাদিন না খাওয়া, বাইরে বাইরে ঘোরা লোকটা শুকনা জিভ টানতেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে জেলে-চাষীদের ঘরেঘরে আশ্রয় খুঁজতেছে। কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাস করতেছে না। যতই পুরানা শার্ট-লুঙ্গি পরুক, চেহারা আর হাবভাব থেকে শহুরে ভাব তো অত সহজে যায় না!’ আমি তাল মিলাই, ‘হুম…বাঁধা কামলার কাজ নেওয়ার পর তো আরেক মুসিবত। কাজকাম তো কিছু পারে না, কোনদিন করে নাই। স্কুল-কলেজের পড়াশুনা সব চাপা দিয়ে অন্য কামলাদের মত হওয়ার কসরত। সারাদিনের খাটাখাটনির পর সন্ধ্যায় কালভার্টের ওপর বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে দুই-তিন জন চাষাকে বিপ্লবে সবক দেওয়ার চেষ্টা।’ বলতে বলতে আমি সেই কালভার্ট, বিড়ির আগুন-ধোঁয়া, জোনাকি দেখতে থাকি। অর্পাও নিশয়ই কচুরিপানাঢাকা হাজামজা খালের জলজ গন্ধের ভেতর তামাকের গন্ধ পায়।
অর্পা কি দরকারে ওয়াশরুমে গেলে আমি টেবিলে হাতের ফ্রেমে মাথা রেখে নিজেই মঈন আলী বনে যাই। নিজের বড়ভাইকে তার ইউনিটের কমরেডরা মেরে ফেলার পরের দৃশ্যে মঈন আলীর জটিল মনস্তত্ত্বে সেঁধানোর চেষ্টা করি। একদিকে সফল বিপ্লবী অ্যাকশনের উত্তেজনা, অন্যদিকে খতম হওয়া আপন ভাইয়ের শৈশব স্মৃতির হানা। অত্যাচারী বর্তমান কই হাপিশ হয়ে যায়। ডাঙগুলি খেলায় অল্পের জন্য চোখ গেলে না যাওয়া, বিড়িসহ হাতেনাতে ধরা পড়ে বাপের হাতে মার খাওয়া, পোষা কুকুর ‘লাট’কে নিজের পাত থেকে খাওয়ানো নিষ্পাপ শিশুকাল দিস্তাদিস্তা পাতাসমেত হাজির হয়। দ্বিধাদীর্ণ মঈন আলীর গোঙানি শুনি ভেতরে। রেস্টোরেন্টে এসির ঠাণ্ডায় গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে এই যন্ত্রণার ভাগ নেওয়াটা নেশাধরা, রোমাঞ্চকর। একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়, তবে সাময়িক। মঈন আলীর যন্ত্রণার মত আসল না, সর্বগ্রাসী না। সিমুলেটেড যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে এসে দেখা যায়, দিব্যি সব ঠিকঠাক চলছে আমার!
অর্পা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলে, ‘শোনো, থানার অস্ত্রশস্ত্র লুট করে জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করাই খালি বিপ্লব না। যে লোকটা কোনদিন অপরিষ্কার টয়লেট ইউজ করতে পারত না, সে যখন কৃষকের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে নাহয় মাঠে দিনের পর দিন টয়লেট সারে সেটা কম স্যাক্রিফাইসিং না! আমি তো ভাল টয়লেটের অভাবে গ্রামেই যাইতে চাইনা! এই রেস্টোরেন্টের ওয়াশরুম ভাল না! এখানে আসবো না আর!’


