ইস্তানবুলের ডায়েরী………কিছু স্মৃতিচারণ

স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা… নাকি দুটোই…অনেকের মত আমিও হাতড়ে বেড়াই এই প্রশ্নের না জানা উত্তরটি। হয়ত সেই অজানা উত্তরের আশায় হাতড়িয়ে বেড়াতেই কেটে গেছে সময়ের গর্ভ থেকে নামবিহীন ২ টি বছর। খুলে দেখা হয়নি সেই পুরনো ডায়েরীর মলাটখানা। হয়তবা তারই আবর্তে ঢাকা পড়ে গেছে সেই অভিজ্ঞতার পাতা গুলো, জীর্ণতা ছেয়ে বসেছে প্রতিটি কোণে। আজ হটাৎ করেই অজানা এক বাস্তবতার বুক চিরে আবারো সেই ডায়েরীর মলাটখানায় হাত রাখলাম। ঝেরে ফেলতে চাইলাম সেই জীর্ণতা আর মেলে ধরতে চাইলাম ধুলোয় ঢাকা পরে থাকা সেই ইস্তানবুলের অভিজ্ঞতার ডায়েরীকে।

আজকের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে অভিজ্ঞতা নয় বরং কিছু কৃতজ্ঞতার কথা সবাইকে বলার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালাব। জানিনা কতটুকু সফল হব, কিন্তু কিছু ব্যক্তিকে স্মরণ করবো, যাদের জন্যে আজ ও আমি নিজেকে গর্বিত বলে মনে করি। যাদের হাত ধরেই এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমার ছোট সংগ্রামী জীবনের পথচলা। দেশ, মাটি, মাতৃকা সব ছেড়ে যখন এক অজানা ভবিষ্যতের আশায় স্বপ্নিল ইউরোপের দ্বার বলে খ্যাত তুর্কির বুকে পদচারণ করলাম, তখন অজানা এক ভাবনা, এক ঘোরের ভীতরে অজানা এক ভয়ের উঁকি অনুভব করছিলাম। পারব তো!! কি যে হয়ে যায়। ঠিক তখনই ইস্তানবুলের মাটিতে আমাদের স্বাগত জানালেন ইফতেখার ভাই আর জাহিদ ভাই। এমনই দু জন মানুষ যাদের দেখলে শত হতাশা, শত বাধা বিপত্তির মাঝেও আশার আলো যে কারো মনেই উঁকি দিয়ে যাবে। ফিরে আসবে নতুন প্রাণ, নতুন উদ্যম। মনে জাগবে নতুন করে বাঁচার আশা। এই দুজন মানুষকে নিয়ে আরো কিছু স্মৃতিচারন করবো পরবর্তী অংশে। কিন্তু যে মানুষটির কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন আমাদের তুরস্কের সবার প্রাণপ্রিয় বরিশাল ক্যাডেট কলেজের সোহাগ ভাই যাকে নাকি সবাই শরীফ ভাই বলে ডাকে আজকাল বাংলাদেশে। যিনি তুর্কীদের কাছে পরিচিত গাজী নামে। আর আমার কাছে যিনি পরিচিত গুরু নামে। আজ শত-হাজার মাইল দূর থেকেও আপনাকে আগে জানাই স্যালুট। একজন মানুষ, যার একটি কথাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এটাকে অনেকটা ক্রিকেটীয় ভাষায় ইনসুইঙ্গার বলের মত আমার জীবনে চিন্তা করা যেতে পারে।তুরস্ক জীবনের প্রথমে প্রায় সব ছাত্রই একটি সমস্যায় পরে থাকে। সেটি হল, কোন বিষয়ে পড়ব আর কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ব।তো আমিও হয়ত তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। কিছুটা চিন্তার রেখা, কিছুটা ভীতি নিয়েই চলছিল প্রথম দিকের দিনগুলো।ক্যাডেট কলেজের বড় ভাই হওয়াতে ভাইয়ের বাসায় প্রায়ই আড্ডা মারতে যেতাম। আর গুরু এমনই এক মানুষ, যিনি অসম্ভব ভাল রকমের আড্ডাবাজ, আমুদে এবং বুদ্ধিদীপ্ত একজন ব্যক্তিত্ব। কথায় কথায় একদিন বলে ফেললাম গুরুকে আমার এই ইউনিভার্সিটি বিষয়ক সমস্যার কথা। শোনামাত্র গুরু বলে দিলেন, আমি কি চাই… খুব ভাল ইউনিভার্সিটি আর ৮ বসরের দীর্ঘ ছাত্রজীবন নাকি প্রথমদিকের (প্রথম ৫ টার একটা) ইউনিভার্সিটি এবং ৪ বছরের ছাত্রজীবন। গুরুকে বললাম দ্বিতীয়টাই যথোপযুক্ত। শুনে গুরুর সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এবং আমার পথচলা। আজও আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে গুরু আমাকে কত সহজেই না সেইদিন চিন্তামুক্ত করেছিলেন। এত ও গেল কেবল একটি ঘটনা, এর বাইরে রয়েছে জীবনকে কিভাবে উপভোগ করতে হয়, কিভাবে সকল সমস্যাকে হাসি মুখে মোকাবেলা করতে হয় সেই শিক্ষা। এখনো মনে পরে যায়, রাত বিরাতে এক সাথে বসে ভাইয়ের সাথে রাতভর আড্ডা দেয়া, রান্না করা, ঘুরতে যাওয়া আর কত কি… খুব কম সময়ে কিভাবে যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায় সেই শিক্ষার হাতেখড়ি ক্যাডেট কলেজে হলেও সেখানে অভিজ্ঞতার তুলির আঁচড়টা গুরুরই দেয়া। একজন মানুষ যাকে দেখলে সব সময়ই মনে হবে আমিও পারব, একজন মানুষ যার রয়েছে যে কোন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর মত গুণ, যার মাঝে বিদ্যমান এক অদ্ভুত পরিপূর্ণ চঞ্চলতা, হাস্য রসিকতা আর বাকপটুতা। গুরু, আপনার জন্যে রইল হাজারো শুভ কামনা।আজ শত-হাজার মাইল দূরে বসে আপনাকে প্রচণ্ড মিস করতেছি।

