রেল লাইনের মত স্বপ্ন (পর্ব ১-৪)

পর্ব ১

জীবন আর স্বপ্ন কেমন যেন রেললাইনের মত মনে হয়। পাশাপাশি চলছে। কিন্তু মিলছে না। আবার যতদূর চোখ যায়, মনে হয় মিলছে! এই মিললো বলে! মাঝে মাঝে মনে হয়, মাঝখানের কাঠের পাটাতনগুলো খুলে জীবন আর সপ্ন এই দুটোকে, জোর করে মিলিয়ে দিই। ধূর! কি সব এলোমেলো ভাবনা ভাবছি!

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দেয়ালে তাকিয়ে আছি। আমার অনাগত শিশুটির কথা ভাবছি। আর মাত্র ২ মাস হলেই আমার কোলে ছোট্ট একটা শিশু দুলুনি খেতো। লোকে বলে, জিজ্ঞাসা করতে নেই। কিন্তু আমি ভেবে রেখেছিলাম ডাক্তারের কাছি গিয়েই আগে জিজ্ঞাসা করব, ” ছেলে না মেয়ে?” ছেলে মেয়ে না জেনে কি আর নিজের হাতে জামা বানানো যায়! অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে নামাযে বসে দূয়া করতাম যেন মেয়ে হয়। মেয়ে ছাড়া কি আর সাজানো যায়! ঝুটি করে মাথায় লাল নীল ফিতা বাধা যায়! আমার শখ ছিল, নিজের কেনা খেলনা দেব আমার ছেলে/ মেয়ে কে। কিন্তু শরীরটা এতো বেশি খারাপ হয়েছিল যে, নতুন পাওয়া চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই নেসলের কর্নফ্লেক্স খেয়ে খেয়ে বহু ফ্রী খেলনা জমিয়েছিলাম।

ভরাট কন্ঠ ভেসে এল আমার পাশে, “এখন কেমন লাগছে রুহি?” ডাক্তার সাহেব এলেন রুটিন চেক করতে।

আমিঃ ভালো। কিন্তু সব কিছু এত হলুদ লাগে কেন?

ডাক্তারঃ সব ঠিক হয়ে যাবে

এতো ঝড়…না ঝড় নয়, বলা উচিত সুনামি। এত সুনামি পেরিয়েও আমার কব্জিতে এখনো প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়। জ্ঞান ছাড়া ১ দিন সহ আজ ২১ দিন হল, বিস্ময়কর এই বেঁচে থাকাকে অনুভব করছি।

কোথা দিয়ে সকাল হয়, বিকেল হয় এখনো তেমন ভালো করে বুঝি না। গলার পাশে কেমন যেন চিনচিনে ব্যাথা। হাত নাড়তেও কষ্ট। নার্স এসে খাওয়ায়, কাপড় বদলে দেয়। আগে ডাক্তার নার্স আর সুই। এসব দেখলে, আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এতোদিন হল নিজের মুখটা দেখিনি। এই হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে আমাকে কেউ উঠতেই দেয়না। আমার পা গুলোতে কোনই ব্যাথা নেই, তাও দেয় না। আমার সাধের চুলগুলো জট পেকে ঝাউগাছ হয়ে গেছে।

রফিকঃ “ঘুম ভেঙ্গেছে?”

পরিচিত কন্ঠটা কানে এল।

আমিঃ কুম্ভকর্ণের ঘুম এত সহজে ভাঙ্গে?

রফিকঃ ও তো ছেলে ছিল, তাই ভাংতো না। আপনি তো মেয়ে

আমিঃ মেয়ে না, মহিলা

এই মানুষটাকে চিনি মাত্র ২১ দিন হল। কিন্তু মনে হয় যেন কত বছরের চেনা। এত ভালো মানুষ আমি কোনদিন দেখিনি। আমার স্বামীও এমন ভালো না।