মঈন আলীর আত্মজীবনী নাযিল হওয়ায় অনিবার্যভাবে বিপ্লবী শৌখিনতায় পায় আমাদের। বস্তিতে আগুন লাগলে কিংবা গার্মেন্টস ধসে পড়লে যে রাজনৈতিক দলগুলো শাহবাগে জমায়েত হয়, আমরা তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে যাই। কিছুক্ষণ স্লোগানে লিপসিংক করে পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনে হালিম খেয়ে বাসায় ফিরে আসি। তারপর হয়ত আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশী হামলার খবর পাই ফেসবুকে। তবে আমাদের গায়ে লাঠির বাড়ি, রাবার বুলেট কিংবা টিয়ার গ্যাসের শেল লাগেনা কখনো। আমরা কখনো অ্যারেস্ট হইনা। (ঝাল)মুড়ি চাবাতে চাবাতে হতাশ হয়ে বলি, ‘নাহ, এই দেশে সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব আর হবে না! মানুষ এখন এত স্বার্থপর হয়ে গেছে! কে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে আন্দোলনে আসবে! এখন বিপ্লবের চিন্তা জেএমবি-আইএসের জিহাদীদের!’ কখনো আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দু’চারজন কর্মীকে আক্ষরিক অর্থে প্রশ্নবিদ্ধ করি। আমাদের মুখে ফেনাওঠা কৌতূহলের বুদবুদ, ওদের তীক্ষ্ণ তেজী গলায় জোরদার ধার। কিন্তু কিছু মুখস্ত সংলাপের তলায় আমরা কেউই থই পাই না। এক সন্ধ্যায় স্ট্রিট লাইটের হলুদ ঝাপসা আলোয় ক্যাপঢাকা একজন আমাদের ঠোকর দিয়ে চলে যায়—‘অ্যামেচার আসছে পার্ট-টাইমারের ইন্টারভিউ নিতে!’ শরমে-মরমে আমরা কিছুদিন ক্ষান্ত দেই। সভা-সেমিনারে ছেলেধরার মত চুপচাপ ওঁত পাতি; পেছন থেকে আন্দাজ করা লোকটার গঠন আর কানে রেকর্ড হয়ে থাকা তার কন্ঠের শ্লেষের সাথে বক্তা-শ্রোতাকে মেলানোর চেষ্টা করি। লোকটাকে পাওয়া না যাওয়ায় কিংবা অ্যামেচার-পার্টটাইমার-ফুলটাইমার-প্রফেশনাল কারও কথায় কোন নতুন মন্ত্র না পাওয়ায় আমাদের অ্যামেচারত্ব থেকে আর রূপান্তর হয় না।
সুন্দরবনে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধী এক অহিংস আন্দোলনে আমরা একদিন শাহবাগে। গণসংগীত আর পথনাটকের আকর্ষণে সেদিন মানুষের আনাগোনা বেশ। তবে বেশিরভাগই উটকো। হঠাৎ আমার ডানের জটলা থেকে মঈন আলী নামটা ছিটকে আসে। আমি আমার বাঁয়ে দাঁড়ানো অর্পাকে কনুইয়ের গুঁতা দেই, ‘এ্যাই, এরা মঈন আলীর নাম বলতেছে। লোকটা আসছে নাকি এখানে?’ অর্পাও কান খাড়া করে। তারপর আমাকে ঠেলে ছেলেগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শোনাশুনির দায়িত্ব হস্তান্তর (বা কর্ণান্তর) করে আমি গণসংগীতে কান দেই। খানিক পর অর্পা হাসিহাসি মুখে আমাকে ভিড় থেকে টেনে বের করে বলে, ‘মঈন আলীকে নিয়ে একটা পাঠচক্র করতেছে এরা! আগামী শুক্রবার! যাক, অ্যাট লাস্ট আমরা তার দেখা পাচ্ছি!’
‘গ্রেট! কোথায়?’
‘আরে ফেসবুকে ইভেন্ট খুলবে ওরা। রাতে বাসায় গিয়ে সার্চ দিলেই পাবা!’
