সেই মোল্লা স্যার

কয়েকদিন আগে গ্রুপ মেইলে মোল্লা স্যারের সেল নম্বর পেয়ে স্যারকে ফোন দিলাম। আমরা যখন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হই তখন স্যার ছিলেন প্রভাষক, আমরা ক্লাস সেভেনে থাকতেই হলেন সহকারী অধ্যাপক এবং তারও পরে সহযোগী অধ্যাপক। স্যার যখন এসোসিয়েট প্রফেসর এবং শের-ই-বাংলা হাউজের হাউজ মাস্টার তখনই আমরা কলেজ ছেড়ে চলে আসি। পরে জানলাম শেষমেষ উনি বরিশালের ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে রিটায়ার করেন। স্যার এখন একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুল দিয়েছেন বাড়ির পাশে। কিছু বাচ্চাকে বাড়িতে প্রাইভেটও পড়ান। ফোনে পরিচয় দেয়ার পর কিছু সময় ওনার সাথে কথা হল। স্যার বললেন, “দোয়া কইরো যাতে ঈমান নিয়া কবরে যাইতে পারি”। স্যারকে বললাম, “স্যার আপনার হাতে এত গাধা-গরু মানুষ হইছে, আপনি ঈমান নিয়া না গেলে কে যাবে?” মোল্লা স্যার আরও বললেন, “চেষ্টা করবা তোমার সন্তানরে যাতে নেক্কার বান্দা হিসেবে বড় করতে পার”। মন দিয়ে স্যারের সব কথাই শুনলাম।

ক্লাসে ব্ল্যাক বোর্ডে বৃত্ত আঁকতে যেয়ে স্যার বৃত্তের মাঝে যখন বিন্দু বসাতেন তখন চকের সামনের অংশের বেশ খানিকটা খসে বৃত্তের বিন্দুর অংশ হয়ে যেত। স্যারের ঠান্ডার সমস্যা ছিল। শীতে মাঝে মাঝে ঘাড়ে ব্যাথার জন্যে কলার পড়তে হত। ওনার ডাস্ট এলার্জিও ছিল। বোর্ডের চকের গুঁড়া নাকে ঢুকলে এক নাগাড়ে ৮/১০ টা হাঁচি দিয়ে ফেলতেন। একদিন ক্লাসে পড়াতে এসে চকের গুঁড়ায় আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগত হাঁচি দিচ্ছেন- হঠাৎ একাডেমি ব্লকের পাশের তাল গাছ থেকে ধপাস্‌ করে একটা তাল মাটিতে পড়লো। মোল্লা স্যার হাঁচি দিয়ে গাছ থেকে তাল ফেলে দিতে পারতেন। ক্লাস সেভেনে একদিন স্যারের কি কথায় সবাই খুব হাসছে, আমাদেরই একজন বলে উঠল “হে হে! স্যার আপনে খুব হাসাইতে পারেন, হি হি!” স্যার এক মুহুর্তও দেরী করেন নাই। ওর ডেস্কে যেয়ে দুই কান ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে বললেন, “আমি হাসাইতেও পারি, কাঁদাইতেও পারি”। আমার ঐ বন্ধু স্বপ্নেও আর স্যারের কথায় হাসবার মত ভুল করেনি। আমরা সেভেনে থাকতেই স্যারের প্রোমোশান হল। নেক্সট ক্লাসে উনি ঢুকতেই আমরা সবাই হাত তালি দিয়ে স্যারের খুশির সাথে শরিক হতে চাইলাম। ফলাফল, পুরা পিরিয়ড আমরা দাঁড়ায় দাঁড়ায় স্যারের ক্লাস করলাম। আমাদের সায়েদুল হাসমত স্যারের গেটআপের অসাধারন বর্ননা দিয়েছে। কলেজে থাকতে মোল্লা স্যারের উপর সবার রাগ এমন ছিল যে কোনও কালাচারাল প্রোগ্রামে স্যার তার ছেলে নয়মানকে নিয়ে এলে সুযোগ বুঝে সবাই নয়মানকে চর মারত, চিম্‌টি কাটতো, গাল ধরে টানাটানি করত। নয়মান এখন অস্ট্রেলিয়া। বড় হয়েছে, হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এ ডিপ্লোমা করেছে।