ইফতেখার ভাই…রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের কলেজ প্রিফেক্ট ছিলেন। একজন মানুষ যিনি একসাথে মেধাবী, পরিশ্রমী,ধৈর্যশীল এবং হার না মানা এক ব্যক্তিত্ব। এই মানুষটিকে যতবারই দেখেছি নতুন করে পথ চলার ইচ্ছাশক্তি খুঁজে পেয়েছি। একটি ছোট ঘটনার কথাই বলি। যখন দুর্বোধ্য ভাষার কারনে নিজের চলার পথটাকে অনেকটা হিমালয়ের মত মনে হচ্ছিল, মন চাইছিল সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাই না আগের জায়গায় তখন ইফতেখার ভাই বলেছিলেন “ক্যাডেট মচকাবে তবু ভাঙবে না। হাজারো বাধা পাবে কিন্তু লক্ষ্য ছাড়বে না”। ভাইয়ের ওই এক কথা আজও কানে বেজে চলেছে। জীবনের প্রতিটি পদে যখনি বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি তখনি ভেবেছি এই একটি কথা। ব্যাস, সব সমসসার সমাধান। ভাই মানুষটা অসম্ভব রকমের রসিক মানুষ ছিলেন।আর ২৯ খেলার ব্যাপারে ছিলেন সব চেয়ে প্রানোজ্জল ব্যক্তিত্ব। আজও মনে আছে, ভাই ২৯ খেলতেন ঘড়ি ধরে। নইলে ওই ২৯ খেলা আর শেষ হত না। চলতেই থাকত… এ যেন এক বিরতিহীন যাত্রা। খেলার কথা আসতেই মনে পড়ে গেল যে ইফতেখার ভাই আর সোহাগ ভাই দুইজন ছিলেন পুরাই দুটি ভিন্ন ব্যক্তিত্ব (খেলার ব্যাপারে)। ইফতেখার ভাই খেলতেন টেকনিক দিয়ে আর সোহাগ ভাই খেলতেন ভাগ্য বিশ্বাস নিয়ে। অনেক সময় দেখা গেছে সোহাগ ভাইয়ের হাতে কল দেয়ার মত কার্ড নাই অথছ ভাই ২৪ পর্যন্ত ডেকে বসে আছেন। ব্যাস, এখন খেল সবাই। ৭ কার্ডের রঙ ডেকে বসে আছেন ভাই।এরপর তো সোহাগ ভাইয়ের বিশেষ গুণ তো আছেই। কিভাবে জানি উনি অন্যদের কার্ড দেখে ফেলতেন। তারপর তো আর কথাই নাই। পুরো খেলাই এমন ভাবে বদলিয়ে দিতেন তা আর কি বলব। ইস্তানবুলের জীবনে ইফতেখার ভাইয়ের বাসা ছিল আমাদের জন্যে স্বর্গীয় এক জায়গা। আর রেখা ভাবী, ওনার তুলনা করার মত শব্দ এখনও আমার শব্দভাণ্ডারে জমা পড়ে নি। এক কথায় অসাধারণ। কত বার যে হাজির হয়েছি হুটহাট করে ভাইয়ের বাসায়। করেছি কতই না বিরক্ত ভাই আর ভাবীকে। হাসিমুখে আমাদের সাথে ছিলেন তারা সব সময়। আজও সেই কথা গুলো ভেবে পুরনো দিনগুলোতে ফিরে যেতে মন চায়। ভাই আর ভাবীকে কি বলে যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবো সে ভাষা খুঁজে পাওয়া আসলেই কঠিন। ভাই আর ভাবী আপনারা ভাল থাকবেন সারাজীবন এই কামনাই করি।

