বৃত্তস্থ ত্রিভুজ

জেবা আফরোজ। বিজনেস ম্যাথের কোর্স টিচারের নামটা চোখের সামনে ঘুরঘুর করলেও আর দশটা সাধারণ সাদামাটা নামের মতই একে আমলে নিইনি। ক্লাসের কেউ কেউ বিশেষত্বহীন জেবা থেকে জেব্রা বের করে হাসাহাসি করতে থাকলে তাতে দু’একবার তাল দিয়েছি, ব্যাস। নতুন শিক্ষক; তাই যাবতীয় প্রাথমিক কৌতূহলসমেত প্রস্তুত আমরা। তা সত্ত্বেও জেবা বা জেব্রা ম্যাম যখন ক্লাসে ঢুকলেন, তার চেনাচেনা চেহারায় ‘জেবা আফরোজ’ খাপে খাপ মিলে যেতেই চমকে উঠলাম! বছর তিনেক আগের সেই অপ্রস্তুত সাক্ষাতে ভড়কে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি; এবারের ঝাঁকি-ঝুঁকি ডিগ্রিকয়েক বেশি। আগে-পরে মেলাতে গেলে এক চেহারার দুই আলাদা মানুষ ভাবলেই স্বস্তি। সেবার জিন্স-ফতুয়া, এবার ফুলহাত ঢিলেঢালা কামিজ-হিজাব। উনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? চেহারার খুঁটিনাটি যদি লাপাত্তা হয়ও, রোলকলের সময় চেহারা-নামের যৌথ হাঁকডাকে স্মৃতি কি ধড়মড় করে জেগে উঠবেনা? এমনিতে না চেনার সুযোগ নেই। প্রথমত, ভাইয়ার সাথে আমার আদলের অসম্ভব মিল (বয়সে দশ বছরের পার্থক্য সত্ত্বেও)। সবাই বলে, আমরা পিঠাপিঠি হলে যমজ বলে চালানো যেত। দ্বিতীয়ত, আমাদের নামের মিল। ভাইয়ার নাম আবিদ জামান আর আমি আদীবা জামান। তৃতীয়ত, প্রেমিকের একমাত্র বোনের সাথে দেখা হওয়ার সেই বিব্রতকর ঘটনা তিনি নিশ্চয়ই ভোলেননি! নাকি প্রেমিক প্রাক্তন হয়ে গেলে তার সংক্রান্ত যে কোন কিছুর (তা স্মৃতিই হোক কি মানুষ) ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা ফরয?
জেবা ম্যাম প্রথম ক্লাসে অ্যাটেন্ডেন্স শিট খুললেন না। দ্বিতীয় ক্লাসে রোলকল করলেও আমার নাম বা চেহারা তার ভুরুতে সামান্যতমও ভাঁজ ফেলল না। না চেনার এমন নিখুঁত ভান! প্রফেশনালিজম না রাগ-ক্ষোভ-তিক্ততা? পরের কারণগুলো ভয় ধরাল।
এরকম আপত্তিকর উদাসীনতা সত্ত্বেও আমি তাকে খেয়াল করে যাই—ক্লাস লেকচারের চেয়ে তার তাকানোর ভঙ্গি, গজদাঁত হাসি, আঙুলের নড়াচড়া, হিজাবের পরিপাট্য। প্রেমের মেয়াদকালীন ভাইয়ার সামনে তার চলনবলন কল্পনায় আনি। ক্লাসের ক্রাশ খাওয়ার বাতিকঅলা ছেলেরা জেবা ম্যামের ওপর ক্রাশ খেয়ে ‘ক্রাশেস অ্যান্ড কনফেশনস’ পেজে পোস্ট দিলে আমার অহেতুক রাগ হয়। রাগের কি, উনি তো আর আমার (আইনত কি আবেগীয়) ভাবী না কিংবা ভাইয়ার এক ও অদ্বিতীয় লাইলীও না।


ভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্টের দিনে সাত সকালে অর্ধেক ঢাকা পাড়ি দেওয়া ‘পুরান ঢাকা টু মিরপুর’ সফর থেকে বাঁচিয়েছিল রোশনী আপু, ভাইয়ার সবচেয়ে পুরনো গার্লফ্রেণ্ড (এক্স)। ঢাকায় আমাদের একমাত্র আত্মীয় মেজমামার পুরান ঢাকার বাসা থেকে মিরপুরের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারার আতঙ্ক ও সন্দেহের কথা পাড়তেই রোশনী আপু সাথে সাথে মুশকিল আসান করেছিল—‘তুই আমার বাসায় চলে আয়! কাছেই তোর সেন্টার।’