তখন আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে, একদিন পরীক্ষা শেষে লাঞ্চের আগে শরিয়তুল্লাহ্‌ হাউজের টুয়েলভ ব্লকে বসে আমরা গসিপ করছি, আমাদের একজন একটা চেয়ারের মাথায় বসে ছিল। মোল্লা স্যার ডিউটি মাস্টার। হাউজের পাশ দিয়ে হেঁটে ডাইনিং হলের দিকে হেলেদুলে চলছিলেন। এমন সময় চেয়ারে বসা বন্ধু চেয়ার সমেত উলটে পড়ে যাচ্ছে আর বলছে ‘ইয়া আল্লাহ্‌’। স্যার ভাবলেন আমরা কেউ বলেছি ‘এই মোল্লা’। আর যায় কোথায়। ‘তোর বাপ মোল্লা’। আমরা হতভম্ব! অকারনে গালি খেয়ে হাজমোলা খুঁজছি। হজম হচ্ছেনা। ফলাফল। ‘এই ধর ধর, মোল্লারে ধর!’ স্যার দৌড়ে প্রিন্সিপালের বাসার দিকে রওয়ানা হলেন। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন। দুই দিন বাদেই রসায়ন পরীক্ষা, ইনভিজিলেটর মোল্লা স্যার। আমরা রীতিমত আতঙ্কিত, উনি হয়তো সেদিন তুলে মুলে শোধ নেবেন। ঠিক হল সন্ধ্যায় মাগ্‌রিবের নামাজের সময় স্যারের কাছে মাফ চেয়ে নেব। আমরা ততক্ষনে বুঝে গেছি, ব্যাপারটা নিতান্তই ভুল বুঝাবুঝি। ইভনিং প্রেয়ার শেষে সবাই স্যারকে ঘিরে ধরলাম। স্যার শিশুর মত সজল চোখে বললেন, ”আজকে দুপুরে বাসায় ফিরে তোমাদের ভাবীকে বলেছি যে ৬ বছর যাদের গায়ের রক্ত পানি করে মানুষ করছি তারা আজকে আমারে নাম ধইরা ডাকে’। আমরা অনুতপ্ত, স্যারকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে আমরা কেউ তাঁর নাম ধরে ডাকিনি। আসল ঘটনা তাকে খুলে বলি। ইন্টার হাউজ কম্পিটিশান গুলায় স্যারের পারফরমেন্স ছিল দেখার মত। পারলে উনিই ক্যাডেটদের হয়ে খেলে দেন। ফুটবল কম্পিটিশানে মাঠের সাইড লাইন থেকে ওনার চিৎকারে মাঠের খেলোয়াড়রা দিশাহারা। খেলা ভুলে যাবার উপক্রম। হাসমতের কমেন্টস এর লিঙ্ক ধরে স্যারের ছবি দেখে পাকা চুল-দাড়িতে স্যারকে বড্ড অচেনা লাগে। বেমানান লাগে, মলিন দেখায়। আমাদের দেখা মোল্লা স্যারকে ঐ ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায়না। ফোনে স্যারের সাথে কথা বলতে যেয়ে গলা কেঁপে ওঠে। মন আর্দ্র হয়। এরই নাম বুঝি ভালবাসা, এরই বুঝি নাম শ্রদ্ধা। স্যার আপনি দীর্ঘজীবি হউন, ভাল থাকুন।

৯৬৫ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “সেই মোল্লা স্যার”

  1. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    মোল্লা স্যারকে নিয়ে এইখানে যত ব্লগ লেখা হইছে আর মনে হয় কোন স্যার কে নিয়ে হয় নাই। স্যারকে একবার এই বার এই ব্লগ গুলো দেখাইতে পারলে হতো।

    শফি ভাই অনেক দিন পর ব্লগ লিখলেন।

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    মোল্লা স্যারের যে ঘটনা গুলো শফি ভাই তুলে ধরলেন, তা সত্যি ই অত্যন্ত মজার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মজার দিক টা যদি আমারা বাদ দিয়ে এর অন্তর্নিহিত দিক গুলো খেয়াল করি, তবে বোঝা যাবে, কত আত্মত্যাগ ছিল স্যারের আমাদের জন্য।

    ক্লাশের খারাপ ছাত্র কিংবা কোন খেলা ধুলার কারণে স্যারের গুড বুকে কোন দিন ই ছিলাম না...কিংবা থাকলেও বুঝিনি। কিন্তু আজ ও স্যার কে ভীষন মনে পরে...

    বাস্কেটবল বা ফুটবল প্রতিযোগীতার সময় স্যারের সেই চীতকার..."ফ...ল ব্যা......ক"... কিংবা সুইমিং কম্পিটিশনের সেই কোচিং সব কিছুই যেন আজ ও কানে বাজে...।

    আল্লাহ যেন স্যার এবং তার পরিবার কে সুখ ও শান্তিতে রাখেন, শেই দোয়া করি।

    শফি ভাই স্যারের নম্বর টা পাওয়া যাবে? খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে স্যারের সাথে...।।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।