স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে

আজ বহুদিন পর ফজলুল করিম স্যারের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আমাদের এফ কে স্যার। বছরের শেষ দিকটায় তিন/চার দিন জুড়ে কলেজে যখন ক্রিকেটের ধুম মৌসুম, সে সময় আমরা এফ কে স্যারকে ব্যাটে-বলে মাঠে নেমে পড়তে দেখতাম প্রিয় ছাত্রদের সাথে। তাঁর চোখে-মুখে তারুণ্যের অরুণ আলোর ঝিলিক। তাঁর হৃদয়ে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ ভালোবাসার বন্যা। আমার সহপাঠীদের মধ্যে নাহিদ, সাব্বির, এনাম ক্ষুদে বয়সেই ছিল তুখোড় ব্যাটসম্যান। ফয়সালের ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া উড়ন্ত ঘুর্ণিবলের দুরন্ত গতি। সেসবের সুবাদে অনায়াসেই তারা স্যারের নিকট-সান্নিধ্য লাভ করেছিল। ব্যাটে, বলে, নেটে, উইকেটে সমর্থ শরীরের সবটুকু ঢেলে দিয়ে তারা স্যারের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সুবিচার করতে পেরে ধন্য হয়েছিল। আমার ছিল দুর্বল দেহ আর ভাঙ্গা শরীর। সর্বশক্তি দিয়ে সার্ভিস করেও ভলিবলের নেট অবধি বল পৌঁছুতে পারতাম না। খেলার মাঠে মাঠে সহপাঠীদের আনন্দ উল্লাস চোখ মেলে দেখাটুকুই ছিল আমার বিকেলের বিনোদন। একসময় আকাশের কপোল জুড়ে অনেক আবীর মাখিয়ে দিতে দিতে ধীরে ধীরে গোলাপি বরন গোধূলি নেমে আসতো। করুণ সুরে বেজে উঠতো বেলা শেষে পতাকা নামানোর দীর্ঘ বিউগল। সেই সময়টুকু আমাদের স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। সেই নিশ্চুপ সময়ে আমার দুচোখ গোধূলির ছায়াপথে হারিয়ে যাবার উদাস নেশায় বিভোর হয়ে উঠতো। মাঝে মাঝে আমিও তো ঐ চৌকশ মানুষটির কাছাকাছি পৌঁছুতে চাইতাম। কিন্তু নিজের অপারগতা নিয়ে আমার ছিল রাজ্যের দ্বিধা। তাই মোহন দৃষ্টিতে দূর থেকে তাঁকে শুধুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম রাতের আকাশের ঐ যে জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, সেও তো অনেক দূরে।

পাহাড় বোধকরি দূর থেকেই বেশি সুন্দর, সবুজ ও সজীব দেখায়! ফজলুল করিম স্যারের নজরে কাড়তে না পারলেও আমি খুব করে মনে রেখেছিলাম তাঁর মুখে শোনা ‘সবুজ বিপ্লব’ ও ‘দি স্কারলেট লেটার’-এর কথা। ইতিহাসের ক্লাসে রাজনীতি কিম্বা সাহিত্যের কথাও যে কতটুকু প্রাসঙ্গিক হতে পারে তিনি সেটা অবলীলায় প্রমাণ করেছিলেন। আমার একটা বড়ই বদগুণ আছে। বড়বেশি আত্মমগ্ন হয়ে পড়লে মাঝে মাঝে আমি পুরনো বইয়ের দোকানে কাটিয়ে দিই একনাগাড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা। পুরনো বইয়ের দোকান যেন জীবনানন্দের লাশকাটা ঘর। সেখানে কোন ক্লান্তি নেই। সংসারের গরল বিষ টেনে নিতে নিতে মানুষের মনে যখন একটু মোহন মেটামরফোসিসের আকাঙ্ক্ষা জাগে, তখন কাফকার বড়গল্পের ধরণে ‘বই পোকা’ হয়ে পুরনো বইয়ের দোকানে পড়ে থাকাই ভালো। সেদিন নীলক্ষেতের এমনই একটি পুরনো বইয়ের দোকানে ইতস্তত: ছড়িয়ে রাখা বইয়ের স্তূপ নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ পেয়ে গেলাম গাদ্দাফীর সেই ‘সবুজ বিপ্লব’, মনে হলো বইয়ের মলাট থেকে উঁকি দিচ্ছে ফজলুল করিম স্যারের বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। লিবিয়ার দুর্দশা দেখে দেখে চোখ দুটি বুঝি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

