কুংফু কারাতে

বাংলাদশের এমন কোন ছেলে আছে কিনা যে ফুটবলের পেলে আর মার্শাল আর্টের Bruce Lee র নাম শোনে নি কিংবা জীবনের কোন একটা সময়ে মনে মনে তাদেরকে দেবতা জ্ঞান (আক্ষরিক অর্থে নয়) করে নি তাতে আমার সন্দেহ আছে। অন্তত পক্ষে আমি যখন ঢাকায় আমার বাল্যকাল কাটাচ্ছি মাঠে ঘাটে মার্বেল, ডাঙ্গুলী আর ফুটবল খেলে তখন অবস্থা সেই রকমই ছিল।

মার্শাল আর্টের প্রতি সব সময়েই আমার একটা দূর্বলতা আছে। মারপিটে আমার কোন আসক্তি নেই। মার্শাল আর্টের আর্ট আমাকে মুগ্ধ করে। হাত পা চালানোর অভিনব সব কৌশল রপ্ত করে একজন ছোটখাট মানুষও যে কেমন শক্তিমান এবং ভয়াবহ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে Bruce Lee তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

Bruce Lee র বিখ্যাত সিনেমাগুলো অধিকাংশ মার্শাল আর্ট প্রেমিকরা অবশ্যই দেখেছেন। ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কতবার দেখেছি হিসেব নেই। ছোটখাট দড়ির মত পাকানো শরীরের একটা মানুষ সব ষন্ডা-পান্ডা গুলোকে পিটিয়ে ভর্তা করছে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাবার কি আছে?

ইদানীং একটা নতুন ছায়াছবি মুক্তি পেয়েছে Bruce Leeকে নিয়ে – বার্থ অব এ ড্রাগন। ছায়াছবিটা তরুণ Bruce Lee এবং আরেক কুংফু মাস্টার ওয়াং জ্যাক ম্যানের প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে উপজীব্য করে নির্মিত। Bruce Lee তখন সান ফ্রান্সিস্কোতে মার্শাল আর্টের স্কুল খুলেছে। ওয়াং জ্যাক ম্যান ছিল শাওলিন মং যে মাত্র চায়না টাউনে এসেছিল চীন থেকে। Bruce Lee র স্টাইল নিয়ে সন্দেহ পোষন করায় Bruce Lee তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আহবান করে। মাত্র জনা সাতেক মানুষের সামনে Bruce Lee র মার্শাল আর্টের স্কুলের ভেতরে দু’জনে এই ঐতিহাসিক লড়াইটা লড়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে। কে জয়ী হয়েছিল সেই যুদ্ধে তা নিয়ে দ্বিমত আছে। Bruce Lee অবশ্য নিজেকে জয়ী বলে ঘোষণা করে কিন্তু নিজের স্টাইলের উপযুক্ততা নিয়ে তার মনে সন্দেহ জাগে। তার পরই সে সৃষ্টি করে তার নিজস্ব স্টাইল জিত কুন ডু।

আমরা খুব ছোটবেলা থেকেই এই গল্প নানা জায়গায় শুনেছি এবং পড়েছি। যাইহোক, এই মুভিটি দেখার সুবাদে আমার বাল্য এবং যৌবনের বেশ কিছু স্মৃতি হড়হড় করে মনে পড়ে গেল। সেই স্মৃতিচারণ না করলেই নয়।

বেশ ছোটবেলায় দেখেছিলাম চাইনীজ বক্সার নামে একটি মুভি। খুব সম্ভবত তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়ি। সময়টা গুলিয়ে গেলেও মুভির প্লটটা এখনও  অল্প সল্প মনে আছে। কুং ফু এক্সপার্ট নায়ক তার শিক্ষকের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য গরম বালুর মধ্যে হাত পুড়িয়ে হাত পাথরের মত শক্ত করে ফেলে। তারপর সে যায় বদমায়েশদের সাথে যুদ্ধ করতে। ভয়াবহ সব ফাইটিং সিন। সেই সিনেমা দেখে হৃদয়ে এমন দাগ কাটল যে যত্র তত্র হাই হুই করে কুংফু কারাতে প্রাক্টিস শুরু করে দিলাম আমরা কয়েকজন ভক্ত। আমাদের ক্যাডেট কলেজে তখন আনোয়ার কামাল ভাই (গ্রান্ড মাস্টার প্রফেসর ইউরি নামে খ্যাত, যিনি ২০১২ তে পৃথিবীব্যাপি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনটি বেসবল ব্যাট এক লাথিতে ভেঙে বিশ্ব রেকর্ড করে, যদিও তার সেই রেকর্ড ইদানীং ভেঙে গেছে) মার্শাল আর্ট শেখাতেন। ইচ্ছে থাকলেও তার সাথে যোগ দান করি নি তখন। সাহস হত না। তাকে দেখেই মনে হত এই বোধহয় পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবে। আদতে সে খুবই শান্ত শিষ্ট ছিল, কথা বার্তা কমই বলত।