জাহিদ ভাই… হ্যাঁ, উনি ক্যাডেট নন, তবে আমার দেখা প্রাণোচ্ছল, উদ্যমে ভরপুর মানুসগুলর মধ্যে একজন। ছিপছিপে গড়ন, মাঝারী উচ্চতা আর মুখে অমায়িক এক হাসি। অসম্ভব বাকপটু এবং মিশুক স্বভাবের একজন। ইস্তানবুলে ইফতেখার ভাই চলে যাওয়ার পর আমাদের ব্যাচেলর গ্যাংদের আড্ডা মারার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল জাহিদ ভাইয়ের বাসা। এমনই এক মানুষ যার সাথে আড্ডা মারার পর মনে হবে আহা জীবনটা কতই না আনন্দের। যেখানে তেতো বলে কিছু নেই। ভাইয়ের অসম্ভব ভাল রান্নার হাট আর গানের গলা। এখন মনে পড়ে যায়, ঈদের দিনগুলোতে নদীর পাড়ের সেই রাতভর আড্ডা, গান আর জীবনকে উপভোগ করার মুহূর্তগুলো। শুনেছি, ভাই অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে তার সাধের ডিগ্রীখানা পেয়েছেন এবং দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই বলব আপনার সাথে  ছোট ভাই হিসেবে কাটিয়েছি প্রায় সাড়ে ৪ টি বছর। ইস্তানবুলের জীবনে ছায়ার মত বড় ভাই, বন্ধু হয়ে ছিলেন।আপনি এমনই এক মানুষ যে হাসি রসে পূর্ণ , আড্ডাবাজ এবং অসম্ভব ভাল গায়ক, পাচক এবং একজন ভাল শ্রোতা। সময়ে অসময়ে কারনে অকারনে হুট হাট করেই হাজির হয়ে যেতাম আপনার বাসায়। রাতভর আড্ডা, দুঃখ হাসি ভাগা ভাগি এবং রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানো,চা খাওয়া এসব যেন নিত্ত নিমিত্ত ব্যাপার ছিল আপনার সাথে। এখন ও মনে পড়ে যায়, ইস্তানবুল ছেড়ে আসার আগে আপনার বাসায় কাটানো সেই দিনগুলো। এখন মনে আছে, আমার বিদায় বেলায় বলেছিলেন আবার দেখা হবে কোন এক দিন। সময়ের স্রোতে হাজারও চরাই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে আপনি স্বদেশে। হাতে নিয়ে সেই স্বপ্নিল ডিগ্রীখানা। জানিনা আবার কবে দেখা হবে ভাই, কিন্তু এটুকু বলতে দ্বিধা করব না যে আপনার প্রতি রইল এই ছোট ভাইয়ের অশেষ শুভ কামনা… যেখানেই যান, যে ভাবেই থাকুন না কেন আপনাকে সব সময় জানাই অশেষ সালাম… আবার ইনশাল্লাহ কোন একদিন দেখা হবে, হয়ত বা আবার ও আড্ডা হবে, আবার জমবে সেই besiktas এর পাড়ে চায়ের আসর…আবার ও আপনার সেই গান হবে…আর হবে সেই সোনালি দিনের স্মৃতি রোমন্থন…

