অধিকার তত্ত্ব

শিউলি নিতান্তই গ্রামের এক সাধারন বাড়ির বউ। জয়ন্ত, শিউলির স্বামী। দিন মজুরী করে সংসার চলে। একটা ৬ বছরের ছেলে আছে তাদের। দেখতে শিউলি একেবারে অসুন্দর না, শ্যামলা রঙের ছিপছিপে দেহ। বাড়ির কাজের পাশাপাশি মাঝে মাঝে নিজেদের খুব ছোট এক খন্ড জমিতে স্বামির সাথে কাজ ও করে। অন্যের জমিতে কাজ করে দিলে ও নিজের জমির জন্য অন্যকে মজুরী দেওয়ার সামর্থ্য বা ইচ্ছা নাই জয়ন্তর। শিউলি নিজে থেকে ই এটা বুঝে স্বামীকে সাহায্য করে।

ছেলে পুলক কে গ্রামের একটা কেজি স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। অন্যদের মত তাদের ও স্বপ্ন ছেলে বড় হয়ে অন্য কিছু করবে, তাদের থেকে ভালো কিছু করবে।

পাশের বাড়ির জয়দেব শিউলির সাথে ঠিক স্বাভাবিক আচরণ করে না, মেয়েদের অস্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে এ ব্যাপারটা বুঝার। সে ও বুঝে যে জয়দেব তাকে পছন্দ করে। সুযোগ পেলে ই এসে এটা ওটা বলে গল্প করতে চায়। শিউলি বুঝে ও কিছু বলে না, তার ও ভাল লাগে গল্প করতে। একটু কথা ই তো বলছে, এ আর এমন কি।

জয়ন্ত এটা পছন্দ করে না। কয়েকবার ঝগড়া ও হয়ে গেছে এটা নিয়ে। শিউলি বুঝে পায় না কেন তার স্বামী এমন আচরণ করে। যাই হোক জয়ন্ত অবশ্য এটা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করে না।

চৈত্র মাসে গ্রামে যাত্রা পার্টি এলো। কেউ কেউ আবার ভ্যারাইটি শো বলে ডাকে। রাত ১০ টার পর থেকে শুরু হয় তাদের শো। রাত ২/৩ তা পর্যন্ত চলে রমণীদের উদ্দাম নাচ। তারপর যাত্রারপালা দেখায়। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এমন কি দু’একদিন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপস্থিত থাকে প্রথম থেকে ই। গরমে ও বাবু রা কাঁধে একটা চাদর ফেলে স্টেজের ডান দিকে চেয়ারে বসে থাকেন। সস্তা সোনালী বিড়ি টান্তে টান্তে নাচ দেখেন। বেশি দামী টিকেট ধারীরা সামনের দিকে। তাদের কারো কারো হাতে টাকার বান্ডিল থাকে। যত টাকা স্টেজে ছুড়ে মারে তত কমতে থাকে স্টেজে নাচতে থাকা মেয়েদের পোশাক। এক পর্যায়ে বোতল থেকে পানি ও নাকি ছুড়ে মেরে ভিজিয়ে দিতে থাকে অপ্সরী গুলোকে। সামনের দিকে বসে থাকা কারো হাত একটু বেশি দানশীল হলে তার মুখে ছুড়ে মারে রমণীদের পরিহিত কাঁচুলি। বাবুরা দেখেন আর হাসেন।

রমরমা ব্যাবসা। মাস ব্যাপি ও চলে এই শো। দিনভর কাজ করে রাতে উপার্জিত টাকা খরচ করতে থাকে গ্রামের নিম্ন শ্রেণির মানুষগুলো। এখানে আবার মেয়ে বা নারী দের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নারী শরীর দেখার অধিকার বুঝি শুধু পুরুষদের ই আছে।

জয়ন্তর এতো টাকা নেই প্রতিদিন যাওয়ার। একদিন সে গেল গ্রামের খগেন, জামাল, কিরন, অমল, মামুন, রফিক দের সাথে। এক রাত দেখে তার লোভ লেগে গেল। পরের দিন ই দুপুরের আগে ই গোয়ালের সাথে লাগানো আথালে বেঁধে রাখা একমাত্র গরুটা বেচে দিল। রাতে শো দেখতে হবে যে। শিউলির কিছু বলার অধিকার নাই এখানে।

রাতে জয়ন্ত গ্রামের অনেকের সাথে আবার যায় শো দেখতে। মনে তার তখন মায়াময় দুনিয়া। বউ বাচ্চার কথা আর নেই মাথায় তখন। সেদিন রাতে হঠাৎ জয়দেব উঠানে এসে ডাক দেয় “জয়ন্ত দা বাড়ি আছো?।। জয়ন্ত দা!”
উত্তরে শিউলি বলে উঠে, ” বাড়ি নাই, ক্যান কোনো কাম আছে? আমারে কও।”
বলতে বলতে শিউলি দরজা খোলে। পুলক অনেক আগে ই ঘুমিয়ে পরেছে। তার ইচ্ছা হয় জয়দেব ভিতরে এসে বসুক। একটু গল্প করুক। সত্যি বলতে কি, তার অনেক সময় জয়দেবের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। তাই বলতে গিয়েও থেমে যায়। জয়দেব বলে ওঠে, “তয় যাই বৌদি, বেহানে আসপানি, দাদারে কইও আইসিলাম।”

