ক্যাডেট কথিকাঃ পর্ব ৫

রনজিৎ কুমার বণিক স্যার ক্লাসে এসে বললেন, ক্যাভিয়ার চিনো নাকি তোমরা? আমরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এর ওর মুখের দিকে তাকাই, ক্যাভিয়ার চিনবো কি; ক্যাভিয়ারের নামই তো শুনি নাই জীবনে! বণিক স্যার ঈষৎ বরিশালের টানে আমাদের ইংরেজী সাহিত্য পড়ান। তাঁর কপালের উত্তরে সুস্পষ্ট টাক, শ্যাম বর্ণ গায়ে বেশ একটা তেল চকচকে আভা। মধ্য তিরিশের বণিক স্যার ক্লাসে নানা উপায়ে আমাদের বিনোদিত করেন। ক্যাভিয়ার শব্দটির মাঝে বেশ একটা বিলাত বিলাত গন্ধ আছে, তাই আমরা রুবাইয়ার দ্বারস্থ হই। আমাদের মাঝে রুবাইয়া বিদেশ বিশেষজ্ঞ, সে দেশ বিদেশের অনেক কিছু জানে। ওর রুম্মান ভাইয়া লন্ডন না আমেরিকা কোথায় জানি থাকে। ভাই নিশ্চয় বোনকে অনেক গল্প বলে। সুতরাং রুবাইয়া আমাদের একমাত্র আশা ভরসা, কিন্তু ও দেখি কিছুই বলতে পারলো না। পারলে না তো? বণিক স্যার প্রশান্তির হাসি দিয়ে বললেন, ক্যাভিয়ার হইল গিয়া মাছের ডিম; ফিস এগ। আমাদের যেমন ইলিশের ডিম হইলো খান্দানী জিনিস, ইউরোপ আমেরিকায় ক্যাভিয়ার হইল তেমন খান্দানী খানা। স্যারের মুখে বিদেশের গল্প শুনতে আমাদের বেশ লাগে। কল্পনায় দেখি, হিমহিম সন্ধ্যায় তুষারকণা উড়ছে বাতাসে, ক্যাফেতে ধোঁয়া ওঠা মগে ক্যাপাচিনো হাতে উনিশ কুড়ির এক তরুণ বসে আছে, পাশে তার স্বল্পবসনা বান্ধবী। মেয়েটির মাঝে কেমন একটা আহ্লাদীপনা আছে! আমাদের কল্পনার মথটি প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলবার আগেই স্যার বললেন আজ তিনি আমাদের সমারসেট মমের দ্য লানচন্ পড়াবেন।

দ্য লানচন্ গল্পটি এমনঃ
সমারসেট মম তখন উঠতি লেখক। লেখালেখি করে কয় টাকাই বা পাওয়া যায়, পকেটের অবস্থা বলবার মত নয়। এমন সময়ে এক নারী ভক্তের সাথে চিঠিপত্র চালাচালি হচ্ছিল লেখকের। ভক্তটি এক সময় লেখকের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। পত্রালাপে জানা গেল যে ভক্ত স্বল্পাহারী মানুষ, দুপুরের আহারে কখনো তেমন কিছু খান না। পকেটে মাসকাবারী খরচ আছে মোটে ৮০ ফ্র্যাংক, তবুত্ত লেখকের পক্ষে অদেখা নারী ভক্তের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা কঠিন। তিনি ভাবলেন, পত্র বান্ধবী যখন কিছুই খায়না তখন কফির পয়সা বাঁচিয়ে মেরে কেটে পনের ফ্র্যাংকে আহারপর্ব চালিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু হায়! চতুর ভক্ত প্যারিসের এক অভিজাত রেস্তোরাঁতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যেখানে ফ্রান্সের সিনেটররা খেতে যান। লেখকের কল্পনায় ছিপছিপে এক তন্বী ছিল যার সাথে উষ্ণ একটি দুপুর কাটানোর ইচ্ছা তার। বিধিবাম! নির্ধারিত দিনে তিনি দেখলেন, চল্লিশোর্ধ এক নারী তার জন্য ফয়ট নামের রেস্তোরাঁতে অপেক্ষা করছে। সে যাই হোক, এ কথা সে কথা শেষে ভদ্রমহিলা নিজের জন্য স্যামন মাছ অর্ডার করলে লেখক মনে মনে প্রমাদ গুনতে শুরু করেন। অগত্যা তিনি নিজে রেস্তোরাঁর সর্বনিম্ন মূল্যের একটি মাটন চপ খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তারপর নানান ছুতোয় ভক্তটি একে একে উচ্চ মূল্যের ক্যাভিয়ার, এ্যাসপ্যারাগাস, অসময়ের পিচ ফল চাইলেন খেতে। যদিত্ত বারবার মুখে বলছিলেন, I never eat anything for luncheon! খাবারের সাথে লেখক জল পান করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভদ্রমহিলা যথারীতি I never drink anything for luncheon বলে দামী শ্যাম্পেন অর্ডার করলেন। হতবুদ্ধি লেখক নিজের পকেটের কথা ভেবে শংকিত হয়ে ভাবছিলেন আজ বুঝি হাতের ঘড়িটি বন্ধক রেখে মান সম্মান বাঁচাতে হবে। ঈশ্বর লেখককে সে যাত্রায় রক্ষা করেন, তিনি মাসকাবারীর সমস্ত টাকাপয়সা খুইয়ে বাড়ি ফেরেন।

