ঘাপলা যখন নাম নিয়ে…

বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর অনেক বালক-বালিকারই নাম নিয়ে ঘাপলা হয় হলের লিস্টে। বেশ কয়েকজন বালকের ক্ষেত্রে দেখেছি এই সমস্যা। কোন বালিকার ক্ষেত্রে হয়েছে কিনা জানা নাই। তবে যেহেতু ছাত্রী হলও বুয়েটেরই হল, ঘাপলা হওয়ারই কথা।

আমার জন্মের পর বাপ-মা অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নাম রাখলো “মোঃ সামিউল ইসলাম”। স্কুল, কলেজ কোন জায়গায় নাম নিয়ে কোন ঝামেলা হয় নাই। যদিও ক্যাডেট কলেজে আমার লকারে আমার নাম “SAMI”র বদলে “SHAMI” লেখা ছিল। 😀

এরপর বুয়েট। লেভেল-১, টার্ম-১ এ ভর্তির পর হলে এসে দেখি হলের লিস্টে আমার নাম লেখা “মোঃ সফিউল ইসলাম”। মেজাজ এমনি এমনি খারাপ হয়না। ডাইনিং এর তালিকায়, রুমের লিস্টে সব জায়গায় লেখা এই ভুল নাম। শুধু website আর একাডেমিক সব কাগজে সঠিক নাম লেখা। সান্ত্বনা পেলাম এই জেনে যে ঘাপলা শুধু আমার একার না। আরও কিছু পোলাপানের দেখলাম একই সমস্যা। হলের টাইপিস্ট কে আল্লাহ্‌ই জানে। ক্যামনে এই রকম ভুল করে??

একজনের নাম “রাকিব হাসান” তার নাম লিখেছে- “বারিক হাসান”। আরেকটা ছেলে তার নাম- “জয়ন্ত চৌধুরী”, হলে লেখা- “জয়ন্তু চৌধুরী”, মানে ‘ত’ এর নিচে ‘ু’- কার। ভাগ্য ভাল যে “য়” টা বাদ দেয় নাই। দিলেই “জন্তু” হয়ে যেত। সবচেয়ে মজা পাইলাম সোহরাওয়ারদী হলের এক বন্ধুর (SCC)  নাম দেখে। তার নাম- “সৌম্য শেখর পাল”। আর হলের লিস্টে নাম এসেছে- “সুমায়া সরকার পাল”। এই নামের ভুলের জন্য সেই বেচারাকে বহুদিন পোলাপানের অনেক টিজ সহ্য করতে হয়েছে।

আমি তখনও ঠিকমত চিনি না কিছু। কিভাবে নাম ঠিক করবো বুঝতেসিলাম না। যাই হোক এই ‘সফিউল ইসলাম’ নাম নিয়ে আমার খুব মেজাজ খারাপ লাগতো। ডাইনিং এ খেতে গেলে দেখতে হয় এই নাম। Feast এর দিন নাম আর রুম নম্বর বলতে হয়। আবার মাঝে মাঝে রুমে স্যাররা আসতেন চেক করতে। সব জায়গায় “সফিউল” দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত।

একদিন গেলাম হল অফিসে, নাম ঠিক করতে। ধরা যাক, হলের ছাত্রদের সব কাগজ পত্র যিনি ঠিক-ঠাক করেন তার নাম ‘করিম ভাই’। তাকে বললাম আমার নামের ভুলের কথা। তিনি বললেন, কোন সমস্যা নাই, ঠিক করে দিবেন। আমি খুশি হয়ে চলে আসলাম।

কিন্তু লাভ হল না। আমার নাম ঠিক করলেন না। আমি আবার গেলাম কয়েকদিন পর। আবার বললাম। তিনি আশ্বাস দিলেন, এবার  ঠিক হয়ে যাবে। এবারও হল না। এইরকম ভাবে আমি ৫/৬ বার তাকে বলেছি নাম ঠিক করার কথা। কোন লাভ হয় নাই। ততদিনে আমি ২-১ এ উঠে গেছি। নাম বদলানোর আশা ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগে।

অবশেষে একদিন। আমার রুমমেটরা আমাকে একটা বুদ্ধি দিল। বলল, যত বার আমার করিম ভাইয়ের সাথে দেখা হবে ততবারই যেন আমি উল্টা-পাল্টা বিভিন্ন নামে তাকে ডাকি। আমার টার্গেট হবে তাকে মহা বিরক্ত করে ফেলা।

যেইকথা, সেইকাজ। করিম ভাইয়ের সাথে দেখা হল রাস্তায়। আমি সালাম দিয়ে স্পষ্ট ভাবে বললাম, “রহিম ভাই, ভাল আছেন?” উনি একটু ভুরু কুঁচকে তাকালেন এবং বললেন, “হ্যাঁ, ভাল আছি”।

এইভাবে শুরু। এরপর যতদিন তার সাথে দেখা হয় আমি একেকদিন একেক নামে ডাকি। আরেকদিন দেখা হল। আমি বললাম, “কী হালিম ভাই, সব ঠিক তো?” আবার বিরক্ত হলেন তিনি। বুঝলাম, এই পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে।

একদিন দেখা হয় তিতুমীর হলের নাপিতের দোকানে। তার ছোট ছেলেকে নিয়ে এসেছেন চুল কাটাতে। আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম,- “জলিল ভাই, কেমন আছেন? এটা কি আপনার নাতি নাকি?” প্রচণ্ড রকমের বিরক্তি ফুটে উঠলো তার চোখে-মুখে। কোন কথা বললেন না।

ওইদিন রাতেই আবার গেলাম হল অফিসে। যেই না তাকে “রওশন ভাই” বলে সম্বোধন করেছি উনি একদম তেলে বেগুনে রেগে গেলেন। বললেন, “আপনের সমস্যা কী? আমারে খালি উল্টা–পাল্টা নামে ডাকেন। আমার নাম আপনি জানেন না?”

আমি হাসতে হাসতে বললাম, “উল্টা–পাল্টা নামে ডাকলে আপনার মেজাজ খারাপ হয়?”

উনি বললেন- “তো, হয় না? নিজের নাম ছাড়া অন্য যেকোন নামে ডাকলে যে কেউই রাগ করে”।

আমি- “আচ্ছা, আমি যে ১০ বার এসে আপনারে বললাম আমার নামটা ঠিক করে দিতে, আপনি তো পাত্তাই দিলেন না। এখন বুঝছেন তো ওই নামে আমারে ডাকলে আমারও খারাপ লাগে”।

উনি বললেন- “আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখনই আপনের নাম ঠিক করে দিচ্ছি। আমারে আর কোন দিন অন্য নামে ডাকবেন না। ঠিক আছে?”

আমি- “অবশ্যই ঠিক আছে, ‘জব্বার ভাই’… সরি সরি করিম ভাই।

.

.

.

অতঃপর পরদিন হইতে হলের সকল তালিকায় আমার পিতা-মাতা প্রদত্ত নাম জ্বলজ্বল করিয়া শোভা পাইতে লাগিলো।

২০ টি মন্তব্য : “ঘাপলা যখন নাম নিয়ে…”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।