আমার বইমেলা ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধযাত্রা ১৯৭১

আমার সাথে বই মেলার আড়ি আছে । বিষয়টা বুঝলাম আমার প্রথম বই প্রকাশের বছর। পান্ডুলিপি এবং পয়সা জমা দেবার পরও বই বের হচ্ছিল না। এ জগতের সাথে যাদের পরিচয় নেই, তারা বিষ্মিত হবেন, বই ছাপতে পয়সা দিতে হয়?

উত্তর হল নতুন লেখকদের প্রায় সময়ই দিতে হয়। যে সব প্রকাশক সৈকত হাবিবের মত ভদ্র এবং নতুন লেখকদেরও মানুষ মনে করেন, তারা মিষ্টি করে বলেন, “আপনাকে কিন্তু কিছু বই কিনতে হবে”।
“কিছু মানে?”
“এই ধরেন ২০০”
“বই কতগুলো ছাপবেন”
“৩০০”
বললাম, ৫০০ ছাপা যায়না? ৩০০ শুনতেই বা কেমন লাগে!
উনি বললেন এদেশে হুমায়ুন আহমেদের সব বইও একটানা ৫০০ বিক্রি হয়না।
আর বই ছাপানো তো বড় কথা না, ছাপাই যায়, সমস্যা হলো বেশিদিন আলমারিতে রাখা নিয়ে। পড়ে থাকতে থাকতে ইঁদুরে কাঁটে, তেলাপোকার বাসা হয়। বুঝলেন না শেষে অন্য বইও নষ্ট হয়। কথাটি যতখানি রসের তার চেয়ে বেশি কষের।গোলাপ চাইলে কাঁটার ভয় থাকলে চলে না। নতুন লেখকদের প্রকাশকের কাছে হত্যে দেওয়া ছাড়া গতি নেই।যেহেতু এ ক্ষেত্রে, প্রকাশকের লগ্নি নেই, কিন্তু লাভ আছে।তাই প্রকাশকের Love নিজের লগ্নির জন্যে তোলা থাকে।দামি লেখকদের পেছনে যেহেতু তাঁকে ইনভেস্ট করতে হয়, তাই সেদিকে টানও বেশি।

একদিন একদিন করে মেলার দিন ফুরোতে থাকে আর আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। প্রথম কয়েকদিন জিগ্যেস করতাম বই কবে মেলায় আসবে । প্রকাশক কোন একটা তারিখ বলতেন। আমি বন্ধু বান্ধবদের সেই তারিখ বলতাম। দুই একজন হয়তো বই মেলায় গিয়ে খবরও নিত। কিন্তু বই এর দেখা না পেতে পেতে ধরেই নিত, বই টই আসলে বের হবেনা। আমার তেমন কোন পাঠক নেই যারা আমার বই কিনতেই মেলায় যাবেন, যে দুই একজন আমার বইয়ের খবর নেন, তারা অন্যদের বই কেনার পর বাড়তি পয়সা এবং ফুরফুরে মেজাজ থাকলে আমার বই কিনলেও কিনতে পারেন। তবে তার জন্যে বইটা তো সামনে থাকতে হবে ।ফুল না ফুটলে ভ্রমর বসবে কিসে?

অবশেষে প্রকাশক বললেন ২১ তারিখে বই বের হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারি সেজেগুজে সকাল সকাল মেলায় হাজির হয়ে নির্দিষ্ট স্টলে গিয়ে দেখলাম, দুই জন মানুষ বিক্রি বাটা নিয়ে ব্যস্ত, তাদের আমার দিকে তাকানোর সময় নেই। ভেবেছিলাম বই এর পেছনে যেহেতু আমার ছবি আছে, তারা তো আমাকে চিনবেনই। তাদের আচরণে কোন ইতর বিশেষ না দেখে, জিগ্যেস করলাম সাইদুল ইসলামের “অচেনা চীনে এসেছে?” তারা এক শব্দে উত্তর দিল, “না”। জিগ্যেস করলাম, “কবে আসবে ভাই?” ভাড়াটে বিক্রেতা সুলভ সারল্যে একজন বলল, “জানিনা”।

প্রকাশককে ফোন করলাম, তিনি বললেন, “মাঝখানে যে শুক্রবার পড়ে যাবে মনে ছিলোনা, বাইন্ডাররা যে কি বজ্জাত আপনি চিন্তা করতে পারবেন না। সব রেডি ছিল, বজ্জাত গুলি করল না”।

এরপর আমি বইয়ের আশা ছেডে দিলাম। হঠাৎ ২৬ বা ২৭ তারিখ উনি বললেন আজ আপনার বই মেলাতে যাবেই। সেদিন মেলায় আগুনলেগে গেল, আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে করতে পাঠক মেলা ছাড়ল । দু’দিন পরে মেলা শেষ।ভাগের ২০০ খানা বই নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বউ বলল, “হুম, বই যদি বিক্রিই হত, তাহলে কি আর গ্রন্থ সত্ব আমায় দিতে!”

অজ্ঞাত কোন কারনে, কয়েক মাসের মধ্যেই সব বই বিক্রি হয়ে গেল। প্রকাশক একদিন ফোন করে বললেন, “বই কি কিছু আছে ? রকমারি থেকে চাচ্ছে”।
সিএসডি তে কিছু বই দিয়েছিলাম, একদিন সিএসডির প্রধান বললেন, বই কি কিছু দিতে পারবা? তোমার বই ফটোকপি করে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমি অবাক। পৃথিবীতে কত অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে!

পরের বছর গোলাপের রঙ বের হবে। আমি এতদিনে বইয়ের জগত কিছুটা চিনেছি। আমি বললাম ৩০০’র বেশি ছাপার দরকার নেই। এবার প্রকাশক বললেন, আপনার বইয়ের কিছু পাঠক আছে, চলেন ৫০০ ছাপাই, আমি বললাম গত বার ৬৬ পার্সেন্ট বই আমায় গছিয়েছিলেন, ৫০০’র ৬৬ পার্সেন্ট কেনার ক্ষমতা আমার নেই। উনি বললেন, আপনার কিনতে হবেনা। কপাল খারাপ, প্রকাশকের বাবা মারা গেলেন। তাঁর সকল প্রচেষ্টা সত্বেও বই বের হল মেলা শেষ হবার আগের দিন।

এবার আবার বই বেরুচ্ছে, শুনেছিলাম ৫ তারিখে মেলায় আসবে। শেষ পর্যন্ত ৬ তারিখে এসেছে। এবং খবর পাচ্ছি, দুই একটা বিক্রিও হচ্ছে।

5.5″ x 8.5″

২ টি মন্তব্য : “আমার বইমেলা ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধযাত্রা ১৯৭১”

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।