লাইন

(ক)

মাইজুদ্দিন ওরফে মজু বেশ একটা সমস্যার মধ্যে আছে। তার বয়স চৌদ্দ অথচ বয়সের তুলনায় তাকে দেখতে অনেকটা বড় লাগে। তবে সমস্যাটা তার বয়স বা উচ্চতা নিয়ে নয়।
তার পিঠ চুলকাচ্ছে। ঘামে।
হেমন্তের শেষ দিনগুলির কোনো এক সকাল। গাছের ফাঁক গলে শীতার্ত সূর্যের উঁকিঝুঁকি। হুট করেই তাতে রোদ চড়েছে। আর মজুরও ঘাম ধরেছে।

গতকাল দিনব্যাপী মাইকিং হয়েছে এখানে, আজ সকাল আট ঘটিকায় মহিম গাজির আড়তের সামনে স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সরকারি রিলিফ বিতরণ করা হবে। কেবল প্রতিষ্ঠিত গরিবদের মধ্যে।
জন্ম থেকেই মজু জানে তারা সেই দাদা পরদাদার আমল থকে বেশ গরিব। এসব রিলিফ-টিলিফ তাদের জন্যই আসে। তবে, এ বছর ফলন কম। রিলিফের লাইনে তাই বহু অপ্রতিষ্ঠিত গরিব ঢুকে যাবার সম্ভাবনা আছে। মজু বুদ্ধি করে তাই লাইন ধরতে এসেছে সেই সকাল ছ`টায়। শুরুতে একবার নিয়ে ফেলতে পারলে আরেকবার চান্স নিবে। এসে দেখে তার সামনে দুশো-আড়াইশো লোক।
নিজে রিলিফের গম নিতে এসেও মজু খুব হতাশা নিয়ে লাইনটা দেখে, আর ভাবে,`দেশটা ভিখিরিতে ভরে গেছে`।
রিলিফ নিতে আসা সিমেন্ট এর বস্তা দিয়ে বানানো বাজারের ব্যাগটা ভাজ করে, অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিজের পিঠ চুলকায় সে।

যদিও সরকারি মাল, তবু যারা দিচ্ছে তারা সবাই স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। তাদের চোখে তিরস্কার আর মুখে উদ্ধত্যের স্পষ্ট ভঙ্গি- `যত্তসব!দেশটা ভিখিরিতে ভরে গেছে`।
নেতাদের আগমন, উদ্বোধন ও গলাবাজি শেষে লাইন এখন একটু একটু করে এগুচ্ছে।

শেষের দিকটায় সামান্য একটু বাঁকা, এ ছাড়া লাইন মোটামুটি সোজাই আছে। তবু টিনের চোঙ্গা দিয়ে একটু পরপরই লাইন সোজা করার আদেশ দিচ্ছে, আদারু। বাস্তব জীবনে সে একজন ক্যানভাসার, তাই লাইন সোজা করার আদেশেও তার হাল্কা রেশ পাওয়া যায়।
কানভাসারি ভাষায় যেকোনো সিরিয়াস ঘটনাও হাস্যকর লাগে। স্থানীয় নেতা পাতি-নেতাদের কাছে সে তাই বিশেষ বিনোদন। কোরবানির আগে আদারু যদি বলে- সমাবেশ! সমাবেশ! বিরাট সমাবেশ! গরু ছাগলের এক ঐতিহাসিক সমাবেশ!
নেতা পাতি-নেতারা দাঁত কেলিয়ে হাসার প্রতিযোগিতায় নামে, কে কার চেয়ে বেশি হাসতে পারে!
গতকাল সারা শহর সে-ই মাইকিং করেছে। আজ তার যদিও ডাক নেই তবু, নেতাদের সরাসরি সান্নিধ্য পাবার জন্য সে নিজেই নিজের চোঙ্গা নিয়ে হাজির।
-লাইন! লাইন! লাইন! রিলিফ নেয়ার লাইন!… এতো দ্বারা সকলকে সোজা লাইনে আসিতে আদেশ করা যাইতেছে।