আজ নাহয় ডায়েরীটা এখানেই সমাপ্ত করি…হয়ত আবারো হাজির হব কোন একদিন, কোন এক সময় আমারও সেই পুরনো জীর্ণ ডায়েরীখানা নিয়ে…

সে পর্যন্ত সবাইকে শুভেচ্ছা…

সায়খ

র ক ক

 

 

২,৭৪৮ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “ইস্তানবুলের ডায়েরী………কিছু স্মৃতিচারণ”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    আশা করি তোমার এই কৃতজ্ঞতার সংবাদ যেন পৌঁছে যায় উনাদের কানে। বিদেশের মাটিতে এরকম মানুষ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমার কপালে খুব একটা জুটে নাই। ভালো লিখেছো। লিখা চালিয়ে যেও কিন্তু! 🙂


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির ভাই, অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। ভাই, ইনশাল্লাহ লেখা চালিয়ে যাবো। কিন্তু কোরিয়ানদের ঠেলা খাওয়ার পরে আর কলম হাতে সহজে বসা হয়ে উঠে না। কিন্তু আশা রাখছি যে এবার চালিয়ে যেতে পারব।

      জবাব দিন
  2. রেজা শাওন (০১-০৭)

    সুন্দর লেখা। আমি লোক টা আজন্ম অকৃতজ্ঞ- সম্ভবত। তোর লেখা পড়ে, দেশের বাইরে এই দীর্ঘদিনে কেন কোন ধন্যবাদ লিস্ট বানালাম না, সেটা ভাবাচ্ছে। অবশ্য যাদের ধন্যবাদ জানানোর, এরা এসবের ধার ধারে না।

    সিসিবি তে লিখিস। আর হ্যাঁ, কোরিয়ার দিকে কুত্তার গোস্তের রেট কত?

    জবাব দিন
    • সায়খ (০১-০৭)

      আসলে বন্ধু কথা ঠিক বলেছ... ধন্যবাদ জানানোর জন্যে এসব লেখা লেখি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওটা মন থেকেই আসে।আর সিসিবিতে লিখতে ভালই লাগে। দেখা যাক এই যান্ত্রিক কোরিয়ানদের ভিড় ঠেলে কতদিন লিখতে পারি। আর ভাল কথা, এরা কুত্তা খাওয়া প্রায় ছাইড়া দিসে। মেলা দাম। প্রায় ৪০ ডলার (প্রতি কেজি)। এই হালারা চিমসা তো। টেকা বাইরায় না সহজে। তাই কুত্তার উপর চাপ কমায়ে দিতাসে। অবশ্য আমি এখনও রাস্তায় কোন কুত্তা দেখলাম না। আমি তো ভয়ে আসি যে কোন দিন না হালারা মানুষ খাওয়া শুরু করে। =))


      নিজে দেখুন এবং জানুন

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়খ (০১-০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।