রোশনী আপুর সাথে সম্পর্কের উসিলা ভাইয়া না, ওরা রংপুরে আমাদের প্রতিবেশী। ক্লাস সিক্সে কি সেভেনে পাশের বাড়ির রোশনীর সাথে ভাইয়ার ইঁচড়ে পাকা প্রেমচর্চার শুরু। সেই ঘটনার কোন সাক্ষ্য দিতে পারব না (এমনকি আমার সামনে চুমু খেয়ে থাকলেও), কারণ বছর তিনের আধোকথা শিশুর সেই বোধ থাকেনা। এইচএসসির পর ভাইয়া ঢাকা ভার্সিটি আর আপু রাজশাহী ভার্সিটিতে চলে গেলে বিস্তর টানাটানিতে টানটান সম্পর্ক পট করে ছিঁড়ে যায়। এই ঘটনার সাক্ষী আমি, তবে আমার মেজাজী ভাইকে দেখে ব্রেকআপের আঁচ তেমন পাওয়া যায়নি। (সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে যে ঘরের দরজা লাগিয়ে রাখে, তার ভেতরে দাবানল না শীতল জল বুঝব কিভাবে!) আমার নাগাল ওই রোশনী আপু পর্যন্তই; তার ডাল-পাতায়, এমনকি শিরা-গিরায়। ব্রেকআপের অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় সে কাঁদত, মাঝেমাঝে কোলবালিশ ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদা শেষে ফোলা চোখ, লাল নাক নিয়ে বলত, ‘চুলে বয়কাট দেওয়ার পর তুই তোর ভাইয়ের ডুপ্লিকেট হয়ে গেছিস!’ ভাইয়া দুই ঈদ ছাড়া বাড়িমুখো হত না। আপু দু-তিন মাস যেতে না যেতেই রংপুরে হাজির; আমাকে ডেকে নিয়ে (শিখিয়ে-পড়িয়ে কল করিয়ে) ভাইয়ার মগজ-হৃৎপিণ্ড-পাকস্থলীর খুঁটিনাটি দানাপানি বের করত। সেসময় খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভাইয়ার একটা (অন্তর্বর্তীকালীন) প্রেম হয়েছিল। সামনাসামনিও না, ফেসবুকে ছবি দেখেই রোশনী আপু মেয়েটার আছরে পড়ল। চেহারাটা এমনভাবে তার মাথায় খোদাই হয়ে গেল যে, প্রায় সবখানেই তেমন আদলের কাউকে না কাউকে সে খুঁজে পেত। ম্যাগাজিন উল্টাতে উল্টাতে কোন মডেলের ছবি দেখে চমকে উঠে বলত, ‘দেখতে আবিদের গার্লফ্রেন্ডের মত নারে?’ রিকশায় যেতে যেতে হঠাৎ আমাকে ঠেলা দিত, ‘দেখ, দেখ, রিকশার হুডে বসা মেয়েটা আবিদের গার্লফ্রেন্ডের ফেসমেট!’ কিংবা ছুটিতে বাড়িতে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলত, ‘জানিস, আমাদের ডিপার্টমেন্টে এ বছর যে নতুন ব্যাচটা আসছে, সেই ব্যাচে হুবহু তোর ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডের মত দেখতে একটা মেয়ে আছে!’ এই অক্লান্ত গোয়েন্দাগিরির ফাঁকেই (হয়ত গোয়েন্দাগিরির নেশা থেকে বাঁচতেই) আপু একজনের সাথে জড়িয়ে যায়। তাতে আমার (সাময়িক) রাগ হয়; কিন্তু আদরে-কদরে কমতি না পড়ায় তেমন আপত্তি তুলিনা। বলা বাহুল্য, রোশনী আপুর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের বহু আগেই সেই হুজুগে সম্পর্ক মিটে যায়।
অ্যাডমিশন টেস্ট শেষে দুপুরে রোশনী আপুর বাসার গেস্টরুমের বিছানায় যখন গা গড়াচ্ছিলাম, ন’মাসের রোজাকে ঘুম পাড়িয়ে এসে আপু শুয়ে পড়েছিল পাশে।
‘আবিদের কারেন্ট গার্লফ্রেন্ড কেমন? কয় নাম্বার চলে?’
‘এখনকার খবর জানিনা। ফেসবুকে গ্রুপ ছবিতে অনেক মেয়েকেই তো দেখা যায়। ডুয়েট পিক নাই কোন। আর ভাইয়া এখন পিএইচডি নিয়ে বহুত প্যারায় আছে।’
‘আমাকে আপডেট জানাইস।’
‘তুমি ভাইয়ার খবর দিয়ে কি করবা? মেয়ের মা হয়ে গেছ এখন!’
‘আরে বোকা! এটা আমার নেশা হয়ে গেছে। সিগারেটখোররা যেমন ছাড়তে পারেনা, আমিও সেইরকম! শোন, তোকে একটা মজার গল্প বলি!’
রোশনী আপু নড়েচড়ে শুরু করে, ‘দক্ষিণপার গেছিস কোনদিন?’