এসবের ভিড়ে এক বৃদ্ধকে দেখা যায় লাইন ছাড়া ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে। তার দৃষ্টি অনিশ্চিত। কি করবে বা করবে না সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তবে তার হাতেও মজুর মতো একটা সিমেন্টের বাজারি ব্যাগ ।
হাতে মাইক থাকায় আদারু কে প্রশাসনের অংশ ভেবে অতঃপর সে তার দিকেই এগিয়ে যায়।
– বাবা, আমার রিলিফের ব্যবস্থাডা… একটু
আদারু বৃদ্ধকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বরং বাকিদের বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করে । ঘোষণার সুরে বলতে থাকে-
– যারা লাইনে না আসিয়া এই বুড়া মিয়াঁর মতো সুবিধা খোঁজার চেষ্টা করিবেন তাহাদের রিলিফ বাতিল বলিয়া ঘোষিত হইলেও হইতে পারে।
এতো মানুষের সামনে বৃদ্ধ লজ্জা পেয়ে যান। তিনি গলার সুর ও স্বর যথাসম্ভব নিচু করে বলেন- ভাইডি …বুড়া মানুষ আমি। লাইনে দাঁড়াইতে ডরাই। একটু দ্যাখো না বাবা! তোমার তো অনেক ক্ষমতা! একদিন তোমারাও বুড়া …
আদারুর ক্ষমতার দৌড়, সে নিজেই ভালো জানে। বৃদ্ধের দিকে তাই হালকা করুণার দৃষ্টি হেনে, মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। বৃদ্ধ তার পিছু নিলে সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত আড়ালে কেটে পড়ে ।
বৃদ্ধ হতাশ হয়ে আবার এদিক ওদিক খোঁজেন । শেষে, যাবে না যাবে না করেও যারা রিলিফ দিচ্ছে সরাসরি তাদের কাছে গিয়ে বলেন- বাবারা, আমি লাইন বড় ডরাই …আমার একটু …
এতোসব হট্টগোলের মধ্যে কে শোনে কার কথা। পাল্লা দিয়ে যব মাপছিল শহিদ । সে একটু খেয়াল করে গোনার ফাঁকেই কড়া ঝাড়ি দেয় – উন্নিশ … উন্নিশ… কুড়ি, কুড়ি …কুড়ি । এই, এখানে কি ! ভাগেন !… কুড়ি কুড়ি.. একুশ
সেটা দেখেই পাতি নেতাদের কেউ একজন হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। বৃদ্ধ উপায় না দেখে এবার লাইনের প্রথম দিকের লোকদের ম্যানেজ করার দিকে মনযোগী হন।

মজু যেখানটায় দাঁড়ানো তার আশপাশে দুয়েক জনের মধ্যে বেশ অসন্তোষ দেখা যায়। একজন মন্তব্য করে, দেওনের কথা চাউল আর দিতাছে কি! আমার তো মনে হয় সব চাউল এরা মাইরা খাইছে। ওহন সান্ত্বনা হিসাবে যব আর ভুট্টা দিয়া বুঝ দিতাছে ! আমরা কি কিচ্ছু বুঝি না! ঘাস খাই!
বিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ এক লোক মন্তব্য করেন- সব হইলো আম্রিকার পলিটিক্স
মজু আর চুপ থাকতে পারে না । বলে- এইখানে আম্রিকা আসলো কই থিকা !!
মজুর সাথে সহমত পোষণ করে আরেকজন বলে- ঠিকই! আমি তো হুনলাম এ সব সৌদি সরকারের উপহার।
বলেই লোকটা গুঁটিয়ে যায় আবার, যেন মজুর মতো এক কিশোরকে সাপোর্ট দিয়ে সে যেন ভুল করে ফেলেছে!