জয়ন্ত একটু ইতস্ত করে বের হয়ে আসে। পথে দেখা হয় পাশের বাড়ির বুড়ির মার সাথে। পাশ কাটিয়ে চলে আসে।

রাতে না আসলেও সকাল হতেই জয়ন্তর মাথায় বউ এর চিন্তা আসে, আসতে বাধ্য। একটু আগে বুড়ির মার কাছে যা শুনে আসছে তার পর আর ঠিক থাকতে পারে না। বাড়ি এসেই কচা গাছের শক্তপোক্ত একটা ডাল ভেঙ্গে শিউলির চুলের মুঠি ধরে সপাসপ পিটাতে থাকে। শিউলি কিছু বুঝে উঠে না।

“শালার মাগি এক ভাতারে তোর কাম হয় না, গোন্ডা গোন্ডা লাগে? …

অনেক কথা চলতে থাকে, হাত থেমে থাকে না। কেউ ঠেকাতে আসে না। পুলক কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে। কাঁধে তার স্কুল ব্যাগ। কাঁপতে থাকে ভয়ে। আরো অনেক্ষন চলে জয়ন্তর হাত, অনেক্ষন। নাহ, শিউলি জ্ঞান হারায় না, বাস্তব জগতে জ্ঞান হারানো এতো সোজা না।

বিকেলে শিউলির বাবার বাড়ি থেকে তার বড় ভাই আর মেঝ ভাই আসে। জয়ন্তর উঠানে বিচার বসে। হোগলা দিয়ে বোনা পাটিতে বসে সবাই। চেয়ারম্যান বসে চেয়ারে। বিচার চলতে থাকে। শিউলিকে আরো কয়েক দফা চড় থাপ্পর মারে তার মেঝ ভাই। ২ ভাই মিলে করজোড়ে ক্ষমা চায় চেয়ারম্যান আর জয়ন্তর কাছে। শিউলি ও বলে, আর হবে না, আর কোন দিন কারো সাথে কথা বলবে না সে।

এ যাত্রায় রক্ষা পায় শিউলি। “ক্ষমাশীল” হয় জয়ন্ত। যদিও তার তাড়া অন্য দিকে।

ভাত তুলে দেয় শিউলি। দুই ভাই কে খাইয়ে বাড়ি পাঠানোর ইচ্ছা। জয়ন্ত অবশ্য মৃদু গলায় বলেছিলো থেকে যেতে, সে অনুরোধের উত্তরের অপেক্ষাও কেউ করেনি যদিও।

৮টার দিকে খেয়ে দেয়ে বিদায় নেয় শিউলির ভাইইয়েরা । পুলক না খেয়ে ই ঘুমিয়ে পরেছে। ভাইদের বিদায় নেওয়ার পর জয়ন্ত তাড়া দেয় শিউলি কে তারাতারি ভাত দিতে। খেতে বসে সে বার বার তার হাতে পড়ে থাকা Casio waterproof ঘড়িটার দিকে তাকাতে থাকে। সময় চলে যাচ্ছে। তাকে আবার ভ্যারাইটি শো দেখতে যেতে হবে। সে দ্রুত ভাত খেতে থাকে।…

১২ টি মন্তব্য : “অধিকার তত্ত্ব”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    দুইটা লেখা সাথে সাথে না দিয়া একটু গ্যাপে দিস। সেরকম জরুরি না হলে অন্তত দিন কয়েক গ্যাপ দিয়া।
    না লিখতে নিরুত্সাহিত করছি না।
    আর লেখার বিষয় দিয়ে দিলে ভালো হয়।
    যেমন, গল্প বা আত্ম্জীবনী বা দিনলিপি।

    আগেরটায় লিখলি প্রবন্ধ..


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    এখনো কিছু টাইপো আছে...
    একটা জিনিস ঠিক পরিস্কার হল না- জয়ন্ত অত খেপে উঠল কেন? খেপে ওঠার মতন কিছু ঘটেছে এমনটি খুঁজে পেলাম না... :-/
    (জয়দেব বসে কিছুক্ষণ শিউলির সাথে কথা বলেছে, এমন একটি দৃশ্য থাকলে মনে হয় ভাল হত... :dreamy: )

    ওভারওল লেখা ভাল লেগেছে...লেখা-লেখি চালু রাখিস... :thumbup: (সম্পাদিত)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • সুশান্ত (০৩-০৯)

      ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
      আমি একটা ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছি যে জয়ন্ত বুড়ির মার কাছ থেকে শিউলি ও জয়দেবের ব্যাপারে জেনেছে। বুড়ির মা কিন্তু ঘটনা কিছু ই জানে না শুধু জয়দেব কে বাড়ী থেকে বের হতে দেখেছে। সে নিজের মত করে ই বলেছে জয়ন্তর কাছে। কি কি বলেছে এটা পাঠকের কল্পনার বা চিন্তার উপর ছেড়েদেওয়া ই ভালো। তাছাড়া গ্রামের বয়স্ক মহিলাদের একটু বাড়িয়ে বলার প্রবনতা যে আছে এটা সবার জানা কথা, ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ও আমি সত্যতা পেয়েছি।

      গল্পটি পুরোপুরি কোন সত্য ঘটনা না হলেও সত্য কিছু ঘটনা ও উপলব্ধি থেকে নেওয়া হয়েছে। 🙂

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।