একজন রোজ আপু

তখনকার দিনে ক্যাডেট কলেজে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ছিল না। বদ্ধ ঘরের ঘুলঘুলির মধ্য দিয়ে কালেভদ্রে বসন্ত বাতাস ঢোকার মত ক্যাডেটদের জীবনে খুশির হাওয়া বয়ে আনত হলুদ খামে ভরা এক একটি চিঠি। আর সে চিঠি যদি আসত অপ্রত্যাশিত কারো কাছ থেকে তাহলে তো কথাই নেই। ফোনে বলা কথাগুলো বার বার শোনা যায় না, কিন্তু চিঠির এক একটি লাইনের দিকে তাকিয়ে অবলীলায় পার করে দেয়া যায় শত শত প্রেপ টাইম। জনি যখন ক্লাস সেভেনে তখন তাদের কলেজ প্রিফেক্ট ছিল যমদূতের দুঃসম্পর্কের ছোট ভাই। না, সে ভাইয়ের নাম এখনও বলা যাবে না। তাহলে হয়ত তিনি জনিকে চৌদ্দ শিকের ওপারটা দেখিয়ে আনতে চাইবেন। গল্পের সুবিধার্থে ধরা যাক ভাইয়ের নাম সাকিব আল হাসান, না না মাশরাফি। মাশরাফি ভাই। নতুন কলেজ প্রিফেক্ট হয়েই মাশরাফি ভাই চাইলেন ক্ষমতার দাপটে প্রথমেই জুনিয়র মহলে ত্রাস সৃষ্টি করতে, অনেকটা বিড়াল মারার মত। তখন থেকেই তিনি বিড়ালের সন্ধানে ছিলেন। সেদিন যখন পেট ডাবানো, বুক ফোলানো, লক্ষ্যদৃষ্টি সামনের দিকে রেখে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় কোমরের পেছনে বেঁধে সটান ভঙ্গিমায় তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তার মনে হল অদূরে ফলিন করে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ হাউসের ক্লাস সেভেনের স্কোয়াডের মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আর যায় কোথায়? কিছুক্ষণ পর খাঁ খাঁ দুপুরের উত্তপ্ত পীচের রাস্তার উপর ৫০ মিটার ক্রোলিং করে যখন ক্যাডেটগুলো উঠল তখন দেখা গেল সবারই হাতের কনুই ছিলে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। মাশরাফি ভাই সফল; বিড়াল না মরলেও অন্তত মূমুর্ষূ হয়েছে।

পাশের হাউসের বন্ধুদের এই পরিণতি ভদ্রবেশী জনির মনে দাগ কেটে গেল। এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই লাইটস অফ বেলের কিছুক্ষণ আগে মাশরাফি ভাই জনিদের ডর্মে এলেন। তারপর বাজখাই গলায় হড়হড় করে কিছু বললেন। জনিরা কিছুই বুঝল না। বস্তুত মাশরাফি ভাইয়ের বজ্রকন্ঠে রোমান্টিক কথা শুনলেও ভয়ে প্রেয়সী পালাবে। যাই হোক, তিনবার পুনরাবৃত্তি শোনার পর তারা বুঝল যে, ভাই জানতে চাচ্ছেন কার কার বাসা খুলনায়। ওয়াসি আর জনি ভয়ে ভয়ে হাত তুলল। এরপর তিনি ওয়াসির কাছে জানতে চাইলেন বয়রা মহিলা কলেজে তার কোন কাজিন পড়ে কিনা। না বোধক উত্তর পেয়ে তিনি এলেন জনির কাছে। জনি যখন বলল যে, জুঁই, রোজ এবং যূথি নামে তার তিন কাজিন উক্ত কলেজে পড়ে তখন মাশরাফি ভাই জনিকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। এরপর আধা ঘন্টা ধরে গলা নামিয়ে যথেষ্ট বোধগম্য করানোর চেষ্টা করে তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে, আমার রোজ আপু মাশরাফি ভাইকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। রোজ আপু প্যারেন্টস ডে তে এসে এই সুদর্শন কলেজ প্রিফেক্টকে দেখে, তার ভরাট কন্ঠ শুনে, তার চাল চলন, কথাবার্তা এবং ব্যক্তিত্বের গভীরতা মেপে অতঃপর তার বন্ধুত্ব কামনা করেছেন। জনি তো একই সাথে অবাক এবং খুশি। এরপরের আধা ঘন্টা জনিকে ‘আমার রোজ আপু’ টপিকের উপর বক্তৃতা দিতে হল। আপু দেখতে কেমন, উচ্চতা কতটুকু, নাচ গান জানে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। জনির চোখে আপুর গুনের কোন কমতি নেই। আর কোথাও কমতি থাকলে জনি নিজ গুণে সেটা পূরণ করে দিল।