অর্পা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি ভাবে, তারপর আঙুলে তুড়ি বাজায়, ‘এ্যাই! তোমার ছাই রঙের ঢিলাঢালা একটা পাঞ্জাবি আছে না? ওইটা পরবা ওইদিন।’
মহা মুশকিল! পাঞ্জাবি পরতে ভাল লাগে না আমার। তাছাড়া ওটা আলমারীর কোন চিপায় লুকিয়ে কে জানে!


শুক্রবার আসার আগ পর্যন্ত আমরা মঈন আলীর সম্ভ্রাব্য অবয়ব নিয়ে বাজি ধরতে থাকি। অর্ধেক বিপ্লবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা!
অর্পা বলে, ‘মঈন আলীর কথা ভাবলে আমার তো ‘কালবেলা’ সিনেমার পরমব্রতর চেহারা মাথায় আসে। গৌতম ঘোষের কাস্টিং ভাল ছিল। নকশালিস্ট ক্যারেক্টারে ভাল মানাইছে ওকে!’
‘আরে ধুর! ওকে একদম মানায় নাই! শুরুর দিকে ঠিক ছিল, কিন্তু বিপ্লবী হওয়ার পর যে চেহারা হওয়ার কথা, সেইটা পরমব্রত ধারণ করতে পারে নাই!’
‘আচ্ছা, এই বইয়ের কাহিনী নিয়ে কিন্তু ভাল সিনেমা হতে পারে!’
‘হুম, কাহিনী জবরদস্ত! তবে স্ক্রীপ্ট লেখার সময় মঈন আলীর এইরকম প্রেমবর্জিত জীবন দেখানো যাবে না! সিনেমা হিট করতে প্রেমিকা লাগবেই! সরাসরি প্রেমিকা যদি নাও দেখায়, ধরো তার কোন অ্যাডমায়ারারের চরিত্র থাকতে পারে! বিপ্লবীর প্রেমে নিবেদিত কোন নারী!’
আমার দুজন হাসতে থাকি। হাসতে হাসতে অর্পা বলে, ‘তারেককে ওই পাঠচক্রে আসতে বলি। ওর তো সিনেমা বানানোর ঝোঁক। সরাসরি মঈন আলীর মুখে কাহিনী শুনুক। কোনদিন প্রডিউসার ম্যানেজ করতে পারলে এটা নিয়ে বানাইতে পারে!’
আমার নাক কুঁচকে যায়, ‘আরে, তারেকের ওইটা হুজুগ। ওর যে লেভেল, তাতে এইরকম সিনেমা বানানোর সাধ্য ওর নাই! একদম নষ্ট করে ফেলবে!’
অর্পা আবার মইন আলীর চেহারা জোড়া দিতে ব্যস্ত হয়, ‘আচ্ছা, ওনার চোখ সুন্দর হওয়ার কথা! বইয়ে আছে না, উনি হলের এক লেফটিস্ট নেতার কাছে যাওয়ার পর সেই নেতা ওনার চোখের দিকে তাকায় ঠাট্টা করে বললেন, তুমি বিপ্লবী হবা? কিন্তু তোমার তো প্রেমিকের চোখ!’
আমার চে গেভারাকে মনে পড়ে। উঠতি বয়সে রুমের দেয়ালে এমা ওয়াটসনের পোস্টারের পাশে চে’র পোস্টার ছিল একটা। সেখান থেকে ঝেড়ে দেই—The true revolutionary is guided by a great feeling of love!
‘তাই!’ বিপ্লবীরাও যে প্রেমের ধার ধারে সেই আভাসে অর্পার মুখ ঝকঝক করে। হয়ত নিজেকে মাধবীলতা ভাবছে! এই প্রেম সেই প্রেম না— গোছের কপচানি শুরু করতে গিয়েও নিজেকে সামলাই। এই কোটেশনে চে যাই বুঝিয়ে থাকুক, নিজে প্রেম তো আর কম করেনি! অর্পা আঙুলে চুল পাকাতে পাকাতে বলে, ‘আমি ওনাকে অনেকগুলা প্রশ্ন করব!’