‘আমি যাব কেন? আমার তো বয়ফ্রেন্ড নাই!’
‘যাস নাই ভাল করছিস। বন্ধুবান্ধবের কাছে তো শুনছিস, ওইখানে ছনের ছাউনির কিছু রেস্টোরেন্ট আছে। খাবার খুব বাজে! পোলাপান তো ওখানে খাইতে যায় না, প্রাইভেট টাইম পাস করতে যায়। সেইজন্যে খাবারের দামও মেলা। আমরা ক্লাস টেনে থাকতে গেছলাম একবার। দুইজনের কাছে গুণে গুণে দুইটা ফুচকার দাম আর রিকসাভাড়াটা ছিল। ফুচকা খাওয়া শেষ করতেই ওয়েটার বিল ধরায় দিল। বিল দেওয়ার পর ব্যাটা আমাদের তক্ষণি উঠে যাইতে বলে! বহু কাপল নাকি ওয়েট করতেছে! আমরা তো খুব রাগ করে উঠে চলে আসছি। এত্তগুলা টাকা লস! পরে আমার এক বান্ধবীর কাছে শুনছি, ওখানে ওয়েটারদের টিপস না দিলে নাকি ব্যাটারা এমন শয়তানি করে!’
‘একটু রেখেঢেকে বলো! নিজেদের প্রাইভেট ডিটেইলস তো সব আমাকে বলে দিচ্ছ!’
‘তুই তোর ভাইয়ের উল্টা হইছিস পুরা!’
রোজার কান্নার আওয়াজে রোশনী আপু প্রেমিকার ভূমিকা ছেড়ে মা হয়ে পাশের ঘরে দৌড়ে যায়। সামলেসুমলে খানিকপর যখন আসে তখন এক হাতে হাই তোলা ঘুমক্লান্ত পিচ্চি, আরেক হাতে একটা বড় খাম আর ডায়েরি।
‘শোন, তোর ভাইয়ের কিছু চিঠি আমার কাছে আছে এখনো। বাসায় রাখা সেফ না। তোর কাছে রাখতে পারবি? আমি শিওর, আমার চিঠিগুলা আবিদ ডাস্টবিনে ফেলে দিছে!’
আমি সান্ত্বনা বিলাই, ‘আরে, ভাইয়া যে অগোছালো! সে যে কখন বেখেয়ালে এসএসসি-এইচএসএসির সার্টিফিকেট ফেলে দেয়, এই ভয়ে আম্মু সব আলমারীতে রেখে দিত! সার্টিফিকেটের ফাঁকে-ফোঁকরে তোমার প্রেমপত্রও ছিল কিনা কে জানে!’
‘তুই প্রিজার্ভ করিস কিন্তু। বাচ্চাকালের প্রেমের চিঠি! আমার একটা ডায়েরিও আছে। সেইরকম সেন্টিমেন্টাল! ফেলে দিতে কষ্ট লাগে!’
রোজাকে কোলে নিয়ে আমি দলাইমলাই করি। এমন ছানাছানা ছানা কোলে ফুপি-বাৎসল্যে গলেগলে যাই। মেয়েকে আমার কোলে গছিয়ে রোশনী আপু আবার নাছোড়বান্দা প্রেমিকার রূপ নেয়।
‘আচ্ছা, দীনার কী খবর রে?’
‘কোন দীনা? আমার স্কুলের?’
‘ধুর! তোর স্কুলের দীনাকে দিয়ে আমি কী করবো? ওই যে, তোর ভাইয়ের একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল না? দীনা দুর্দানা।’
‘আমি কীভাবে জানবো!’
আমার গলার ঝাঁজে ভাইয়া-প্রসঙ্গে ইস্তফা দেয় সে। এরকম বার্তাবাহকগিরিতে বিরক্তি ধরে মাঝেমাঝে। আপুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি চেহারায় অপ্রস্তুত হাসি, অপরাধীভাব। নেশাখোরদের মতই মরিয়া, নিরুপায়। মায়া লাগে! ভাবি হাত ধরে একটা আবেগী ডায়ালগ দেবো— তুমি ভাবী না হওয়ায় ভাল হইছে গো, তুমি আমার আপু হইছ!
রোশনী আপুর আদর-যত্নে আফসোসে চিড়বিড় করতে থাকি। ঢাকায় পড়তে আসবো মাস কয়েক পর, এরকম একটা ভাবী যদি এখানে থাকত (মুখর গল্প-মুখরোচক খাবার সাজিয়ে)! আপুর ঘরসংসারের খবর কানাডাপ্রবাসী ভাইয়াকে দিলে সে খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে মামুলি মেয়েলি গেরস্থালি গল্প। আমি সাহস করে বলেই ফেলি, ‘ইশ! রোশনী আপু তোমার বউ হইলে কত ভাল হইত!’, ভাইয়া ঠিক হাসে না; হাসির মত আওয়াজ তুলে বলে, ‘ভাবী হইলে আর এত ভাল থাকত নারে বোকা! তখন বুঝতি! আর তুই এই অল্প বয়সে আব্বু-আম্মুর মত হয়ে গেলি কেন? তারা নাহয় ছেলের বউ-ছেলের বউ করে পাগল হয়ে যাচ্ছে, তুই এত ভাবী-ভাবী করতেছিস কেন? নিজের লাইফ নাই?’
