দত্তক

আমি অনেক ছোট । আমার বয়স তিন বছর। কিন্তু আমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। আমরা থাকি শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি বহুতল ভবনের তিন তলায়। শহরে থাকলেও আমাদের পরিবার কিন্তু যৌথ পরিবার। সকালের আলো ফুটতেই কাজিনরা সবাই চলে আসে বড় হলরুমটাতে। বসে খেলাধুলা আর চিৎকার চেঁচামেচির আসর। রীতা খালামনিই আমাদের সবচেয়ে বেশী আদর করে। আমাদের খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়ায় আবার শাসনও করে। সারাটা দিন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। এসময় আমার মন খুব ভাল থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা যতই এগিয়ে আসতে থাকে আমার মন খারাপ হতে থাকে। আমার খুব কান্না পায়।

মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক আসেন আমাকে নিতে। গাড়িতে মাঝে মাঝে এক ভদ্র মহিলাও থাকেন। আমি পেছনের সীটে মুখ নিচু করে বসে থাকি। আমি মেনে নিতে পারি না যে, বাসায় অনেক ছেলে মেয়ে থাকলেই কেন কাউকে দত্তক দিয়ে দিতে হবে। তাও কিনা শুধুমাত্র রাতের জন্য। মহিলা আমাকে আদর করার চেষ্টা করেন। আমার অস্বস্তি লাগে। চুপচাপ বসে বসে আমি উনাদের কথা শুনি। এরই মধ্যে আমি তাদের অনেক কিছুই জেনে গেছি। ভদ্রলোক সরকারি হাসপাতালের ডিগ্রীধারী মস্ত বড় ডাক্তার। আর ভদ্র মহিলা কয়েক বছর ধরে ব্যাংকে চাকরি করেন। তার সামনে নাকি এখন প্রমোশনের মুলা ঝুলছে। কাজের চাপে তাই মাঝে মাঝে বাসায় ফিরতে রাত হয়। তখন ডাক্তার সাহেব একাই নিয়ে আসেন আমাকে। সন্ধ্যার পর পরই আবার বদ্যি মশাই বাসার পাশের চেম্বারে গিয়ে বসেন।

বদ্যি মশাইয়ের বউ রাতের বেলা আমাকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত জুন ক্লোজিং এর সামারি, অডিটের হিসাব ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে তখন আমি নিজের মনে সময় কাটাতে পারি। রোগী সমাজের কল্যান সাধন করে বাসায় ফিরে ডাক্তার বাবু মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলেদের মত পড়তে বসেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞ্যানার্জন নাকি বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে। আমি খুব নিবিড়ভাবে উনাদেরকে পর্যবেক্ষণ করি। শত বিরক্তি সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ইনাদের জন্য করুনা হয়। তারা হয়ত জানে না যে, আমি তাদের চেয়েও অনেক বুদ্ধিমান।

আসে ভোর। শেষ হয় আমার আংশিক দত্তক জীবন। ভদ্র মহিলা ব্যাংকে যাবার আগে নামিয়ে দিয়ে যায় আমাকে। আমি ফিরি আপনালয়ে। মিলি শৈশবের উচ্ছ্বাসে। হাটি হাটি পা পা করে দম্ভ বিলাই পৃথিবীময়। ক্রমে ফিকে হয়ে আসে রাতের স্মৃতি। ভুলে যাই ব্যাংক, ভুলে যাই হাসপাতাল, ভুলে যাই কর্মব্যস্ত অফিস আদালত যত। খালামনির কোলে আদর খুঁজি। খেলার সাথীদের সাথে সুর মিলাই হর্ষের ঐকতানে। এভাবেই শেষ হয় দিন, থেমে যায় স্বপ্ন। আমি আবার ফিরি আমার চিরাচরিত দত্তক জীবনে। প্রমোশনের আনন্দ দেখি, চেম্বারের লক্ষ টাকা রোজগার দেখি, নতুন ফ্ল্যাটের স্বপ্নের আলো চোখের তারায় চিকচিক করতে দেখি, দেখি আভিজাত্যের স্বপ্নচূড়া।

এভাবেই দিন যায়। বড় হই আমি। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই হোচট খেলাম আজ। এতদিন ভাবতাম সবকিছু আমি জানি, সবকিছু আমি বুঝি। মুহূর্তে ভুলুন্ঠিত হল আমার অহমিকার অট্টালিকা। অতি অপ্রিয় এক সত্যের মুখোমুখি আজ আমি। আজই জানতে পারলাম যারা আমাকে দত্তক নিয়েছেন বলে ভাবতাম, তারাই আমার বাবা মা। আর যে হলরুমটাকে আপনালয় বলে ভাবতাম ওটা ডে কেয়ার। রীতা খালামনি হচ্ছে ডে কেয়ার এর কর্মী। কর্মব্যস্ত বাবা মা অফিসে যাবার আগে আমাকে ডে কেয়ারে রেখে যেত আর সন্ধ্যার সময় নিয়ে যেত। এখন আমি বড় হয়েছি। এখন আমাকে ফিরে যেতে হবে তথাকথিত নিজের বাড়িতে। শুধু আমি নই, আমার মত হতভাগা ডে কেয়ারের সকল শিশুই। জীবনে স্বাচ্ছন্দ আনতে গিয়ে আমার বাবা মা সুখকেই বিসর্জন দিয়েছেন। ক্যারিয়ার আর অর্থের নিচে চাপা পড়ে গেছে আদর স্নেহ।

ডে কেয়ারের স্বজনদের ছেড়ে আমি আজ চলে যাচ্ছি আদর স্নেহহীন একটা পরিবারে। এটাকে হয়ত পরিবার বলা যায় না। তারপরও সেখানেই বড় হব আমি। স্কুলে যাব। অনেক পড়াশোনা করব। অনেক বড় চাকরি করব। মিশে যাব জীবন নদীর ব্যস্ত স্রোতে। বাবা মা হয়ত সারা জীবন ব্যস্ত থাকতে পারবে না। লাগাম টেনে ধরবে বয়স। তখন তাদের দরকার হবে নিবিড় পরিচর্যা আর আমার কাছ থেকে একটু সময়। কিন্তু তখন আমার ব্যস্ততার ব্যবসা থাকবে তুঙ্গে। সময়ের একাউন্ট থেকে গুনে গুনে বিনিয়োগ করা থাকবে প্রতিটি সেকেন্ড। বাবা মার পরিচর্যার জন্য দরকার হবে রীতা খালামনির মত কাউকে। সমবয়সী আরো কিছু সঙ্গী। আর একটি বড় হলরুম।।

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।