গল্পের শেষ ভাগে বহু বছর পর লেখকের সাথে ভক্তের আবারও সাক্ষাত ঘটে। ততোদিনে ভোজনবিলাসী নারীটি ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করেছে। বলাবাহুল্য বিশাল বপুর দাঁতালো নারীটিকে দেখে লেখক তীব্র প্রতিশোধের আনন্দ পান মনেমনে!

এই হলো দ্য লানচন্ এর গল্প। গল্পে গল্পে বহু বিদেশি খানার নাম জানা গেল। ক্যাভিয়ার, পিচ ফল, এ্যাসপ্যারাগাস ইত্যাদির নাম বলার সাথে সাথে স্যার আমাদের খাবারের বর্ণনাও দেন, যেমন এ্যাসপ্যারাগাস হলো আমাদের ডাটা আর পিচ ফল অনেকটা আমাদের গাবের মত!

মুস্তাফিজ স্যার যেমন ক্লাসে আসার আগে চট করে চুলে আঙুল চালিয়ে নিতেন, বণিক স্যারের মাঝে সেসবের বালাই ছিল না। তিনি খানিক বেভুল মনের মানুষ; তার পড়ানোর কায়দাটিও নানান কারণে অন্যদের থেকে আলাদা। এমন নয় যে বণিক স্যার অসাধারণ একজন শিক্ষক ছিলেন, তবুত্ত স্যারকে ভুলতে পারা প্রায় অসম্ভব। শ্যাম্পেন কী বস্তু তা আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। একজন বললো, স্যার শ্যাম্পেন কি? বণিক স্যার তার পান খাওয়া ঈষৎ লাল ঠোঁট খানিক কুন্চিত করে বললেন, ঐ যে দ্রাক্ষাফলের রসে বানানো মদ্য হইলো শ্যাম্পেন। স্যারের মুখভঙ্গী দেখে শ্যাম্পেন সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন উচ্চ ধারণা হয় নাই। দ্য লানচন্ পড়বার অনেক বছর পর আমাদের জনৈক রাশিয়া প্রবাসী বন্ধু শ্যাম্পেনে চুমুক দিতে দিতে বণিক স্যারের গল্প জুড়েছিল। স্যার আমাদের শ্যাম্পেন বানান শিখিয়েছিলেন। সিএইচএএম চ্যাম হলো শ্যাম, তারপরে প্যাগ-নে এই দুয়ে মিলা হলো চ্যাম-পেগ-নে ওরফে শ্যাম্পেন, ক্যাডেটস। আমার কথা মনে রাখো তোমরা, শ্যাম্পেন জীবনে ভুলবা না। প্রথমবার দ্য লানচন্ পড়বার পর তিরিশ বছর পার হয়েছে, শ্যাম্পেনের মৃদু ঝাঁজ কিংবা স্যারের পড়ানোর ভংগীমাটির কারণে চ্যাম-পেগ-নে’র কথা আজো মনেপড়ে!