তারপর জোরে হেসে প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দেয়, ‘ওকে এতই যখন পছন্দ, লেসবিয়ান হয়ে যা না!’


ঢাকায় চলে আসার পরপর রোশনী আপুর বায়নার বাহানায় (এবং নিজেরও কৌতূহলে) আমি দীনা দুর্দানাকে ফেসবুকে খুঁজে বের করি। আপু বরাবর লিংকটা পাঠিয়ে প্রোফাইলে তল্লাশী চালাতে চালাতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো নিয়ে দোনামনায় ভুগি। এদিকে আমার বেখেয়াল আঙুল কখন যেন ‘অ্যাড ফ্রেন্ড’ এ চাপ দিয়ে বসে।
দুই ঈদ বাদে ভাইয়ার দেখা পাওয়া না গেলেও সেবার ঈদের নামগন্ধ ছাড়াই ভাইয়া বাড়িতে আসল; সাথে দুই বান্ধবী। আসার আগে বলেছিল, ‘দুই বন্ধু নিয়ে আসতেছি।’ (ভাইয়া অবশ্য জেন্ডার নিরপেক্ষভাবে সবাইকেই বন্ধু ডাকত।) এখন দুই তরুণীকে দেখে বাবা-মা প্রচণ্ড রেগে গেলেন। চেহারায়, হাবেভাবে বোঝা যায়, কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না। মা গম্ভীরমুখে সরিষা ইলিশ রান্নার ফাঁকে ভাইয়াকে পাকড়াও করে ফিসফাসে জিজ্ঞাসা করলে ভাইয়া জোরেশোরেই বলে, ‘ওরা নর্থবেঙ্গল দেখেনি কখনো। তাই আমার সাথে আসছে।’ দুই বন্ধু সুমি আর দীনাকে নিয়ে সে তিস্তা নদীর চর, তাজহাট জমিদারবাড়ি আর পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার বাড়ি টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। একতলা-দোতলার ভাড়াটেরা ফিসফাস করতে থাকে, আম্মুর কাছে মেয়ে দু’টোর বৃত্তান্ত দাবি করে।
আমাদের বাড়ির পেছনে প্রচুর নারকেল গাছ। ছাদের এক কোণায় পানির ট্যাংক আর ছাদসমান লম্বা নারকেল গাছের আড়ালে এক বিকালে তারা তিনজন সিগারেট ফুঁকতে থাকে। আমি ছাদে উঠে সেই দৃশ্য দেখে এক দৌড়ে নিচে নেমে পাকা ইনফর্মারের মত আম্মুর কান ভারী করি। আম্মু ভাইয়াকে এমন ঝাড়ি দেয় যে সেদিনই সন্ধ্যায় তারা তিনজন বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মাস কয়েক পর তিনবন্ধুর জোট থেকে ভাইয়া আর দীনা দুর্দানা জুটি হয়ে বেরোয়। আমার অবশ্য তখন দীনাকে মোটেই পছন্দ হয়নি। শার্ট-প্যান্ট পরা ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া চুলের ব্যাটা ব্যাটা স্বভাবের মেয়ে, যে কথায় কথায় ‘বাল’ কিংবা ‘শালা’ ছোটায় (আমি ভাইয়ার ঘরের দরজায় আড়ি পাতি আর জিভ কাটি)। রোশনী আপুর ঘরোয়া পরিপাটি মায়ামায়া উপস্থিতির বিপরীতে উশকোখুশকো, রুক্ষ, বুনো। আম্মুর ভাষায় ‘বেয়াড়া, উচ্ছৃঙ্খল’। ভাইয়ারা যাওয়ার পর পাশের বাড়ির তনুর মা-ও তাদের সিগারেট খাওয়ার কাহিনী পাড়ায় প্রচার করে বেড়ায়। ভার্সিটির বন্ধে রোশনী আপু বাড়িতে এসে এই খবর পেয়ে আমাকে তলব করে। তখনো দীনা আপুর সাথে ভাইয়ার প্রেম দশকান হয়নি। তাই দীনা এবং সুমি দুইজনকেই গার্লফ্রেন্ড ঠাওরে ভাইয়ার অধঃপতনে সে ক্ষেপে যায়। গুম হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বিড়বিড় করতে থাকে সেইসময় হিট হওয়া ফুয়াদের সিলেটি গানের কথা—দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড লইয়া ফরছি আমি ফান্দে, বড় গুরে মায়া করলে মাইঝলা গুয়ে খান্দে।