যাই হোক, এই সব ধ্যান ধারণা কারো মাথায় একবার ঢুকে গেলে সেটা তাড়ানো দুঃসাধ্য। নিজে নিজে বাসায় প্রাক্টিস করতে গিয়ে থালা-বাসন-বাটি-গ্লাশ থেকে শুরু করে ভাই বোনের জীবন যখন দুঃসহ করে দিলাম তখন মা একদিন ঝাড়ু হাতে তেড়ে এলেন। “আবার যদি দেখেছি ছোট ভাই বোনের সাথে ভ্যাড়াং ভ্যাড়াং করছিস! যা, তোর সাইজের কারো সাথে গিয়ে কর।”

তখন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। Bruce Lee বলতে অজ্ঞান। খুঁজে পেতে ভিডিও ক্যাসেট এনে তার পুরানো সিনেমাগুলো দেখি আর ঢাই ঢুই করি। ছোট ভাইয়ের আগ্রহ কম নয় কিন্তু সমস্যা হল হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে গেলে দু’ একটা বাড়ি খেলে সে মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ দেয়। নিজেই কাঠ ফাঠ জোগাড় করে নান চাক্কু বানিয়ে ছাদের উপর খুব ক্যাচাং ক্যাচাং করে প্রাক্টিস করতে গিয়ে মুখে মাথায় বাড়ি খেয়ে প্রায়ই ক্ষত বিক্ষত হয়ে বাসায় ফিরতাম। কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবার জন্য মা তেঁতো হয়ে বলত, “একদিন নিজেই নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে চিৎ পটাং হয়ে থাকবি। কি রে আমার কুংফু মাস্টার! ফুঁ দিলে উড়ে যায়!”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলের ছাত্র। নিকটেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল জিমনেশিয়াম। সেখানে তখন মহা সমারোহে মার্শাল আর্ট শেখান বিটু ভাই (তার আসল নাম নয়)। মাকে দেখানোর জন্যই হয়ত তার দলে গিয়ে নাম লেখালাম। বিটু ভাই ন্যাশানালে গোল্ড মেডাল পেয়েছিল। কয়েকজন বন্ধুরও দেখা পাওয়া গেল। বিশাল সব স্বপ্ন। ন্যাশনালে যাবো, গোল্ড মেডেল পাবো। গাছে কাঠাল গোঁফে তেল!

ক’দিনেই বুঝলাম কত ধানে কত চাল। ভোর পাঁচটায় উঠে দুই মাইল দৌড়ে যাই প্রাক্টিসে। সেখানে ঘন্টা খানেক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে আবার দৌড়ে বাসায় ফিরে তৈরী হয়ে যেতে হয় ক্লাশে। তারপরও লেগে ছিলাম বেশ কিছুদিন। বিটু ভাই আমার অতিমাত্রায় হাত পা চালাচালি দেখে একদিন এক বিশাল দেহীর সাথে লাগিয়ে দিল। আমার চেয়ে এক মাথা লম্বা ছেলেটার দিকে ধেয়ে গিয়ে ফ্লাইং কিক করতে গিয়ে তার ঢেঁকির মত হাঁটুতে গিয়ে আছড়ে পড়ে নিজেই পা ধরে ব্যাথায় ককাতে লাগলাম। বিটু ভাই হেসে বলল, “শুধু লাফ দিলেই চলবে? মাথা খাটাতে হবে না?”

ক’দিন বাদে বিটূ ভাই নিজেই প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেল। তার ভয়াবহ দাঁত খিচানি আর বিকট চীৎকার চেঁচামেচি শুনে এমন ভড়কে গেলাম যে লড়ব কি পালিয়ে বাঁচি না। প্রায় মিনিট তিনেক চেষ্টা করেও যখন আমার নাগাল পেল না তখন বিটূ ভাই হতাশ হয়ে থেমে গেল। “পালিয়ে বেড়ালে চলবে? ফাইট করতে হবে না?”