ভাবলাম ফিরতি পথে আজিজে একটু থেমেই যাই। কতদিন ‘পাঠক সমাবেশ’-এ যাওয়া হয় নি। অথচ ২৫ খণ্ড রবীন্দ্রসমগ্র বুকিং দেবার পর থেকে ফি মাসেই যাওয়া হতো ওঁদের ওখানটায়। ব্যস্ততা কি এভাবেই মানুষের মনের সুস্থতাকে হরণ করে ? মানুষকে আত্মমগ্নতার শুদ্ধতা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে আত্মকেন্দ্রিকতার কালো কারাগারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়? নিজেকেই প্রশ্ন করি, মনের গহীন তলদেশ থেকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে ক্ষীণ আশার মতো কোন উত্তর উঠে আসে না। ‘পাঠক সমাবেশ’-এর বুক শেলফে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে, নাথানিয়েল হথর্নের লেখা ‘দি স্কারলেট লেটার’-এর বাংলা অনুবাদ ‘অসতী’, শেলফ থেকে নামিয়ে আনি সেটাকে। প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০১২ তে। আলতো করে চোখ রাখি ভেতরের পাতায়। ফজলুল করিম স্যারের মুখ থেকে ‘দি স্কারলেট লেটার’-এর গল্প শুনবার পর পরই কলেজের লাইব্রেরী থেকে খুঁজে বের করেছিলাম বইটিকে। সেই ১৯৮৫ সালে। সিয়েরালিয়নের পথে পাড়ি জমাবার সময় পড়েছিলাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘ধ্রুপদী নায়িকাদের কয়েকজন” বইটি। সেখানে “ত্রিভুজের প্রথম বাহু” প্রবন্ধটিতে হথর্ণের নায়িকা হেষ্টার প্রিনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন লেখক। মোটের উপর, অনুবাদের সতীত্বটুকু ছাড়া ‘অসতী’-র কিছুই আমার কাছে নতুন নয়। তবুও বইয়ের পাতায় মন পাতি। শুনতে পাই, সেখান থেকে যেন ভেসে আসে ফজলুল করিম স্যারের কণ্ঠস্বর, “মোস্তফা, দেখো, কেমন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক। কোন বেনামী অজানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা ? কোন এলোমেলো গন্তব্যে ?”

১,৩৭৮ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    "অনুবাদের সতীত্ব" কিংবা "বইয়ের মলাট থেকে উঁকি দিচ্ছে ফজলুল করিম স্যারের বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। লিবিয়ার দুর্দশা দেখে দেখে চোখ দুটি বুঝি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।" এমন কথার বুননে উঠে এসেছে প্রকাশের মনশীয়ানা ।
    এফ কে স্যারের স্মৃতির সাথে আমরা ঘুরে এলাম কলেজ লাইব্রেরী, সিয়েরা লিয়নের যাত্রাপথ থেকে কলেজের ভলিবল কিংবা ক্রিকেট গ্রাউন্ড ।
    ভালো লাগলো। এক রকম নস্টালজিক ভাইরাস কিঞ্চিত সেই অসুখটাকেও ছড়িয়ে দিয়ে গেলো ।
    ~ তাহলে চলুক অমন খোঁড়াখুঁড়ি ।

    "সহপাঠীদের মধ্যে নাহিদ, সাব্বির, এনাম ক্ষুদে বয়সেই ছিলেন তুখোড় ব্যাটসম্যান" এর মাঝে ছিলেনটাকে ছিলো করে দিলে পড়তে ভালো লাগবে ।
    এমন লেখা আরো চাই ।

    জবাব দিন
  2. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    খুব ভাল লাগল । নীলক্ষেতে পুরোনো বই ঘাঁটা আমার প্রিয় কাজ ছিল, বইওয়ালাদের দূর্ব্যাবহার আর পথিকের ধাক্কা সয়ে বহু ঘন্টা কাটিয়েছি ওখানে। এখন সেখানে শুধু রাশি রাশি নোট আর পাঠ্য (অপাঠ্যও বলা যায়) বইয়ের স্তুপ।
    স্কারলেট লেটারের একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম অনেক আগে- "রক্ত আঁখর" অনুবাদকের নাম মনে নেই।
    ঢাকার বই বাজার নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা মোটেই ভাল না। কি নিউমার্কেট কি আজিজ - এনিয়ে পরে লেখের ইচ্ছা আছে।

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      মাহবুব ভাই, আমি ছাড়াও এমন পাগল আরো আছেন, জেনে স্বস্তি পেলাম। অনুবাদ হিসেবে 'রক্ত আঁখর'-এর চাইতে 'অসতী'-কে আমার বেশি প্রাঞ্জল মনে হয়েছে। আপনার সুলেখনে বই বাজার নিয়ে অভিজ্ঞতা জানার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে রইলাম।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।