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর দু’দিন পর দীনা দুর্দানা আমাকে এক্সেপ্ট করে। সপ্তাহখানেক নীরব লাইক বিনিময়ের পর অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা করার কথা পাড়ে।
প্রথমবার ডেটে যাওয়ার কৌতূহল-অস্বস্তি-ভয়-উত্তেজনা নিয়ে ভাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিকার জন্য আমি অপেক্ষা করতে থাকি আমার ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে। দীনা দুর্দানা আসে (কুঁচকে থাকা) ফতুয়া আর ধুতি সালোয়ারে। ঘাড় পর্যন্ত চুল আগের মতই জংলী। তবে উশকোখুশকো লাগে না। (ডিলাইট ইন ডিজঅর্ডার?) বরং আমার টান টান ইস্ত্রি কামিজ, পাট ভাঙা ওড়না, আঁটসাঁট বাঁধা চুলে সংকোচ হয়, নিজেকে স্কুলের ইউনিফর্মপরা বালিকা মনে হয়।
হাসিমুখ দীনা বলে, ‘ফেসবুকে তোমার ছোটবেলার ছবি দেখে আমাদের সেই নর্থ বেঙ্গল ট্যুরের কথা মনে পড়ল! তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করল! আবিদ রাগ করে তোমাদের বাসা থেকে আমাদের নিয়ে বের হওয়ার পর আমরা কিন্তু ঢাকা ফিরি নাই। গাইবান্ধা-লালমনিরহাট-পঞ্চগড় ঘুরছি! সেই একটা ট্যুর ছিল! তখন চাকরিচাকরি না করে ট্র্যাভেল এজেন্সি খোলার পোকা ঢুকছিল আমাদের মাথায়!’
আমি মন্তব্য করার মত কিছু না পেয়ে ভদ্রতার হাসিতেই সীমিত। দীনা এবার আমার হাত ধরে, ‘কত বড় হইছ তুমি এই সাত-আট বছরে! তোমার আর আবিদের চেহারা একদম একরকম। বলে দিতে হয় না ভাই-বোন! ঢাকায় কেমন লাগতেছে তোমার?’
‘ভাল।’ আমি এক শব্দে দাড়ি টেনে দেই।
‘কোন প্রবলেম হইলে আমাকে বলবা। আবিদ তো অ্যাজমায় খুব ভুগত! তোমারও আছে নাকি?’
‘হুম…আছে।’
‘এখানে আন্টি নাই যেহেতু, নিজেই সাবধান থাকবা। হলের ক্লিনারদের হাতে কিছু টাকা ধরায় দিয়ে ঘরের ঝুল-ময়লা পরিষ্কার করাবা প্রতি সপ্তাহে। ইন্ডিয়ার এক ডাক্তার দুইমাস পরপর ঢাকা আসে। আমার এক কলিগ তাকে দেখানোর পর অ্যাজমা কন্ট্রোলে আসছে। তোমাকে ডিটেইলস দেবোনে। আচ্ছা, আন্টি কেমন আছে? জানো, আন্টির রান্না সরিষা ইলিশ আর সিঁদলের টেস্ট এখনো আমার জিভে লেগে আছে। তোমাদের ছাদটাও সুন্দর ছিল। ছিমছাম, মায়ামায়া, হাওয়াহাওয়া। তখন তো রংপুর মফস্বল শহর ছিল। বিভাগ হওয়ার পর বদলায় গেছে, না?’
‘হুম।’
আমি বেফসকা বলে ফেলি, ‘ভাইয়া কি আপনাকে আমার খোঁজখবর রাখতে বলছে?’
আমার সোজাসাপ্টা প্রশ্নে দীনা থতমত খায়। ‘একদমই না! আমার তো ওর সাথে শেষ আলাপ হইছিল বোধহয় মাস তিনেক আগে। এমনিতে শুনছিলাম যে তুমি ঢাকা আসতেছ। আবিদ আফসোস করতেছিল, তুমি যখন ঢাকায় আসলা ও তখন কানাডা চলে গেল! আর আজকের দেখা করা একদম আমার নিজের ইচ্ছায়! তোমার সাথে তো রংপুরে ছাড়া আর কখনো দেখা হয়নি। তাও আই ফেল্ট আ কানেকশন। এই দেখা করাটা তেমন কিছু না। অত ভাবনাচিন্তা করে কিছু করিনা আমি। ইভেন তোমার এইটা আবিদকে বলারও দরকার নাই!’