বিজ্ঞ লোকটি চান্স পেয়ে তার জ্ঞান ফলাবার চেষ্টা করে। বলে -শোনেন, সৌদি হইলে পাঠাইত খাজুর আর দুম্বা। আমি মানুষটা নগণ্য, তয় আপ্নাগো দোয়ায় ২/৪ জন মান্যগণ্য লোকের সাথে ওঠবস আছে। বুঝেন না ক্যান! এই জামানায় ফাউ কেউ কাউরে কিছু দেয়! আম্রিকা এইসব খাবারের লগে মেডিসিন মিশায়। তারপর সেই মেডিসিন আমাগো উপর টেস্ট করে। যদি মইরা যাই তাইলে এই ঔষধ বাতিল আর বাইচা থাকলে টেস্ট সাকসেস !
তার এমন নতুন ধরনের কথায় সবাই চমৎকৃত হলেও মজুর মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। সে খোঁচা মেরেই বলে- মরার এতো ভয় থাকলে আপনে এইসব নিতে আসছেন ক্যান!
বিজ্ঞলোকটি হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসী গলায় বলে- না খাইয়া থাকনের চেয়ে মেডিসিন খাওনও ভালা…
তার এ উদাসী ভাব সবার মধ্যে সংক্রমিত হতে থাকে।

বৃদ্ধ লোকটির নাম আশরাফ আলী। তার সুযোগ সন্ধানী তৎপরতা এখনো চালু আছে । চেহারা প্রয়োজনের চেয়েও করুন করে সে লাইনের সামনের দিকের একজনকে বলেন
-রিলিফের মাল না নিয়া গেলে বউমা আমারে ঘরে ঢুকতে দিবো না। একটু জায়গা …
কিন্তু এসব কথায় কারো মনই সে গলাতে পারে না। অকারণ ব্যস্ততা দেখিয়ে তারা সামনের জনকে তাড়া দেয়- ওই! আগান না ক্যান!
কম বয়সী এক ছোকরা মজা নেয়ার চেষ্টা করে- দাদু মনে হয় এই এলাকার জমিদার। ছদ্মবেশে গরিবের খোঁজ নিতে আসছে রিলিফ কেমন চলে! লাইনে দাঁড়াইতে কি পেস্টিজে লাগে ?
বৃদ্ধ আশরাফ আলী দুর্বল গলায় বলার চেষ্টা করে- না না, আমি ইহ-জীবনে লাইনে দাঁড়াই নাই। পারি না । আমার খুব ডর করে
ছোকরা দাঁত কেলিয়ে তার রায় জানিয়ে দেয়- বলছিলাম না জমিদার !
এ কথায় ইতস্তত হাস্যার আওয়াজ পাওয়া যায়।

মজুদের আলোচনা ক্রমে গরম হয়ে ওঠে । সবার মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে, যে চাল এসেছিল সেটা ক্ষমতাধরদের কাছে পাচার করে দিয়ে, যব আর ভুট্টা দিয়ে তাদের সাথে মজা নেয়া হচ্ছে। ক্যানভাসার আদারু লুকাতে এসে মজুদের এই অংশটায় চলে এসেছিল। সে আগামাথা না জেনেই সবার অসন্তোষকে বিনোদন ভেবে হুট করেই স্লোগান দিয়ে ফেলে – `চাউল চাই গরিবের; দোয়া চাই সকলের’
এর ফল হলো মারাত্মক। ঐ কেরে ? বলে নেতা পাতি নেতারা ছুটে আসে। আলোচনা তখন গরম। তাই উত্তেজনায় স্লোগানের সুরে আরও কয়েকজন বলে ফেলে – `আমাদের চাউল আমাদের চাউল; পাচার করা চলবে না’
মুহূর্তে ছোট্ট জায়গাটা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। নেতারা লাঠি পেটা শুরু করলো। আর জনগণ ইট পাটকেল। লাইন ভেঙ্গে একদম চৌচির।