আমি নিরীহ কন্ঠে বল্লাম, “লিভ টুডে, ফাইট টুমরো।”

ভালোই চলছিল। কষ্ট হত কিন্তু তারপরও দল বেঁধে মারপিট প্রাক্টিস করার মধ্যে কি যেন একটা মোহ ছিল। বিটূ ভাই কানে কানে বিড় বিড় করে, ‘চালিয়ে যাও। তুমি হ্যাংলা পাতলা আছো। ন্যাশানালে কম ওজনের গ্রুপে সুযোগ হতে পারো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। বাতাসে লাথি ঘুষি ছোড়া আর টুর্নামেন্টে গিয়ে রক্ত মাংশের প্রতিদ্বন্দ্বির বিরুদ্ধে লড়াই করা কি এক কথা? কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। দেখাই যাক না পানি কত দূর গিয়ে গড়ায়।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাকে কোথাও যেতে হয় নি। বিধাতাই আমাকে রক্ষা করলেন। বিটু ভাই এক শুভ সকালে এক গাদা বই নিয়ে এসে হাজির হল ট্রেনিং ক্লাশে। কি ব্যাপার? না, সে একটা কবিতার বই ছাপিয়েছে। পাতা ভর্তি তার লেখা কবিতা। আমার মার্শাল আর্টে দক্ষতা অমার্জনীয় হলেও লেখা লেখি কিছু কিছু করি, কবি না হলেও কবিতা জ্ঞান একেবারে মন্দ নয়। বিটূ ভাইয়ের কবিতার বইয়ের দ্বিতীয় পাতাতেই আটকে গেলাম। সমস্যা অবশ্য হল যখন বিটু ভাই সবার হাতে দুই ডজন করে কবিতার বই ধরিয়ে দিয়ে বলল, “বিক্রী করে এক সপ্তাহ পরে আমাকে টাকা দিও”।

সেই কবিতার বই কাউকে একটাও গছাতে পারি নি এবং আমি আর লজ্জায় ফিরেও যাই নি। আমার কুংফু কারাত ইতিহাসের সেখানেই যবনিকাপাত।

Bruce Lee র কথায় ফিরে যাই। মার্শাল আর্টে কিংবদন্তীর নায়ক হলেও Bruce Lee নিজে ছায়াছবির জগতের বাইরে খুব একটা লড়াই করত না। কিন্তু অসম্ভব সাধনার সাথে ট্রেনিং করত। মার্শাল আর্টকে পশ্চিমে জনপ্রিয় করবার পেছনে তার অবদান খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশী। তার একটা উক্তি আমার খুব মনে ধরেছে। এই উক্তি থেকে বোঝা যায় তার অধ্যাবসায় কোন পর্যায়ের ছিল।

“যে দশ হাজার লাথি একবার করে প্রাক্টিস করেছে তাকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই, কিন্তু যে এক লাথি দশ হাজার বার প্রাক্টিস করেছে তাকে নিয়ে আমার অনেক ভয়।”

শুজা রশীদ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ (৭৮-৮৪)

৬,০৮৪ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “কুংফু কারাতে”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    বেশ মজা লেগেছে পড়তে। হাসলামও খানিকটা। নির্ভয়ে মন্তব্য করার সাহস পেলাম কারন যখন রচনার শেষে জানলাম আপনি ঐ মারদাঙ্গা প্রশিক্ষন সম্পন্ন না করে আমাদের অনেকের মতো ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন। ভাল থাকবেন।

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আহারে ! সেই সব দিন !
    ব্রুস লি, চাক নরিস আর যতো কুং ফু কারাতে আইডল আছে; সব দেখে প্রায় মুখস্ত। বন্ধের দিনে ইউল্যাব-এর বন্ধ গেট টপকে ভিতরে শুরু হয়েছিলো তাইকেন্দু ক্লাব। আমাদের জলাস এইটে থাকাকালে কলেজ গেমস্ প্রিফেক্ট হাসান জাহাঙ্গীর ভাই কর্ণধার। আমরা একদল নিরলস পরিশ্রমী শিক্ষানবিশ। একবার বার্মা থেকে এলো এক গুরু, দু সপ্তা থাকবে। সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো তাকে সাইড কিক মারতে গিয়ে দেখি আমার মাথার ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে পেছনে হাজির। কি কাণ্ড ! নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় না। বলেন চারজনকে তাকে ঘিরে দাঁড়াতে, এটাক করতে। চোখের পলকে চার জনকেই ফ্লাইং কিক্। এমন মাপা যে গায়ে আঘাত না করে শুধু জামায় স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় সেই তড়িৎ আক্রমণ !
    কাঠের নানচাকু ঘোরাতে ঘোরাতে পারলে হাতে ফোস্কা ফেলে দিই। দেয়ালে কারাতে কোপ, ঘুষি, ফ্রন্ট কিক, সাইড কিক যখন তখন। ভাগ্যিস দেয়াল কথা বলতে পারতো না।
    সেলুলয়েড জাগিয়ে দিলে বন্ধু !

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।