একটা অস্বস্তিকর ছেদ পড়ে। দীনার ঠোঁট আলগা হাসিহাসি, কিন্তু তার সাথে খুশির কোন সম্পর্ক নেই। চোখ নামানো, হালকা কোঁচকানো। প্রখর আলোয় বা চিনচিনে ব্যথায় যেমন কুঁচকে যায়? আমি ভাবি, সেই আনন্দময় ট্যুরের স্মৃতিচারণা করতেই কি আমাকে ডাকা? নাকি ভাইয়া নাগালের বাইরে থাকায় কাছেপিঠে তার এক সংস্করণ আমাকে খুঁজে নেওয়া? আমার সন্দেহ হয়, বন্ধুত্ব যা অবশিষ্ট তা কি প্রাক্তনের বোনের খোঁজ-খবর রাখতে যথেষ্ট?
দীনা দুর্দানা শিগগিরই অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে তার সর্বশেষ ট্যুরের গল্প জুড়ে দেয়। সুন্দরবনে বাঘশুমারি দলে ভিড়ে গিয়ে এক সপ্তাহ দুর্গম সব জায়গা চষে বেড়ানোর গল্প—জোঁকের কামড়, মরা গাছের খোড়লে ঘামটি মেরে থাকা লাউ ডগা সাপ, খালপানিতে লতাপাতায় মাথা ঢেকে হরিণ দেখা, চাকরি ছেড়েছুড়ে ট্যুর অপারেটর হওয়ার ভাবনা। শুনতে শুনতে লোভ হয় আমার। ঠোঁটের আগায় প্রায় চলে আসে, ‘আমাকে একবার নিয়ে যাবেন?’ কিন্তু এতদিন গীবত গেয়ে বেড়ানোর পর হুট করে গলায় গলায় পিরীতের ভাব ধরতে কেমন সংকোচ হয়।
কফি আর মোমো খেয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আমরা রিকসায় উঠি। দীনা সিগারেট সাধে, না করে দেই (বান্ধবীদের পাল্লায় বড়জোর দু’তিনবার মিষ্টিমিষ্টি জাভা ব্ল্যাক টানার অভিজ্ঞতা আমার)। সে ভাইয়ার প্রসঙ্গ নিষিদ্ধ মেনে কথা বলে যায় অনগর্ল। (যেন শপথ নিয়েছে কিছুতেই এই দেখা করায় অস্বস্তিসূচক নীরবতা থাকবেনা!) আমি হঠাৎ খেয়াল করি বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা দুই মোটরসাইকেল আরোহীর একজন দেবতার আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তার ডান হাত উঁচু করে আছে। আমাদের পেরিয়ে যাওয়ার সময় সেই দেবতার হাত আমার বুকে থাবা মেরে চলে যায়! আমি চিৎকার দিয়ে কাঁপতে থাকি, হতভম্ব দীনা তক্ষণি রিকসা থেকে নেমে ওদের ধাওয়া করে। দ্রুতগামী মোটরসাইকেল মুহূর্তেই হাওয়া। ফোনের ক্যামেরায় নম্বর প্লেটের ছবি তোলারও সুযোগ থাকেনা। দীনার মুখে খিস্তিখেউড় ছোটে। বারবার বলে, ‘আমি কথা বলায় এমন মশগুল ছিলাম খেয়ালই করি নাই আপু। আমি খুবই স্যরি তোমার এই এক্সপেরিয়েন্স হইল! আগে খেয়াল করলে ওই ব্যাটার হাত এমন মোচড়ায় দিতাম! আমি একবার এক ইভটিজারের কলার বোন ভাইঙ্গা দিছলাম!’ সে এবার সেই কলার বোন ভাঙার গল্প বয়ান করে। আতঙ্কে কাবু আমি থম মেরে থাকি। অবসাদের ভেতর থেকে হালকা স্বস্তির উপশম ভাপের মত বেরোয়—ভাইয়া না থাকুক, দীনা আপু তো ঢাকায় আছে, ঘন্টাখানেকের দূরত্বে।


জেবা ম্যামকে দেখার পর পুরনো ঘটনারা পুনঃপ্রচারের মত ফেরে, পুনরাবৃত্তির ক্লান্তি ছাড়াই। ভাইয়ার প্রেমিকাভাগ্য বিস্ময়কর। তার চেয়ে বিস্ময়কর তাদের ছেড়ে যাওয়া। তারও চেয়ে বিস্ময়কর তাদের মনে কোন মিহিন কোমল সূক্ষ্মতায় ভাইয়ার থেকে যাওয়া। ক্ল্যাসিক প্রেমের মত কেউ কারও জন্য নিজেকে নিঃশেষ করেনি, কিন্তু কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল। ব্রেকআপের সহজাত ঘৃণা, শত্রুতা, অস্বস্তির ঊর্ধ্বে যার যার ঠিকঠাক ব্যক্তিগত জীবনের তলায় এই বিষণ্ন মায়া তারা পোষে কেন? সেই মায়া আমি অবধি—প্রাক্তন প্রেমের নস্টালজিয়ার পার্শ্বচরিত্র। আমি কি আমিই, নাকি জোড়ালাগানী সেতু? ওরা ভাইয়াকে খোঁজে— আমাদের উনিশ-বিশ চেহারায়, যৌথ শৈশব-কৈশোরে, কানাডা থেকে ভাইবারে ভাইয়ার টুকরাটাকরায়। ভাইয়া ঢাকায় না থাকলেও তার ঢাকানিবাসী প্রাক্তন প্রেমিকাদের মধ্যে থেকে যাওয়া আবিদ জামান আমার কাছাকাছি থাকে। অচেনা আপন ভাইকে আবিষ্কার করি প্রেমিকাদের অদ্ভুত ভিন্নতায়। তার থিতু না হতে চাওয়ার ছেঁড়াখোঁড়া বয়ান জোড়াতালি দেই। প্রেম পচে উপযোগিতামূলক জৈবসার কিংবা দূষিত বর্জ্য হওয়ার আগেই তাকে প্রতিবার পালাতে দেখি।
কারও জীবনী কি সবচেয়ে ভাল লেখে তার প্রেমিকারা?