আমাদের বাড়িতে বই পড়বার চল ছিল। মায়ের সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথের গীতান্জলী থেকে বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম ছিল। মা পড়তে ভালবাসতেন। সেকালে জীবন বড় সাদামেটে ছিল, মায়েরা দুপুরে ঘর গেরস্থালী আর খাওয়ার পাট চুকিয়ে বই নিয়ে বসতেন। পড়তে পড়তে ভাতঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতো। বিকালে ছাদে আবারও ঘুরেফিরে শেষ-না-হওয়া বইটি হাতে মায়ের ছবি এখনও চোখে ভাসে। বাড়িতে দৈনিক পত্র পত্রিকার সাথে সাপ্তাহিক বেগম আসতো নিয়ম করে। বেগমের পর বিচিত্রা আর রোববারও এলো। নিউজপ্রিন্টের কাগজে বেগম পত্রিকাটি ছোট কলেবরে প্রকাশিত হতো। মায়ের পড়া হয়ে গেলে বেগম আমাদের হাতে হাতে ফিরতো। বেগম পড়ে কতটুকু বুঝতে পারতাম তার আলোচনা আজ নাইবা হলো, তবে বেগম আমাদের পড়বার ইচ্ছাটি তৈরী করে দিল। সেই সময়ে রুশ দেশের উপকথা বাচ্চাদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। আমরা সুর করে পড়তামঃ
ছোট গোলরুটি
চলছে গুটিগুটি
গমের ধামা চেঁছে
ময়দার টিন মুছে
ময়ান দিয়ে ঠেসে
ঘি দিয়ে ভেজে
জুড়োতে দিল যেই
পালিয়ে এলাম সেই!
রুশ দেশের আরো অনেক গল্প ছিল। মালাকাইটের ঝাঁপি, বোকা আইভানের গল্প আর বুদ্ধিমতি মাশাও ভাল লেগেছিল পড়তে। তখন হাতে গোণাগুন্তি করার মত বই ছিল ছোটদের জন্য। তাই একই বই বারবার পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে যেতো। ক্যাডেট কলেজে যাবার আগেই আমার বঙ্কিম-শরৎ রচনাবলী, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়া হয়ে গেল! বড় আপা ছিল সর্বগ্রাসী পাঠক; ঠাকুর থেকে ঠোঙা কোন কিছুই আমাদের বাড়িতে অপঠিত থাকতো না। আপা মাসুদ রানা আর কুয়াশাও পড়তো, আমি বয়সে খানিক ছোট ছিলাম বলে তার নানা খবরদারি ছিল আমার প্রতি। আপার গোয়েন্দাগিরি এড়িয়ে মাসুদ রানা লুকিয়ে পড়তে হতো। সে সময়ে শেক্সপিয়ার সমগ্র অনুবাদ করেছিল কেউ একজন। বাংলায় শেক্সপীয়র পড়ে আমি দারুণ হতাশ। বণিক স্যারের সুরেলা গলায় শেক্সপীয়ার আবার ফিরে এসেছিলেন আমার পৃথিবীতে। স্যারের কাঁপা কাঁপা গলায় টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দা কুশ্চেন এর গল্প কি আমাদের কেউ আজো ভুলতে পেরেছে?

রাতে হাউন্ডস্ অব বাস্কারভিল পড়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাতে যেতাম। ড্রাকুলা পড়বার পর তো আমি রাতে পাশের ঘরে যেতেও ভয় পেতাম। কলেজে এসে বাড়ির যথেচ্ছ পড়াশোনার পরিবেশটির অভাব বোধ করছিলাম। একাডেমিক ব্লকের তিনতলায় ছিল কলেজের লাইব্রেরী। অন্য ক্লাসে আমাদের আগ্রহের কমতি থাকলেও লাইব্রেরীর ঘণ্টা বাজতে না বাজতে হাজির হতাম তিনতলায়। দোতলার সিঁড়ি ভেঙে ওপরতলার হলওয়েতে উঠতেই বই বই একটা গন্ধ নাকে এসে লাগাতো। আমরা অনেকেই সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকতাম এই সময়টুকুর জন্য। আগের সপ্তাহে শেষ না হওয়া লুকিয়ে রাখা বইটির খোঁজ করতাম প্রথমেই, বলাবাহুল্য সেটির খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না। অতি সিরিয়াস বন্ধুদের কেউ কেউ এই সময়ে নোট লিখতো, কিংবা বিড়বিড় করে পড়া তৈরী করতো।