পর্ব ২

প্রথমে হাসপাতালের সবাই ভেবেছিলো রফিক সাহেবই আমার স্বামী। এতো কষ্ট করছে বেচারা আমাকে নিয়ে। দিন নেই, রাত নেই পাশে বসে থাকে। যখন যা লাগে, এনে দেয়। নিজের অফিসে যায় না আজ ২১ দিন হলো। কি যেন, তার চাকরিটা আছে কি না! তিনি কথা বলেন খুব কম।

আমিঃ আপনার কি খাওয়া হয়েছে? আসেন একসাথে নাস্তা করি।

রফিকঃ আমি খেয়ে নিয়েছি, রুহি। এখন আপনি খেয়ে নেন।

চশমাটার জন্য পরিচিত এই মুখটাকে কেমন যেন গম্ভীর দেখায়। আজকে আমার খুব মন চাচ্ছে, তার চোখের চশমাটা সরিয়ে একবার দয়ালু চোখ দুটো দেখি।কিন্তু কি ভাববে এই লোকটা?

কিছু বোঝার আগেই কিভাবে যেন আমার হাতটা উনার চশমাটা খুলে নিলো। কি নিষ্পাপ এক জোড়া চোখ!এতদিন হলো প্রয়োজন ছাড়া আমার দিকে একবারও তাকান নি।একবার আমার হাতটাও ধরেন নি।কিন্তু আজ ধরলেন, কারন চশমা ছাড়া উনি কিছুই দেখতে পান না।

কিন্তু হাত ধরলেও লাভ হলো না। চশমাটা মাটিতে পড়ে গেছে। ভাব্লাম চশমাটা উঠিয়ে দিই। একটু চেষ্টা করছি নামার, অমনি কিছু বোঝার আগেই উলটে পড়ে গেলাম। আমার মনেই ছিল না যে, আমার ডান পা টায় ব্যান্ডেজ করা। রাবার বুলেটের আঘাতে পায়ের ভীষণ বাজে দশা মনে হয়। আমি অবশ্য দেখি নি, ধারণা করে নিয়েছি।যাই হোক, তাকিয়ে দেখি মাটিতে পড়িনি। সময়মত আমাকে দুই হাতে ধরে নিয়েছেন রফিক সাহেব।এভাবেই সামলে যাচ্ছেন আমাকে দিনের পর দিন।অথচ আজ ২১ দিন হয়ে গেছে, তাও আমার স্বামী একবারও খুজতে আসেনি আমাকে।

পুরনো দিনের কথা ভেবে মন কেমন করে উঠলো।আজ থেকে ৫ বছর আগে আমার স্বামী রাতুলও আমাকে এভাবেই কোলে নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকেছিলো।ছোট একটা ফ্ল্যাটে নতুন সংসার ছিল আমাদের দুইজনের।ভালোবাসায় ভরা ছিলো আমাদের জীবন।একসাথে বেড়ানো, খাওয়া, গল্প করা, টিভি দেখা। ঘর সামলাবো বলে নিজের চাকরীও ছেড়ে দিয়েছিলাম।

ভালোই চলছিলো গুছানো জীবন।কিন্তু আমার ছেলে সন্তান হবে এটা জানার পর থেকেই কেমন যেন সব বদলে গেল। এত খুশির খবর কিন্তু রাতুল খুশি নয়।তার মেয়ে সন্তান চাই ই চাই।খুব মন খারাপ করে থাকতো।আমিও কেমন হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন রাতুল খুব রাগ করলো

রাতুলঃ রুহি, এতো কিছু পারো একটা মেয়েতো দিতে পারলে না

আমিঃ রাতুল, ছেলে মেয়ে এসব প্রাচীন ভাব কেন করছো? একটা সন্তান হবে আমাদের এটাই কি খুশির কথা নয়?

রাতুলঃ না, খুশির কথা নয়!

আমিঃ আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছা করে, কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে

রাতুলঃ যাবে কোথায় শুনি? বাবা মার বাড়ী? ওই রাস্তাতো আগে থেকেই নেই! তোমাকে বিয়ে করে আমার শশুরবাড়ীও জোটেনি ভাগ্যে!