হয়ত মাশরাফি ভাইয়ের মনে রোজ আপু ক্ষণিকের স্বপ্ন ছড়িয়েছিল। তিনি বিচরণ করেছিলেন আলো ছায়ার স্বপ্নঘেরা পথে। আমের বোলের মত সোঁদা গন্ধে ভরা কালো এলো চুল, হাতে চুড়ির রিনি ঝিনি, লাজ নম্র মুখখানি, অধরের মিষ্টি হাসিতেই যার সৌন্দর্যের পূর্ণতা সেই রমনী হয়ত এসেছিলেন চুপিসারে, নিভৃত মনের দ্বারে; আবার হারিয়ে যেতেন ভোরে ডিউটি ক্যাডেটের ঘণ্টার শব্দে। এরপর মাশরাফি ভাইয়ের চাল চলন আরও বদলে গেল, কমান্ড দেয়ার সময় তার প্রশংসাপ্রাপ্ত কন্ঠস্বর আরও ভরাট করার প্রচেষ্টা দেখা গেল, একা একা তাকে আপন মনে হাসতেও দেখা গেল। আসলেই রোজ আপু মাশরাফি ভাইয়ের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কিনা জনি তা জানে না। শুধু এটুকু জানল যে, ক্লাস টুয়েলভের কাছে তার কদর হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। কারণ অপরিচিত কোন মেয়ের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে চিঠি পাওয়ার ঘটনাতো আর শুধু নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার মত খবর না। এরপর জনিকে প্রায়ই দেখা যেত মাশরাফি ভাইয়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। জনির ‘স’ এবং ‘শ’ জনিত উচ্চারণ ত্রুটি শোধরানোতেও মাশরাফি ভাইয়ের যথেষ্ট আগ্রহ দেখা গেল। জুনিয়রদের ত্রাস ক্লাস টুয়েলভের থাকার রুম ডর্ম ফোর তখন জনির জন্য অভয়াশ্রম। ভাইদের কয়েকজন আবার নিজেদেরকে মাশরাফি ভাইয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড দাবি করে তাদের কথাও জনির কাজিন আপুদের কাছে বলার অনুরোধ করতেন। ক্লাস টুয়েলভের সাথে যখন জনির শালা দুলাভাই সম্পর্ক তখন অন্যান্য ক্লাসের সিনিয়ররাও জনিকে একটু অন্য চোখে দেখত।