ছুটিতে বাড়ি ফিরে আমার আগের রুটিনে ফিরে যাই। বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি, আবার ঘুম থেকে জেগে নাকের ডগায় চশমা এঁটে বই নিয়ে বসি। ছুটিতে যাবার আগে অন্য সবার মত মনেমনে ভাবতাম এবার বাড়িতে দুয়ার এঁটে পড়তে বসবো। বন্ধুদের কাউকে বলবো না যে পড়ছি, তারপর এক একটা ফোর্টনাইটলি পরীক্ষা কি টার্ম ফাইনালে ফাটাফাটি রেজাল্ট করবো। বাড়ি ফিরে দু’ চারদিন খুব সিরিয়াস থাকি; সকাল বিকাল মা বেলের সরবত কি হরলিক্স বানিয়ে টেবিলে রেখে যায়, সাথে এক টুকরো ঠান্ডা কেক বা দই। আমি সেসব নিঃশব্দে খেয়ে ‘আউট বই’ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দেই যে ছুটি তো আনন্দ করবার জন্য। আমি অপাঠ্য বইয়ের অক্ষরে আনন্দ খুঁজি! এক একটা লেখা এক এক ভাবে মনের দুয়ার খুলে দেয়। সুনীলের কেউ কথা রাখেনি’ র মত কবিতা ইঁচড়ে পাকার মত মুখস্ত করেছিলাম ক্লাস ফাইভে। এখন ‘নীরার অসুখ’ এর সাথে ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি’ পড়ি। বড় মানুষের বড় বড় দুঃখ-বেদনার কথা সব যে বুঝি তা নয়। না বুঝেই মুগ্ধ হয়ে পড়ি,
নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?- অথবা চশমা বদলের মতো
কয়েক মিনিট আলোড়ন?

বাড়িতে অফুরন্ত অবসর। ছুটিতে এসে দেখলাম, আগে যে খাবার দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম এখন সেটি আর অতোটা খারাপ লাগছে না। আলুর চিপস্ খেতে খেতে আমি সুনীল থেকে আল মাহমুদে নিমগ্ন হই।
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়োনা হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি!

আমাদের কোন গাইড ব্যাচ ছিল না। সবাই নতুন ছিলাম বলে কেউ সবজান্তা শমশের হতে পারে নাই। আমরা সবার জুনিয়র অষ্টম শ্রেণীর ক্যাডেট ছিলাম বলে নিজেদের যে ঠিক প্রজা প্রজা ভাবছিলাম তা নয়। আমরা রাজা হতে না পারি অন্তত জমিদারশ্রেণীর তো বটেই! কলেজে ব্যক্তিত্বের ব্যাপারটি গুরত্বপূর্ণ ছিল। জগৎজুড়েই মানুষ শক্তের ভক্ত আর নরমের জম। দেখা গেল দৃঢ় মনোবল আর ব্যক্তিত্বের কারণে জুনিয়রকেও কলেজের সিনিয়ররা সমঝে চলতো। আমাদের সময়ে শারিরীক শাস্তির চাইতে মানসিক শাস্তিই বেশী দেয়া হতো। প্রিফেক্টদের কেউ তার রুমে আমাদের ডাকলে খবর হয়ে যেতো ভেতরে ভেতরে। দোষী সাব্যস্ত হলে নানান কিসিমের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। যেমনঃ
অপরাধীর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে দুই চারবার তাকানো
অপরাধের প্রকারভেদে একশো থেকে এক হাজার বার খাতায় লেখানো
আমি আর করবো না এটি উচ্চস্বরে দশবার বলানো
কঠিন বাক্যবাণে বিদ্ধ করা
অন্যদিকে আমাদের এ্যাডজুটেন্ট স্যারের শাস্তি বলতে ছিল দুই হাত ওপরে তুলে ডাবল আপ। এই দৌড়াদৌড়িতেই অনেকের আলজিভ অবধি বের হয়ে যেতো।