পুলিশ পাশেই ছিলো। এবার তারাও নেতাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহানুভূতির সাথে মাঠে নামল। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে, সবাইকে ধরে ধরে আবার দাঁড় করানো হল।
লাইন আবার সোজা।
মাঝখানে বিপাকে পড়লেন সেই বৃদ্ধ, আশরাফ আলী। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে লাইন। ঘটনার আকস্মিকতায় স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানটায়।
সিনিয়র এক পুলিশ তেড়ে আসেন- কি চাচা ! লাইন ধরার জন্য আপনারে আলাদা করে বলতে হবে নাকি! না আমন্ত্রনপত্র দিতে হবে ?
– স্যার আমি লাইন ধরতে …
-ঐ মাদারচোদ…বুইড়া! আর একটা কথা বললে …
কথা শেষ না করে কোথাও কিছু প্রবেশ করানো জাতীয় আশ্লিল একটা ইঙ্গিত করে অফিসার।
মজু বৃদ্ধকে এক টানে তার সামনে নিয়ে এসে লাইনে জায়গা করে দেয়। গ্যাঞ্জামের সময় সে তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগ বুঝে সে লাইনের অনেকখানি সামনে চলে এসেছে।

কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়েই ভারি অস্বস্তি হতে শুরু করে বৃদ্ধের।
মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের কেমন একটা শীতল স্রোত নামতে থাকে।
গলা শুকিয়ে যায়।
গ্যাঞ্জাম না করে জনগণ যাতে সোজা লাইনে থাকে সে কারণেই পুলিশ তাদের জীপের পাশ থেকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
সেটা দেখে মাথাটা যেন আরও চক্কর দিয়ে ওঠে ।
প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করে তার।
জুলফির কোনা দিয়ে চিকন ঘাম ঝড়তে থাকে।
পুরো লাইনটা হঠাৎ দুলে ওঠে।
কি এক তীব্র আতংকে জ্ঞান হারিয়ে চাতালে লুটিয়ে পড়েন তিনি ।

(খ)
আজ থেকে অনেক বছর আগে, হেমন্তের শেষ দিনগুলির কোনো এক সকাল। গাছের ফাঁক গলে শীতার্ত সূর্যের উঁকিঝুঁকি। হুট করেই তাতে রোদ চড়েছে।
ড্রেনের পাশে জনসাধারণের লম্বা লাইন।
বাড়ি থেকে এদের সবাইকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে শহরের শেষ প্রান্তে। দূরে আর্মির জীপ। লাইন যাতে সোজা থাকে, তাই সৈন্যরা দূরে তাদের জীপের পাশ থেকে রাইফেল তাক করে আছে লাইনের দিকে।
কয়েকজন সৈন্য লাইন থেকে একেকজনকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। দুয়েক জনের কথা পছন্দ না হওয়ায় সেখানেই গুলি করে দিয়েছে। চোখের সামনে কেমন তড়পাতে তড়পাতে সেসব মানুষগুলো মরে যাচ্ছে।
দেখেই মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের কেমন একটা শীতল স্রোত নামতে থাকে যুবক আশরাফ আলীর ।
গলা শুকিয়ে যায়।
মৃত্যু নিশ্চিত ভেবেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে তার ।
প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করে।
জুলফির কোনা দিয়ে চিকন ঘাম ঝড়তে থাকে।
পুরো লাইনটা হঠাৎ দুলে ওঠে।
ঠিক তখনই দূরে কোথাও হঠাৎ স্লোগান শুরু হয় `আমার দেশ তোমার দেশ; বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ উনিশশো একাত্তরের শেষভাগের এই হেমন্তে পদে পদে হেরে যাওয়ার গ্লানি মুছতেই যেন জীপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অসহিষ্ণু সৈন্যরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করে লাইনে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষগুলোর উপর।
গায়ে গুলি লাগার আগেই, কি এক তীব্র আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়ে ড্রেনের ভিতর লুটিয়ে পড়েন তিনি।

১৫ টি মন্তব্য : “লাইন”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    পয়সা খরচ করে কিনে পড়ার মত লেখা।
    দেখলাম, ছ'বছর পরে লিখেছো।
    এমন লেখা এত দিন ধরে আসছে না বলেই হয়তো সিসিবি আজ ঝুলে গেছে!!!

    খুব ভাল লাগলো।
    এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাবার মত একটা গল্প!!!
    ::salute:: ::salute:: ::salute::


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : টিটো রহমান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।