প্যারেন্টস ডের আগের দিন মাশরাফি ভাই জনিকে একটি চিঠি দিয়ে সেটা রোজ আপুর কাছে পাঠিয়ে দিতে বললেন। জনি খুব খুশি মনে প্যারেন্টস ডে পালন করল। তারপর দিন রুমে বসে মাশরাফি ভাইয়ের চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করল। অপ্রত্যাশিতভাবে রোজ আপুর কাছ থেকে চিঠি পেয়ে তিনি যে খুবই অবাক এবং খুশি হয়েছেন সেটাই দাঁত ভাঙা ইংরেজিতে কঠিন কঠিন প্রতিশব্দ প্রয়োগে প্রকাশ করেছেন। জনি কিছুক্ষণ মন খুলে হেসে নিল। তারপর কাল্পনিক রোজ আপুর নামে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখতে বসল। কাবার্ড থেকে প্রেমপত্র লেখার রঙিন কাগজের প্যাড বের করল। হাতের লেখা যেন না মেলে সেজন্য লেখার ধরণ পরিবর্তন করা লাগে। একই অক্ষর যেন একেক জায়গায় একেক রকম না হয় সেজন্য পরিবর্তিত অক্ষরের একটি বর্ণমালা আগেই কাগজে লিখে রাখা আছে। সেই বর্ণমালা দেখে দেখে খুবই সাবধানতার সাথে লিখে ফেলল চিঠির উত্তর। এরপর সন্তর্পণে চিঠিটি ভাঁজ করে হলুদ খামে ভরে বন্ধ করে দিল মুখ। এরপর টেবিলের উপর পলিথিনের যে টাল্ক পেপার থাকে ওইটার উপর জেল কলম দিয়ে আঁকা হল গোল পোষ্ট অফিসের সীল। প্রথমে একটা কাগজ নিয়ে ওটার উপর থেকে ছাপ নিয়ে ঝাপসা করা হল কালি। এরপর আসল খামটা নিয়ে পলিথিনের উপর চাপ দিয়ে পোষ্ট অফিসের মত ঝাপসা কালির সীল লাগানো হল। সব শেষে কেটে ফেলা হল খামের মুখ। ব্যাস, কাজ শেষ। এখন শুধু এক সপ্তাহ অপেক্ষা। সপ্তাহ খানেক পর নাইট প্রেপ থেকে ফিরে চিঠি এসেছে কিনা দেখার নাম করে হাউস বেয়ারা মইদুল ভাইয়ের কাছে থেকে সবগুলো চিঠি নিল জনি। এরপর আস্তে করে চিঠির বহরে যোগ হল আরও একটি নতুন চিঠি, রঙিন চিঠি।

মাশরাফি ভাই উত্তর দিয়েছিলেন। জনি আবার চিঠি লিখেছিল। এভাবেই দেখতে দেখতে বয়ে গেল সময়। জনি ভেবেছিল মাশরাফি ভাইরা যেদিন কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবেন, বিদায়বেলায় তাকে বলবে যে রোজ আপু বলে কেউ নেই। পরে ভেবেছিল, কি দরকার? বদ্ধ কলেজ জীবনের কল্পনার ক্ষণিক মধুর স্মৃতি কেউই জীবনের পুঁজি করে বয়ে বেড়াবে না। তাহলে খামোখা এই রঙ্গরসাত্মক কাল্পনিক শালা দুলাভাইয়ের সম্পর্কটা ভাঙার দরকার কি। বাইরের স্কুল কলেজে ছেলে মেয়েরা গন্ডায় গন্ডায় প্রেম করেও যে উচ্ছ্বাসের সন্ধান কোনদিন পায় না, অপরিচিতার দু লাইনের চিঠি সেখানে ক্যাডেটের মনের সাগরে সাইক্লোন তোলে। বইয়ে পড়া সতী, দেবী, দিপা, মাধবিলতা, সাবিত্রী আর রুপাদের মুখ উঁকি দিয়ে যায় সেই চিঠির ভাঁজে।

জনিরাও একদিন কলেজকে বিদায় দিয়ে চলে গেল। বহুদিন পর একবার দেখা হয়েছিল মাশরাফি ভাইয়ের সাথে। জনি ভেবেছিল মাশরাফি ভাই তাকে চিনতে পারবে না। ক্লাস সেভেনের জুনিয়রকে কারও মনে থাকার কথা না। কিন্তু জনিকে অবাক করে দিয়ে মাশরাফি ভাই সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিরে তোর রোজ আপু কেমন আছে?

৫,৭৭০ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “একজন রোজ আপু”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

    তোমার রোজ আপুর গল্প শুনে আমারও এমন এক পিটুল ভাইয়ের গল্প মনে পড়ে গেল। আমার ব্লগে সেই গল্প বলবো তোমাদের। খুব ভাল লাগলো তোমার লেখাটি। কলেজের ছোট ছোট সব ঘটনাগুলো নিয়ে লিখতে থাকো, ভাইয়া। আমার শুভাশীষ জেনো।

    জবাব দিন
  2. ধন্যবাদ, আপা।
    এখনও ভাবলে অবাক লাগে ক্লাস সেভেনে থাকতে ক্লাস টুয়েলভের ভাইয়ের সাথে এই রকম মশকরা করার দুঃসাহস কিভাবে হত, তাও আবার স্বয়ং কলেজ প্রিফেক্টের সাথে।
    নাহ, তখনকার দিনগুলো আসলেই অনেক মজার ছিল।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সেলিম রেজা (০২-০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।