পর্ব ৩

বাবা মা নেই বলে, আমার শিশুকালের তেমন মজার কোন গল্পও নেই। বড় হয়েছি কার কাছে, সেটাও বিরাট ভাবনার বিষয়।বাবার কোন ভাই বোন ছিল না। মায়ের দুই বোন থাকতেন কানাডায়।ভালোবেসে বিয়ে করার জন্য, আমার নানাবাড়ীর সাথে মায়ের কোনই যোগাযোগ ছিল না। এমনকি আমার জন্মের খবর পাঠানোর পরও নানাবাড়ীর কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। আর তাই এটাও তারা কেউ জা্নতে পারেননি যে, আমি জন্মের পরই আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।

দাদা বলেছিলেন, মা যাবার পরই বাবা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিলো।কথা বলা, খাওয়া সব ছেড়ে পথে পথে ঘুরত। আমাকে দেখলেই বাবা রেগে যেত।একদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম,আর বাবা এসে আমার গলা টিপে দিয়েছিল।মৃত ভেবে দাদা দাদী অনেক কেদেছিলেন। কিন্তু আমাদের বাসার বুয়া রহিমা খালাই একমাত্র আমাকে বুকে জড়িয়ে বুঝেছিলেন, আমি তখনও বেচে ছিলাম।খুব কষ্ট করে দম ফিরিয়েছিলেন ডাক্তার দাদু।

খুব বেশি দিন বাবা বাচে নি।বৃদ্ধ দাদা দাদী কোনমতে আমাকে বড় করেছেন।তারপর এস সি দেবার আগেই দাদীর হাতের মুরগীর ঝোল আর খাওয়া হল না।দাদী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমাকে ঢাকা ভার্সিটির গেটে পৌছে দেবার সপ্নটাও দাদার পূরণ হয়নি।ভার্সিটি ভর্তির আগেই দাদীর পথ ধরে দাদাও জীবনের মায়া কাটালেন।রহিমা খালা আর আমি মিলে আমাদের ছোট্ট পরিবার।

নতুন ল্যাপ্টপ কিনতে গিয়ে পরিচয় রাতুলের সাথে।আমার বন্ধু রাতুল একটা মাঝারী দরের ফার্মে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছে।আমি কলা বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। পড়েছি উইমেন স্টাডিসে।বড় বড় এনজিও ফেলে, কেন আমি বাচ্চাদের একটা স্কুলে চাকরি নিলাম, এটা কেউ বোঝে না; এমন কি আমিও না।কিন্তু ওই বাচ্চাগুলোকে দেখে আমি কেমন একটা মায়ায় আটকে গিয়েছি।

আমার ধারণা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হলেই মানুষ গম্ভীর হয়। কিন্তু রাতুল একেবারেই আলাদা। আমার মত বাচালের চেয়েও বেশী কথা বলে।চটপট সিদ্ধান্ত নিতেও ওর বেগ পেতে হয় না। সব সমস্যার আশ্চর্য সমাধান থাকে তার কাছে।মাত্র ৬ মাসের মাথায় আমাকে রাতুল কিভাবে যেন বিয়ে করে ফেলল।আর নিজের বিশাল বাড়ি ভারাটের হাতে ফেলে, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে যেতেও রাজী করে নিল। আশ্চর্য জাদুর ক্ষমতা তার হাতে।কিছুদিন পর স্কুলের ছোট বাচ্চাগুলোর মায়াও হারিয়ে গেল কোথায়!আকাশী রঙ এর ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতেই আমার বিশাল নীল আকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।

পর্ব ৪

সিনেমার ধনী বাপের কন্যাদের মত আমিও চুলা পর্যন্ত জালাতে পারি না, এমনটা নয়।বরং, দাদীর সাথে থেকে থেকে আমি বেশ ভালোই রাধতে শিখেছি। রাতুলের খাবার খাওয়ার চেয়ে দেখার শখ বেশী ছিল। দুইজন মাত্র মানুষ। অথচ টেবিল ভরা খাবার রাখতে হত।সবচেয়ে পছন্দ তার গরুর মাংস।রাত নেই, দিন নেই। যখন মনে চাবে রাধতে হবে। কিন্তু যখন থেকে আমি মা হতে চলেছি, রান্নার গন্ধ পেলেই আমার বমি লাগে।তাই রাতুলের বেশ কষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু এই মানুষে ভরা শহরে, কাজের মানুষ পাওয়া কঠিন। তাছাড়া রাতুল বুয়ার রান্না খেতেও চায় না।খুব কষ্ট হত আমার, কিন্তু কিছুই বলি না কোনদিনই।

একদিন নাস্তা বানাতে গিয়ে আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।

রাতুলঃ কি হয়েছে?