‘আসলেই প্রশ্ন আছে, নাকি ওনার নজরে পড়ার ধান্দা?’
‘আরে আছে আছে! জেল থেকে বেরোনোর পর কি করল তার তো কিছুই জানি না! অনার্স কমপ্লিট করেনি। বয়স বত্রিশ পার। অনেক স্ট্রাগলের কাহিনী থাকার কথা!’
অর্পাকে ভাবুক ভাবুক দেখায়। কেমন অপরাধীর চেহারা করে বলে, ‘উনি অন্য প্রজাতির মানুষ। আমাদের মত লাভ লোকসানের হিসাব, আরাম-আয়েশ-ক্যারিয়ারের ধান্দা ছিল না! খুব স্ট্রেঞ্জ লাগে আমার!’
আমি ওকে চুপসে দিতে বলি, ‘অত রোম্যান্টিসাইজ করো না! ওনারও লোভ ছিল। মহত্ত্বের লোভ! ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের মত অমর হওয়ার লোভ!’
ওপরে-বাইরে মঈন আলীকে আনরোম্যান্টিসাইজ করলেও আমারও খুব ইচ্ছা মানুষটার সাথে হ্যান্ডশেক করার। আমার কাছেও উনি যতটা মানুষ, তার চেয়ে বেশি আইডিয়া।


আমরা জ্যামের ভয়ে আগেভাগে বেরিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শুরুর আধ ঘন্টা আগেই পৌঁছে গেছি। অর্পার অতি উৎসাহে তারেকও কাবাব মে হাড্ডি। এ ঘরটায় আমরা ছাড়া আরও জনা চার। এই বেকার সময়ে অর্পা মঈন আলীর গুণগান শুরু করে দেয়। তারেকও তাতে খানিক বিরক্ত, ‘এ্যাই, তুই ওনার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নাকি!’
অর্পাকে আজকে অন্যরকম লাগছে। ওর ঠোঁটে সবসময় লিপস্টিক থাকে। আজকে খালি। চোখে কাজল,খোলা চুল,কপালে বড় টিপ। যত্ন করে সেজেছে বোঝা যায়। কিন্তু লিপস্টিক পরতে ভুলল কেন! আমি ফিসফিস করি, ‘এই, লিপস্টিক পরোনি যে! তোমাকে আজকে অন্যরকম লাগতেছে!’
অর্পা চোখের ইশারায় খানিক দূরে বসা দুই মেয়েকে দেখায়, ‘ওদের লিপস্টিক পরতে দেখছ? এই ধরনের গেটআপে লিপস্টিক যায় না।’
প্রেমিকার অনুমতিক্রমে আমি এবার মেয়ে দু’টোকে ভালভাবে দেখি। একজন সালোয়ার কামিজ, আরেকজন শাড়ি। দু’জনেরই কপালে মস্ত টিপ এবং হ্যাঁ, ঠোঁট খালি। তবে ওদের মুখের ত্বকও খালি। অর্পার মত দাগ-গর্তের ওপর পাউডারের পরত নেই। আমি অর্পাকে বলি, ‘ওদের চেহারায় ন্যাচারাল ভাব আছে। তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি সেজে আসছ!’
অর্পা উচিত জবাব হাতড়ে না পেয়ে আমাকে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘ওঠো, আমার পাশের চেয়ার থেকে ওঠো! তারেকের পাশে গিয়ে বসো, যাও! তোমার পারফিউমের গন্ধে আমার বমি পাচ্ছে!’