শুধু জেবা আফরোজের রহস্য এখনো ভাঙল না। কোন অভিমান, তিক্ততা? সবশেষে শেষ হওয়া প্রেম, তাই হয়ত ক্ষত এখনো কাঁচা। ফতুয়া-জিন্স থেকে হিজাবে রূপান্তর হয়ত গোপন অতীত সিলগালা করার নমুনা।
সেবার এসএসসির লম্বা ছুটিতে আমি ঢাকায়। ভাইয়া তখন একটা কোম্পানীতে চাকরি করে, ছোট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। দিনেরবেলা সেখানে (দেয়ালের টিকটিকি ছাড়া) আর কেউ থাকে না, তাই ঘুরেফিরে মামার বাসাই আমার ঠিকানা। এক বিকালে সারপ্রাইজ দেওয়ার খেয়ালে আমি একাই ভাইয়ার বাসায় চলে আসি। এর আগে একবার আব্বু-আম্মুসহ আসায় দারোয়ান চাচা আমার চেনা। উনি বাড়িঅলার কাছ থেকে চাবি এনে বাসার দরজা খুলে দেন। বেডরুমে তালা লাগানো। আমি বাইরের ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে হেডফোনে গান শুনতে থাকি, ফ্রিজ থেকে কোকের বোতল বের করে চুমুক দেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ভাইয়ার চলে আসার কথা। বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দে ভাইয়া ভেবে পেছনে তাকিয়ে অবাক, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে! আমরা দু’জনই থতমত খাই। মেয়েটাই আগে মুখ খোলে,
‘আমি জেবা।’
জেবা নামটা তখনো ভাইয়ার মুখে শুনিনি। আমি আমার ডাক নামে পরিচয় দেই, ‘আমি অদ্রি।’
জেবার কাঁচুমাচু মুখ, ‘হ্যাঁ, তোমার কথা অনেক শুনছি! তুমি বাসায় আসছ জানতাম না!’
‘আমি ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে ফোন না করেই চলে আসছি!’
‘দারোয়ান তো কিছু বলল না…।’
আমি ততক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছি যে ইনি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড। জেবা ব্যাগ থেকে চাবি বের করে বেডরুমের তালা খোলে।
‘তুমি ভেতরে আসো। বাইরের ফ্যানে বাতাস কম।’
ঘরে ঢুকেই তার হন্তদন্ত হয়ে আলমারী খোলায় আমার একবার সন্দেহ হয়, গার্লফ্রেন্ডই তো? ছদ্মবেশী চোর-ডাকাত না তো?
‘আমার কালকে একটা আর্জেন্ট অফিস ট্যুর। এখানে কিছু কাপড়চোপড় ছিল। তাই নিতে আসছি।’
সৃজিত মুখার্জীর সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’ দেখে গিলে ফেলা (কিন্তু হজম না হওয়া) লিভ ইন-লিভ টুগেদারের ধারণার নিষিদ্ধ, গোপনীয় কিন্তু জ্বলজ্যান্ত উদাহরণের সামনে আমার মুখে গরম ভাপ ছোটে। জেবা আলমারীর তাক থেকে জামাকাপড় বের করে বারান্দায় নেড়ে দেওয়া ব্রা-প্যান্টি আমার চোখ এড়াতে জামার তলায় লুকিয়ে আনে। ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে বলে, ‘স্যরি, আমাকে এখন যেতে হবে। তুমি থাকো, আবিদ এখনি চলে আসবে।’ যেতে যেতে আবার উল্টা ঘুরে ব্যাগ থেকে একটা আধগলা ক্যাডবারি ডেইরি মিল্ক বের করে দেয়, ‘একটাই আছে। প্লিজ টেক ইট!’