আমিঃ কিছু না।

রাতুলঃ ও আমাকে বলবে না? ছেলে না হতেই এই দশা? হলে কি করবে? আমাকে চিনবে?

আমিঃ কি সব বাজে কথা বলছো?

রাতুলঃ আমাকে ভালো না লাগ্লে আগে থেকেই বলে দিও।

আমিঃ ছেলেটা তোমার আমার দুইজনের। তুমি কি ছেলেকে ভালোবাসবে না?

রাতুলঃ ছেলে তোমার। মেয়ে হলে আমার হত

রাগ করে অফিস চলে গেল রাতুল। আমিও কাদতে কাদতে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। চারপাশাটা কেমন যেন ঝাপ্সা লাগছিল। হঠাত কি যে শব্দ! মনে পড়ল, হরতাল চলছিল তখন। আমি এই তুমুল অবস্থায় ঘরের বাইরে এসেছি! থাক, কি যায় আসে! পৃথিবীতে আমাকে কেউ আর ভালোবাসার নেই।

কারা যেন দৌড়াচ্ছে।পুলিশের গাড়ী রাবার বুলেট ছুড়ছে।বুঝে উঠার আগেই কোথাও বোমা ফুটলো। শব্দে কানে তালা লেগে গেল। কোথায় যাব, চারপাশে ধোয়া আর ধোয়া।পায়ে কি যেন ঢুকে গেল। শাড়ির গায়ে রক্ত কিসের? সেকি! আমার গাল বেয়ে রক্ত পড়ছে! তবে কি বোমা আমার গায়ে লেগেছে? আমার পেটে যে সন্তান! কি হবে আমার। সবার মত আমি দৌড়াতে পারব না। আমাকে এগিয়ে নেবার মত কোথাও কেউ নেই।আমি মাটিতে পড়ে গেছি। উঠিয়ে নেবার কেউ নেই।ওইতো পুলিশের গাড়ী এগিয়ে আসছে বন্দুক তাক করে। কোথায়, কিভাবে দৌড়াবো আমি!

মন শক্ত করে উঠলাম খোড়াতে খোড়াতে।সামনে চার রাস্তার মোড়।মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ৫/৬ টা গাড়ী। বিশাল বিশাল পানির পাইপ লাগানো ওগুলোতে। মনে হয় গরম পানি ছাড়বে।বন্দুক তাক করে তাকিয়ে আছে সব পুলিশ। আর আমাকে দেখে আরো অবাক হয়ে সরে হাত নেড়ে সরে যাবার ইশারা করছে।আমার সন্তান কি জন্মের আগেই গুলির আঘাতে জীবন হারাবে? আমার গায়ে গরম পানি দিলে, আমার ছেলেটা কি বাচবে? কতটা গরম পানি দেয়? আমি কি ঝলসে যাব?

আমার পায়ে, হাটুতে রাবার বুলেট ঢুকে অবিরাম ব্যথা করছে। কোথা থেকে যেন গায়ে অসুরের শক্তি এল। উঠে দাড়ালাম এক পায়ে ভর করে। আরেকটু রাস্তা পার হলেই বড় সপিং মল। ওখানে নিশ্চয়ই কেউ আমাকে সাহায্য করবে। প্রায় পেরিয়ে গেছি চার রাস্তার মোড়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।গরম পানির তীব্র ছোয়া লাগলো সারাটা শরীরে। পুড়ে গেলাম আমি! হায় আমার সন্তান! দিশেহারা হয়ে কতদুর এগিয়েছি কে জানে!

১,৮৯৪ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “রেল লাইনের মত স্বপ্ন (পর্ব ১-৪)”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।