প্রথমবার ছুটিতে গিয়ে দশম শ্রেণীর আপাদের অনেকেই বাড়ি থেকে কলেজে ফিরলো না। তাদের ভয় ছিল, কলেজের পিটি প্যারেড আর নানা আনুষ্ঠানিকতার ডামাডোলে কলেজে পড়াশোনার ব্যাপারটি হয়তো গৌণ। আসন্ন এসএসসি পরীক্ষায় হয়তো তারা ভাল ফলাফল করতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে কলেজের ক্যাডেট সংখ্যা কমে গেল। এসএসসি পরীক্ষার পর একাদশ শ্রেণীর একটা বিশেষ ব্যাচ এলো কলেজে। ততোদিনে কলেজের গলিঘুপচি সব চিনে গেছি। আমরা তখনো কলেজের সর্বকনিষ্ঠ ক্লাস। সুযোগসন্ধানী বেড়ালছানার মত নৈতিক অনৈতিক সব আবদার করি বড়দের কাছে। নতুন একাদশ ক্লাসের আগমন আমাদের বেড়াল রাজ্যে রয়েল বেংগল টাইগারকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে ডেকে আনার মত মনেহলো!

৮,৮৩৪ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট কথিকাঃ পর্ব ৫”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

    এমজিসিসির দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছিলাম ঈদানিং। এটি সেই ধারাবাহিকতার পন্চম অংশ। প্রতিটি এপিসোডের ভিন্ন নাম দিয়েছি। মন চাইলে কেউ আগের পর্বগুলো পড়তে পারে আবার নাও পড়তে পারে। প্রতিটি পর্ব অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আধুনিক ব্যস্ত মানুষের ফেসবুকের স্ট্যাটাস পড়বার মত ধৈর্য আছে, এর বেশী পড়াশোনা মনের ওপর চাপ ফেলে। পাঠাভ্যাস কমতে কমতে তলানিতে থেমেছে তাই চাপাচাপি না করে নিজের আনন্দে লিখছি। রেসপন্স খুব ভাল আমি বলবো, এমজিসিসির অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন!

    পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ছোটভাই। আশাকরি কুশলে আছো।

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    যতদূর মনে পড়ে, দ্য লানচন্ গল্পটা আমাদের একাদশ শ্রেণীতে পাঠ্যতালিকায় ছিল। প্রয়াত মীর ওয়ালীউজ্জামান স্যার পড়িয়েছিলেন। আমরা যখন একাদশ শ্রেণীতে উঠলাম, দেশ সদ্য স্বাধীন হবার পর স্যার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেবল ইংরেজীতে মাস্টার্স শেষ করে আমাদের কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন বিচিত্র বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া এই তরুণ শিক্ষকের সাথে আমাদের বয়সের ব্যবধান খুব বেশী ছিলনা। আর তাছাড়া মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত বন্ধু বৎসল ছিলেন। তাই তিনি অচিরেই সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আমাদের হাউসের তেতলায় একটি ছোট্ট কক্ষে তিনি হাউস টিউটর হিসেবে থাকতেন। কিন্তু সুযোগ পেলেই প্রেপ টাইম ছাড়াও সময়ে অসময়ে এসে তিনি আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দিতেন। উল্লেখ্য, আমাদের সময়ে আমরা প্রেপ টাইমে হাউজের নিজ নিজ কক্ষে বসেই পড়াশোনা করতাম, এখনকার মত শ্রেণীকক্ষে গিয়ে নয়।
    তিনি অত্যন্ত হ্যান্ডসাম ছিলেন। যেমন ফর্সা, তেমনি স্মার্ট। খুব বেশী লম্বা না হলেও মেদহীন হবার কারণে তাকে দেখতে লম্বাই লাগতো। কড়কড়ে ইস্ত্রী করা পোশাক পরতেন। হাতে ধরা থাকতো "এরিন মোর" (তামাক)এর হলুদ রঙের কৌ্টো। ক্লাসে ধুমপান নিষেধ ছিল, কিন্তু তিনি যখন হাউসে আসতেন, কোন একটা রুমে ঢুকে গল্পের আসর জমাতেন। বুক পকেট থেকে আস্তে করে সিগারেট বানানোর কাগজ বের করে এক শৈল্পিক নিপুণতায় "এরিন মোর" এর কৌ্টো খুলে তামাক বের করে সিগারেট বানাতেন। তাতে আগুন ধরিয়ে যখন সুখটান দিতেন, পুরো রুমটা এরিন মোর এর মাদকতাময় গন্ধে ভরপুর হয়ে যেত। ততদিনে আমাদের কেউ কেউ সিগারেট টানে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। স্যার চলে যাবার পর তাদের কারো কারো আক্ষেপ শোনা যেত, ইস! একটা যদি পাইতাম!
    সেই স্যারকে আমরা কুবুদ্ধি দিয়ে (সেই সময় আমাদের ক্ষুদ্র বিবেচনায় সেটা সৎ পরামর্শই ছিল) সেনা শিক্ষা কোরে যোগদানের জন্য ভীষণভাবে উৎসাহিত এবং বলা চলে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। আমরা বলতাম, স্যার আপনি এখনই যান, আমরা আসছি দুটি বছর পর। স্যার গিয়েছিলেনও। কিন্তু ঐ যে, বোহেমিয়ান জীবন যাপন! তার মত লাইফ স্টাইলের লোকের জন্য সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলিত জীবন নয়। তাই তাকে ক্যাপ্টেন পদবীতেই নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিতে হয়েছিল। পরে তিনি "প্রশিকা"য় ছিলেন। অন্যান্য কিছু এনজিওতেও বোধহয় চাকুরী করেছিলেন। বছর তিন কি চারেক আগে তাঁর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল গাজীপুরে, রাওয়া পিকনিকে। ততদিনে বেশ কিছু অসুখ বিসুখের কারণে এক সময়ের এই উজ্জ্বল তারকা দ্যূতি হারিয়েছিলেন। বছর দেড়েক আগে তিনি বলা যায় অপরিণত বয়সেই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁকে স্মরণ করে আমি তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
    স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারতের শিলঙ রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ট্রাক চালিয়ে জীবন যাপন করতেন। তবে তা যতটা না জীবিকার তাগিদে, তার চেয়ে বেশী রোমাঞ্চের অনুসন্ধানে। ব্যক্তি জীবনে তিনি নির্ঝন্জাট ছিলেন। কারো সাতে পাঁচে থাকতেন না। তিনি ফ্রী ল্যান্স লেখক ছিলেন। তার কয়টা বইও প্রকাশিত হয়েছিল।
    স্মৃতিকাতর হয়ে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে অনেক কিছু বলে ফেললাম। পরে আবার ফিরে এসে মূল লেখার উপর মন্তব্য করার আশা রাখছি। মনে পড়ে, ইংরেজী Blush শব্দটার অর্থ আমি প্রথম শিখেছিলাম দ্য লানচন্ পড়ে। সেই মহিলার সাথে লেখকের কথোপকথনের সময় এ শব্দটা এসেছিল।

    জবাব দিন
    • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

      🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

      মীর ওয়ালীউজ্জামান স্যারের গল্পটি মন ছুঁয়ে গেল, কবি। তাঁকে ভীষণ দুঃসাহসী আর আধুনিক একজন মানুষ মনেহলো। মানুষ মনে মনে যে জীবনের আরাধনা করে তা যাপন করবার মতো সাহসিকতা খুব কম জনের হয়। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা মেধা থাকুক কিংবা না থাকুক সকলেই ডাক্তার কিংবা ইন্জিনিয়র হতে চায়। এটি হয়তো তাদের চাওয়া নয়, কেউ মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা বিদ্যার মূল মন্ত্রটি বুকে ধারণ করতে পারেনা, কেউবা বাবার স্বপ্ন পূরণে জ্যামিতির আঁক কষে সারাজীবন কিন্তু মন পরে থাকে ছবি আঁকায় কিংবা ভ্রমণে। জামান স্যার তাঁর কাংখিত জীবন যাপন করে গেছেন বহুদিন আগেই; আমরা এখনো অনেকে জানিই না কী চাই!

