আমার শিক্ষকগণ ১

আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো ফাঁকিবাজিতে ভরা । তবে আমার শিক্ষকরা ছিলেন চমতকার। বইএর বাইরে তাদের কাছে যা শিখেছি তাই ভাঙ্গিয়েই জীবন চলছে । প্রথমে সুলতা দিদি মনির কথা বলি। আমি যখন মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম (এই স্কুলের ভালো নাম স্যাকরেড হার্ট জুনিয়ার হাই স্কুল) তখন আমার নিজের ভালো নাম জানতাম না। একটা মৌখিক ভরতি পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। মাদার ভিঞ্চিন্সা, সিস্টার জেমস আর সুলতা দিদি মনির কাছে। মাদার শুধু হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে ছিলেন। তবু মোটা কাঁচের চশমার আড়ালে তাঁকে দেখতে মায়ের মত লাগছিলো না। সিস্টার জেমস আমার গাল টিপে দিলেন আদর করে। তার পর বললেন তোমার নাম কী?
– বাচ্চু
– আসল নাম বল
আমি ঘাবড়ে গেলাম। সিস্টার জেমস বললেন “আমি তোমার সিস্টার হইতেছি। সিস্টার মানে ভগিনী”। আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম ভগিনী মানেই বুঝিনা। আমার হাতে মলাট দেওয়া রেডিয়েন্ট রিডিং, আব্বা সেখানে ইংরেজিতে নাম লিখে দিয়েছেন। বললাম, বইয়ে লেখা আছে।
সুলতা দিদি মনি এতক্ষণ কিছুই বলেননি। সাদা মেম দের সামনে ছোট খাটো কালো রঙের মানুষটা একেবারেই দ্রষ্টব্য নন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়েও দেখিনি। উনি চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার কাছ থেকে বইটি নিয়ে, মুখটিপে হাসতে হাসতে বললেন আমাদের বাবুর নাম “এস এম সাইদুল ইসলাম”। ওনার সুন্দর সাদা ঝকঝকে দাঁত আর স্মিত হাসি আমার স্কুলের প্রথম দিনটিকে অন্যরকম করেদিলো।

আমার রেজাল্ট ভালো হওয়ায়, আমাকে কেজিতে পড়তে হয়নি। নার্সারি থেকে একেবারে স্ট্যান্ডার্ড ওয়ান। প্রথম দিন ক্লাশে ঢুকতে গিয়ে দেখি, নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা রাগী আগী চেহারার বীনা দিদি মনি গম্ভীর মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি তাঁকে দেখে উলটো হাঁটা শুরু করলাম। বীনা দিদি মনি যতই ডাকেন আমি উলটো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকি। তাঁ অনেক চাপাচাপির পর শধু বলতে পারলাম সুলতা দিদি মনির কাছে যাবো। বীনা দিদি মনি কিছু না বলে বাইরে চলে গেলেন।

একটু পর সুলতা দিদি মনি এসে আমাকে বললেন “ক্লাশে যাবে না?” আমি চুপ। উনি বললেন ট্রেন দেখবে? আমি একদিকে মাথা কাত করে বললাম হু। দিদিমনি আমাকে কোলে নিয়ে চার তলা স্কুলের ছাদে চলে গেলেন। আমদের স্কুলের চারপাশটা যে এত সুন্দর ছাদে না উঠলে বোঝা যেত না। চারিদিকে গাছ পালা, শাপলা ফোটা পুকুর, একটু দূরে গির্জার চুড়া, দূরে রেল লাইন, তার পর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, তার ওপারে ছবির মত গ্রাম। এসব দেখে দিদি মনির সাথে ঘুরতে ঘুরতে টিফিনের ঘন্টা বাজার সময় হয়ে গেল। দিদিমনি আমার পকেটে দু’টি চকলেট গুঁজে দিয়ে বীনা দিদিমনির ক্লাশে বসিয়ে দিয়ে গেলেন।

আমার মেয়েরা নামি স্কুলে পড়ে কিন্তু সেখানে সুলতা দিদিমনিরা পড়ান না।

১০ টি মন্তব্য : “আমার শিক্ষকগণ ১”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂

    আপনার লেখা পড়ে আমার নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে পরে গেলো। আমরা পড়েছি দা রেডিয়েন্ট ওয়ে, প্রি ক্যাডেট স্কুলে। কত যে রাইম পড়েছি ঝুঁটি নেড়ে নেড়ে!

    চমৎকার লেখা, ভাইয়া!

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    সুলতা দিদিমনির হাতে গড়া মানুষটার এই লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হ'লাম। আর..
    "মাদার শুধু হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে ছিলেন। তবু মোটা কাঁচের চশমার আড়ালে তাঁকে দেখতে মায়ের মত লাগছিলো না।" - এই চমৎকার অভিব্যক্তিটুকু পড়ে মনে হলো, পর্যবক্ষণ কতটা গভীর হলে এরকমভাবে লিখা যায়!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।