এরকম আশঙ্কা আমারও ছিল! আমার ছাইরং পাঞ্জাবিটা আলমারীর এক কোণে দলা পাকিয়ে পরিত্যক্ত পড়ে ছিল বহুদিন। আজ ধোব, কাল ধোব করে একেক দিনের রুটিনে ধোয়াধুয়ি গছাতে গছাতে শেষতক আর ধোওয়াই হয়নি! অর্পা ঝামেলা করতে পারে এই ভয়ে ওই স্যাঁতসেঁতে গন্ধঅলা পাঞ্জাবিটাই বিপুল পারফিউমের বৃষ্টিতে ভিজিয়ে এনেছি। ওর মতে, এইরকম বিপ্লবী পাঠচক্রের ড্রেসকোড—লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি (খদ্দরের হলে ভাল)।
আমি আগতদের জরিপ করতে থাকি। ওই মেয়ে দু’টো ছাড়া আরও তিনজন আছেন। অফ হোয়াইট সিল্কের পাঞ্জাবি পরা টাকমাথা মোটাসোটা এক বয়স্ক লোক। তার পাশে বছর পনেরর এক মায়ামায়া কিশোরী। দু’জনের চেহারায় মিল। মেয়ে বা নাতনী হবে হয়ত। কাস্ত্রোর ছবিঅলা লাল টি-শার্ট গায় ঝুঁটিবাঁধা এক তরুণ সেই অফ হোয়াইট পাঞ্জাবির সাথে কথা বলছে। একজন দু’জন করে আসছে। আমি সামনাসামনি মানুষ দেখা বাদ দিয়ে ফেসবুকে মানুষের ছবি দেখি। হঠাৎ অর্পা আমাকে গুঁতা দেয়, ‘এই, মঈন আলী মনে হয় আসছেন!’
অর্পার বলে দিতে হয় না কে মঈন আলী। আগতদের মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন এক লোক। লম্বা পেটানো শরীর। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। মুখের ভাঁজগুলো যেন ছুরি দিয়ে কাটা। কাঁচা-পাকা গোঁফটা স্ট্যালিনীয়। তীক্ষ্ণ চোখ। এবং হ্যাঁ, খদ্দরের পাঞ্জাবি। অর্পা তারেককে বলে, ‘ওনার ছবি তুলে রাখিস। যদি শেষমেশ সিনেমাটা বানাস, এরকম দেখতে একজন অ্যাক্টর কাস্ট করবি।’
তারেক ঘাড় ঘুরিয়ে, মাথা উঁচু-নিচু, ডান-বাম করে দেখতে থাকে। ভুরু কুঁচকে নোটবুকে কি কি জানি লেখে। মাপজোক, আঁকিবুঁকি, হাবিজাবি। মঈন আলীর জেশ্চার-পশ্চার, এক্সপ্রেশন, মুডের হিসাব? ওর চাউনিতে পোর্ট্রেট আর্টিস্টের সিরিয়াসনেস দেখে আমি ওকে নিয়ে আশান্বিত (হতে না চেয়েও) হই খানিকটা।
এতক্ষণে মানুষের সমাগমে ঘর গমগমে। পাঠচক্রের সঞ্চালক যিনি, উঠে দাঁড়ালেন। ছোটখাট ভূমিকা দিলেন মঈন আলীকে নিয়ে। এত দিনের ‘মিথ’ মঈন আলীর কথা শোনার জন্য আমরা উৎসুক ও উশখুশ। লোকটা উঠে দাঁড়াতেই পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলাম! ইনি দুর্ধর্ষ বিপ্লবী মঈন আলী? সেই অফ হোয়াইট সিল্কের পাঞ্জাবি আর সোনালী ফ্রেমের চশমার টাক মাথা ভদ্রলোক! নিরীহ ছাপোষা কারও সাতেপাঁচে না থাকা ভেতো গৃহস্থ সুখী চেহারা।
তারেক বিড়বিড় করে, ‘রং কাস্টিং!’

৬,০৮১ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “রং কাস্টিং”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    তারেকের মুখ থেকে বিড়বিড় করে বেরিয়ে আসা মনোলগ- ‘রং কাস্টিং’ শিরোনাম হিসেবে চমৎকার মানিয়েছে।
    খুব সুন্দর হয়েছে এ গল্প। তোমার লেখার হাত চমৎকার। লেখা চালিয়ে যেও।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।