      আমার সামান্য ব্লগ পোস্টটি পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ, কবি।

      জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    দ্যা লাঞ্চন পড়ার পর আমাদের মধ্যে 'ভিনডিকটিভ' শব্দটা খুব হিট হল। আমাদের একজন ভীষণ ভিনডিক্টিভ ছিল। অবধারিতভাবে ওর নামের সাথে চিরস্থায়ীভাবে ভিনডিক্টিভ শব্দটা জুড়ে গেল।

    সিরিজটা দারুণ লাগছে, আপা!
    চলুক... 🙂


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

      🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

      বিশেষ কোন শব্দ নয় বরং বলতে পারিস লানচনের মেনু্ আমার কাছে বেড়ে লেগেছিল। স্যার বলেছিলেন এ্যাসপ্যারাগাস হলো আমাদের ডাটা জাতীয় সব্জী, আমরা ভাবছিলাম বিদেশে ডাটার এতো দাম? লানচন্ পড়বার বছর কয়েকের মাঝে আমি মার্কিন দেশে চলে আসি। আমার বাঙাল জিভে এ্যাসপ্যারাগাসকে কোন মতেই সুস্বাদু কিছু মনে হয়নি। আমাদের জর্জিয়া স্টেটটিকে পিচের রাজ্য বলে। হামেশাই এখানকার রাস্তাঘাটের নাম পিচ স্ট্রিট তো পিচ এভিন্যু কিংবা পিচ বুলোভার্ড। শহর ছেড়ে দশ পন্চাশ মাইল পেরুলে পিচের বাগান চোখে পরে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসের শেষ শুক্রবার ওয়াইন এ্যান্ড চিজ পার্টি হতো ছাত্র লাউন্জে। আমি সেখানে শ্যাম্পেন পরখ করেছিলাম প্রথমবারের মত। ক্যাভিয়ার খাওয়ার কায়দাকানুন শিখলাম এদেশে আসার কিছুদিন পর। মনে অনেক উচ্চাশা নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। রুশ রেস্তোরাঁ ছিল সেটি। ছোট ছোট প্যানকেকে সাদা সাওয়ার ক্রিম ছড়িয়ে ওপরে কালো রঙের স্টার্জন ক্যাভিয়ার এলো প্লেটে। রাশান এই বিশেষ প্যানকেকের নাম হলো ব্লিনি। মাছ মাছ গন্ধযুক্ত ক্যাভিয়ার খেতে ঈষৎ লবণাক্ত।

      একটি আহারপর্বে কত ভাবেই না মানুষকে চেনা যায়। মানুষের রুচি ও পছন্দ, এটিকেট ও ম্যানারস্ ফুটে ওঠে এক খাওয়াতেই।

      তোর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলুম, ভাইটি। আমার লেখা পড়বার জন্য প্রতি বৃহষ্পতিবার সিসিবির পাতায় চোখ রাখিস।

      (তোর মত কায়দা করে বাংলায় লানচন্ লিখতে চেয়েছি অনেকবার, পারি নাই। ক্যামনে লিখলি বল দেখি!)

      জবাব দিন
  4. জিয়া হায়দার সোহেল (৮৯-৯৫)

    আপু, তোমার লিখা যেরকম জীবন্ত মনে হয়, অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের লিখায় সেটা পাওয়া যায় না। তুমি ভ্রমন কাহিনী কিংবা আত্মজীবনীমুলক উপন্যাস অনেক সুন্দর করে লিখতে পারবা। খুব ভালো লেগেছে পড়ে। অন্য লিখাগুলোও পড়ে নিবো। অনেক ভালো থেকো।