জেবার স্বরের ওঠানামায়, আত্মবিশ্বাসী চাউনিতে, হাঁটাচলার ঋজু ভঙ্গিতে নিখুঁত ব্যকরণমানা ভদ্রতা থাকলেও কাছে ঘেঁষতে না দেওয়া (যেন আমাদের ওয়েভলেংথ মিলবেনা) চাপা অনুষ্ণতায় আমার বুকে জ্বালাপোড়া হয়। বিড়বিড় করি, জেবা…এহ! কুইন অব শেবা! সেদিন ভাইয়া বাসায় ফিরে আমাকে বকাঝকা করে এক দফা। তারপর শান্ত হয়ে শাসানি এবং অনুরোধের মিশ্র স্বরে বলে, ‘শোন, ওর কথা আম্মুকে বলার দরকার নাই!’
আরও বহুদিন তাদের প্রেম চললেও সেদিনের পর জেবাকে আমি আর দেখিনি।


‘ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ কে কে হতে চান?’ জেবা আফরোজ ম্যাম গোটা ক্লাসকে জিজ্ঞেস করেন। ম্যামের নেকনজরে থাকতে ক্রাশ খাওয়া ছেলের দলের উৎসাহী হাত প্রায় সিলিং ছোঁয়ছোঁয়। ম্যাম সবার ভোটে একজনকে বাছেন। মেয়েদের হাত গুটিয়ে থাকতে দেখে বলেন, ‘মেয়েরা কেউ সিআর হবেন না, এটা কিছু হল?’ আমি হাত তুলিনা। চোখ নামিয়ে রাখি। গত সেমিস্টারে একটা কোর্সে সিআর ছিলাম বলে কয়েকজন আমার নাম প্রস্তাব করে, ‘ম্যাম, আদীবা হোক।’
জেবা আফরোজ এবার এদিকে তাকান—অপরিচিত ফাঁকাদৃষ্টির ভেতর থেকে চেনা চাউনি ফোটে। ডাকনাম ধরে বলেন, ‘অদ্রি, ক্লাসের শেষে আমার সাথে দেখা করোতো।’ আমার পাশে বসা ক্লাসমেটটা ফিসফিস করে, ‘জেবা ম্যাম তোকে চেনেন নাকি রে?’
জেবা আফরোজ প্রবাবিলিটি চ্যাপ্টারের অংক করাতে থাকলে, আমার সাথে তার আসন্ন আলাপে সম্ভ্রাব্য কথাবার্তার (শীতল/উষ্ণ/নাতিশীতোষ্ণ) প্রবালিটি সাজাতে সাজাতে ক্লাসে খেই হারিয়ে ফেলি। শেষে অংক করা বাদ দিয়ে খাতার কোণায় গোলাপ আঁকি।
বারান্দায় যত্নে-অযত্নে ফোটা ঘরোয়া গোলাপ। গোলাপি পাপড়ি অবিন্যস্ত। পানিটানি দেওয়া হয় মাঝেমাঝে, তবে সার-কীটনাশকের বালাই নেই। রোশনী আপুর মত মিষ্টিগন্ধী, আপন আপন। দীনা দুর্দানা সুনামগঞ্জের হাওড়ে ঘুরতে গিয়ে বুনো গোলাপের দেখা পেয়ে ছবি পোস্ট করেছিল ফেসবুকে। সাদা, পাঁচ পাপড়ির সেই আদি গোলাপও আঁকি, শীতে হাওড়ের পানি শুকালে যে অযত্নে ফোটে ঝোঁপালো গাছে। দীনা দুর্দানার মত সোজাসাপ্টা, জঙ্গুলে। আর জেবা? (হোয়াইট বোর্ডে প্রবাবিলিটি বের করতে থাকা জেবার লাল-কালো হিজাব ক্রিস্টালের ছোট্ট লালগোলাপ ক্লিপে আটকানো।) গোলাপচাষীর বাগানে ফোটা উন্নতজাতের লাল গোলাপ। মখমলী পাপড়ি সুবিন্যস্ত। সার-কীটনাশক-প্রিজারভেটিভে পুষ্ট। খোঁপায় পরার জন্য আদর্শ। কিন্তু…গন্ধমরা।
কোন খেয়ালে এঁকে ফেলা সেই তিন গোলাপের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, রোশনী আপু-দীনা দুর্দানার মত জেবা ম্যামও আমার ব্যক্তিগত বৃত্তে ঢুকে পড়বেন কিনা—(সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে) নস্টালজিয়া চর্চায়। তারা তিনজন পালাক্রমে আমার পথ বাতলানো, মাথা ওলটানো, ভোল পালটানো শিক্ষক-বন্ধু-বোন কিংবা বন্ধু-বোন-শিক্ষক অথবা বোন-শিক্ষক-বন্ধু। কখনো কখনো কি প্রেমিকাও নয়? ভাইয়া তিনজনকে কখনো একসাথে পায়নি, আমি পেয়েছি।

৭,০৪০ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “বৃত্তস্থ ত্রিভুজ”

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।