    জবাব দিন
  5. 🙂 সাবিনার সাথে কাজের মাধ্যমে পরিচয় জানা ছিল। ওর কল্যানে এক জনের শিক্ষা জীবন সচল হয়েছে। ওর সাথে আরো ক্যাডেট আছে তিন জন। সাইফুল এর সুবাদেই ওর সাথে পরিচয় এবং এখন ফেসবুক ফ্রেন্ড। আমি নিজেকে কারো ফ্যান বলিনা। কিন্তু আমি ওর লেখার ফ্যান হয়ে গিয়েছি। এখন ওর লেখা না ওর লেখা না পড়লে আমার অস্থির লাগে। আজ তাগাদা দিচ্ছিলাম। ও এই লেখাটার লিঙ্ক পাঠিয়ে দিল। অর লেখা পড়লে ক্যাডেট জীবনের সার্বজনীনতা পাওয়া যায়। ওর প্রথম লেখা পরে মনে হলো এটা যেন রংপুরের ক্যাডেট দের ও কাহিনী। আমার খুব কৌতুহল ছিল ক্যাডেটদের একান্ত দিন গুলির কাহিনী জানতে। ওদের জগতে ঢোকা আমাদের জন্য টাবু ছিল। নিজেরা বেশ গল্প করছে,হাসছে, যেই আমি গিয়েছি অমনি সব চুপ। কোন মতেই গল্প জমাতে পারিনি। ফৌজদার হাটে থাকতে অনেকের সাথে ঘণিষ্ঠতা হয়েছিলো, অনেক কিছুই আলাপে আস্তো। কিন্তু ওদের জগতে ঢুকা যেতনা। অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে। এম জি সি সি র ক্যাডেটরা তাদের ফোউজদার হাটে অবস্থান কালে কলেজ হাস্পাতালে থাকতো। আর ওই সময় শুরু হয়ে যেতো ড্রেনের ভিতর দিয়ে স্বেচ্ছা ক্রলিং। একটু দেখা ,একটু কথা বলার জন্য ক্যোঁতও ঝুকি নিয়ে যেত। আমি বরাবরই ফ্রি মিক্সিং এর বযাপারে ভোকাল ছিলাম। কিন্তু সবাইতো এক রকম এ। ফলে কলেজে এক সাথে পার্টি হয়ে উঠেনি। আশা করি সবাই তাদের কলেজ জীবনের দিন গুলিকে এই বড়বেলায় এখানে তুলে আনবে।আমারো ইচ্ছে করে কলেজ জীবনের গল্প বলতে। কিন্তু যখনই ভাবি লিখব,তখনই একজন নিষ্ঠুর মানুষের চিত্র ফুটে উঠে। কারো কারো প্রতি আমার নির্দয় ব্যবহার এই পড়ো বেলায় আমাকে কষ্ট দেয়। বিশেষ করে মোস্তফ আর তামজিদের সাথে যে আছরোন করেছি,সেটা এক মাত্র স্যাডিস্ট ছাড়া আর কেউ করতে পারেনা। আসলে আমি নিজেই স্যডিস্ট কে ঘৃনা করি। অথচ মোস্টফার বইপড়া,গান শোনা, খেলাধুলা সব কিছুই ভাললাগতো। একটা দারূণ ছেলে ছিল। কানাডায় থাকার সুযোগ থাকা সত্বেও পরিবার নিয়ে বুয়েট ফিরে এসেছে,দেশের টানে। মাঝে মাঝে ফুটবলার হিসেবে ওকে দেখি। সাবিনার লেখার অপেক্ষায় থাকব নিরন্তর। 🙂 🙂 🙂 🙂

    জবাব দিন
  6. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

    সালাম, স্যার। আপনার মন্তব্য এবং স্মৃতিচারণ আমার সামান্য লেখাটিকে দ্যুতিময় করে তুলেছে।

    ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের ঋন শোধ করবার নয়। তাঁরা আমাদের জন্য কী না করেছেন! মনে কষ্ট পাবেন না স্যার, আমি নিশ্চিত আপনার ছাত্ররা আজো আপনাকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।

    আমরা ১৯৮৮ তে ফৌজদারহাটে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছিলাম খোলা আকাশের নীচে। একই সময়ে সিলেট ক্যাডেট কলেজও ফৌজদারহাটে অবস্থান করছিল।

    আপনার স্মৃতিকথা লেখায় হাত দেবার সময় বয়ে যায়, স্যার। ভাল থাকবেন।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।